আল্লাহর পথ থেকে সরে-পড়া,পথ-হারা মানুষকে হেদায়েতের আলো দিতে আল্লাহ মুহাম্মদ(সাঃ)-কে নির্বাচন করেন। এমন কাজ খুবই কঠিন ও দুরূহ। কেবল উত্তম চরিত্রের সুমহান ব্যক্তিত্বই এই গুরুদায়িত্বের সম্পাদন করেন এবং তাদের সাথে সংযুক্ত হোন এমন কিছু বড়-মাপের মানুষ যারা নবীদের আদর্শ বুঝেন এবং সেই লক্ষ্য অর্জনে নিজেদের জান ও মাল নির্দ্বিধায়, অকুণ্ঠচিত্তে কোরবানি করেন। এখানে নবী-রাসূল ও তাঁদের সঙ্গীদের মধ্যে নবুয়তের লক্ষ্য ও কর্ম-পদ্ধতি বুঝা ও একাত্ম হয়ে কাজ করার যে কেমিস্ট্রি গড়ে ওঠে, আল্লাহ এরই মাধ্যমে সাফল্যের দ্বার খুলে দেন। মুহাম্মদ(সাঃ)এঁর রেসালতের দায়িত্ব বুঝে সেই লক্ষ্য অর্জনে যারা তাঁর পাশে সংযুক্ত হয়েছিলেন তাঁদের সর্বপ্রথম ছিলেন এই উদারচিত্ত, প্রজ্ঞার গুণে গুণান্বিত, প্রভাব ও বিত্তে প্রতিষ্ঠিত, তাঁরই সহধর্মীনী, উভয় জগতের আলো, কাল-কিয়ামত পর্যন্ত মু’মীনদের প্রেম-ভালবাসা, আবেগ ও শ্রদ্ধায় সিক্ত এই মহীয়সী, হজরত খাদিজাতুল কুবরা(রাঃ), যার জান ও মাল নিবেদিত ছিল এই ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায়। প্রাথমিক পর্যায়ে ইসলাম যখন পা পা করে হাঁটতে শুরু করে তখন তাঁরই ধন-মালের উপর দিয়ে শুরু হয় সেই হাটা, সেই পথ চলা।
হেদায়েতের জন্য কোন ব্যক্তিকে নির্বাচন করা যেন সেই ব্যক্তিকে এক কঠিন রাস্তায় দাঁড় করিয়ে দেয়ার সমতুল্য। এখানে পরিত্যাজ্য হওয়া, আক্রমণের শিকার হওয়া, আহত-নিহত হওয়া, ঠাট্টা-বিদ্রূপের পাত্র হওয়া ইত্যাদির সবকিছু রয়েছে কিন্তু এর মধ্যে আবারও রয়েছে আধ্যাত্মিকতার আলোয় আলোকিত হওয়া, এর মধ্যে রয়েছে আত্মার অনাবিল শান্তি, তার রিজিক-সামগ্রী। এতে রয়েছে পরম নেয়ামত। এটা প্রাপ্তির পর এই লক্ষ্যে জীবনের মোকাবেলায় মৃত্যুও তুচ্ছ হতে পারে। আবার এরই মধ্যে নিহিত রয়েছে বিশ্বাসে প্রতিষ্ঠিত সম্প্রদায়ের বিপুল মান-সম্মান। এই দিক থেকে এই নির্বাচন হচ্ছে আশীর্বাদ ও রহমত।
আল্লাহ তাঁর ইচ্ছা মোতাবেক মুহাম্মদ(সাঃ)-কে সর্বশেষ নবী হিসাবে মক্কায় পাঠানোর পর তাঁর সাহায্যের জন্য কিছু মহতী-প্রাণ লোকদের সেই বাণীর প্রতি আকৃষ্ট করান। তাঁরা তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপন করেন। তাঁরা দুনিয়া আখেরের সাফল্যের উদ্দেশ্যে তাঁর সাহাবি হোন, তাঁর সাহায্যকারী হোন। এই সাহাবীদের মধ্যে রয়েছেন তাঁর সহধর্মীগণ। তাঁদের জন্যও রয়েছে এক বিপুল মর্যাদার স্থান। যেহেতু রাসূল(সাঃ)এঁর জীবন ছিল ইসলামের জন্য নিবেদিত, তাই তাঁর বিবাহ-শাদিতেও ইসলামের প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশও স্থান পেয়েছে। যারা তাঁর সহধর্মীনী হয়েছেন, তাঁরা দুনিয়া ও আখিরাতে সৌভাগ্যবান হয়েছেন, তাঁরা এক বিরাট মর্যাদার স্থানে এসেছেন। তাঁরা আর অন্যান্য নারীদের অবস্থানে থাকেননি। আল্লাহ নিজেই নবীর সহধর্মীনিদের অবস্থান ও মর্যাদার কথা উল্লেখ করে বলেন,
“হে নবী পত্নীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মত নও।” (৩৩-৩২)
এখানে আল্লাহ যা স্পষ্ট করে দিয়েছেন তা হল এই যে নবী পত্নীগণ সেই অর্থে অন্যান্য নারীদের মত নন যে তারা যেখানে ইচ্ছা সেখানে চলাফেরা করতে পারবেন, এইভাবে চলা ফিরা করলে কোথাও আল্লাহর দ্বীনের কাজ ব্যাহত হতে পারে। তাদের এই বিশেষ অবস্থানের কারণে কিয়ামতে তাদের পুরস্কার দ্বিগুণ হবে আর এবং এই অবস্থান থেকে কোন অন্যায় করেন তাহলে তার জন্য শাস্তিও দ্বিগুণ হবে। আল্লাহ তাঁদেরকে এই অবস্থানের জন্য উম্মতে মুসলিমায় এক অতি উঁচু মর্যাদার আসনে সমাসীন করেছেন।
নবুয়তের অনেক আগ থেকেই আল্লাহ পাক খাদিজা(রাঃ)-কে তাঁর সহধর্মীনী হিসেবে নির্বাচন করেন, কেননা খাদিজা(রাঃ)এঁর মধ্যে এমনসব গুণাবলী ছিল যা সকল দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে, দ্বীনের খেদমতে শীর উঁচু করে, স্থবির-চিত্তে অগ্রসর হওয়ার অনুকূল ছিল। খাদিজা(রাঃ) সমস্ত উম্মাহর মধ্যে সেরা সাহাবী এবং ব্যক্তিত্বশালী ছিলেন শুধু তাই নয় সর্বকালের সেরা চার মহিলার মধ্যে তিনিও ছিলেন একজন।
খাদিজা(রাঃ) পুরো নাম হচ্ছে খাদিজা বিনত খাওয়াইলিদ ইবনে আসাদ ইবনে আব্দেল ওজ্জা ইবনে কুসাই। তাঁর বংশতালিকা কুসাই পর্যন্ত গিয়ে মুহাম্মদ(সাঃ)এঁর বংশের তালিকার সাথে মিলেছে। তিনি তাঁর মায়ের দিক দিয়েও সম্পর্কিত ছিলেন। তাঁর মায়ের বংশতালিকাও মুহাম্মদ(সাঃ) এঁর ৭ম প্রপিতামহ লো’আই এর সাথে মিলিত হয়েছে। অতএব খাদিজা(রাঃ)-কে নবী(সাঃ)এঁর বংশের সব চেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের স্ত্রী হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং এই স্ত্রীর সন্তান ফাতিমা(রাঃ) এবং জায়নাব(রাঃ) মাধ্যমে মুহাম্মদ(সাঃ) এঁর বংশধরদের বিস্তৃতি বজায় রয়েছে।
প্রথমে আমরা খাদিজা(রাঃ)এঁর ইসলাম পূর্ব আভিজাত্য এবং সমকালীন সময়ে তাঁর মর্যাদা কত উঁচু ছিল তা দেখব।
