৭ পর্ব
ভালোবাসা পেতে হলে
আমার নিকটতম প্রতিবেশী ফাহিমের আম্মা একবার বাচ্চাদের ঝগড়া ঝাটি নিয়ে বেশ কিছু কড়া কথা শুনিয়ে গেলেন আমাকে। পরদিন কোথাও যাওয়ার উদ্দেশ্যে গেট খুলে বের হতেই তার সাথে দেখা হলো আমি সালাম দিলাম। আমার প্রতিবেশী অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখলেন। বাসায় ফেরার পথে আবার দেখা হলো তার সাথে। আবার সালাম দিলাম। এবারও মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। পরদিন আবার দেখা হলো তার সাথে আমি সালাম দিলাম। এবার অন্য দিকে তাকিয়ে সালামের উত্তর দিলেন ভদ্রমহিলা। তার আচরণে আমার কেমন যেন একটা কৌতুক বোধ হচ্ছিল। হাসি পাচ্ছিল। হাসি মুখেই বললাম “আমি সালাম দিলাম আপনাকে আর আপনি ওদিকে তাকিয়ে উত্তর দিচ্ছেন কাকে?”
ভদ্রমহিলা এবার আমার দিকে তাকালেন বললেন “ভালো আছেন তো?” বললাম “আলহামদুলিল্লাহ। আপনি ভালো তো?”—
পরদিন সকাল বেলা আমার আর এক প্রতিবেশী মিলটনের আম্মা বেশ রাগত: স্বরেই বললো “আপা আপনি কেন ফাহিমের আম্মার সাথে কথা বলতে গেছেন? আপনার এমন কি দায় পড়েছিল?”
আমি হাসিমুখে বললাম “কেন? কি হয়েছে?”
ঃ ঐ মহিলা সবার কাছে বলে বেড়াচ্ছে তোমাদের ঐ আপার সাথে আমি জীবনেও কথা বলতাম না। মহিলা সেধে সেধে তিনদিন আমাকে সালাম দেওয়ার পর বাধ্য হয়ে কথা বলেছি। নইলে—–।”
ঃ কথা শেষ করতে না দিয়ে বললাম, সত্যি বলছেন? ফাহিমের আম্মা বলেছে এই কথা?”
মিলটনের আম্মা আরো রেগে গেলেন। বললেন “বলেনি মানে? আরও প্রায় আট/দশজনের সামনে বলেছে।”
বললাম “আলহামদুলিল্লাহ। আপা কথাটা একদম সত্যি। প্রথম দুইদিন তো ফাহিমের আম্মা সালামের উত্তরই দেয় নি তৃতীয় দিন উত্তর দিয়েছে অন্যদিকে তাকিয়ে।
ফাহিমের আম্মা যে সেই কথা আপনাদের কাছে বলেছে তার জন্য আমি খুব খুশি হয়েছি আপা।”
মিলটনের আম্মা অবাক হয়ে বললেন “কেন আপা?”
বললাম“ আপনি ঐ হাদীসটা তো জানেন যে আগে সালাম দেয় সে আল্লাহর অধিক নিকটবর্তী। তাহলে ফাহিমের আম্মা আপনাদের সবাইকে সাক্ষ্য রেখে বলেছে আমি আগে সালাম দিয়েছি। দ্বিতীয়তঃ ‘তিন দিনের বেশি কোনো মুসলমানের সাথে কথা বন্ধ রাখা হারাম। এ হাদীস টাও তো জানেন। তাহলে বলেন তো কিভাবে কথা না বলে পারি? আর তাছাড়া আমি নিজেই তো বিভিন্ন বৈঠকে এসব হাদীস বলি আর নিজে যদি তার আমল না করি তো কেমন হয় বলেন?”
