পূর্বের পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
পর্ব ২
রাজনীতি ও ইসলাম
ইংরেজিতে বলা হয় (politics) আরবীতে বলা হয় (السياسة), বাংলায় বলা হয় রাজনীতি।
বর্তমান বিশ্বে রাজনীতি মানুষের নিকট অতি পরিচিত একটি বিষয়। নারী-পুরুষ, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকলেরই এ বিষয় আগ্রহের কমতি নেই। কাজেই মুসলিম-অমুসলিম, ধর্ম-বর্ণ, নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য এ বিষয়টি সরল সহজভাবে পরিস্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন। কেননা, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনীতি থেকে কেউ বিচ্ছিন্ন নয়। বিশেষ করে কোন মুসলমানের পক্ষে এর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কোন সুযোগ নেই। রাজনীতি হলো জীবন নীতি। জীবন রক্ষা ও জীবনের উন্নয়নের জন্য পরস্পর সহযোগিতামূলক নীতি (রাজনীতি) মানুষের জন্য অপরিহার্য। রাজনীতি ছাড়া রাষ্ট্র চলে না, সমাজ চলে না, পরিবার চলে না। এমনকি সুস্থ রাজনীতি না থাকলে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব আশা করা যায়না। কাজেই রাজনীতি ছাড়া মানুষের জীবন অচল।
রাজনীতি নিছক ক্ষমতা দখলের ব্যাপার নয়। একশ্রেণীর লোকেরা রাজীতিকে তাদের ব্যক্তি স্বার্থ হাসিল করার মাধ্যম বানিয়ে, সম্পদ অর্জনের হাতিয়ার বানায়। ব্যবসা-বাণিজ্য আয়ত্তে আনার জন্য, মন্ত্রীত্ব লাভের জন্য, টেন্ডার দখলের জন্য, লাইসেন্স ও বড় বড় ঠিকাদারী ইত্যাদির জন্য রাজনীতি অপরিহার্য মনে করে। প্রকৃত পক্ষে এরা রাজনীতিকে গুটির চাল দিয়ে নিজেদের আখের গোছাতে চায়। এদের দ্বারা দেশ ও জনগণের কোন কল্যাণ আশা করা যায়না। বর্তমান রাজনীতি এসকল আনাড়ীদের হাতে পড়ায় রাজনীতিতে ব্যাপক বিকৃতি ঘটেছে। এ বিকৃতির অন্যতম কারণ হচ্ছে রাজনীতিকে ধর্ম থেকে আলাদা করা। যার ফলে মানুষ রাজনীতির সুফল ভোগ করতে পারছে না। সুফল ভোগ করবে কিভাবে? প্রচলিত রাজনীতির নামে যা চলছে তা সত্যিকারে কোন নীতিই নয়। এখানে ধোঁকা, প্রতারণা, মিথ্যা, দুর্নীতি, ওয়াদা ভঙ্গ করা ইত্যাদি কোন অপরাধকে অপরাধই মনে করা হয় না। এ রাজনীতিতে নাকি শেষ বলতে কিছুই নেই। মানে লাগাম হীন কথা-বার্তা। ধর্মহীন রাজনীতিতে কোন বাঁধন থাকে না, থাকে না কোন উচ্চতর লক্ষ্য। ধর্মহীন রাজনীতি মানে আদর্শহীন রাজনীতি। প্রচলিত রাজনীতির এটাই হচ্ছে অন্যতম দিক, যা মানুষের কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণই বেশি হয়। প্রচলিত রাজনীতির বৈশিষ্ট্যসমূহ সামনে এনে আজকের বাস্তবতার সাথে মিলালেই এর কু-ফল উপলদ্ধি করা সম্ভব হবে।
প্রচলিত রাজনীতির অন্যতম কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো :
১. নীতি ও নৈতিকতার তোয়াক্কা না করা: প্রচলিত রাজনীতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্যই হল নৈতিকতাকে নির্বাসিত করা। কিছুটা ব্যতিক্রম থাকলেও এ ধারার রাজনীতিতে নৈতিকতার বাধন ছিন্ন করা হয়েছে। স্বার্থ ও নিজের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে এখানে চলে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র। হয়রানীমূলক মামলা, প্রশাসন ও প্রচার মাধ্যমের অপব্যবহার, জনগণের কষ্টার্জিত অর্থের অপব্যবহার, ধোঁকাবাজি ও মিথ্যা আশ্বাসে ফুলঝুরী।
২. রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা; প্রচলিত রাজনীতিতে শাসকের প্রতি আনুগত্য ও তার দায়িত্বশীলতা উভয়ই অত্যন্ত দুর্বল ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। কেননা, এখানে জবাবদিহিতার তেমন কোন দায়িত্ববোধ থাকে না। আর জবাবদিহিতার তোয়াক্কা না করার কারণেই চলে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা।
৩. ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন পদ্ধতি; যেখানে ব্যক্তি বা দল বিশেষ নেতৃত্বের জন্য তাদের দলীয় মেনিফেস্টো পেশ করে এবং জনগণের রায়ের জন্য নির্বাচনী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এ যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য যার যা শক্তি থাকে তা সবই ব্যবহার করতে চান। ফলে টাকার ছড়াছড়ি, পেশি শক্তির অপব্যবহার, এমনকি সন্ত্রাসী বাহিনীও ব্যবহার করতে দেখা যায়। আবার যারা ক্ষমতায় থাকেন তারা এ নির্বচনী অরগাণগুলোকে ক্ষমতাবলে নিজেদের স্বার্থেই ব্যবহার করতে সচেষ্ট থাকেন। এর ফলে সাধারণ মানুষ তাদের পছন্দ মতো ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন না। তাছাড়া উন্নয়নশীল দেশসমূহের সংখ্যাগরিষ্ঠ স্বল্প শিক্ষিত ও অশিক্ষিত মানুষ জাতীয় জীবনে নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজের তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারেন না। নেতৃত্ব নির্বাচন যে একটি পবিত্র দায়িত্ব এবং ভুল নির্বাচন যে জাতির কতটা অকল্যাণ বয়ে আনতে পারে, এ চেতনা ও উপলদ্ধি তাদের নজরে আসে না।
৪. হিংসা-বিদ্বেষ, অসহনশীলতা: প্রচলিত রাজনীতিতে দলে দলে, আদর্শে আদর্শে, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে হিংসা-বিদ্বেষের বিষবাষ্প ছড়ানো হয় ভয়ানকভাবে। যার ফলে জাতীয় জীবনে আসে নৈরাজ্য আর আন্তর্জাতিক জীবনে সূচিত হয় ক্ষমতা ও আধিপত্যের প্রতিযোগিতা। যে কারণে আজকের বিশ্ব মানবতাকে করেছে হুমকির সম্মুখীন।
৫. রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন; সন্ত্রাস-দুর্নীতি রাজনীতিকে কলুষিত করে তার প্রকৃত চেহারাকে বদলে দিয়েছে। যার ফলে সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ ও কালো টাকার মালিকরা কার্যত প্রচলিত রাজনীতির নিয়ন্ত্রক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ফলে মেধাহীন ও অযোগ্য লোকেরা রাজনীতিকে উপার্জনের হাতিয়ারে পরিণত করেছে। এরা ক্ষমতায় গিয়ে সর্বময় ক্ষমতার মালিক বনে যান। সেই সাথে এ রাজনীতিতে যে কোন উপায়ে, তা অবৈধ হলেও ক্ষমতা লাভ করাটাই বড় সফলতা মনে করা হয়।
৬. রাজনৈতিক দলের চাইতে ব্যক্তিই অনেক সময় সর্বেসর্বা হয়ে উঠেন। ফলে তারা জনমতের কোন তোয়াক্কা করেন না। নিজের স্বার্থ হাসিলই এ রাজনীতির মুখ্য বিষয় হয়ে দাড়ায়।