প্রাক-ইসলামি মক্কী সমাজে নারীদের তেমন কোন সামাজিক মর্যাদা ছিলনা। সেই সময়ে নিজের জ্ঞান বুদ্ধি আর পরিশ্রম দ্বারা প্রতিকুল পরিবেশে তিনি সম্মানিত মহিলার স্থান অর্জন করেছিলেন এবং চরম অশ্লীলতায় ভেসে যাওয়া সমাজে তাঁর শালীনতা বোধ রক্ষা করে তাহিরা উপনামে খ্যাত হয়েছিলেন এবং ব্যবসায়িক জ্ঞানের দ্বারা বিশাল বাণিজ্য পরিচালক হিসাবে তিনি সুপরিচিত ছিলেন। ধীশক্তি আর সৌন্দর্যে, দৃঢ় চরিত্র এবং নরম হৃদয়ের সম্মিলন ছিলেন এই মহীয়সী, এই সমস্ত সকল গুণরাজি তাকে দিয়েছিল সূক্ষ্ম জ্ঞান এবং মানুষ আর ঘটনাকে বিচার করার পরিপক্ব ক্ষমতা।
খাদিজা(রাঃ) আমাদের মা, তিনি আমাদের ধর্মীয় বোনও বটে। তিনি আমাদের আদর্শ। তিনি ছিলেন তৎকালীন মক্কা নগরের অন্যতম ধনাঢ্য মহিলা। তাঁর এই ব্যতিক্রমধর্মী ব্যক্তিত্ব ছাড়াও তাঁর আর এক পরিচিতি ছিল- তিনি ইসলাম পূর্ব আরবে পৌত্তলিকতায় ভেসে যাওয়া সময়ে কখনও স্বজাতি আরও দশজনের মত মূর্তিপূজা করেন নাই।
খাদিজা(রাঃ) বিবেক বুদ্ধি, সৌন্দর্য, বংশ মর্যাদায় সেকালের শ্রেষ্ঠ নারী ছিলেন। যে মহিলাকে কুরাইশরা সম্মানের সাথে উপনাম দিয়েছিল, ‘তাহিরা’ অর্থাৎ ‘খাঁটি মহিলা’ (আল-ইসাবা)। আর যিনি এই ‘তাহিরা’কে বিয়ে করেছিলেন সেই মুহাম্মদ(সাঃ)কেও আরবের লোকেরা ‘বিশ্বস্ত’ ও ‘সৎ-চরিত্রের অধিকারী’ হিসেবে জানত। কারণ মুহাম্মদ(সাঃ) মিথ্যা কথা বলতেন না, ওয়াদার খেলাফ করতেন না, আমানতের খেয়ানত করতেন না, তাই তো সম্মান করে সবাই ডাকত ‘সাদিক’ ও ‘আল-আমিন’ অর্থাৎ ‘সৎ’ এবং ‘বিশ্বাসী’! আল্লাহ পাক কী চমৎকার মিলন ঘটিয়ে দিলেন দুই সেরা চরিত্রের মধ্যে!
মুহাম্মদ(সাঃ) এঁর সাথে বিয়ের পূর্বে খাদিজা(রাঃ)এঁর দুই দুই বার বিয়ে হয়েছিল। প্রথম স্বামী ছিলেন আতেক আল- মাখযোমি, যিনি বিয়ের কয়েক বছর পর মারা গিয়েছিলেন। সেই বিয়ের তাদের দুইটি সন্তান ছিলেন: একজন ছেলে এবং অপরজন মেয়ে। দ্বিতীয় স্বামী ছিলেন আবু-হালা আল-তামিমি। এই স্বামীর ঔরসে তাঁর আরও দু-জন সন্তান ছিলেন। যখন দ্বিতীয় স্বামী মারা যান তখন খাদিজা(রাঃ)এঁর বয়স ৩৭ ছিল। (ইতিহাসে প্রথম স্বামী কোন্ জন ছিলেন, তা নিয়ে দ্বিমত পাওয়া যায়)।
প্রথম স্বামী মারা যাবার পর উত্তরাধিকার সূত্রে বিপুল সম্পত্তি লাভ করেছিলেন। (এই সম্পত্তি লাভের বিষয় নিয়েও ভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়, আমরা ধরে নিচ্ছি যে, যেহেতু খাদিজা(রাঃ) এঁর বাবা ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ছিলেন তাই বাবার উত্তরাধিকার সূত্র থেকে পাওয়ার সম্ভাবনা নাকচ করা যাবেনা। পরবর্তীতে স্বামীদের কাছ থেকেও সম্পত্তি লাভ করে থাকবেন)। যেহেতু তিনি বুদ্ধিমতী ছিলেন তাই এই সমুদয় সম্পত্তি ব্যবসায় নিয়োগ করেন। চরম পুরুষবাদী সমাজে একজন নারী হয়েও প্রতিকুল পরিবেশে অত্যন্ত দক্ষ-হস্তে ব্যবসাকে সম্বৃদ্ধ করে তোলেন এবং ক্রমান্বয়ে এক সময় মক্কার সেরা ব্যবসায়ীতে পরিণত হোন।
দ্বিতীয় বারের বিধবা, কয়েক সন্তানের মা এবং বয়স ৩৭ হওয়া সত্ত্বেও মক্কার কত গণ্যমান্য তরুণ, সুদর্শন যুবক, বীর যোদ্ধা, ধনী আমির তাঁকে বিয়ে করার প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন কিন্তু তিনি সেই প্রস্তাবগুলো কঠোর ভাবে ফিরিয়ে দিয়ে ছিলেন। কারণ দুই স্বামীর অকাল মৃত্যুর জন্য তিনি আবার বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। তাই দ্বিতীয় স্বামীর মৃত্যুর পর ৩ বছর পর্যন্ত একা ছিলেন। তাঁর কাছে শুধু তাঁর ছোট ছেলে হিন্দ ছিল বাকি ৩ সন্তানকে আগেই বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন।
তখন যেহেতু তাঁর স্বামী নেই, তার বিশাল ব্যবসা বাণিজ্য তদারকির জন্য একজন নির্ভরযোগ্য বিশ্বাসী লোকের খোঁজ করছিলেন যাকে তাঁর আগামী সিরিয়াগামী বিরাট বাণিজ্য কাফেলার দায়িত্ব দিতে পারেন। সারা মক্কায় সেদিনের সমাজে যে ব্যক্তিকে একমাত্র সৎ হিসেবে জানা ছিল সেই ব্যক্তিটি ছিলেন যুবক মুহাম্মাদ(সাঃ)। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২২ বছর ছিল। খাদিজা(রাঃ) তখন এই যুবক মুহাম্মদ(সাঃ)কে এই পদে নিয়োগ দানের কথা ভাবছিলেন।
সে বছর আরবে দারুণ দুর্ভিক্ষ চলছিল, আবু তালিব অর্থনৈতিক দুঃসময়ে তাকে সাহায্য করার জন্য খাদিজা (রাঃ) বাণিজ্য কাফেলার দায়ীত্ব নেবার জন্য মুহাম্মদ (সাঃ)-কে উপদেশ দেন। এই আবু তালিব তাঁকে শিশুকাল থেকে পিতৃ-স্নেহে লালন-পালন করে বড় করেছিলেন। কিন্তু মুহাম্মদ (সাঃ) নিজ থেকে উপযাচক হয়ে তা করতে রাজী হোন নাই, তিনি উত্তর দিলেন- খাদিজা(রাঃ) যদি নিজ থেকে প্রয়োজন মনে করেন তাহলে তিনি নিজেই প্রস্তাব পাঠাবেন। আবু তালিব মুহাম্মদ(সাঃ)এঁর জবাব শুনে শঙ্কিত হলেন এই ভেবে যে, খাদিজা(রাঃ) ঐ পদের হয়তো অন্য কাউকে নিয়োগ দিয়ে দিবেন। তাই তিনি নিজ থেকেই খাদিজা(রাঃ)এর কাছে এসে পরামর্শ দিলেন- আপনি কি মুহাম্মদ(সাঃ)এর কাছে আপনার সিরীয়াগামী কাফেলার দায়ীত্ব নেবার প্রস্তাব করতে পারবেন? খাদিজা(রাঃ) তাঁর উত্তরে জানান- আপনি যদি এক অপরিচিত কাউকে প্রস্তাব করতেন তা আমি রাখতাম, কিন্তু আপনি যার নাম উল্লেখ করেছেন তাকে কেন আমি প্রস্তাব করতে যাবনা?
