বিশ্বনেতাদের প্রতি হেদায়েতী পত্র

মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুয়্যাতের মাদানী জীবন ও পর্যালোচনা

মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুয়্যাতের মাদানী জীবন ও পর্যালোচনা

পূর্বের পর্ব পাঠ করতে এখানে ক্লিক করুন

মদীনায় হিজরত করে যাওয়ার পর রাসূল (সা.) বিশ্বনেতাদের প্রতি ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন। যা বিশ্বনেতাদের প্রতি হেদায়েতী পত্র শিরোনামে আলোচনা করা হলো।

বিশ্বনেতাদের প্রতি হেদায়েতী পত্র

হুদায়বিয়ার সন্ধির ফলে বাইরের সমস্যা কিছুটা শান্ত হওয়ায় এবং দাওয়াতী কাজে কোন বাঁধা না থাকায় রাসূল সা: বহির্বিশ্বের তখনকার প্রতাপশালী রাজা-বাদশাদের নিকট পত্রের মাধ্যমে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তদুপরি হুদায়বিয়ার সন্ধিকে আল্লাহ তায়া‘লা ‘মহাবিজয়’ আখ্যা দেওয়ায় এ কাজে তাঁর আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। তখনকার দিনে জগতের ইতিহাসে যে কয়টি রাজশক্তি বিদ্যমান ছিল, তাদের মধ্যে এশিয়ায় চিন ও পারস্য, ইউরোপে রোম-সাম্ররাজ্য এবং আফ্রিকায় হাবসী সাম্ররাজ্যই ছিল প্রধান। ষষ্ঠ হিজরীর শেষ কিংবা সপ্তম হিজরীর শুরুতে তিনি বিশ্ব নেতাদের নামে ইসলাম গ্রহণের আমন্ত্রণ জানিয়ে পত্র পাঠাতে থাকেন। এসব পত্র লোক মারফত পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়। ইতিহাসে যে সব আমন্ত্রণ পত্রের কথা উল্লেখিত হয়েছে তার কয়েকটি উল্লেখ করা হলো:

প্রথম পত্রটি রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের নামে দেহিয়া কল্ব এর মাধ্যমে পাঠানো হয়। এ পত্রটি কখন কি অবস্থায় তার হাতে পৌঁছায় সে বিষয় কিছুটা উল্লেখ করা হলো। বহুদিন হতে রোম ও পারস্য-সাম্রাজ্যে ভীষণ যুদ্ধবিগ্রহ চলছিল। রোমকগণ পশ্চিম এশিয়ার এক বিস্তীর্ণ অংশ জয় করে রোম-সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে লয় এবং এর নাম দেয়া হয় ‘বাইজান্টাইন’ বা প্রাচ্য রোম-সাম্রাজ্য। এসময় এই বাইজান্টাইনের শাসন করতেন হিরাক্লিয়াস। ইনি কনষ্টান্টি নোপলে থেকে রাজ্যশাসন করতেন। ইহাকে ‘কাইসার’ও বলা হত। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর প্রথম দিকে পারস্য-সম্রাট খসরু রোমকদের পরাজিত করে মিসর,সিরিয়া, ফিলিস্তিন উদ্ধার করেন। কিন্তু বেশী দিন সেগুলোকে অধিনে রাখতে পারেন নাই। কিছুদিনের মধ্যেই হিরাক্লিয়াস পারসিকদিগকে পরাজিত করে হৃতরাজ্যগুলো পুনরায় দখল করে নেন। ঠিক এই সময় মুহাম্মাদ সা: হুদায়বিয়ায় কুরাইশদের সাথে সন্ধি করতে ব্যস্ত ছিলেন। হিরাক্লিয়াস মনে মনে প্রতিজ্ঞা করছিলেন যে,যদি পারসিকদের পরাজিত করে প্যালেষ্টাইন পুনরায় দখল করতে পারেন তাহলে তিনি পায়ে হেটে জেরুজালেম পরিদর্শন করবেন। প্রতিজ্ঞানুযায়ী তিনি প্যালেষ্টাইন দখল করে মহা আনন্দে জাকজমক ভাবে জেরুজালেমে আসতেছিলেন। এমন সময় সীলমহরযুক্ত আরবী-ভাষায়-লিখিত একখানি পত্র তার হাতে এসে পৌঁছায়। দেহিয়া কল্ব নামে জনৈক আরবীয় দূত পত্রখানি প্রথমে বসরার শাসনকর্তা হারিসের নিকট প্রদান করেন। হারিস জনৈক কর্মচারীকে সাথে দিয়া দেহিয়া কলবকে জেরুজালেমে হিরাক্লিয়াসের নিকট পাঠায়ে দিলেন। পত্রখানিতে যে কথা লেখাছিল:

‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল মুহাম্মাদের পক্ষ হতে রোমের প্রধান হিরাক্লিয়াসের নামে। যে ব্যক্তি সত্যপথ অনুসরণ করে, তার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। অত:পর আমি আপনাকে ইসলামের দিকে আহবান করতেছি। ইসলাম গ্রহণ করুন, আপনার কল্যাণ হবে, শান্তিতে থাকবেন। আল্লাহ আপনাকে দ্বিগুণ প্রতিফল দিবেন। কিন্তু যদি আপনি এতে অস্বীকার করেন, তাহলে আপনার প্রজাসাধারণের পাপের জন্য আপনি দায়ী হবেন। ‘হে আহলে কিতাব! এস এমন একটি কথার দিকে, যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে সমান; তা এই যে, আমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারো ইবাদত করবো না, তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবো না এবং আমাদের মধ্যেও কেউ আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে নিজের প্রভু বানাবো না। কিন্তু তোমরা যদি এ কথা মানতে অস্বীকৃত হও, তাহলে (আমরা স্পষ্ট বলে দিচ্ছি যে,) তোমরা সাক্ষী থাক, আমরা মুসলিম। ( সূরা আল-ইমরান-৬৪)। পত্রের নীচে ‘মুহাম্মাদুর রাসূলূল্লাহ’ মোহর (সীল) মারা ছিল। (পত্রের ভাষার দিকে লক্ষ্য করলে সহজেই যে বিষয়গুলো বুঝা যায় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, কোন দেশের রাষ্ট্রপতি যদি আল্লাহর নীতি মালা লংঘন করে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন তাহলে জাতি পথভ্রষ্ট হয় এবং জাতির বিপর্যয় দেখা দেয়। ফলে জনগণের পাপসহ এর যাবতীয় দায়ভার প্রথমত: রাষ্ট্র পরিচালকদের ই বহন করতে হবে। আসমান -যমিনে যাকিছু আছে সবকিছুরই একমাত্র মালিক হচ্ছেন আল্লাহ। দেশ ও জাতি কোন নীতিমালার ভিত্তিতে পরিচালনা করলে সফলতা আসবে তাও জানেন আল্লাহ। তাই তিনি পৃথিবী পরিচালনার জন্য বান্দার হাতে তুলে দিয়েছেন বিজ্ঞান সম্মত এক নীখুঁত নীতিমালা সম্বলিত কিতাব। যাকে আল্লাহ তায়া‘লার ভাষায় বল হয়েছে ‘নেয়া‘মত’(কুরআন)। যে জাতির পরিচালকরা এ নেয়া‘মতকে উপেক্ষা করে অন্য নীতিমালা দিয়া দেশ ও জাতি পরিচালনা করবে সে দেশ ও