ঈদুল আজহার গুরুত্ব অপরিসীম। কুরআন-হাদিসে এ ব্যাপারে যথেষ্ট তাকিদ দেয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,
১. ‘আর কোরবানির পশুসমূহকে আমরা তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্তর্ভুক্ত করেছি। এর মধ্যে তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে।’ (সূরা হজ : ৩৬)
২. ‘আর আমরা তাঁর (ইসমাইলের) পরিবর্তে জবেহ করার জন্য দিলাম একটি মহান কোরবানি। এবং পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে চিরকালের জন্য তার প্রশংসা রেখে দিলাম।’ (সূরা আস সাফফাত : ১০৭-১০৮)
৩. ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশে সালাত আদায় কর এবং কোরবানি কর।’ (সূরা কাওসার : ২)
৪. রাসূল (সা) ইরশাদ করেছেন, ‘কোরবানির দিনে মানবসন্তানের কোনো নেক আমলই আল্লাহ তায়ালার নিকট এত প্রিয় নয়, যত প্রিয় কোরবানি করা। কোরবানির পশুর শিং, পশম ও ক্ষুর কিয়ামতের দিন (মানুষের নেক আমলনামায়) এনে দেয়া হবে। কোরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যায়। সুতরাং তোমরা আনন্দচিত্তে কোরবানি করো।’ (তিরমিজি)
৫. রাসূল (সা) আরো বলেছেন, ‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কোরবানি করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়।’ (ইবনে মাজাহ)
কাজেই কোরবানি ইসলামের একটি ‘মহান নিদর্শন’ যা ‘সুন্নাতে ইবরাহিম’ হিসেবে রাসূলুল্লাহ (সা) নিজে মদিনায় প্রতি বছর আদায় করেছেন এবং সাহাবীগণও নিয়মিতভাবে কোরবানি করেছেন। অতঃপর অবিরত ধারায় মুসলিম উম্মাহর সামর্থ্যবানদের মধ্যে এটি চালু আছে। এটি কুরআন ও সুন্নাহ এবং ইজমায়ে উম্মত দ্বারা সুপ্রমাণিত। কোরবানি ও জীবনদানের প্রেরণা ও চেতনা সমগ্র জীবনে জাগ্রত রাখার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নবী (সা)কে আরো নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘বলো, আমার নামাজ, আমার ইবাদতের সমস্ত অনুষ্ঠান, আমার জীবন ও মৃত্যু সবকিছু আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য, যার কোন শরিক নেই। এরই নির্দেশ আমাকে দেয়া হয়েছে এবং সবার আগে আমিই আনুগত্যের শির নতকারী।’ (আল আন’আম : ১৬২-১৬৩)
ঈদুল আজহার প্রকৃত তাৎপর্য
১. ঈদুল আজহা হযরত ইবরাহিম (আ), বিবি হাজেরা ও ইসমাইলের পরম ত্যাগের স্মৃতিবিজড়িত উৎসব। ত্যাগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার কারণেই ইবরাহিম (আ)কে পবিত্র কুরআনে মুসলিম জাতির পিতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে- ‘তোমাদের পিতা ইবরাহিমের মিল্লাতের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাও।’ (সূরা হজ : ৭৮) এ পরিবারটি বিশ্ব মুসলিমের জন্য ত্যাগের মহত্তম আদর্শ। তাই ঈদুল আজহার দিন সমগ্র মুসলিম জাতি ইবরাহিমি সুন্নাত পালনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রাণপণ চেষ্টা করে।