খাদিজা(রাঃ) তাঁর সিরিয়াগামী বাণিজ্যিক কাফেলার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেবার জন্য যুবক মুহাম্মদ(সাঃ)কে প্রস্তাব দেন। এবং তাঁকে অন্য লোকদের চেয়ে দ্বিগুণ পারিশ্রমিক দেবার কথা উল্লেখ করেন। মুহাম্মদ(সাঃ) সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেন।
খাদিজা(রাঃ) এঁর এক বালক দাস ছিল, যার নাম ছিল মায়সারা। তিনি মায়সারাকে এতই বিশ্বাস করতেন যে তাকে নিজ ‘চোখ’ বলে বিবেচনা করতেন। মায়সারা বাণিজ্যিক কাফেলার খবরদারীর দায়িত্বে থাকতেন। মুহাম্মদ(সাঃ)এর নেতৃত্বে এবং মায়সারার তত্ত্বাবধানে সে-বার খাদিজা(রাঃ)এঁর বাণিজ্যিক কাফেলা সিরিয়ায় যায়। প্রত্যাশার অধিক মুনাফা নিয়ে মুহাম্মদ(সাঃ) মক্কায় ফিরে আসেন। খাদিজা(রাঃ) এহেন বাণিজ্যের ফলাফল দেখে চমকিত হোন। তিনি মায়সারাকে ডেকে মুহাম্মদ(সাঃ) এঁর কাজ কর্ম সম্পর্কে খোঁজ খবর নেন: বাণিজ্যে সফরের সময় তাঁর ব্যবহার কেমন ছিল, দীর্ঘ বাণিজ্য যাত্রায় তিনি কী কী করেছিলেন ইত্যাদি।
পরবর্তি সময়ে তিনি মুহাম্মদ(সাঃ)কে আবার ইয়ামেন বাণিজ্য কাফেলা দিয়ে পাঠান, সেই কাফেলায়ও মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর নিজস্ব বাণিজ্যিক দক্ষতার দ্বারা প্রচুর লাভ অর্জন করেছিলেন ।
খাদিজা(রাঃ) বাণিজ্য চলাকালে আমানতদারিতা,ব্যবসায় কর্মরত সকল কর্মীদের সাথে ন্যায় পরায়ন ব্যবহার, নির্লোভ, নির্মোহ এবং ব্যবসায় তীক্ষ্ণ ধীর অধিকারী মুহাম্মদ(সাঃ) এঁর ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। তাঁর আচার-আচরণ, ন্যায়-নিষ্ঠা, কোমল ব্যবহার ইত্যাদি গভীরভাবে নিরীক্ষণ করতে থাকেন। এমন বিরল প্রতিভার অধিকারী ব্যক্তিকে তখন নিজের করে নেবার ইচ্ছা খাদিজা(রাঃ)এর অন্তরে জাগে। খাদিজা(রাঃ) যেহেতু উচ্চ বংশের সম্মানিত মহিলা ছিলেন তাই তিনি মুহাম্মাদ(সাঃ)কে স্বামী হিসাবে পাবার ইচ্ছা লালন করলেও সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব না দিয়ে সংযমের সাথে অন্যের মাধ্যম ব্যবহার করেন। তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠ বিশ্বস্ত বান্ধবী নাসিফা বিনত মুনিয়ার কাছে কৌশলে বিষয়টি তুলে ধরেন। খাদিজা(রাঃ) নাসিফা(রাঃ)কে জানালেন যে মুহাম্মদ(সাঃ) হচ্ছেন একজন অসামান্য, অনন্য চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তিত্ব। তবে তাঁর মুহাম্মদ(সাঃ)এঁর প্রতি কোন প্রেম বা অনুরাগের কথা উল্লেখ করেন নাই। নাসিফা(রাঃ) নিজেও জানতেন মুহাম্মদ(সাঃ) কে ছিলেন, কেমন ছিলেন। খাদিজা(রাঃ) এঁর মুখ থেকে প্রশংসা শুনেই নাসিফা(রাঃ) বলে উঠেন- আমি বিশ্বাস করি, মুহাম্মদ(সাঃ) হতে পারেন তোমার জন্য চমৎকার এক স্বামী। পাঠক, লক্ষ্য করুন, এটি ছিল নাসিফা(রাঃ)এঁর নিজের ধারণা। তারপর নাফিসা(রাঃ) এই বিষয়ে মধ্যস্থতা করার জন্য খাদিজা(রাঃ) অনুমতি চাইলেন। খাদিজা(রাঃ) তাকে সেই অনুমতি দিলেন।
নাসিফা(রাঃ) মুহাম্মদ(সাঃ)এঁর কাছে যান এবং তার একান্ত বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তারপর এক পর্যায় জানতে চান,- আপনি বিয়ে করছেন না কেন? (তবে কোন অবস্থায় খাদিজা(রাঃ) এঁর বিষয়ে কিছু বলেন নাই)। সে সময় মুহাম্মদ(সাঃ) বয়স হয়েছিল মাত্র ২৫ বছর।
যে সমাজে যৌনতা ছিল ডাল-ভাত, যেখানে যৌনতাকে পূজা অর্চনা করার রেওয়াজ ছিল, সেই সমাজে মুহাম্মদ(সাঃ) ছিলেন সুদর্শন যুবক, গড় উচ্চতার সুগঠিত শরীর ছিল তাঁর, মাথার চুল আর দাড়ি ছিল ঘন কালো এবং কোঁকড়ান, চেহারায় ছিল উজ্জ্বল অভিব্যক্তি যা বিশেষ ভাবে সবার নজর কাড়ত। (মুহাম্মদ(সাঃ )মহানবীর জীবনী – ক্যারেন আর্মস্ট্রং পৃঃ ৮৯) অধর কান্তি সুন্দর সুদর্শন এক যুবক থাকা সত্ত্বেও তাঁর সেই জীবনের ২৫ বছর পর্যন্ত কখনও কোন নারীর সান্নিধ্যে কাটান নাই।
মুহাম্মদ(সাঃ) নাফিসা(রাঃ)এঁর প্রশ্নের জবাবে জানান- বিয়ে করার জন্য যে অর্থ-বিত্তের দরকার, তা এখনও আমি অর্জন করতে পারিনি। নাসিফা(রাঃ) জিজ্ঞাস করেন,- যদি আপনার বিয়েতে সেই অর্থ-বিত্তের দরকার না পড়ে, আর যদি একজন অর্থশালী, সুন্দরী মহিলা কোন কিছুর দাবী ছাড়াই আপনাকে বিয়ে করতে চান, তাহলে আপনার কি অভিমত?
মুহাম্মদ(সাঃ) প্রশ্ন করেন, কে সেই মহিলা?
নাসিফা(রাঃ) জবাব দেন, খাদিজা(রাঃ)!
সাথে সাথে জানতে চান- খাদিজা(রাঃ) কি আমাকে গ্রহণ করবেন?
নাসিফা(রাঃ) বলেন- আমি তাকে জিজ্ঞাসা করতে পারি।
তারপর, তিনি সেই শুভ সংবাদ নিয়ে খাদিজা(রাঃ) এঁর কাছে ফিরে আসেন।
পাঠক, এখান থেকে শুরু হয়েছিল পৃথিবীর এক অমর সম্পর্কের আখ্যান। সে আখ্যানে তাঁদের বিবাহিত জীবনের ২৫টি চমকপ্রদ বছর কেটে গিয়েছিল এবং তা খাদিজা(রাঃ) ওফাতের পরও ১৫টি বছর পর্যন্ত বহাল রয়ে গিয়েছিল। ইতিহাসে কোথাও এমন একটি বাক্য নেই যেখানে মুহাম্মদ(সাঃ) এমন কোন নেতিবাচক শব্দ প্রয়োগ করে গিয়েছিলেন এই খাদিজা(রাঃ) সম্পর্কে! এখানেও আল্লাহর এক কারিশমা কাজ করেছে বলে আমার বিশ্বাস। না হলে, বাস্তব দুনিয়ায় দু’বারের এক বিধবা, যিনি কয়েক জন সন্তানের মা এবং যুবক স্বামীর চেয়ে ১৫ বছরের বেশী বয়সী স্ত্রীর সাথে দাম্পত্য জীবন অনাবিল শান্তিতে ২৫ বছর কেমন করে কাটতে পারলেন?
