পূর্বে প্রকাশিতের পর
আপোষ প্রস্তাব ও প্রলোভন
প্রাথমিক স্তর অতিক্রম করার পর যখন ইসলামী আন্দোলন দ্রুতগতিতে প্রসার ঘটতে লাগলো এবং পরবর্তীতে যখন অপপ্রচার ও হিংস্রতার বিভিন্ন আয়োজন ব্যর্থ ও নিষ্ফল হয়ে গেল, তখন বিরোধীরা অনুভব করলো যে, ইসলামী আন্দোলন একটা অজেয় শক্তি এবং তা অচিরেই দেশে একটা বিরাট পরিবর্তন ঘটিয়ে ছাড়বে। তাই আপোষ মীমাংসা ও সমঝোতার একটা পথ খুঁজে পাওয়ার আশায় তারা আপোষ প্রস্তাবের তৎপরতা শুরু করলো। তাদের একটা প্রস্তাব এই ছিল যে, মুহাম্মদ (সাঃ) তাদের দেবদেবী ও মূর্তিগুলোর নিন্দা সমালোচনা করবেন না এবং তাদের ধর্মে হস্তক্ষেপ করবেন না। এ ছাড়া আর যত ইচ্ছা ওয়ায নছিহত ও নৈতিক উপদেশ দিতে চান, দেবেন, তাতে কোন আপত্তি করা হবে না। অর্থাৎ আল্লাহর নাম নেয়ার অবকাশ থাকবে, কিন্তু আল্লাহ ছাড়া আর কোন মা‘বুদ নেই এ কথা বলা যাবে না। যে বাতিল ধ্যানধারণার ওপর প্রচলিত সভ্যতা দাঁড়িয়ে আছে, তাকে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। সমাজে খারাপ পরিবেশ ও খারাপ উপাদান যেটুকু যেভাবে আছে, তাকে ঐভাবেই বহাল থাকতে দিতে হবে। সত্য ও ন্যায়কে এমন আকারে পেশ করতে হবে, যেন তা বিপ্লবের পথ উন্মুক্ত না করে এবং তা থেকে বৈপ্লবিক প্রেরণা নির্মূল করে দিতে হবে। ইসলামের রাজনৈতিক সংলাপ নিষ্ক্রিয় করে দিতে হবে। সমাজ ব্যবস্থাকে যথারীতি বহাল রেখে তার অধীনে আধ্যাত্মিক ধরনের সমাজ সংস্কারের কাজ করে যেতে হবে। ভাবখানা যেন এই কোরাইশদের শ্রেণীগত শ্রেষ্ঠত্ব ও আভিজাত্য, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রাধিকার ও নেতৃত্ব, ধর্মীয় নেতৃত্ব ও কৌলিন্য, কায়েমী স্বার্থ এবং অর্জিত পদমর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা সবই বহাল রাখতে হবে। এরপর তুমি যা করতে চাও, কর। বর্তমানে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ্বীরা সে ধরনেরই প্রস্তাব নিয়ে ময়দানে নেমেছে। কিন্তু আদর্শবাদ্বী আন্দোলনে এত বেশি শৈথিল্যেও অবকাশ থাকেই-না যে, লেনদেন ও গোজামিলের মাধ্যমে একটা মধ্যবর্তী পথ খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। ইসলামী আন্দোলন যদি এ শর্ত মেনে নিত, তবে তা আপনা থেকেই বিলুপ্ত হয়ে যেত। তাদের অন্যান্য প্রস্তাবের মধ্যে ছিলো, এই কুর‘আন বাদ দিয়ে তদস্থলে অন্য কোন কুর‘আন আনতে হবে অথবা তাতে এমন রদবদল করতে হবে, যাতে আমাদের দাবী দাওয়াও পূর্ণ হয় এবং তোমার আশপাশ থেকে সমাজের নিম্ন শ্রেণীর লোকগুলোকে বের করে দাও। যারা ইতিপূর্বে আমাদের গোলাম ছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল যে, যে সব তাজা প্রাণ তরুণ সত্য ও ন্যায়ের ঝাণ্ডা তুলে নিয়েছিল, যারা নিজেদের যাবতীয় স্বার্থ কুরবানী করে সব রকমের বিপদমুসিবত হাসিমুখে বরণ করে নিচ্ছিল এবং যাদের প্রতিটি নিঃশ্বাস এ পবিত্র লক্ষ্য অর্জনের কাজে নিবেদিত ছিল, তাদের উৎসাহ যেন ভেংগে যায় এবং ইসলামী আন্দোলন যেন তাদের একনিষ্ঠ সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। রাসূল (সাঃ)-এর মনে এ প্রতারণাপূর্ণ আপোষ প্রস্তাবের কোন প্রভাব