২. কোরবানি হলো চিত্তশুদ্ধির এবং পবিত্রতার মাধ্যম। এটি সামাজিক রীতি হলেও আল্লাহর জন্যই এ রীতি প্রবর্তিত হয়েছে। তিনিই একমাত্র বিধাতা প্রতি মুহূর্তেই যার করুণা লাভের জন্য মানুষ প্রত্যাশী। আমাদের বিত্ত, সংসার এবং সমাজ তাঁর উদ্দেশেই নিবেদিত এবং কোরবানি হচ্ছে সেই নিবেদনের একটি প্রতীক।
৩. কোরবানির মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর জন্য তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস ত্যাগ করতে রাজি আছে কিনা সেটিই পরীক্ষার বিষয়। কোরবানি আমাদেরকে সেই পরীক্ষার কথাই বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়। ইবরাহিম (আ)-এর কাছে আল্লাহর পরীক্ষাও ছিল তাই। আমাদেরকে এখন আর পুত্র কোরবানি দেয়ার মতো কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয় না। একটি ‘মুসান্নাহ’ হালাল পশু কোরবানি করেই আমরা সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারি। ঈমানের এসব কঠিন পরীক্ষায় যারা যত বেশি নম্বর অর্জন করতে পারেন তারাই হন তত বড় খোদাপ্রেমিক ও ততই সফল মানুষ এবং আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে ততই সফল। ঈদের প্রকৃত আধ্যাত্মিক আনন্দ তারা ঠিক ততটাই উপভোগ করতে পারেন যতটা তারা এ জাতীয় পরীক্ষায় সফল হন।
৪. কোরবানির পশুর রক্ত মাটি স্পর্শ করার আগেই আল্লাহর কাছে তার সওয়াব গ্রাহ্য হয়ে যায়। আল্লাহর কাছে কোরবানির সওয়াব গ্রাহ্য হওয়ার তাৎপর্য হচ্ছে, যে অকুণ্ঠ ঈমান আর ত্যাগের মহিমায় উদ্দীপ্ত হয়ে ইবরাহিম (আ) স্বীয় প্রাণাধিক পুত্রের স্কন্ধে ছুরি উত্তোলিত করেছিলেন, কোরবানির পশুর গলায় ছুরি দেয়ার সময়ে কোরবানিদাতার হৃদয়তন্ত্রী সেই ঈমান ও ত্যাগের সুরে অনুরণিত হতে হবে। কোরবানিদাতার হৃদয়তন্ত্রী যদি সেই ঈমান ও ত্যাগের সুরে অনুরণিত না হয়ে ওঠে, তাদের দেহ আর মনের পরতে পরতে যদি আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের আকুল আগ্রহ উদ্বেলিত না হয়, তাহলে তাদের এই কোরবানির উৎসব গোশতখুরির পর্বেই পর্যবসিত হবে। আল্লাহ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় কোরবানিদাতাদের সাবধান করে দিয়েছেন, ‘কোরবানির পশুর গোশতও আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, তাদের রক্তও না। কিন্তু তাঁর কাছে পৌঁছে যায় তোমাদের তাকওয়া।(সূরা হজ : ৩৭)
৫. কোরবানি কেবল পশু কোরবানি নয়। নিজের পশুত্ব, নিজের ক্ষুদ্রতা, নীচতা, স্বার্থপরতা, হীনতা, দীনতা, আমিত্ব ও অহঙ্কার ত্যাগের কোরবানি। নিজের নামাজ, কোরবানি, জীবন-মরণ ও বিষয়-আশয় সব কিছুই কেবল আল্লাহর নামে, শুধু তাঁরই সন্তুষ্টির জন্য চূড়ান্তভাবে নিয়োগ ও ত্যাগের মানস এবং বাস্তবে সেসব আমল করাই হচ্ছে প্রকৃত কোরবানি। এই কোরবানি পশু জবেহ থেকে শুরু করে নিজের পশুত্ব জবেহ বা বিসর্জন এবং আল্লাহর পথে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালানোর মাধ্যমে তার রাস্তায় শাহাদতবরণ পর্যন্ত সম্প্রসারিত। এই কোরবানি মানুষের আকাক্সক্ষা, নিয়ত, প্রস্তুতি ও গভীরতম প্রতিশ্রুতি থেকে শুরু করে তার চূড়ান্ত বাস্তবায়ন পর্যন্ত সম্প্রসারিত।