বিয়ের চিরন্তন ও শাশ্বত রীতি অনুযায়ী মুহাম্মদ(সাঃ) তাঁর চাচা আবু তালিবকে সব জানান। এই বিয়ে খাদিজা(রাঃ) এঁর সম্মতি জানতে পেরে আবু তালিব যথা নিয়মে খাদিজা(রাঃ)এঁর চাচা আমর বিন আছের কাছে বিয়ের প্রস্তাব পেশ করেন। সকলের সম্মতিক্রমে বিয়ের দিন তারিখ এবং মোহর ঠিক হয়। পাঁচশত স্বর্ণ মুদ্রা মোহর ধার্য করা হয়। খাদিজা(রাঃ) নিজেই উভয় পক্ষের যাবতীয় খরচ বহন করেন। তিনি দুই উকিয়া সোনা ও রুপো মুহাম্মদ(সাঃ) এঁর নিকট পাঠান এবং তা দিয়ে উভয়ের পোশাক ও ওয়ালিমার বন্দোবস্ত করেন। এভাবেই নবুয়তের পরবর্তীতে হযরত খাদিজা(রাঃ) মুসলিম উম্মাহর প্রথম ‘উম্মুল মোমেনিন’, মু’মীনগণের মা হবার সম্মান অর্জন করেন।
মক্কার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে দু’জনের শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয়। এই বিয়েতে আবু তালিব যে খুৎবা পাঠ করেন আরবি সাহিত্যের মানের দিক দিয়ে এ খুৎবা জাহেলী যুগের আরবি গদ্য সাহিত্যে বিশেষ স্থান দখল করে। সেই খুৎবার উত্তর প্রদান করেছিলেন খাদিজা(রাঃ) এঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা বিন নওফেল। (মোস্তফা চরিত ২৮৫/২৮৬)
ইতিহাসের পাতায় তাদের বিয়ের পর থেকে মুহাম্মদ(সাঃ)এঁর নবুয়াতী লাভ পর্যন্ত ১৫ বছরের শুধু হাজরে আসওয়াদ এর ঘটনা ছাড়া আর তেমন কোন কিছুর উল্লেখ পাওয়া যায়না। তবে উল্লেখ আছে যে ঐ সময়ের মধ্যে তাঁদের চার কন্যা: জায়নাব(রাঃ), রোকাইয়া(রাঃ), উম কুলসুম(রাঃ), ফাতিমা(রাঃ) এবং দুই পুত্র: আল কাসেম, আব্দুল্লাহ বা আল তাহেরের জন্মের কথা। আরও জানা যায় তাদের প্রতিপালক পুত্র ছিলেন আলি ইবনে আবি তালিব(রাঃ), জাইদ ইবনে হারিস(রাঃ), আল যুবায়ের ইবনে আওয়াম(রাঃ)পালক পুত্রদের এবং হিন্দ(রাঃ) নামক খাদিজা(রাঃ)এঁর আগের পক্ষের পুত্রকে লালন পালনের কথা। আমরা অনুধাবন করতে পারি এত বড় পরিবারের তত্ত্বাবধান করতে খাদিজা(রাঃ) কত ব্যস্ত ছিলেন! উপরে উল্লেখিত ব্যক্তিরা পরবর্তীতে ইসলামের ইতিহাসে নিজ নিজ গুণে ঐতিহাসিক নেতৃত্বের ভূমিকায় আসেন। তারা সেই পর্যায়ে উপনীত হওয়ার পিছনে খাদিজা(রাঃ) এঁর ভূমিকা ছিল ব্যাপক।
খাদিজা(রাঃ) এঁর বয়স যখন ৫০ বছরের উপরে তখন থেকেই মুহাম্মদ(সাঃ) নির্জন এলাকায় ধ্যান-সাধনার মগ্ন এবং ঘর সংসারের প্রতি উদাস হয়ে পড়েন। সাধনার উদ্দেশ্যে কয়েক সপ্তাহের জন্য শহরের কোলাহল থেকে দূরে গিয়ে জবল-ই-নুর পাহাড়ের হীরা নামক এক গুহায় নির্জন-বাস শুরু করেন। সেই সময়ে খাদিজা(রাঃ)ও তাঁর স্বামীর ধ্যান-তপস্যায় যেন কোনরূপ বিঘ্নতা না হয় সেদিকে সব সময় নজর রাখতেন। সেই বয়সে স্বামীর জন্য খাদ্য পানীয় এবং আনুষঙ্গিক ব্যবহার্য অন্যান্য উপকরণ নিজে বহন করে সেই উঁচু পাহাড়ের গুহায় নিয়ে যেতেন। আজকালকার অনেক স্ত্রীদের মত তিনি কখনও এই নিয়ে স্বামীর প্রতি অভিযোগ করে নাই, ‘কেমন মানুষ আপনি? সারাদিন পাহাড়ে বসে বসে হাওয়া খাচ্ছেন! বলি সংসারের দায়-দায়িত্ব বলতে কি স্বামীর জন্য কিছু নেই! আমি কি স্ত্রী হয়ে এসেছি সারাদিন বাচ্চাকাচ্চার ফাই-ফরমাশে দাসীর মত কাজ করে যাবার জন্য?’ না, তিনি কখনও এমন কথা বলেন নাই। বরং তিনি যেমন স্বামীর সেবা যত্ন করতেন তেমনি স্বামীর প্রতিটি কাজে-কর্মে একবাক্যে সমর্থন এবং সহযোগিতা করে যেতেন।
একটি রাতের কথা!
মুহাম্মদ(সাঃ) সবে মাত্র ৪০ বছর বয়সে পা দিয়েছেন এবং খাদিজা(রাঃ) ৫৫ বছর বয়স। সেই অভিজ্ঞতা কথা স্বয়ং মুহাম্মদ সাঃ এঁর মুখে শুনুন:
‘সে রাতে আমি ছিলাম গুহায়। আমি দেখতে পেলাম জিবরাঈল(আঃ) আমার পাশে দাঁড়ানো, এবং আমাকে আলিঙ্গন করে চাপ দিয়ে বললেন, পড়! আমি জানালাম, আমি তো পড়তে জানিনা। তখন তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে আবার আলিঙ্গনের দ্বারা চাপ দিলেন এবং সেই চাপের কারণে আমি অনুভব করলাম যেন আমি মারা যাচ্ছি। তিনি আবার বললেন, পড়! আমি বললাম, আমি তো পড়তে জানিনা। তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে এবার আরও অধিক জোরে আমাকে চাপ দিয়ে বললেন, পড়! তখন আমি জানতে চাই কি আমি পড়ব? তিনি বললেন, পড় তোমার সৃষ্টিকর্তার নামে– قْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ পড়ো! (হে নবী), তোমার রব এবং পালন কর্তার নামে ৷ যিনি সৃষ্টি করেছেন৷’ (কোরআন: ৯৬:০১)
৬১০ খ্রিষ্টাব্দের রমজান মাসে প্রাপ্ত এই একটি মাত্র বার্তা পৃথিবীর ইতিহাসের চাকাকে নতুন মোড়ে ঘুরিয়ে দিয়েছিল । এই বার্তা দিয়েই নতুন জীবন ব্যবস্থা ইসলামের পৃথিবীতে সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করার যাত্রা শুরু হয়েছিল। যখন জিবরাইল(আঃ) অদৃশ্য হয়ে গেলেন।মুহাম্মদ(সাঃ) এত ভয় পেয়ে যান যে সারা শরীরে কম্পন শুরু হয়। তিনি বুঝতে পারছিলেন না আসলে কি ঘটে গেয়েছিল। তিনি দ্রুততার সাথে মক্কায় ফিরে ফিরে আসেন। এই অবস্থায় তিনি তাঁর প্রাণের বন্ধু আবু বকর রাঃ এর কাছে পরামর্শের জন্য ছুটে যাননি, যাননি বিজ্ঞ অভিজ্ঞ প্রবীণ ব্যক্তিত্ব তাঁর আপন চাচা আবু তালিবের কাছে যিনি তাঁকে লালন পালন করে বড় করেছিলেন। তিনি শুধু ছুটে গিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী খাদিজা(রাঃ)এঁর কাছে!
থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে নিজ ঘরে হামাগুড়ি দিয়ে প্রবেশ করেই খাদিজা(রাঃ) কোলে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং কম্বল দিয়ে নিজের গা জড়িয়ে দেয়ার জন্য বলেন। বারবার বলতে থাকেন, ‘আমাকে আবৃত কর!’ ‘আমাকে আবৃত কর!’ খাদিজা(রাঃ) স্বামীর এই অবস্থা দেখে তাঁকে গভীর ভাবে জড়িয়ে রাখলেন। কম্পিত দেহের শঙ্কা কমানোর চেষ্টা করলেন, অভয় দিলেন, আশংকা দূর করার চেষ্টা করলেন। জিজ্ঞাস করেন, আপনার কি হয়েছে তো বলুন? তিনি জবাব দিলেন যে, সম্ভবতঃ শয়তান আমাকে আশ্রয় করেছে! সাথে সাথে এই সম্ভাবনার কথা খাদিজা(রাঃ) নাকচ করে দিয়ে বলেন, না, আল্লাহর কসম, তিনি এই ভাবে আপনার মর্যাদাহানি করতে পারেন না! খাদিজা(রাঃ) তাঁর স্বামীকে অকুণ্ঠচিত্তে সমর্থন দিলেন এবং স্বামীকে দিলেন তাঁর দ্ব্যর্থহীন আস্থা। সংকট কালে খাদিজা(রাঃ) উপর মুহাম্মদ(সাঃ) এঁর গভীর নির্ভরশীলতা ছিল। (এই ভাবে উম্মতে মুহাম্মদীর সকল পুরুষের উচিত তাদের স্ত্রীদের উপর নির্ভর করা) খাদিজা(রাঃ) সর্বপ্রথম নবী মুহাম্মদ(সাঃ) পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। খাদিজা(রাঃ)ই তাঁকে নবী হিসাবে প্রথম তাঁকে অনুসরণ করেন এবং তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি ইসলামী রীতি রেওয়াজ চর্চা শুরু করেন।(উম্মতে মুহাম্মদীর নারীদেরও উচিত সংকটকালে খাদিজা(রাঃ)এঁর মত স্বামীর পাশে দাঁড়ানোর।)
ভীতি দূর করার জন্য মুহাম্মদ(সাঃ)কে নিয়ে খাদিজা তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের কাছে যান। সেই জাহেলী যুগে তিনি খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। হিব্রু ভাষায় ইনজিল কিতাব লিখতেন। তিনি তখন বৃদ্ধ ও দৃষ্টিহীন। এই সেই নওফেল যার আপন বোন কাতিলা বিনত নওফেল একদিন মুহাম্মদ(সাঃ)এঁর পিতা আব্দুল্লাহর কাছে বিয়ে বসার জন্য নিজেই আব্দুল্লাহকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আবার তার চাচাতো বোন খাদির(রাঃ)কে দেখতে পেয়েছি যিনি মুহাম্মদ(সাঃ) কে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। (শিবলী নুমান-বিশ্ব নবীর জীবনী পৃঃ ৭৪৪)। খাদিজা(রাঃ) ওরাকাকে বললেন- শুনুন আপনার ভাতিজা কি বলে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ভাতিজা, তোমার বিষয় কি? মুহাম্মদ(সাঃ) পুরো ঘটনা বর্ণনা করলেন। শুনে ওয়ারাকা বললেন- এই তো সেই ‘নামুস’ (ফেরেশতা), আল্লাহ যাকে মুসা(কঃ)র নিকট পাঠিয়েছিলেন। নওফেল তাঁকে শেষ নবী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তারপর জানান- আফসোস! সেদিন তোমার দেশবাসী তোমাকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিবে। মুহাম্মদ(সাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, এরা আমাকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিবে? তিনি বললেন- হ্যাঁ, তুমি যা নিয়ে এসেছ, যখনই কোন ব্যক্তি তা নিয়ে এসেছে, সারা দুনিয়া তাঁর বিরোধী হয়ে গিয়েছে। যদি সে সময় পর্যন্ত আমি বেঁচে থাকি, তোমাকে সব ধরনের সাহায্য করব, কিন্তু এই ঘটনার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ওয়ারাকার মৃত্যু হয়।
খাদিজা(রাঃ) রাসূল (সাঃ)এঁর উপর প্রত্যাদেশ অবতরণের পর বুঝতে পারেন যে,এটি প্রতিষ্ঠা করতে হলে তাঁর স্বামীকে পুরো আরবের সকল সমাজের মানুষের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়াতে হবে। (কারণ তৎকালীন পৌত্তলিক নেতৃত্বের ভীত ধ্বংস করা ব্যতীত ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার অন্য কোন উপায় ছিলনা) তখন থেকে দিন-রাত্রি তিনি তাঁর পরিচিত জনদের মধ্যে ইসলামের বার্তাকে প্রসারিত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তিনি অনেক টাকা পয়সা খরচ করে আরও অনেক দাস ক্রয় করেন মুহাম্মদ(সাঃ)কে নিরাপদ রাখার জন্য। আবু লাহাবের (যিনি মুহাম্মদ(সাঃ) আপন চাচা ছিলেন) দুই ছেলের সাথে মুহাম্মদ(সাঃ) দুই মেয়ে রোকাইয়া(রাঃ) উম কুলসুম(রাঃ) বিয়ে হয়েছিল। (খুব সম্ভব তখন রোকাইয়া(রাঃ) এর বয়স ৯ এবং উম কুলসুম(রাঃ)এঁর বয়স ৭ বছর ছিল) মেয়ে দুইজন মুসলিম হয়ে যাবার কারণে সে বিয়ে ভেঙ্গে যায়। পরবর্তীতে রোকাইয়া(রাঃ) এঁর সাথে উসমান ইবনে আফফান(রাঃ) এঁর সাথে বিয়ে হয়। পরে স্বামীর সাথে হাবাসা হিজরত করেন।
নামায ফরয হওয়ার হুকুম তখনও নাযিল হয়নি। হযরত খাদিজা(রাঃ) এর ঘরের মধ্যে মুহাম্মদ(সাঃ) এর সাথে সেই প্রথম থেকেই নামায আদায় করতেন। ইবনে ইসহাক উল্লেখ করেছেন, একদিন আলী(রাঃ) দেখতে পেলেন তাঁরা দু’জন অর্থাৎ নবী(সাঃ) ও খাদিজা(রাঃ) নামায আদায় করছেন। আলী(রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন- মুহাম্মদ(সাঃ) এ কি? মুহাম্মদ(সাঃ) তখন নতুন দ্বীনের দাওয়াত আলীর কাছে পেশ করলেন এবং এ কথা কাউকে বলতে নিষেধ করলেন। এ বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় যে, উম্মতে মুহাম্মদী(সাঃ) এঁর মধ্যে সর্ব প্রথম খাদিজা(রাঃ) রাসুলুল্লাহ(সাঃ) এঁর সাথে নামায আদায় করার গৌরব অর্জন করেন।