জাতি ধ্বংসের সম্মুখীন হবে। আল্লাহর বাণী, “তুমি কি তাদেরকে দেখনা, যারা আল্লাহর তায়া‘লার নেয়ামতের পরিবর্তে কুফর অবলম্বন করেছে এবং তাদের অনুসারী জাতিকে ধ্বংস ও বিপর্যয়ের অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে? তারা জাহান্নামে প্রজ্জ্বলিত হবে। আর জাহান্নাম কতইনা নিকৃষ্ট আবাস স্থল”। সূরা ইবরাহীম- ২৮,২৯। আজকের পৃতিবী জ্ঞান-বিজ্ঞানে, শিক্ষা-দিক্ষায়, আবিস্কারে অনেক উন্নতি হওয়ার সত্ত্বেও কেন এত অশান্তি? তার মূল কারণ উল্লেখিত আয়াতে বলা হয়েছে)। প্রবল ক্ষমতাধর রোম সাম্রাজ্যের অধিপতি হিরাক্লিয়াসের নিকট একজন নিরক্ষর মরুবাসীর পত্র। পত্রের সারমর্ম বুঝে হিরাক্লিয়াস বিস্ময় অভিভূত। রাজ্যের মন্ত্রীবর্গ, প্রশাসনের উচুঁ স্তরের লোকেরা পরামর্শ দিলেন তাঁকে সমুচিত শিক্ষা দেয়া হোক। কিন্তু হিরাক্লিয়াস তাদের কথায় সায় দিলেন না। তিনি বাইবেল থেকে জানতে পেরেছেন যে, একজন মহামানব আসবেন। তিনি মুহাম্মাদ সা: সম্পর্কে জানার আগ্রহ ব্যক্ত করলেন। মন্ত্রী, পুরোহিত ও অন্যান্য জ্ঞানী ব্যক্তিদিগকে নিয়ে একটি পরামর্শ সভার আয়োজন করলেন। সেখানে পত্রবাহক সহ অন্যান্য আরবদেরও ডাকলেন। ঘটনা চক্রে এ সময়ে ইসলাম বৈরী আবু সুফিয়ানও বাণিজ্য উপলক্ষে জেরুজালেমে অবস্থান করছিলেন। সম্রাটের আদেশক্রমে তাকেও রাজ্যসভায় উপস্থিত করা হলো। দোভাষীর সাহায্যে কথাবর্তা আরম্ভ হবে। সম্রাট আরবদের জিজ্ঞাসা করলেন:মুহাম্মাদের সর্বাপেক্ষা নিকট আত্মীয় কে আছে? আবু সফিয়ান উত্তর দিল:আমি আছি। মুহাম্মাদ আমার ভ্রাতুষ্পুত্র। তখন সম্রাট আবু সুফিয়ানকে নিকটে ডেকে অন্যান্য আরবদের বললেন: এ ব্যক্তিকে আমি কতগুলো প্রশ্ন করবো। সে যদি মিথ্যা উত্তর দেয়, তাহলে তোমরা তার প্রতিবাদ করবে। আবু সুফিয়ান মহা সংকটে পড়লো। ভেবেছিল প্রাণ ভরে মুহাম্মাদের কুৎসা বলে যাবে। কিন্তু সে সুযোগ আর রইলো কোথায়। বরং মিথ্যা বললে তাকে এ রাজ দরবারে অপমানিত,লাঞ্ছিত হতে হবে। বাধ্য হয়েই তাকে আজ মহা শত্রুর বিরুদ্ধে সত্য কথা বলতে হবে। এ চিন্তায় আবু সুফিয়ান মহা সংকটে পড়ল।