বিকেলেই ফাহিমের আম্মা এলেন। মাথা নিচু করে বললেন, “আপা আমাকে মাফ করে দেন। আমি আপনার সম্পর্কে বাজে কথা বলেছি।”
আমি ফাহিমের আম্মাার হাত ধরে বললাম “কি যে বলেন না- কি এমন বলেছেন? ওসব বাদদেন তো। এক জায়গায় থাকলে কতো কথা হয়? আপন বোনের সাথেও লাগে। আপনি আমার ছোট বোনের মতো। আমি কিছু মনে করিনি।” ফাহিমের আম্মার সাথে এরপর অনেকদিন পাশাপাশি বাস করেছি। বদলি হয়ে চলে আসার সময় ফাহিমের আম্মা খুব কাঁদছিলেন। ভালোবাসার কান্না।
শাশুড়ী পুত্র বধূর ভালোবাসার অভাবে অনেক পরিবারে দেখেছি অশান্তির আগুন। আর ভালোবাসার অভাব সৃষ্টি হয়েছে Sacrifice এর অভাবে কিছুটা ক্ষমতার অপব্যবহারও বলা যায়।
১৯৮৪ সালে হাফেজা আসমা খালাম্মা আমাকে বলেছিলেন “যেখানে যাবে তোমার ব্যাগের মধ্যে বই রাখবে। পারলে বিক্রি করবে, না হলে বিলি করবে। বই বিক্রি সর্বোত্তম দাওয়াতী কাজ।” সেইদিন থেকে আমি যেখানে যাই বই আমার ব্যাগে থাকেই। আর কোনো বৈঠক বা প্রোগ্রামে গেলে তো উদ্দেশ্য মূলক ভাবেই বেশি করে বই নিই। বই কেনার জন্য যার সাথে জোর করা যায় তার সাথে জোর করি যাকে অনুরোধ করা যায় অনুরোধ করি। বই বিক্রি করা আমার যেনো একটা নেশা হয়ে দাড়িয়েছে। বই বিক্রির বহু মিষ্টি এবং তিক্ত অভিজ্ঞতা আমার আছে তা সময় মতো বলব ইনশা আল্লাহ।
যা বলছিলাম শাশুড়ি পুত্রবধূর ক্ষমতার অপব্যবহারের কথা তখন নওগাঁ শহরে থাকি। এক ওয়ার্ডেও সাধারণ বৈঠকে আমি মেহমান। ছোট বড় বেশ কিছু বই নিয়ে গিয়েছি। বৈঠক শেষ করে বই বের করলাম। বৈঠক শেষ হয়ে গেছে তাই অনেকে চলে যাচ্ছিলেন। বললাম,“প্লিজ যাবেন না, বই না কেনেন অন্তত একটু দেখেন। কষ্ট করে নিয়ে আসলাম আপনাদেও জন্য।” আর কেউ গেল না সবাই বই দেখতে লাগলেন। আবার বললাম “আপা বই কেনেন একটা ভাল বই কেনা সদকায়ে জারিয়া। আপনার মৃত্যুর পরে এই বইটা যে ই পড়বে মৃত্যুর পরও আপনার আমল নামায় তার সওয়াব লেখা হবে।” বই প্রায় সবই বিক্রি হয়ে গেলো। যে বাসায় বৈঠক করছি সেই আপা জামায়াত রুকন। তার খুবই অল্প বয়স্কা নতুন পুত্রবধূ বেছে বেছে কয়েকটা বই হাতে তুলে নিয়ে বললো “খালাম্মা আমি এই কয়টা নেব।” মনে মনে খুব খুশি হলাম। কিন্তু অবাক করে দিয়ে সেই রুকন আপা মানে বউটির শাশুড়ি বলে উঠলেন, “ঘরে কতো বই আছে তাই পড়। তুমি বই নিচ্ছ ক্যান?” বউটি লজ্জা পেয়ে গেলো। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। বললাম“আপা এসব অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের নতুন বই। এ বই আপনার কাছে নেই। নিক না বেশি দামতো না।”
ঃ“ না না রুমী আপা বই এর দামতো আমাকেই দিতে হবে।”
বললাম “পরে দিয়েন।”
ঃ “ না আপা বই এখন দিয়েন না।”
মেয়েটি সব বই রেখে দিয়ে একটা বই হাতে নিয়ে চুপ করে দাড়িয়ে থাকল। একবার ইচ্ছে হলো বলি ‘রাখ বইগুলো তোমাকে গিফ্ট করলাম। বললাম না।
মেয়েটির নানী এসেছে বেড়াতে তাকে বললো “ নানী আমাকে দশটা টাকা দাও আমি এই বইটা কিনব।”
