প্রয়াত
শব্দটি ব্যাকরণে বিশেষ্য। এর অর্থ হলো প্রস্থান, গমন। বিশেষণে প্রয়াত। এর অর্থ হলো, চলে গিয়েছে পরলোকগত হয়েছে এমন। প্রয়াত আর প্রয়াণ একই অর্থবোধক শব্দ প্রয়াণ সংস্কৃত শব্দ, প্রয়াতও তাই। উভয় শব্দের অর্থ হচ্ছে মৃত্যু। প্রাণী মাত্রই মরণশীল। জন্ম আর মৃত্যু দুনিয়ার জীবনের শুরু ও শেষ অবস্থার নাম। এ ক্ষেত্রে বিশেষ লক্ষণীয় দিকটি হচ্ছে এই, প্রয়াত আর প্রয়াণ অর্থ মৃত্যু হলেও কোন পশু-পাখির মৃত্যু বুঝাতে গেলে আমরা প্রীত বা প্রয়াণ শব্দ ব্যবহার করিনা। বলি পশুটির মৃত্যু হয়েছে বা মারা গিয়েছে।
প্রয়াত বা প্রয়াণ শব্দ দুটি যে ধর্মের বা সংস্কৃতির শব্দ, সেই ধর্মের ধর্মালম্বী বা সেই সংস্কৃতির অনুসারীরা তাদের মৃতদের নামের আগে প্রয়াত বা প্রয়াণ সঙ্গত কারণেই ব্যবহার করতে পারেন। কারণ, মৃত ব্যক্তির নাম উচ্চারণের সাথে তার জন্য দোয়ার বাক্যও উচ্চারণের কোন রেওয়াজ নেই সে ধর্মে। কিন্তু মুসলমানদের তথা ইসলামে সে ব্যবস্থা আছে এবং ক্ষেত্র বিশেষে এ উচ্চারণ মুসলমানদের জন্য বাধ্যতা মূলক। যেমন ধরুন, আমরা যখন হযরত আবু বকর সিদ্দিকের নাম উচ্চারণ করি, সাথে সাথে অর্থাৎ কোন বিরতি না দিয়ে, ‘রাদি আল্লাহ আনহু’ উচ্চারণ করি এবং এ উচ্চারণের মাধ্যমে তাঁর জন্য দোয়া করি। কারো নামের পরে রাহমাতুল্লাহি আলাই বা রাদিয়াল্লাহ আনহু ও বলি। সম্মানিত মুসলমানদের নামের পূর্বে বা পরে যোগ করার জন্য কয়েকটি শব্দই রয়েছে, যা গভীর অর্থবোধক এবং পবিত্র লক্ষ্য ভিত্তিক। এ জন্যে অন্য ধর্মের সংস্কৃতির অভিধান থেকে মুসলমানদের শব্দ হাওলাত করার কোন প্রয়োজন নাই। মুসলমানদের জন্য রয়েছে দু’টি মূল্যবান ও গভীর অর্থবোধক শব্দ। দুনিয়ার যে কোন ভাষাবাভাষী মুসলমান শব্দ দু’টি নিজস্ব শব্দ হিসেবে ব্যবহার করেন। এই দু’টি শব্দের একটি হলো ‘মরহুম’ আর একটি হচ্ছে ‘ইন্তেকাল’। দু’টি শব্দই আরবী ভাষার শব্দ, যা ইসলামী পরিভাষার অন্তরর্ভুক্ত।
‘মরহুম’ শব্দটি ব্যাকারণ বিধি অনুযায়ী বিশেষণ। ‘মরহুম’ শব্দের অর্থ হলো, যিনি আল্লাহর রহমত প্রাপ্তহন (অ জবপবঢ়বহঃ ড়ভ ধষষধ’ং সবৎপু) ইন্তেকাল অর্থ মৃত্যু হলেও মুসলমানদের মৃত্যু একান্তভাবে ইন্তেকাল। ইন্তেকালের অর্থ হলো, জবসড়াধষ, ঞৎধহভবৎ ইত্যাদি। অর্থাৎ আসল ঠিকানাই যাত্রা বা প্রত্যাবর্তন। এজন্য এক জন মুসলমানের ইন্তেকালের সংবাদ অন্য মুসলমানের নিকট পৌঁছার সাথে সাথে অন্যান্য জিজ্ঞাসার আগে পড়তে হয় ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন’। এর অর্থ হচ্ছে ‘বস্তুত আমরা আল্লাহর, তার দিকে আমাদের প্রত্যাবর্তন’। মানুষকে আল্লাহ দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন তার খলীফা বা