আবু সুফিয়ানের সাথে আলোচনা

হিরাক্লিয়াস: নবুয়্যাতের দাবীদার ব্যক্তির বংশ কেমন?

আবু সুফিয়ান: সে সম্ভ্রান্ত বংশের লোক।

হিরাক্লিয়াস: এ বংশের আর কেউ নবুয়্যাতের দাবী করেছে?

আবু সুফিয়ান: কখনো কেউ নবুয়্যাতের দাবী করেনি।

হিরাক্লিয়াস: তাঁর পূর্ব পুরুষদের কেউ রাজা ছিলেন?

আবু সুফিয়ান: না।

হিরাক্লিয়াস: কোন শ্রেণীর লোক তাঁর ধর্ম গ্রহণ করছে?

আবু সুফিয়ান: বেশির ভাগ দরিদ্র শ্রেণীর লোকই তাঁর ধর্ম গ্রহণ করছে।

হিরাক্লিয়াস: তাঁর অনুসারীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, না কমছে?

আবু সুফিয়ান: ক্রমান্বয় বৃদ্ধি পাচ্ছে।

হিরাক্লিয়াস: এ ব্যক্তিকে কোন দিন মিথ্যা বলতে দেখেছ কি?

আবু সুফিয়ান: না, জীবনে কোন দিন মিথ্যা বলেননি।

হিরাক্লিয়াস: তিনি কি কখনো কোন চুক্তি বা ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন?

আবু সুফিয়ান: না, আজ পর্যন্ত তা দেখি নাই। তবে বর্তমানে হুদায়বিয়ার চুক্তি রয়েছে। দেখি সে চুক্তিতে অটল থাকে কি না?

হিরাক্লিয়াস: তাঁর সাথে তোমাদের কোন যুদ্ধ হয়েছে কি না?

আবু সুফিয়ান: হয়েছে।

হিরাক্লিয়াস: যুদ্ধের ফলাফল কি হয়েছে?

আবু সুফিয়ান: কখনো আমরা জিতেছি, আবার কখনো তাঁর জয় হয়েছে।

হিরাক্লিয়াস: তিনি মানুষদের কি শিক্ষা দেন?

আবু সুফিয়ান: তিনি বলেন: এক আল্লাহ ব্যতিত আর কোন উপাস্য নেই। তাঁর সাথে আর কাউকে শরীক করা যাবে না। নামাজ পড়। সত্য কথা বল, সুপথে চল, চরিত্রবান হও। পরস্পর মিলে-মিশে থাকো। মানুষকে উপকার কর, ক্ষতি করনা, ইত্যাদি।

এই আলোচনার পর হিরাক্লিয়াস বললো: “দেখ এ ব্যক্তি যে সত্যসত্যিই নবী, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তোমাদের কথা হতে  স্পষ্ট বেরিয়ে এসেছে যে, তাঁর বংশ খুব সম্ভ্রান্ত, এ বংশে পূর্বে কেউ কোন দিন নবী বা রাজা ছিলনা। নবীগণ সব সময় সম্ভ্রান্ত বংশেই জন্ম গ্রহণ করেন। পূর্বে কেউ নবী বা রাজা থাকলে তিনি তাঁর বংশের হারানো গৌরব ফিরে পাবার নেশায় তা করছেন বলে ধরে নেয়া যেত। ব্যাপারটি কিন্তু তেমন নয়। দরিদ্র লোকেরাই তাঁর বেশি অনুসরণ করছে। সত্য ধর্মের ব্যাপারে চিরকালই এমনটি হয়ে আসছে। জীবনে কোন দিন মিথ্যা বলেন নি, চুক্তি ও ওয়াদা ভঙ্গ করেন নি। ইহাই সত্য নবী হওয়ার লক্ষণ। তোমরাই ভেবে দেখ, জীবনে যিনি এমনটি করেন নি, তাহলে তিনি যা কিছু বলছেন তা মিথ্যা হওয়ার কোন প্রশ্নই আসে না। তাঁর অনুসারী দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, নবীদের অনুসারী বৃদ্ধি পায় কমে না। ইহা ছাড়াও তিনি তোমাদেরকে মহৎ ও উন্নত জীবন-যাপন পদ্ধতি শিক্ষা দেন। কাজেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস তিনিই হবেন বিশ্ব নবী, যার জন্যে সারা পৃথিবী অপেক্ষা করছে। তাঁর আধিপত্য একদিন আমার রাজত্ব পর্যন্ত পৌঁছবে। আমি যদি তাঁর নিকট যেতে সক্ষম হতাম, তাহলে নিজেই তাঁর পা মোবারক ধুয়ে দিতাম।”