৭. পারস্পরিক দোষারোপ, প্রতিহিংসা, সংঘাত-সংঘর্ষ, বিভাজনের ধারাই প্রচলিত রাজনীতিতে পরিলক্ষিত হয়। নীতি জ্ঞান হীন রাজনীতির ফলে অসৎলোকদের সকল প্রকার দৌড়াত্ব বৃদ্ধি পায়।
৮. প্রচলিত রাজনীতিতে তোষামোদকারী, চাটুকার, মতলববাজ, ধান্দাবাজদের কদর বেশি পরিলক্ষিত হয়। এসব লোকদের দাপটের কারণে সৎলোকের স্থান ও মর্যাদা এখানে থাকে না।
৯. এ রাজনীতিতে নেতারা তাদের ক্ষমতা ও সম্পদের প্রতি লালায়িত থাকেন। ফলে দলের গণতন্ত্রের চর্চা খুব কমই দেখতে পাওয়া যায়। তোষামোদ ও স্বজনপ্রীতির কারণে সঠিক নেতৃত্ব সহজে দেখতে পাওয়া যায় না। ফলে নীতিবানদের চেয়ে দুর্নীতিবাজদের প্রাধান্যই বেশি থাকে। এ কারণে নেতারা অন্যায়-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকরে রাজনীতির ময়দান দখল করেন। ১০. প্রচলিত রাজনীতির ময়দানে নেতারা মুুখে নীতিবাক্য শোনালেও বাস্তবে কর্মীদেরকে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অন্যায় আচরণ শেখান। পরে কোন এক সময় এ নেতারাই কর্মীদের হাতে নাজেহাল হন। স্বার্থে ব্যাঘাত হলেই কর্মীরা দলে বিরোধ সৃষ্টি করে পাল্টা দল, উপদল গঠন করেন। এভাবেই এক একটি দল পরবর্তীতে ভেঙ্গে বহুদলের সৃষ্টি করে। তারা মনে করেন, যে কোন উপায়ই হোক ক্ষমতা দখল করাটাই হচ্ছে সফলতা। এ ক্ষেত্রে চুরি, মিথ্যা, শঠতা, প্রবঞ্চনা, খুন, রক্তপাত ইত্যাদি কোন ব্যাপারই নয়। প্রচলিত রাজনীতি, প্রতারণার মাধ্যমে মানব জাতিকে শাসন ও শোষণ করার কৌশল মাত্র।
প্রচলিত রাজনীতির এসব ভয়াবহ রোগের অন্যতম উপসর্গ গুলো হচ্ছে কিছু রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা ও আদর্শ। যেমন:- ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, জাতীয়তাবাদ, একনায়কত্ব, আধিপত্যবাদ, সা¤্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ, ফ্যাসিবাদ, নব্য উপনিবেশবাদ ইত্যকার নানাবিধ তত্ত্ব। মানব রচিত কোন তত্ত্বই যে শান্তি দিতে পারে না, তা বার বার প্রমাণিত হওয়ার পরেও অধিকাংশ মুসলমানরা কেন সে রাজনীতি আকড়ে থাকেন এবং ইসলামী রাজনীতি অপছন্দ করেন? এর অন্যতম কারণ হচ্ছে উপরে উল্লেখিত আদর্শে বিশ্বাসী লোকেরাই যুগ যুগ ধরে রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। সে সাথে জনগণকে শোষণ করে তাদের অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ছেন যা ইসলামী রাজনীতিতে আদৌ সম্ভব নয়, বরং ইসলামী আইনে তাদেরকেই সবার আগে আসামীর কাঠ গড়ায় দাড়াতে হবে। কাজেই ইসলাম ভীতির কারণেই তারা মুসলমান দাবী করা সত্ত্বেও ইসলামী রাজনীতিকে প্রতিরোধ করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আর ইসলামের প্রতিরোধ করতে হলে তার ধারক-বাহকদের আগে প্রতিরোধ করতে হয়। যা নবী-রাসূলদের জীবনেও দেখা যায়। যে কারণে আজ বিশ্বব্যাপী ইসলামী রাজনীতির ধারক-বাহকদের নানা অজুহাতে জেল-জুলুম এমনকি হত্যা করতেও পিছপা হচ্ছে না। তাদের একটাই লক্ষ্য, যে কোন মূল্যেই হোক ইসলামকে প্রতিরোধ করতে হলে ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। ইসলামী রাজনীতি যতদিন ঠেকানো যাবে ততোদিনই তারা বিশ্বকে শাসন করতে পারবে। তাদের এই দুরভিসন্ধির কথা আল্লাহ তায়ালা কুরআনে কারীমে উল্লেখ করে মুসলমানদেরকে সতর্ক করেছেন, “এসব কাফেররা বলে, এ কুরআন তোমরা কখনো শুনবে না। আর যখন তা শুনানো হবে তখন হট্টগোল বাধিয়ে দেবে। হয়তো এভাবে তোমরা বিজয়ী হবে।” (হা-মিম আস সাজদাহ: ২৬) আজকের মুসলিম মিল্লাত স্বেচ্ছায় উল্লেখিত ষড়যন্ত্রকারীদের প্রিয়পাত্র হওয়ার জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্র থেকেই কুরআনকে নির্বাসনে দিয়েছে। যার ফলে বিজয়ী বেশে গোটা পৃথিবী শাসন করছে কাফের ও তাদের দোসর মুনাফিকরা। এ কারণেই আজকের বিশ্ব মানবতা এক মহা দুর্যোগের মধ্যে পড়েছে। কুরআনী শাসন না থাকলে যে মহা বিপর্যয় হবে, সে পূর্বাভাস আল্লাহ তায়ালা প্রায় পনের শত বছর পূর্বেই দিয়ে রেখেছেন। “তাদের পর আসলো অপদার্থ পরবর্তীরা, তারা নামায নষ্ট করলো আর কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করলো; তাই শীঘ্রই তারা গোমরাহীর পরিণাম ভোগ করবে।” (মারইয়াম: ৫৯) তাদের কোন পূণ্যের কাজই আল্লাহর নিকট গ্রহণীয় হবে না। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার পরিস্কার ঘোষণা রয়েছে।
“আর যে কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য জীবন ব্যবস্থা অবলম্বন করতে চায় তার সে পদ্ধতি কখনোই গ্রহণ করা হবে না এবং আখেরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত। (ইমরান: ৮৫) প্রতিটি মুসলমানের জীবনের প্রতিটি স্তরেই রাসূল (সা.) এর আদর্শ অনুযায়ী সাজাতে হবে। আর জীবন চলার প্রতিটি স্তরেই রয়েছে রাসূল (সা.) এর সুমহান আদর্শ। জীবনের কোন একটি স্তর থেকেই রাসূল (সা.) এর আদর্শ বাদ দেওয়া যাবে না। তাহলে মুসলমান দাবী করাই বৃথা। ইসলামের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ অপরিহার্য। আল্লাহ তায়ালার হুশিয়ারী, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা পুরোপুরি ইসলামে প্রবেশ করো এবং শয়তানের অনুসারী হয়ো না, কেননা সে তোমাদের সুস্পষ্ট দুশমন।” (বাকারা: ২০৮)
উল্লেখিত আয়াতে কারিমায় আল্লাহ তায়ালা মানুষের সমগ্র জীবন ব্যবস্থাকে ইসলামের আলোকে সাজাতে বলেছেন। কোন প্রকার ব্যতিক্রম ও সংরক্ষণ ছাড়াই জীবনের সমগ্র পরিসরটাই এর অধীনে হতে হবে। আমাদের চিন্তা-ভাবনা, আদর্শ, মতবাদ, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি ও আন্তর্জাতিকসহ প্রতিটি ক্ষেত্রই ইসলামের কর্তৃত্বাধীন আনার কথা স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে। কাজেই আমাদের জীবনের কিছু অংশে ইসলামী অনুশাসন মেনে চলবো আর কিছু অংশকে ইসলামী অনুশাসনের বাইরে রাখবো, এমনটি করার কোন সুযোগই মুসলমানদের দেয়া হয়নি।
জীবনের সকল স্তরে রাসূল (সা.) এর আদর্শ পাওয়া গেলো আর রাজনীতির ক্ষেত্রে রাসূল (সা.) এর আদর্শ পাওয়া যাবে না, এটা কি করে সম্ভব? তাহলে ইসলাম পরিপূর্ণ জীবন বিধান হলো কি করে? (চলবে—-)