প্রতিনিধি হিসেবে। প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরণের উদ্দেশ্য মাত্র একটি আর তা হচ্ছে, আল্লাহর বান্দা হিসেবে আল্লাহর ইবাদাত-দাসত্ব বা গোলামী করা। এই ইবাদাত করার জন্যও আল্লাহ একটা নির্দিষ্ট জীবন দিয়েছেন। এ জীবন শেষ হলে আল্লাহ তার বান্দাহ কে তার কাছে নিয়ে যান। বান্দা তার প্রভূর প্রতিনিধি হিসেবে দুনিয়াতে এসে কি কি দায়িত্ব কিভাবে পালন করলো, সে হিসাব তিনি নেন। যেখান থেকে বান্দাহর আগমন সেখানে তার প্রত্যাবর্তন, দুনিয়ার ঠিকানা অস্থায়ী, ইন্তেকালের পরের ঠিকানা স্থায়ী। কোন বান্দাহ জানেন না কত দিন তিনি প্রতিনিধি হিসেবে এই দুনিয়াতে থাকতে পারবেন। এ জন্য সচেতন বান্দা সদা সতর্ক ও সচেতন থাকেন, কখন তার ডাক আসে আসাল ঠিকানায় প্রত্যাবর্তনের। এরই নাম ‘ইন্তেকাল’। প্রয়াত বা প্রয়ানণ মুসলমানদের ব্যবহার উপযোগী শব্দ নয়। ইন্তেকাল শব্দের বিকল্প কোন শব্দ নাই।
যে সব মুসলমান প্রয়াত প্রয়াণ শব্দ ব্যবহার করে ইন্তেকাল শব্দকে আউট করতে চাচ্ছেন, তারা আত্বঘাতী মূর্খতার পরিচয় দিচ্ছেন। যদি তারা অজ্ঞতাবশত অথবা বেখেয়ালে প্রয়াত শব্দ ব্যবহার করেন, তাহলে তাদের জন্য আল্লাহপাকের কাছে দোয়া করি, তাদের মধ্যে আল্লাহপাক যেন শুভবুদ্ধি জাগ্রত করেন, কোনটা নিজের আর কোনটা অপরের, এই বাদ বিচার করার বুদ্ধি যেন মহান আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন তাদের দেন।
“যে সব মুসলমান জেনে বুঝে মরহুম আর ইন্তেকালের (শব্দের) বিরুদ্ধে লড়াই করতে নেমেছেন, তারা নিশ্চিত জেনে রাখুন, তাদের মৃত্যু প্রয়াত আর প্রয়াণের অন্তর্ভুক্ত হবেই। তারা কখনো মরহুম হবেন না। ইন্তেকালের ফায়দাও পাবেন না। তাদের মৃত্যু সংবাদ শুনে কেউ ইন্না লিল্লাহও পড়বে না। অতীতের মুসলিম নামের অনেকের মৃত্যু হয়েছে, তাদের মৃত্যু সংবাদ শুনে কেউ ইন্নালিল্লাহও পড়েনি”।
নিজেদের সংস্কৃতি কুষ্টি ও ঐতিহ্যের শব্দ ভান্ডারে মরহুম আর ইন্তেকালের মতো অফুরন্ত মর্যাদা ও বরকত ময়শব্দ থাকতে কেন যে তারা অপরের দ্বারে গিয়ে ভিক্ষা করে শব্দ আনেন আর নিজেদের ভিত্তিকে প্রকারান্তরে দূর্বল করেন, তা আমার বুঝে আসেনা। অর্থ ভিক্ষা যে চায়, সেই শুধু ভিক্ষুক নয়, অপরের সভ্যতা-সংস্কৃতি আর কৃষ্টি যারা ভিক্ষা করে, তারাও ভিক্ষুক বরং এমন ভিক্ষুক আসল ভিক্ষুকের চেয়ে অধিকতর নিলর্জ্জ ও ব্যক্তিত্বহীন।
নিজে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, লেখক ও সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রি মরহুম আতাউর রহমান ইন্তকালের কিছু দিন আগে এক সূধী সমাবেশে অত্যন্ত আবেগময় প্রসঙ্গত বলে ছিলেন, ‘আমি ইন্তেকাল করার পর আমাকে কেউ প্রয়াত করবেন না, প্রয়াণে পাঠাবেন না। আমি ইন্তেকালের পর প্রয়াত হতে চাইনা, মরহুম থাকতে চাই। আমার ইন্তেকালের পর কেউ আমার নামের আগে কেউ প্রয়াত যুক্ত করবেন না’।