আফীফ আল- কিন্দি নামক এক ব্যক্তি কিছু কেনা-কাটার জন্য মক্কায় এসেছিলেন। তিনি হযরত আব্বাস(রাঃ )বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। একদিন সকালে লক্ষ্য করলেন, এক যুবক কা’বার কাছে এসে আসমানের দিকে তাকালো। তারপর ক্বিবলামুখী হয়ে দাঁড়াল। একজন কিশোর এসে তার পাশে দাড়িয়ে গেল। তারপর চলে এল এক মহিলা সেও তাঁদের পিছনে দাঁড়াল। তাঁরা নামায শেষ করে চলে গেল। দৃশ্যটি আফীফ কিন্দী দেখলেন। আব্বাস(রাঃ) কে তিনি জিজ্ঞাস করলেন- বড় রকমের একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে? আব্বাস(রাঃ) বললেনঃ -হ্যাঁ। তিনি আরও বললেন, এ যুবক আমার ভাতিজা মুহাম্মদ(সাঃ), কিশোরটি আমার আরেক ভাতিজা আলী(রাঃ) এবং মহিলাটি মুহাম্মদ(সাঃ) এঁর স্ত্রী, … আমার জানামতে দুনিয়ায় তারা তিনজনই নতুন ধর্মের অনুসারী।
ইসলামের কাজে অনেক টাকা ব্যয় হচ্ছিল। তাই রাসূলকে (সাঃ) একদিন বিমর্ষ দেখায়। খাদিজা জিজ্ঞেস করেন- কি ব্যাপার, মন খারাপ করে বসে আছেন যে? তিনি বলেন- আমি যে দীনি কাজে তোমার টাকা খরচ করে যাচ্ছি। তখন খাদিজা কোরেশের কিছু লোকজনকে ডেকে ধনসম্পদ বের করে বলেন-‘আমার যা কিছু ছিল এ মুহূর্তে সবই আপনার। আপনি যেভাবে ইচ্ছা তা ব্যয় করতে পারেন। আমি কেবল আপনার সেবায় থাকতে চাই। ‘ খাদিজা(রাঃ) এঁর এই ঘোষণার পর মুহাম্মদ(সাঃ) মক্কার শ্রেষ্ঠ ধনীদের একজন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। কিন্তু খাদিজা(রাঃ) এর দেয়া ধনসম্পদ তিনি ব্যক্তিগত ভোগ-বিলাসে ব্যয় করলেন না। সকল ধনসম্পদ তিনি এতিম, মিসকিন, অভাবী ও অনাথদের মাঝে বিলিয়ে দিলেন। এভাবে ধন-সম্পদ বিলিয়ে দেয়ার পরও তাঁদের দাম্পত্য জীবন ছিল অত্যন্ত মধুর।
এই ইসলামী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার কারণে খাদিজা(রাঃ) সম্পদ দ্রুত কমে যেতে লাগল, কিন্তু তাঁদের হৃদয় আগের চেয়ে আরও বেশী একতাবদ্ধ হতে থাকে। এরপর ৬১৬ খ্রিঃ তাঁদের উপর নেমে আসে চরম দুর্দশা, যখন কুরাইশরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তারা আবি তালিবের পুরো গোত্র এবং মুহাম্মদ(সাঃ) এঁর অনুসারীদেরকে শাস্তি দিতে তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করবে। এর ফলে মক্কার কোন গোত্র তাদের সাথে কোনও প্রকার সামাজিক ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ রাখতে পারবে না। সম্পূর্ণ বয়কট। এভাবে তাদেরকে তিন বৎসর ‘ শিয়াবে আবু তালিব’ নামক গিরিখাতে অবরোধ করে রাখা হয়। সেই অবরোধের সময় তারা চরম অনাহারে থাকতে হয়েছেন। এমন কি ক্ষুধা নিবারণ করতে গিয়ে গাছের শুকনা পাতা পর্যন্ত তাদের খেতে হয়েছিল। এবং এই পাতাগুলো খাদিজা(রাঃ) সংগ্রহ করে এনেছিলেন যদিও তাঁকে কুরাইশদের অবরোধের আওতা থেকে মুক্ত রাখা হয়েছিল। কিন্তু ধনাঢ্য মহিলা তাঁর মুসলিম অনুসারীদের সাথে ক্ষুধার জ্বালাকে বরণ করে নেন এবং ক্রমান্বয়ে ভয়ানক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। কুরাইশদের কিছু লোক যারা খাদিজা(রাঃ)এঁর আত্মীয় ছিলেন। তারা তার এই অবস্থা দেখে এই চিন্তায় পড়েন। তারা ভাবেন, খাদিজা(রাঃ) হয়তো মারা যেতে পারেন। আর এটা ঘটলে তাদের জন্য চরম মর্যাদাহানি হবে। তখন তারা লুকিয়ে লুকিয়ে তাঁর কাছে খাদ্য পাঠাতে শুরু করেন। এই তিনজন হলেন: তাঁর ভাতিজা-হাকিম ইবনে হিযাম, আবুল বুখতারী ও যুমআ ইবনুল আসওয়াদ। তাঁরা সকলে ছিলেন কুরাইশ নেতৃবর্গের অন্যতম। অমুসলিম হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা বিভিন্নভাবে মুসলমানদের কাছে খাদ্য-শস্য পাঠাতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। একদিন হাকিম ইবনে হিসাম তাঁর চাকরের মাধ্যমে ফুপু খাদিজা(রাঃ) এঁর কাছে কিছু গম পাঠাচ্ছিলেন। পথে আবু জাহেল বাধা দেয়। হঠাৎ আবুল বুখতারী সেখানে উপস্থিত হন। তিনি আবু জাহেলকে বললেন- এক ব্যক্তি তাঁর ফুপুকে সামান্য খাদ্য পাঠাচ্ছে, তুমি তাঁকে বাধা দিচ্ছ?
এই খাদ্যগুলো তিনি না খেয়ে অবরুদ্ধ মুসলিমদের মাঝে বিলিয়ে দিতেন। এমনকি যখন তিনি বুঝতে পারলেন যে তাঁর সময় শেষ হয়ে আসছে, তখনও তিনি ইসলামে প্রতি আহ্বান জারি রাখেন। ৬১৯ খ্রিঃ ১০ই রমজান যখন মুহাম্মদ(সাঃ)এঁর অতি প্রিয়তম স্ত্রী মারা যাচ্ছেন তখন জিবরাইল(আঃ) তাঁর নিকট আসেন এবং বলেন- হে মুহাম্মদ(সাঃ) আপনি খাদিজা(রাঃ)কে আল্লাহর তরফ সালাম পৌঁছান। তাঁকে জানিয়ে দিন যে, আল্লাহ তাঁর জন্য বেহেস্তে মুক্তা দিয়ে দুর্গ বানিয়ে রেখেছেন, যেখানে কোন ধরণের গোলমাল এবং যন্ত্রণা থাকবেনা। বলা হয়ে থাকে জান্নাতের পুরস্কার তাঁর জন্য দুনিয়াতে থাকতেই নির্ধারিত করে দেওয়া হয়েছিল এবং এইটি ছিল তাঁর প্রাপ্য। জানাজা নামাযের বিধান তখনো চালু হয়নি। সুতরাং বিনা জানাজায় তাঁকে মক্কার কবরস্থান জান্নাতুল মুয়াল্লায় দাফন করা হয়। মুহাম্মদ(সাঃ) নিজেই তাঁর লাশ কবরে নামান।
মুহাম্মদ(সাঃ) খাদিজা(রাঃ)এঁর ওফাতের কারণে হত-বিহ্বল হয়ে পড়েন।সেই একই সময়ে তাঁর চাচা আবু তালিবও মারা যান। সাহেবায়ে কেরামগণ সেই বছরকে দুঃখের বছর বলে উল্লেখ করেন। অন্য যে কারো চেয়ে খাদিজা(রাঃ) এঁর জন্য তাঁর ভালবাসা তাঁর হৃদয়ে গভীরভাবে আজীবন সতেজ এবং উজ্জ্বল থাকে।