হিরাক্লিয়াসের এসব মন্তব্যের ফলে তার সভাস্থলে তুমুল উত্তেজনা দেখা দিল। খ্রীষ্টান পাদ্রীগণ ও তার দরবারের আলেমরা কথাগুলোকে তাদের স্বার্থের বিপরিত মনে করায় তুমুল উত্তেজনা দেখা দিল। এমন কি তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেখা দেয়ার মতো পরিস্থিতি দেখা দিল। এর ফলে তার বিবেকে যে সত্যের আলো উদ্ভাসিত হয়েছিল, তা আবার নিভে গেলো। সাম্রাজ্যের আসন্ন বিপদের আশঙ্কা দেখা দেয়ায়, তিনি তার কথার কূট রাজনৈতিক ব্যাখ্যা দিয়ে সকলকে শান্ত করলেন। প্রকৃত পক্ষে সত্যকে গ্রহণ করার পথে ধন-সম্পদ ও ক্ষমতার মোহই সবচেয়ে বড়ো প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্ব নবীর পত্রের মাধ্যমে বাণী প্রেরণ খ্রীষ্টান- জগতে এক অভূত দোল খেতে লাগলো।

পারস্য সম্রাট খসরুর নামে পত্র

খসরু পারভেজ ছিল পারস্য (ইরানের) সম্রাট এবং অগ্নি উপাসক। রাসূল (সা.) আব্দুল্লাহ ইবনে রওয়াহা (রা.) এর মাধ্যমে তার নিকট পত্র পাঠান। পত্রের ভাষা ছিল নিম্নরূপ-

“বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম।” আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে পারস্যের সম্রাট খসরু সমীপে। ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর বিধান মানে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে বিশ্বাস করে তার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া সত্যিকারে কোন মা‘বুদ নেই এবং আমি তাঁর প্রেরিত রাসূল। বিশ্ব মানবকে আল্লাহর নাফরমানি থেকে সতর্ক করার জন্যে আল্লাহ আমাকে পাঠিয়েছেন। আপনি ইসলাম গ্রহণ করুন, আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হবে। যদি না করেন, তাহলে আপনার প্রজাদের অগ্নিপূজার পাপের জন্যে আপনি দায়ী হবেন।’ মহাপ্রতাপান্বিত সম্রাটখসরু পারভেজ। তার কাছে এমন করে কে পত্র লেখলো? কার এতবড় বুকের পাটা? তার কাছে লিখিত পত্রে শুরুতে আল্লাহর নাম, এরপরে প্রেরকের নাম, শেষে গিয়ে সম্রাটের নাম। তাও আবার নিতান্ত সাদামাঠা, তদুপরি দরবারে প্রচলিত নিয়ম-কানুনের লঙ্ঘন- এ ধরণটাই তার নিকট বড়ই অসহনীয় মনে হলো। ক্ষমতার অহংকারে সম্রাটক্রোধে একেবারে আত্মহারা হয়ে বললো: ‘আামার গোলাম হয়ে আমায় এমনিভাবে পত্র লেখার স্পর্ধা!’ তৎক্ষণাত পত্র খানি ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেললো। সেই সাথে ‘ইয়ামানের’ শাসনকর্তা ‘বাজান’-কে হুকুম দিয়ে পাঠানো হলো: “অনতিবিলম্বে মুহাম্মাদকে গ্রেফতার করে আমার দরবারে হাযির করা হোক।” সম্রাটের আদেশক্রমে শাসনকর্তা মুহাম্মাদের নিকট গ্রেফতারী পরোয়ানাসহ দু‘জন কর্মচারীকে পাঠিয়ে দিল। কর্মচারীদ্বয় মুহাম্মাদের নিকট উপস্থিত হয়ে বললো:‘সম্রাটের আদেশ পালন করুন! অন্যথায় তার সৈন্যবাহিনী এসে পুরা আরব দখল করে নিবেন।’ কথা শুনে মুহাম্মাদ সা: হেসে বললেন, “আাজ আমি কিছুই বলবো না। কাল এসো উত্তর দিব।” পরদিন কর্মচারীদ্বয় উপস্থিত হলে মুহাম্মাদ সা: জিজ্ঞেস করলেন: কার পরোয়ানা? কর্মচারীদ্বয় বিস্মিত হয়ে বললেন, “কেন সম্রাটখসরুর।” রাসূল সা: বললেন, সম্রাটখসরু? তিনিতো জীবিত নেই!