৬. মূলত কোরবানি হচ্ছে একটি প্রতীকী ব্যাপার। আল্লাহর জন্য বান্দার আত্মত্যাগের একটি দৃষ্টান্ত মাত্র। কোরবানি থেকে শিক্ষা নিয়ে সারা বছরই আল্লাহর নৈকট্য লাভের প্রত্যাশায় নিজ সম্পদ অন্য মানুষের কল্যাণে ত্যাগের মনোভাব গড়ে উঠলে বুঝতে হবে কোরবানি সার্থক হয়েছে, কোরবানির ঈদ সার্থক হয়েছে। নতুবা এটি নামমাত্র একটি ভোগবাদী অনুষ্ঠানই থেকে যাবে চিরকাল। এ জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আল কুরআনে বারবার ত্যাগের নির্দেশ দিয়েছেন। কোরবানির গোশত আল্লাহর কাছে যায় না। যতটুকু যায় বা রেকর্ড হয়ে থাকে তা হলো আমাদের মনে আল্লাহপ্রেমের গভীরতার মাত্রা। কোরবানির গোশত দরিদ্রদের জন্য যতটুকু বিলিয়ে দেয়া হয় কেবল সেটাই পরকালে আমাদের পাথেয় হয়ে থাকবে। আর যেটাকে আমরা আমাদের অংশ মনে করে কৃপণের ধনের মতো আঁকড়ে আছি সেটাই বরং আমাদের কাছ থেকে হাতছাড়া হয়ে আছে যা আমরা জানি না। আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! যে অর্থ তোমরা উপার্জন করেছো এবং যা কিছু আমি জমি থেকে তোমাদের জন্য বের করে দিয়েছি, তা থেকে উৎকৃষ্ট অংশ আল্লাহর পথে ব্যয় করো।’ (সূরা আল বাকারাহ : ২৬৭) কাজেই আমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ মানবতার সেবায় ব্যয় করতে হবে। দরিদ্র মানুষের সহযোগিতায় সরকারের পাশাপাশি সকল বিত্তশালী লোককে এগিয়ে আসতে হবে। সারা বছর, সারা জীবন সাধ্যমত আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের কথা বিবেচনা করে মানুষকে সাহায্য করতে হবে। চিত্ত আর বিত্তের মিল ঘটানোর জন্যই আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বারবার মানুষকে আহ্বান করেছেন।
৭. কোরবানি কোনো লোক দেখানো বা গোশত খাওয়ার উৎসব নয়। কোরবানিতে যদি আল্লাহভীতি ও মনের একাগ্রতা না থাকে তাহলে এই সুবর্ণ সুযোগ বিফল মনোরথ ছাড়া আর কিছুই হবে না। আমাদের সমাজে আজ অনেককে বড় বড় পশু ক্রয় করে প্রদর্শন করা কিংবা বাহাদুরি জাহির করতে দেখা যায়। আবার অনেককে দেখা যায় গরিব-মিসকিনদের যথাযথভাবে না দিয়ে ঈদের দিন নিজেরা যৎসামান্য গোশত রান্না করে; আর বাকিটা ফ্রিজে রেখে দেয়। এরপর সারা বছর কিছু কিছু নিয়ে নিজেরা খায়। এসব কোনো মতেই প্রকৃত কোরবানির পর্যায়ে পড়ে না। লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে বড় বড় গরু ক্রয় করে প্রদর্শন করা, বাহাদুরি জাহির করা অথবা গোশত খাওয়ার নিয়তে কোরবানি করলে কোরবানি কবুল হবে না। তা কেবলমাত্র পশু জবাইয়ের আনুষ্ঠানিকতা হিসেবেই বিবেচিত হবে। এসব পশুর রক্ত আর গোশত যেমন আল্লাহর নিকট যায় না তেমনি গ্রহণযোগ্যতা পায় না এগুলোর কোরবানিও। হালাল উপার্জন, ইখলাস ও একনিষ্ঠতাই হলো কোরবানি কবুল হওয়ার আবশ্যকীয় শর্ত। কে কত টাকা দিয়ে পশু ক্রয় করল, কার পশুটি কত মোটাতাজা বা সুন্দর, আল্লাহ তা দেখেন না। তিনি দেখেন সহিহ নিয়ত ও তাকওয়া। মূলত আল্লাহর রাহে জীবন উৎসর্গ করার জজবা সৃষ্টি করা, ইবরাহিম (আ)-এর পুত্র কোরবানির ন্যায় ত্যাগ-পূত আদর্শকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ করা ও তাঁর বড়ত্ব প্রকাশ করাই ঈদুল আজহার প্রকৃত তাৎপর্য।