অনেক বছর পর একদিন নবী (সাঃ)এঁর সাথে আয়েশা(রাঃ) বসা ছিলেন। তখন কেউ একজন দরজায় করাঘাত করে ভিতরে আসার অনুমতি প্রার্থনা করে। তখন মুহাম্মদ(সাঃ) বলে উঠেন, খাদিজা(রাঃ)! এবং দ্রুত উঠে দরজা খুলার সময় বলেন- ও আল্লাহ এই যেন হা’লা হয়! হা’লা ছিলেন খাদিজা (রাঃ)এঁর বোন। আর সত্যিই তখন হা’লাই এসেছিলেন। আর হালাহ(রাঃ) কণ্ঠস্বর ছিল বিবি খাদিজা(রাঃ) এর কণ্ঠের মত। যখন তিনি পশু কুরবানি দিতেন তখন তাঁর গোস্ত উপহার স্বরূপ খাদিজা(রাঃ) পরিচিত মহলে পাঠিয়ে দিতেন। এর এই কারণে আয়েশা(রাঃ) খাদিজা(রাঃ)কে ঈর্ষা করতেন। একদিন সেটি প্রকাশ করে ফেলেন। বললেন- খাদিজা, মনে হচ্ছে সমগ্র পৃথিবীতেই শুধু খাদিজা। মুহাম্মদ(সাঃ) উত্তর দেন- আয়েশা, এইভাবে খাদিজাকে নিয়ে কথা বলবে না। আমি তাকে ভালবাসি এবং যে তাকে ভালবাসবে আমি তাকে ভালবাসব।
আরেক সময়ের একটি ঘটনা। মুসলিমগণ মুহাম্মদ(সাঃ) মেয়ের স্বামীকে বন্দী করে। তার নাম আল-আস ইবনে আল- রাবী। তিনি মুসলিম ছিলেন না এবং মুসলিমদের বিপক্ষে বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। আল-আস ধরা পড়ার পর তার স্ত্রী জায়নাব (রাঃ) (মুহাম্মদ(সাঃ)এঁর বড় মেয়ে) তাকে মুক্তিপণ দিয়ে ফিরিয়ে নিতে চান। তিনি তাঁর মা খাদিজা(রাঃ)এঁর দেওয়া উপহার মুক্তার-হার বাহকের মারফত মুক্তিপণ হিসাবে পাঠান। মুহাম্মদ(সাঃ) যখন সেই হারটি দেখতে পান তখন খাদিজা(রাঃ) কথা মনে পড়ে ব্যকুল হয়ে পড়েন। তিনি তাঁর সাহাবীদেরকে বলেন- তোমরা যদি তাঁর স্বামীকে এবং তাঁর হারকে ফেরত দেওয়া ভাল বিবেচনা কর, তাহলে তা করতে পার। সাহাবীগণ মুহাম্মদ(সাঃ) এর মর্ম বেদনা বুঝতে পেরে তাঁর প্রস্তাবকে মেনে নেন। তিনি জায়নাব(রাঃ) প্রেরিত হারটি বাহকের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন- এইটি জায়নাবকে ফিরিয়ে দিয়ে বলবে, সে যেন এই হারটি নিরাপদে রাখেন।
যেদিন মুহাম্মদ(সাঃ) মক্কা বিজয় করেন, তখন কোরাইশগণ তাঁর চারপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। এমন সময় এক বৃদ্ধ মহিলা আসেন। মুহাম্মদ(সাঃ) তাঁর সাহাবিদের ছেড়ে এই মহিলাকে একপাশে নিয়ে গিয়ে নিজের গায়ের কাপড় মাটিতে বিছিয়ে দিয়ে তাতে সেই মহিলাকে বসিয়ে অনেকক্ষণ কথা বললেন। আয়েশা(রাঃ) তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন- এই মহিলা কে? তিনি জবাব দেন, এই মহিলা খাদিজা(রাঃ)এঁর বান্ধবী। তখন আয়েশা(রাঃ) আবার জিজ্ঞাস করেন- আপনারা কোন বিষয়ে আলাপ করলেন? তিনি বললেন- আমরা খাদিজা(রাঃ) এঁর পুরানো দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করেছি। আয়েশা(রাঃ) তখন জানতে চাইলেন- আপনি এখনও কি সেই বৃদ্ধ মহিলার কথা স্মরণ করে চলছেন যেখানে আল্লাহ আপনাকে তাঁর চেয়ে উত্তম স্ত্রী দান করেছেন? এই কথা শুনে মুহাম্মদ (সাঃ) রাগ করে ফেলেন এবং বলেন- না, আল্লাহর কসম, তিনি আমাকে খাদিজার(রাঃ)এর চেয়ে ভাল কাউকে দান করেন নাই। মানুষ যখন আমাকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছে, তখন সে আমাকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে। সবাই যখন কাফির ছিল তখন সে ছিল মুসলমান। কেউ যখন আমার সাহায্যে এগিয়ে আসেনি, তখন সে আমায় সাহায্য করেছে। তাঁর গর্ভেই আমার সন্তান হয়েছে। (আল্লামা শিবলী নুমানীর সীরাতুন নবী গ্রন্থ ২য় খণ্ড পৃঃ ৮২৮)। আয়েশা(রাঃ) বুঝতে পারলেন যে তিনি আল্লাহ রাসুলকে রাগান্বিত করে ভুল করে ফেলেছেন। তাই তিনি মুহাম্মদ (সাঃ)কে বললেন- আপনি আল্লাহর কাছে আমার ভুল সম্পর্কে ক্ষমা চান! মুহাম্মদ রাজী হোন। তিনি জানান- আপনি আল্লাহর কাজে খাদিজা(রাঃ) এঁর জন্য ক্ষমা চান। শেষে তিনি বলেন- চার জন মহিলা: মারিয়াম বিনত ইমরান, ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া, খাদিজা বিনত খাওয়ালিদ এবং ফাতিমা বিনত মুহাম্মদ ছাড়া কোন মহিলাই পরিপূর্ণতার স্তরে পৌছতে পারবেন না।
যারা মুহাম্মদ (সাঃ) এঁর চরিত্র নিয়ে কটাক্ষ করেন তারা মানুষের জীবনে সব চেয়ে উন্মাতাল সময় এই ২৫ বছরের সত্য ইতিহাসকে ইচ্ছাকৃত ভাবে পাশ কাটিয়ে যান। এদের মধ্যকার মূর্খরা অপপ্রচার করতে গিয়ে বলেন, মুহাম্মদ (সাঃ) নিছক অর্থের লোভে এই মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন। মুহাম্মাদ (সাঃ) যদি অর্থ লোভ থাকত, তবে তিনি সেই সম্পদ আঁকড়ে ধরে থাকতেন, দ্বীন ও জনকল্যাণের কাজে ব্যয় করে নিঃস্ব হতেন না। তাছাড়া কোন যুবকই কোটি টাকার বিনিময়ে তাঁর যৌবনে যুবতি মেয়ের কথা না ভেবে চল্লিশোর্ধ নারীকে বিয়ে করতে রাজী হবেনা। আর মুহাম্মদ (সাঃ) তো শুধু এক মাস বা একবছরের জন্য খাদিজা (রাঃ) বিয়ে করেন নাই। দীর্ঘ ২৫টি বছর তাঁর সাথে ঘর করেছেন। সেই ২৫ বছরে একদিনের জন্য কখনও খাদিজা(রাঃ) উপর বিরক্ত হয়েছিলেন কিংবা তাঁকে বিয়ে করে সমগ্র জীবন নষ্ট হল বলে আক্ষেপ করেছিলেন এমন প্রমাণও কেউ দেখাতে পারবেনা। এমন কি খাদিজা (রাঃ) ওফাতের যে ১৫ বছর মুহাম্মদ(সাঃ) বেঁচে ছিলেন সেই সময় পর্যন্ত কেউ দেখাতে পারবেনা যে তিনি খাদিজা(রাঃ) সম্পর্কে কোন নেতিবাচক কিছু বলেছিলেন। তাছাড়া বিয়ের পর মুহাম্মদ (সাঃ) যে অর্থ বিত্তের মালিক হয়েছিলেন সেই সম্পদ অভাবী গরীব দুঃখী মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছিলেন, দ্বীন-ইসলামের স্বার্থে ব্যয় করেছিলেন। সেই সম্পদকে তিনি ভোগ করে আরাম আয়েশে জীবন কাটিয়েছিলেন সেরূপ কোন ইতিহাস কেউ প্রমাণ করতে পারবেন না। যদি কেউ সম্পদ ভোগই না করেন তাহলে কি ভাবে তিনি অর্থের মোহে এই বিয়ে করতে পারেন? তাই এই বিয়ে কোন অর্থ বা প্রতিপত্তির মোহে নয় এই বিয়ের পিছনে মহান আল্লাহর ইচ্ছা ছিল প্রধান।
