জীবনে একবার হজ্জ করা ফরজ আর তাও সচ্ছল সুস্থ ব্যক্তির জন্য। এ কারণে হজ্জের নিয়ম ও মাসয়ালাগুলোকে জটিল মনে হয়। একজন সাধারণ মুসল্লির কাছে সূরা ‘কাফিরুন’কে সূরা ফাতিহার চেয়ে কঠিন মনে হয় এ কারণে যে, সূরা কাফিরুন সব নামাজে পড়তে হয় না বা পড়াও হয় না। আবার নামাজের মাসয়ালা বেশ কঠিন ও বিস্তৃত হওয়ার পরেও অব্যাহত প্রচেষ্টা ও দিনে পাঁচবার অনুশীলনের কারণে মাদরাসায় শিক্ষিত নয় এমন একজন স্বল্পশিক্ষিত সাধারণ নামাজিরও তা আয়ত্তে এসে যায়। কিন্তু হজ্জের বিষয়টি ভিন্ন। যে স্বল্পসংখ্যক লোকের ওপর হজ্জ ফরজ হয়, তাদের অনেকেই সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত এবং বয়সের শেষভাগে হজ্জের প্রাক্কালে এ চিন্তাভাবনা ও অনুশীলন শুরু করেন। তা ছাড়া তারা যে বইগুলো পড়েন এবং যাদের সাহায্য নেন সেখানে তারা ব্যাপক আলোচনা ও বিবিধ নতুন আরবি পরিভাষার সম্মুখীন হন। ব্যাংকে টাকা দাখিল করতে গেলে, হাজী ক্যাম্পে গেলে, ইমিগ্রেশনের কাজে গেলে সব জায়গা থেকে দেশী-বিদেশী লেখকদের গাদা গাদা বই হজ্জ গমনেচ্ছুদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়। বইগুলোতে এবং প্রশিক্ষণ আলোচনায় ইফরাদ, কিরান, তামাত্তু, ইস্তেবা, আকাফি, রমল, জেনায়েত, তাত্তয়াফে কুদুম, ইজাফা, হাদি ইত্যাদি পরিভাষা হাজী সাহেবদের মনে হজ্জ বিষয়ে জটিলতার এমন এক আবহ সৃষ্টি করে যে, তাদের অন্তরে একটি ভীতি সৃষ্টি হয়ে যায়। অথচ বিষয়গুলো খুব সহজ্জ। মাতৃভাষায় বিষয়গুলো বুঝিয়ে দিলে একজন স্বল্পশিক্ষিত সাধারণ মুসলমান অন্যের সাহায্য ছাড়াই হজ্জ সম্পাদন করতে পারবে।
হজ্জের ফরজ ওয়াজিব সুন্নাত মুস্তাহাব সব একত্র করে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যে, শেষ পর্যন্ত উচ্চপদস্থ অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাও হুজুরের কাছে এসে বলেন, ‘হুজুর, সাথে নিয়ে আমাকে কাজগুলো সম্পাদন করিয়ে দেবেন’। অনেকে আবার কোথায় কোন দোয়া পড়তে হবে তা নিয়ে পেরেশান হয়ে যান এবং মুখস্থ করা শুরু করেন। অথচ এ দোয়ার বেশির ভাগই মুস্তাহাব। মুখস্থ না হলে কোনো গোনাহ নেই। অথচ একটি ফরজ বাদ পড়লে হজ্জ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যাবে, একটি ওয়াজিব বাদ পড়লে একটি ক্ষতিপূরণমূলক কোরবানি (দম) দিতে হবে।