ঈদুল আজহার শিক্ষা
মানুষ মহান আল্লাহর জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করবে, এই শিক্ষাই ইবরাহিম (আ) আমাদের জন্য রেখে গেছেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা) আমাদের জন্য ঐ ত্যাগের আনুষ্ঠানিক অনুসরণকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন। ঈদুল আজহার মূল শিক্ষা হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্য প্রকাশ করা। সকল দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে এক আল্লাহর দিকে রুজু হওয়া। সম্পদের মোহ, ভোগ-বিলাসের আকর্ষণ, সন্তানের স্নেহ, স্ত্রীর মুহাববত- সবকিছুর ঊর্ধ্বে ওঠে আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রতি আত্মসমর্পিত হয়ে যাওয়া। স্বামী, স্ত্রী ও শিশু-পুত্রের গভীর আত্মবিশ্বাস, অতলান্তিক ঈমানী প্রেরণা, আল্লাহর প্রতি নিশ্চিন্ত নির্ভরতা ও অবশেষে আল্লাহকে খুশি করার জন্য তাঁর হুকুম মোতাবেক জীবনের সর্বাধিক প্রিয় একমাত্র সন্তানকে নিজ হাতে জবেহ করার কঠিনতম পরীক্ষায় উত্তরণ-এসবই ছিল আল্লাহর প্রতি অটুট আনুগত্য, গভীর আল্লাহভীতি এবং নিজের তাওহিদ ও তাকওয়ার সর্বোচ্চ পরাকাষ্ঠা। ইবরাহিম (আ) আল্লাহর হুকুমে পুত্র কোরবানি করার মধ্য দিয়ে মূলত পুত্রের মুহাব্বতকে কোরবানি করেছিলেন। আল্লাহর ভালোবাসার চাইতে যে পুত্রের ভালোবাসা বড় নয়, এটিই প্রমাণিত হয়েছে তাঁর আচরণে। ইবরাহিম (আ)-এর নিকট থেকে আল্লাহ এটাই চেয়েছিলেন। আর এটাই হলো প্রকৃত তাকওয়া বা আল্লাহভীতি। ইবরাহিম (আ) তাঁর প্রিয়পুত্র ইসমাইল (আ)কে কোরবানি করে এক বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, যাতে অনাগত ভবিষ্যতের অগণিত মানুষ আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণের বাস্তব শিক্ষা লাভ করতে পারে। আর ইসমাইল নবীন বয়সেই বিশ্ববাসীকে আত্মসমর্পণের এক বাস্তব ও জ্বলন্ত শিক্ষা প্রদান করে গেছেন। মূলত আল্লাহর রাহে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দেয়ার নামই হলো আত্মসমর্পণ। পিতা-পুত্র আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণের যে অনুপম আদর্শ স্থাপন করে গেছেন, আজকে ইবরাহিমি আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পশু কোরবানির সাথে সাথে আমাদের দৃপ্ত শপথ নিতে হবে যে, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে জান, মালসহ যেকোন ত্যাগ স্বীকার করতে আমরা প্রস্তুত আছি। আর এটিই হলো কোরবানির শিক্ষা।
হযরত ইবরাহিম (আ) সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করেছিলেন, হয়েছিলেন স্বয়ং আল্লাহঘোষিত মানবজাতির ইমাম। তিনি মানবজাতির আদর্শ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা যারা আল্লাহ ও পরকালের ভয় কর তোমাদের জন্য ইবরাহিম ও তাঁর সাথীদের মধ্যে একটি উত্তম আদর্শ বিদ্যমান।’ (সূরা মুমতাহিনা : ৪)