মুহাম্মদ (সাঃ) যদি সেই সময়ে কোন অল্প বয়সী মেয়ে বিয়ে করতেন তাহলে কি হত? সেই মহিলা কি মুহাম্মদ (সাঃ)এঁর ধ্যানমগ্নতার সময়ে উদ্ভূত পরিস্থিতির সামাল দিতে পারতেন? নাকি নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে মুহাম্মদ (সাঃ) কে অস্থির করে তুলতেন? অল্প বয়সী স্ত্রীর পক্ষে কি একাকী জবল-ই-নুরের, হীরা নামক গুহায় মুহাম্মদ (সাঃ)এঁর জন্য খাদ্য পানীয় বহন করে নিয়ে যাওয়া নিরাপদ হত? মূলত এসবের পিছনে আল্লাহর পরিকল্পনাই কাজ করেছিল –যা কাফের-মোনাফেক ও অপ-প্রচারকারীরা বুঝার মত নয়।
মুহাম্মদ (সাঃ) যৌবনে একাধিক বিয়ে করতে পারতেন কিন্তু তা না করেই খাদিজা (রাঃ)এঁর সাথেই জীবনের প্রধান অংশ কাটিয়েছেন। কোনও কোনও অপপ্রচারকারী এটাও বলে যে খাদিজা (রাঃ) অর্থ-বিত্ত এবং সামাজিক প্রতিপত্তির কারণে তিনি ইচ্ছা থাকলেও বিয়ে করা সম্ভব ছিলনা। কাজেই বাধ্য হয়েই সেই সময়ে অন্য বিয়ে করতে সক্ষম হন নাই। আমি বলব, ইতিহাস পড়ুন, আর জেনে নিন সেই সময়ে সারা মক্কা জুড়ে ছিল চরম পুরুষবাদী সমাজ। এখানে উচ্চ নিম্ন বংশের মধ্যে কোন তফাৎ ছিলনা। ‘পুরুষেরা ইচ্ছেমত একাধিক বিয়ে করতে কোন সামাজিক বা আইনগত বাধা ছিল না। এর বিপক্ষে চলে যাওয়ার অধিকার নারীদের ছিলনা। কেবল তারা তুচ্ছ সম্পদ হিসাবে ব্যবহৃত হত। যেহেতু নারীদের মাধ্যমে বংশগতি রক্ষা করা হত। তাই নারীরা আইনগত ভাবে সম্পত্তির উত্তরাধিকার হলেও তাতে তারা কোনপ্রকার ক্ষমতা বা প্রতিপত্তির অধিকারী হতে পারতোনা। অনেক সময় শুধু তাদের সম্পত্তি হাতিয়ে নেবার জন্য পুরুষরা তাদের বিয়ে করত।’ (মুহাম্মদ(সাঃ) মহানবীর জীবনী-ক্যারেন আর্মস্ট্রং পৃঃ ৬৮)। মক্কার কুরাইশরা যখন তাঁকে ইসলাম প্রচার না করার স্বার্থে মক্কার সেরা সুন্দরী মেয়েদেরকে বিয়ে দেবার প্রস্তাব করেছিল তখন তিনি তা গ্রহণ করতে পারতেন। সেই ক্ষেত্রে খাদিজা (রাঃ) কোন আপত্তি খাটাতে পারতেন না। তাছাড়া প্রাপ্ত সমুদয় সম্পত্তি স্বামীকে দিয়ে দেওয়া এবং স্বামী কর্তৃক গরীব দুঃখী মানুষদের মধ্য বিলিয়ে দেওয়ার পর তো প্রভাব খাটাবার প্রশ্ন আসতে পারে কি? আসলে অপপ্রচারকারীরা সবদিকে কেবল কুদৃষ্টি নিক্ষেপ করে। ওদের চোখে ভাল কিছু পড়ে না। তাদের ক্ষুদ্র মনের প্রতিফলন সব কিছুতেই পড়ে। সবকিছুতেই তারা কুতর্ক উত্তাপন করে। এরা বিয়ের অন্তর্নিহিত ব্যাপারটি উপলব্ধি করতেও অক্ষম।
পরিশেষে বলব, ইসলামে খাদিজা (রাঃ)এঁর অবদান এবং তাঁর মূল্যায়ন বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। উপরে যে কয়টি ঘটনা বর্ণিত করেছি সেগুলো যদি আমরা খোলা মনে পর্যালোচনা করি তাহলে অবাক বিস্ময়ে অনেক বৃহত্তর মৌলিক বিষয় লক্ষ্য করে থাকব। আরবের সেই অন্ধকার যুগে খাদিজা(রাঃ) আত্মার উৎকর্ষ সাধনে, পরকালে মুক্তির লক্ষ্যে উদ্বুদ্ধ হন, এই পথ নিজের ও সমাজের জন্য উৎকৃষ্ট পথ হিসেবে বিবেচনা করেন, এই পথেই ব্যক্তি, সমাজ ও জাতির পরিত্রাণ নিহিত –এই সত্য উপলব্ধি করেন। শুধু তাই নয়, এই কাজে নিজের জীবন, অর্থ-বিত্ত নিয়োগ করেন। তিনি নিঃসঙ্কোচে মুহাম্মদ (সাঃ) এঁর নবুয়তে বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন। তাঁর মনে বিন্দুমাত্র সংশয় ও সন্দেহ ছিল না। মুহাম্মদ(সাঃ) এর নবুয়ত লাভের পূর্ব থেকে খাদিজা (রাঃ) দৃঢ় প্রত্যয়ী ব্যক্তি-সত্তা ছিলেন। মুহাম্মদের (সাঃ) চরিত্র ও আচরণে তিনি এক মহান উদ্দেশ্য লক্ষ্য করেছিলেন। তাই জিবরাঈল (আঃ) এঁর আগমনের পর ক্ষণিকের জন্যও তাঁর মনে কোন রকম ইতস্তত-ভাব দেখা দেয়নি। এসব যাবতীয় বিষয়ে খাদিজা (রাঃ) এঁর গভীর দূরদৃষ্টি ও তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ-ক্ষমতা স্পষ্ট হয়ে উঠে। নবুয়ত লাভের পূর্বে ও পরে সর্বদাই তিনি মুহাম্মদ(সাঃ) কে সম্মান করেছেন, তাঁর প্রতিটি কথা বিশ্বাস করেছেন। পঁচিশ বছরের দাম্পত্য জীবনে তিনি অনড় ব্যক্তিও ছিলেন। সেই জাহিলি যুগেও তিনি ছিলেন পুতঃ পবিত্র। তিনি কখনো মূর্তি পূজা তো করেননি এমন কি তাদের প্রসঙ্গ উত্থাপন করতেন না ।
খাদিজা (রাঃ) নবুয়তে মুহাম্মদী (সাঃ)এর উপর প্রথম বিশ্বাস স্থাপনকারী এবং তাঁর সাথে প্রথম সালাত আদায়কারী। শুধু তাই নয় তিনি ইসলামের সূচনা লগ্নে ছিলেন মুহাম্মদ (সাঃ) এর পরামর্শদাত্রী। ইসলামের ঘোর দুর্দিনে তিনি শক্তি যুগিয়েছেন। তার স্মৃতি শুধু ইসলামের ইতিহাসে নয় মানব সভ্যতার ইতিহাসে চিরদিন অমর, অম্লান হয়ে থাকবে।