মেয়েটির নানী উঠে দশটা টাকা দিলেন। আমার সেই আপা পুত্রবধূর কথাও শুনলেন নানীর টাকা দেওয়াও দেখলেন। আমার এই রুকন বোনটি ঐ এলাকার মধ্যে সবচেয়ে ধনী। এতো লোকের মধ্যে বিশেষ করে বউটির সামনে আমি আমার রুকন বোনটিকে কিছুই বলতে পারলাম না। যা হোক আর এক রুকন বোনের খোঁজ নিলাম যে এই বৈঠকে আসেনি। অথচ আমি এসেছি শোনার পর তো আর না আসার কথা না। তার বাসাটাও কাছে তাই আমিই গেলাম তার খোঁজ নিতে। যেয়ে শুনি তার পায়ের ব্যাথা বেড়েছে। হাঁটতে পারছেন না। বললেন “ আপা আপনি এসেছেন অথচ আমি যেতে পারছি না কি-যে খারাপ লাগছিল। মনে মনে অবশ্য আশা করছিলাম আপনি আসবেন। এই দেখেন আপনার জন্য চিনি ছাড়া চা তৈরী করে রেখেছি। বললাম “এতদূর এসে আপনার সাথে দেখা না করে যাই কি করে বলেন তো?” উল্লেখ্য আমার বাসা নওগাঁ শহর থেকে প্রায় বিশ কিলোমিটার দূরে। বদলগাছী থানায়। আমি এক পর্যায় ঐ আপার কথাটা বললাম।
বললাম “ আপা, আমি ঐ আপাকে অত লোকের সামনে কিছু বলতে পারলাম না। আবার কবে দেখা হবে তারও ঠিক নেই কিন্তু কথাটা বলা দরকার। আপনি বলবেন রুমী আপা বলেছে আজকে যে ব্যবহার আপনি করলেন, আপনার ছেলের বউ সারা জীবনেও তা ভুলবে না। আর বউকে আপনি অন্য কোনো বই পড়াতেও পারবেন না।”
আমার এই আপা তখন আমাকে বললেন “আপা বই কয়টি আপনি গিফ্ট করলেন না ক্যান? আপনি তো কতো বই কতোজনকে গিফ্ট করেন।” কথাটা যে আমারও মনে হয়নি তা না। দেওয়া যখন হয়নি কি আর করা। যা হোক, ইতোমধ্যে মেক্সি বিক্রি করতে এক মহিলা এলো এই বাড়িতে। এই আপার শাশুড়ি একটা মেক্সি হাতে নিয়ে বললো“ বৌমা এই মেক্সিটা কিনলে হতো না?”
আপার মুখে একটা বিরক্তির ছায়া পড়ল। বললেন, এক্ষুনি নিতে হবে? এখন টাকা নেই। পড়ে নেওয়া যাবে।” শাশুড়ি তাড়াতাড়ি মেক্সিটা রেখে দিয়ে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। আমিও উঠে পড়লাম। বললাম “আপা আর দেরী করব না। বাসায় পৌঁছাতে রাত হয়ে যাবে।”আমি দোতলা থেকে নিচে নেমে এলাম। আপার পায়ে ব্যথা বিধায় নামতে পারলেন না।
নিচে এসে দেখি ম্যাক্সিওয়ালা চলে যাচ্ছে, আপার শাশুড়ি গ্রিল ধরে চুপ চাপ দাঁড়িয়ে আছেন।
বললাম “খালাম্মা মেক্সি কার জন্য নিতে চেয়েছিলেন? খালাম্মা একটু ইতস্তত করে বললেন “ঐ আমার বিধবা মেয়েটার জন্য—-।” আমি মেক্সিটা দেড়শ টাকা দিয়ে কিনে খালাম্মার হাতে দিতেই খালাম্মা শ-শ ব্যস্ত হয়ে বললেন “না মা বৌমা শুনলে রাগ করবে।” বললাম “রাগ করবে না বলবেন রুমী জোর করে দিয়ে গেছে।”
এই আপাই কিন্তু একটু আগে আমাকে পরামর্শ দিয়ে ছিলেন “বই কয়টি আপনি গিফ্ট করলেন না কেন?” তার পরামর্শ অনুযায়ীই ম্যাক্সিটা তার শাশুড়িকে গিফ্ট করলাম। অবশ্য কয়েকদিন পরে আবার যখন দেখা হয় আপা তখন আমার টাকাটা দিয়ে দিয়েছিলেন। এই দুই জন আপাই যথেষ্ট ধনী। কুরআন হাদীসও কম বোঝেন না। অথচ দুজনেই ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। একজন ছেলের বৌর উপর নির্যাতন করছেন আর একজন শাশুড়ির উপর। অথচ এই আচরণটুকু তারা না করলেই পারতেন। বছরখানেক পর খবর পেলাম প্রথম আপার ছেলের বউ শাশুড়িকে একদম মানে না। নামায কালাম পড়েনা মনে মনে বললাম ঠিক আছে এমনটি হওয়াই স্বাভাবিক। এই দুটি পরিবারের অশান্তির জন্য আমি ঐ দু’জন আপাকেই দায়ী করব। তারা খুব ছোট ছোট ব্যাপারে স্বার্থত্যাগ করতে পারেনি। (চলবে)