যাও তোমাদের সম্রাটকে বলিও, খসরু যেমন করে আমার পত্রখানি টুকরো টুকরো করেছে আল্লাহ তার রাজ্যকে ঠিক তেমনি টুকরো টুকরো করে ফেলবেন। সেই সাথে অতি শীঘ্রই ইসলামের রাজ্য পারস্যের রাজধানী পর্যন্ত বিস্তৃত হবে।” কর্মচারীদ্বয় রাসূল সা:-এর কথায় স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কোন উপায় না দেখে তারা ফিরে চললেন। যাত্রা প্রাক্কালে তাদেরকে আরো বললেন, “ইয়ামানের শাসনকর্তাকে বলিও, সে যেন ইসলাম গ্রহণ করে। তাহলে আমি তাকে স্বপদে বহাল রাখবো।” কর্মচারীদ্বয় অবাক হয়ে ইয়ামানে ফিরে গেল। ইয়ামানে পৌঁছেই শুনতে পেলো সম্রাটখসরু তার নীজ পুত্র ‘শেরওয়া’ কর্তৃক নিহত হয়েছেন। নতুন সম্রাটইয়ামানের শাসনকর্তাকে নতুন আদেশ জারি করেছেন যে, সেই আরবীয় নবীর বিষয় দ্বিতীয় আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত কোন কিছু যেন না করা হয়।

কর্মচারীদের মুখে মুহাম্মাদ সা:-এর সমস্ত কথা শুনে শাসনকর্তা ভাবনায় পড়ে গেলেন। তিনি গভীরভাবে ভাবতে লাগলেন,পারস্য সম্রাটের বিষয় ভবিষ্যৎবাণী যখন সফল হয়েছে, তখন পারস্য সাম্রাজ্যের বেলায়ও তা অবশ্যই ঘটবে। নিশ্চয়ই তিনি একজন সত্য নবী। আমাকে যে পরামর্শ দেয়া হয়েছে অবশ্যই তা আমাকে মানতেই হবে। না মানলে দুনিয়াও হারাবো আখেরাতও হারাবো। তাই তিনি কাল বিলম্ব না করে ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং তার দেখাদেখি আরো অনেকে মুসলমান হয়ে গেল। শাসনকর্তা মুহাম্মাদকে গ্রেফতার করতে গিয়ে নিজেই আত্মসমর্পণ করলো। আর এর মাধ্যমে নিজের জীবনে সফলতার দ্বারে প্রবেশ করলো।