পড়ার আগেই কুরআন তাঁকে সতর্ক করে দেয় যে, এটা ইসলামের শক্রদের একটা চিরাচরিত ধাপ্পাবাজী। পূর্ববর্তী সকল নবীর সাথে এই ধাপ্পাবাজীর আশ্রয় নেয়া হয়েছিল। সূরাহ হুদের ২৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে যে, হযরত নূহ (আঃ) কেও এধরনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। আন‘আমের ৫২ নং আয়াতে বলা হয়েছে যে, তুমি ইসলামের শক্রদেরকে খুশী করার জন্য সকাল বিকাল আল্লাহর ইবাদতকারী একনিষ্ঠ সাথীদের নিজের সান্নিধ্য থেকে দূরে সরিয়ে দিও না। শুয়ারার ২১৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে যে, তোমার এই সব নিষ্ঠাবান অনুসারীদেরকে স্নেহের সাথে লালন করতে থাক। এমনকি সূরাহ আবাসায় তাঁকে শুধু এজন্য ভর্ৎসনা করা হয়েছে যে, তিনি একজন প্রভাবশালী কাফেরের সাথে কথা বলার সময় নিজের একজন অন্ধ সাহাবীর প্রশ্ন করাকে অপছন্দ করেছিলেন। কুরাইশরা এদিক থেকেও নিরাশ হয়ে অবশেষে তারা উতবা বিন রবিয়ার মাধ্যমে খুব লোভনীয় প্রস্তাব পাঠালো। সে বললোঃ ‘তোমার উদ্দেশ্য যদি ধনসম্পদ অর্জন করা হয়ে থাকে, তাহলে আমরা তোমার জন্য এত ধনসম্পদ সংগ্রহ করে দেব, যাতে তুমি আমাদের সবার চেয়ে ধনবান হয়ে যাবে।’ আর যদি তুমি নেতৃত্ব ও ক্ষমতা হাতে পেতে চাও, তাহলে আমরা তোমাকে আমাদের নেতা ও সরদার নিযুক্ত করতে প্রস্তুত আছি। তুমি যদি দেশের রাজা হতে চাও তাহলে আমরা তোমাকে রাজা বানাতেও প্রস্তুত। আর যদি তোমার ওপর কোন জ্বীনের প্রভাব হয়েছে মনে কর, তাহলে আমরা চাঁদা তুলে তোমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করবো। বাতিলরা শুধু এটুকুই জানে যে, ধন-সম্পদ আর শাসন-কতৃত্ব লাভের উদ্দেশ্যেই মানুষ জান-মাল কুরবানী করে থাকে। তারা কি করে বুঝবে যে, আখেরাতে অনন্ত জীবনের কামিয়াবীর জন্যেও মানুষ এগুলো উৎসর্গ করে থাকে? সব ক‘টা প্রস্তাব শোনার পর রাসূল (সাঃ) সূরাহ হা-মিম সাজদা তেলাওয়াতের মাধ্যমে শুধু তাওহীদের দাওয়াত এবং তাঁর নবুয়্যতের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানিয়ে দিলেন। রাসূল (সাঃ)-এর জবাব শুনে উতবা অত্যন্ত মুগ্ধ হয়ে ফিরে গেলো। সে কুরাইশ নেতৃবর্গের সামনে নিজের রিপোর্ট পেশ করতে গিয়ে বললোঃ ‘মুহাম্মদ যে কালাম পেশ করছে, তা কিন্তু কবিত্ব নয়, বরং অন্য কিছু। আমার মতে মুহাম্মদকে তাঁর নিজের ওপরই ছেড়ে দেয়া উচিত। যদি সে সফল হয় তো সমগ্র আরবের ওপরই বিজয়ী হবে এবং তাতে তোমাদেরও ইজ্জত বাড়বে। আর তা না হলে আরব নিজেই তাকে ধ্বংস করে ফেলবে।’ কিন্তু কুরাইশরা তার এ অভিমত সমর্থন করলো না। এরপর একটি কর্মপন্থাই শুধু বাকি রইলো। যা এ পর্যায়ে এসে প্রত্যেক বাতিল শক্তিই হকের বিরুদ্ধে অবলম্বন করে থাকে। তাহলো, পূর্ণ জোর-জবরদস্তি ও নিষ্ঠুরতার সাথে হকের আওয়াজকে স্তব্ধ করে দেয়ার প্রয়াস। তাই কুরাইশরা ফয়সালা করলো যে, মুসলমানরা যাতে অতিষ্ঠ হয়ে নিজেরাই নিজেদের সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হয, সেজন্যে তাদের ওপর নির্দয় ব্যবহার করতে হবে। তাদের যাকে যেখানে পাওয়া যাবে, সেখানেই নিপীড়ন চালাতে হবে। (চলবে-)