অনেক হাজী সাহেবকে জিজ্ঞাসা করে দেখেছি তারা এগুলো বলতে পারেন না অথচ রুকনে ইয়ামানিতে কী দোয়া পড়তে হবে, সাফা-মারওয়া পাহাড়ে কী পড়তে হবে তা মুখস্থ করেছেন এবং সব সময় চর্চা করছেন। অথচ ওই দোয়া পড়তে না পারলে হজের মৌলিক কোনো ত্রুটি হবে না কিন্তু একটি ফরজ বাদ পড়লে বা কোনো কারণে বাদ পড়া ওয়াজিবের ক্ষতিপূরণ আদায় না করলে হজ্জ নষ্ট হয়ে যাবে, হাজার মাইল সফরের কষ্ট পণ্ডশ্রম হবে, পুরো হজ্জ সম্পাদনের খরচ পানিতে যাবে, জীবনের একটি ফরজ অসমাপ্ত থেকে যাবে। কাজেই এত বড় ক্ষতি না চাইলে অন্যের ওপর ভরসা বাদ দিয়ে সংক্ষিপ্ত অথচ স্বচ্ছ জ্ঞানের বর্ম পরিধান করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞ আলেমদের জ্ঞান ও সহযোগিতা আপনার অর্জিত জ্ঞানকে আরো শানিত করবে। কোনোক্রমেই অন্ধের পথ চলার মতো চলা যাবে না। এ জন্য পবিত্র হজে গমেনেচ্ছুদের খেদমতে কয়েকটি কথা বিনীতভাবে উপস্থাপন করতে চাই।
এক. হজ্জবিষয়ক একটি প্রামাণ্য বই আপনি ঞঊঢঞ ইঙঙক হিসেবে গ্রহণ করুন। প্রথমেই একাধিক বই পড়লে কিছুটা সমস্যা দেখা দিতে পারে। দুই. সহজে বহনযোগ্য একটি ডায়েরি বা নোটখাতায় হজের ফরজ-ওয়াজিবগুলো নোট করুন। তিন. মক্কায় পৌঁছার পর প্রথমেই আপনাকে কী করতে হবে নোট করুন। চার. হজ্জ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত (৮ জিলহজ্জ-১২ জিলহজ্জ) পাঁচ. দিনের কাজগুলোকে ধারাবাহিকভাবে জানুন এবং সংক্ষেপে নোট করুন। পাঁচ. হজ্জ থেকে বিদায়ের (মক্কা থেকে বিদায়) সময়ের করণীয় কাজগুলো জানুন এবং নোট করুন।
উপরিউক্ত পাঁচটি বিষয়ে অধ্যয়ন ও সংক্ষিপ্ত নোট করার পর আপনি হজ্জ সংক্রান্ত আরো দু-চারটি বই পড়–ন এবং আগে হজ্জ করেছেন এমন আলেম বা বিজ্ঞ হাজীর সাথে অর্জিত জ্ঞানের বিষয়ে মতবিনিময় করুন। এতে আপনার জ্ঞান আরো বাড়বে এবং আপনার আত্মবিশ্বাসও বেড়ে যাবে। শুধু তা-ই নয়, আপনি আপনার বস্তুনিষ্ঠ স্বচ্ছ জ্ঞানের মাধ্যমে অন্যকেও উপকার করে অশেষ সওয়াবের অধিকারী হতে পারবেন। কিন্তু নিজের মধ্যে জ্ঞান না থাকলে অন্যের ওপর ভরসা করে রওয়ানা হলে যেকোনো ভুল বা সমস্যার জন্য আপনাকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
হজ্জের ফরজ ৪টি