পরবর্তীতে রাসূল সা: আবিসিনিয়ার নাজ্জাশী ও মিসরের আজীজের নামে পত্র পাঠিয়েছেন। নাজ্জাশী ও রাসূল সা: একে অপরের সম্পর্কে জানাশোনা ছিল। মুসলমানগণ কুরাইশদের অত্যাচার থেকে আত্মরক্ষার্থে পর-পর দু‘বারই এই ন্যায়পরায়ণ সম্রাটের দেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন। নাজ্জাশীও সমস্ত বিষয় অবগত হয়ে মুসলমানদিগকে সাদরে নিজ রাজ্যে আশ্রয় দিয়েছিলেন। যাহোক নাজ্জাশী রাসূলের পত্রের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন এবং ইসলাম গ্রহণ করে পত্রের উত্তর দিয়েছিলেন। তিনি বিনীতভাবে লিখে জানান যে, রাজনৈতিক নানা ঝামেলার কারণে নিজে এসে তাঁর পতাকা তলে দাঁড়াতে না পারায় তিনি অত্যন্ত দু:খিত। অপরদিকে মিসরের আজীজ যদিও চিঠি পড়ে ইসলাম গ্রহণ করেননি, কিন্তু তিনি পত্র বাহককে খুব সম্মান করেন এবং উপঢৌকন দিয়ে ফেরত পাঠান।

রাসূল সা:হেদায়তী পত্রের মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে ইসলামের সুমহান শান্তির বাণী প্রেরণ করলেন। মহানবীর আহবানে তিনটি মহাদেশেই এক অপূর্ব স্পন্দন ও আলোড়নের সৃষ্টি হলো-স¤্রাটদের রাজসিংহাসন কেঁপে উঠলো। পৃথিবীর খ্যাতনামা সম্রাটও বীরগণ যুদ্ধ করে যা করতে পারেন নাই, রাসূল সা: দূর থেকে তাঁর পত্রের মাধ্যমেই তা সম্পন্ন করলেন। ইসলামী দাওয়াতের এই কলমী সংগ্রাম থেকে গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল পাওয়া গেছে এবং তা ইসলামের প্রসার ও বিকাশ সাধনে খুবই সহায়ক হয়েছে। প্রথমত এর দ্বারা পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোতে ইসলামের দাওয়াত একটা আলোচ্য ও বিবেচ্য বিষয়ে পরিগণিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ক্ষমতাসীন শাসক এই সব চিঠির কল্যাণে এমন অবস্থায় ইসলাম গ্রহণ করে, যখন মুসলমানরা সাংস্কৃতিক দিক থেকে খুবই অগ্রসর ছিল। এর দ্বারা প্রমাণিত হয়, ইসলাম একটা সত্য ও স্বাভাবিক ধর্ম। ইসলাম গ্রহণকারী এই ক্ষমতাসীন শাসকদের সাথে সাথে তাদের প্রজারাও ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়ে। পত্র পেয়েও যারা ইসলাম গ্রহণ করেনি, তাদের মনের ওপরও এর যথেষ্ট প্রভাব পড়েছিল। তা ছাড়া চিঠি প্রেরণের মাধ্যমে যে আন্তর্জাতিক যুগের সূচনা হয়, তা দেশের ভেতরেও পরিবেশ অনুকূল করতে যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এর ফলে মুসলমানদের সামনে একটা সুপরিসর কর্মক্ষেত্র উপস্থিত হয়। তাদের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটা বিরাট ও সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেয়া হয়। ফলে আরবে ইসলামী রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পরও মুসলিম মুজাহিদরা ক্ষান্ত হয়নি, ভোগ বিলাসে মত্ত হয়নি এবং তাদের মনে এ ধারণা জন্মেনি যে, যা কিছু করণীয় ছিল, তা করে ফেলেছি। বরং তাদের আকাংখা ও অভিলাষ আরো বেড়ে গেছে। রাসূল সা: সূচিত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই অসম্পূর্ণ দাওয়াতী অভিযানকে সম্পূর্ণ করার দায়িত্ব এসে পড়ে সাহাবীদের ওপর। রাসূলের সা: সুযোগ্য সাহাবীগণ সে দায়িত্ব যথাযথ ভাবে আঞ্জাম দিয়েছেন। বর্তমানে এ দায়িত্ব বর্তায় প্রথমত ওলামায়ে কেরামদের, এর পর সমগ্র উম্মতের ওপর। এ দায়িত্ব থেকে বিরত থাকার কোন সুযোগ নেই।

Related Post