মরহুম খানের এই দোয়াই হোক আমাদের সকলের কামনা।
বিছমিল্লায় গলদ: শব্দটি সূচনাতেই ভুলবা ত্রুটি অর্থে শব্দটি ব্যবহৃত হয়। এই শব্দ মুসলিম লেখক বা বক্তাগণ ব্যবহার করেন, তারা শব্দটির অর্থ-ভাবার্থ এ
বং ঈমান আকিদার দিকটি চিন্তা করে ব্যবহার করেন কিনা তা জানিনা। চিন্তা-ভাবনা করে ব্যবহার করলে নিশ্চয় কোন মুসলমান এর ব্যবহার করতে পারতেন না। ভুল করে বা বেখেয়ালে যারা ব্যবহার করেন, আল্লাহ তাদরে মাফ করে দিতে পারেন। কিন্তু যারা জেনে বুঝে ব্যবহার করেন, তারা কবীরা গুনাহ করেন। ঈমানের বিরুদ্ধে তা ব্যবহার করেন। তারা জানেন কিনা যে, এই শব্দটির আবিস্কারক মুসলিম বিদ্ধেষী লেখক, তারা বিছমিল্লায় গলদ বলে বিছমিলল্লাহ ভিত্তিক ইসলামের যাবতীয় কর্মকান্ডকে গলদ প্রমান করতে চান। তারা তাদের চিন্তানুযায়ী হীনমন্যতার পরিচয় দিতে পারেন। কিন্তু মুসলমান লেখকরা কিভাবে তাদের অনুসরণ করে নিজেদের ঈমানের গলায় ছুরি চালাতে পারেন, তা আমার বুঝে আসেনা।
ইসলামে বিছমিল্লাহর গুরুত্ব কতো গভীর অর্থবহ, ব্যাপক, বরকতময়, তা প্রত্যেক মুমিন-মুসলমানই জানেন। কালামে পাকে একটি মাত্র সূরা-সূরা নং ৯ আত্তাওবা ছাড়া প্রত্যেক সূরার শুরুতে বিছমিলল্লাহ ব্যবহার স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন করেছেন। আল্লাহর রাসুল (সা.) তাঁর পবিত্র জিন্দেগীতে যতো কাজ করেছেন, সব কাজের শুরু বিছমিলল্লাহ দিয়ে করেছেন। আল্লাহর রাসূল (সা:) কে অনুসরণ করেছেন সকল সাহাবী (রা:) এবং সাধারণ মুসলমানগণ। এই সিলসিলা এখনো জারি আছে, জারি থাকবে রোজ কিয়ামত পর্যন্ত। বিছমিল্লাহ বলে কাজ শুরু করলে আল্লাহ বরকত দেন কাজে। কাজের জটিলতা দূর করে সহজভাবে সম্পন্ন করার সহায়তা দেন আল্লাহপাক। এই বরকতময় বিছমিল্লাহতে কেমন করে গলদ থাকতে পারে, তা বোগম্য নয়। আরম্ভে ভুল-ত্রুটি অর্থে যারা বিছমিল্লাহকে গলদের বাহন বানিয়েছেন, তাদের মতলব ছিল খারাপ। মুসলমানদের মধ্যে যারা এ শব্দ ব্যবহার করেন, তারা কি চিন্তা করে দেখেছেন যে, বিছমিল্লায় যদি গলদ থাকে, তাহলে ‘শুদ্ধ’ আর কোথায় পাওয়া যাবে? বিছমিল্লাহ আল-কুরআনের একটি পবিত্রতম শব্দ। যারা কথায় বা লেখায় ‘বিছমিল্লায়গলদ’ শব্দ ব্যবহার করেন, তারা কি সরাসরি কুরআনকেই ‘গলদ’ বলছেন না? ‘মিছমিল্লাহতে গলদ’ এ শব্দ লেখার সময় মুসলিম লেখকের তো হাত কাঁপার কথা। গোড়ায় গলদ, সূচনায় গলদ, মূলে গলদ, শুরুতেই ভুল-এসব শব্দ দ্বারা সুন্দরভাবে ভাব প্রকাশ করা যায়। আমরা এ ভুল যেন না করি।