এক. হজের নিয়ত করে হজের পোশাক (সেলাইবিহীন দুই প্রস্থ সাদা কাপড় পুরুষদের জন্য) পরিধান করা ও তালবিয়া (লাব্বাইকা … লা শারিকালাক) একবার পড়া। এটাকে ইহরাম বলে। দুই. ৯ জিলহজ্জ আরাফায় অবস্থান করা (কিছু সময়ের জন্য হলেও)। যদি কোনো কারণে হাজী ৯ জিলহজের দিনে অথবা রাতে আরাফাতে পৌঁছতে না পারেন, তাহলে তার হজ্জ হবে না। তিন. জিয়ারতের তাওয়াফ বা ফরজ তাওয়াফের প্রথম চার চক্কর ফরজ, বাকি তিন চক্কর ওয়াজিব। এ তওয়াফ ১০ জিলহজ্জ করতে হয়। ১১-১২ তারিখেও এ তাওয়াফ করলে ফরজ আদায় হয়ে যাবে। চার. এ ফরজগুলো নির্দিষ্ট স্থানে, নির্দিষ্ট সময়ে এবং নির্ধারিত ক্রমানুসারে আদায় করা।
উল্লেখ্য, উপরি উক্ত চারটি ফরজের কোনো একটি বাদ পড়লে হজ্জ হবে না।
হজ্জের ওয়াজিব ৯টি
১. সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝে দ্রুত চলা। বর্তমানকালে হাজীদের সুবিধার জন্য এ পথের মাঝে খুব সহজে চোখে পড়ার মতো, মাথার ডানে-বামে ও ওপরে সবুজ বাতির দু’টি বেষ্টনী আছে। এই দুই বর্ডার লাইনের মধ্যে দৌড়ালেই ওয়াজিব আদায় হবে। সাফা-মারওয়ার মধ্যবর্তী বাকি অংশে হেঁটে চলতে দোষ নেই। এ দ্রুত চলাকে সায়ি বলে।
২. মুজদালিফায় অবস্থান করা। ৯ জিলহজ্জ (আরাফাতে অবস্থানের দিন) দিবাগত রাতের যেকোনো সময়ে সেখানে পৌঁছানো এবং সূর্যোদয় পর্যন্ত সেখানে কিছু সময় অবস্থান করা।
৩. শয়তানের স্তম্ভে (জুমরাত) পাথর মারা। এটাকে ‘রামি’ বলে।
৪. মক্কা শরিফের চতুর্দিকে ইহরাম বাঁধার যে নির্দিষ্ট স্থান রয়েছে, সেই পরিসীমার বাইরে যারা অবস্থান করে তাদের জন্য মক্কা শরিফে প্রবেশ করার পর সর্বপ্রথম খানায়ে কাবার তওয়াফ করা। বাংলাদেশী হাজীদের জন্য এ তওয়াফ ওয়াজিব। এ প্রাথমিক তাওয়াফকে ‘তাওয়াফে কুদুম’ বলে।
৫. বিদায়ী তাওয়াফ করা। খানায়ে কাবা থেকে শেষ বিদায়ের সময় (হজ্জ থেকে ফেরার দিন) তাওয়াফ করা। এটা বহিরাগতদের জন্য ওয়াজিব, কাজেই এ দেশী হাজীদের এ তাওয়াফ ওয়াজিব।
৬. মাথা মুড়ানো বা চুল ছাঁটা। হজের আরকান শেষ করার পর মাথা মুড়িয়ে ফেলা অথবা চুল ছাঁটা। ১০ জিলহজ্জ শয়তানের বড় স্তম্ভে (জুমরাতে উকবায়) পাথর মারার পর মাথা মুড়িয়ে ফেলা বা চুল ছোট করা।
৭. কোরবানি করা। বহিরাগত হাজীদের জন্য এটা ওয়াজিব।
৮. দুই নামাজ একত্রে পড়া। অর্থাৎ আরাফাতের ময়দানে জোহর-আসর একত্রে এবং মুজদালিফায় মাগরিব-এশা একত্রে পড়া ওয়াজিব।
৯. পাথর মারা (রামি), কোরবানি ও মস্তক মুণ্ডন ক্রমানুসারে করা (কোরবানি ও মস্তক মুণ্ডনের ক্রমধারা লঙ্ঘিত হলেও হজ্জ হয়ে যাবে বলে অনেক ইসলামী বিশেষজ্ঞ অভিমত ব্যক্ত করেছেন)।