মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুয়্যাতের মাদানী জীবন ও পর্যালোচনা

পূর্বে প্রকাশিতের পর

৬ষ্ঠ পর্ব

বীরে মাউনার ঘটনা
আবু বারা আমের বিন মালেক রাসূলের খেদমতে হাজির হয়ে, এই বলে আবেদন করলো যে, আমার সাথে কতিপয় লোক পাঠিয়ে দিন, আমার বংশের লোকেরা ইসলামের বাণী শুনতে চায়। আশা করা যায় লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করবে। আবু বারার কথায় বিশ্বাস করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৭০ জন উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন সাহাবী পাঠিয়ে দিলেন। যাদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন আমলের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী-গুনী সাহাবী। এদের নেতা ছিলেন মুনযির বিন আমর। এই দাওয়াতী দল যখন বীরে মাউনা নামাক স্থানে পৌঁছলো, তখন বনু আমের গোত্রের শাসনকর্তা ‘আমরা বিন তোফায়েল’ আরো কতিপয় গোত্রকে সাথে নিয়ে তাদেরকে হত্যা করলো। মাত্র একজন ব্যক্তি ‘কাব বিন যায়েদ’ রক্তাক্ত দেহ নিয়ে লাশের স্তূপে লুকিয়ে থেকে কোন মতে প্রাণে বেঁচে মদীনায় পৌঁছে, রাসূল (সা.)-কে এই মর্মান্তিক দুঃসংবাদ জানালেন। শত্রু বেষ্ঠিত একটি নবীন রাষ্ট্রের এ নিষ্ঠুরতা কতটা মারাত্মক।

এ মর্মান্তিক ঘটনায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত ব্যথিত ও শোকাতুর হয়ে পড়লেন। তিনি এই হৃদয় বিদারক ঘটনার জন্য একমাস যাবৎ ফজরের নামাযে তাঁর প্রিয় সাহাবীদের খুনীদের বিরুদ্ধে বদদোয়া করেন। যাকে কুনুতে নাযেলা বলা হয়। এভাবে আরবের বিভিন্ন গোত্রের সঙ্গে মুসলমানদের নিয়মিত সংঘর্ষ চলছিলো। এ সময় ইহুদী আলেমদের বিরুধিতা শুরু হলো। ইসলামী আন্দোলনের ক্রমবর্ধমান উন্নতিতে ইহুদী আলেম ও পীরগণ বিশেষভাবে বিরোধিতা করতে শুরু করে। এরপর বনু কায়নুকার সাথে যুদ্ধ। ইসলামের দুশমন বিক্ষাত কবি, ‘কা‘ব বিন আশরাফ’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যার পরিকল্পনা নিলে ‘মুহাম্মাদ বিন মুসলিমা’ তাকে হত্যা করেন। বনী নযীর গোত্রের ইহুদীগণ চুক্তি ভঙ্গ করে ইসলামের বিরুদ্ধে গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এমনকি তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যার জন্য কয়েকবার পরিকল্পনা নিলো। ফলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বহিস্কার করেন। বনু নাযীরের ঘটনার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাতুর রেকা, গাতফান গোত্রের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। আবু সুফিয়ানের চ্যালেঞ্জের জবাবে ওহুদ যুদ্ধের এক বছর পর দ্বিতীয় বার বদর অভিযানে বের হন। আবু সুফিয়ান সেখানে উপস্থিত হয়নি। দীর্ঘ আট দিন সেখানে অবস্থানের পর মদীনায় ফিরে আসেন।
এরপর বনী মুস্তালিক গোত্রের অভিযান পরিচালনা করেন। এই সফরেই হযরত আয়েশা (রা.) কাফেলা থেকে প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিয়ে গিয়ে পেছনে পড়ে যান। ফলে তাঁর বিরুদ্ধে জঘন্যতম মিথ্যা অপবাদ রটানো হয়; তাকে পূত-পবিত্র প্রমাণ করার জন্য স্বয়ং আল্লাহ সূরা নূরে আয়াত নাযিল করেন। ওহুদ যুদ্ধের পর খন্দক যুদ্ধের আগ পর্যন্ত এসব ঘটনা ঘটতে ছিলো। ইসলামী রাষ্ট্রকে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার্থে আইন-শৃঙ্খলা বহাল রাখা ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার প্রয়োজনেই উল্লেখিত পদক্ষেপসমূহ নিতে হয়েছে। রাসূলের বিপ্লবী জীবনে ঘটে যাওয়া আরো কিছু যুদ্ধের বিবরণ সংক্ষেপে তুলি ধরছি।
সম্মিলিত বাহিনীর আক্রমণ “খন্দকের যুদ্ধ”
যুদ্ধের পটভূমি: এমনিতেই মুসলমানদেরকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য ষড়যন্ত্রের পর ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছিল। যার ধারাবাহিকতায় ইতোপূর্বে বদর ও ওহুদ যুদ্ধ সংগঠিত হয়। কুরাইশদের দলনেতা আবু সুফিয়ান সদাব্যস্ত কি করে মুসলমানদের শেষ করা যায়। তদুপরি এবার তাদের সাথে স্বেচ্ছায় ঐক্যবদ্ধভাবে যুদ্ধের প্রস্তাব আসলো কুচক্রী ইহুদীদের পক্ষ থেকে। বনু নযীর ও বনু ওয়াইলের ইহুদীদের একটি সম্মিলিত প্রতিনিধি দল মক্কায় গিয়ে কুরাইশদেরকে মদীনার উপর আক্রমণ করে মুসলমানদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার আহ্বান জানায় এবং এজন্যে তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। সেই তারা আরবের আশ-পাশের গোত্রগুলোকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তুললো। কুরাইশরা তাদেরকে জিজ্ঞেস করলো “ইহুদীগণ! তোমরা তো প্রথম কিতাবের অধিকারী, তোমরাই বলো; আমাদের ধর্ম ভালো না মুহাম্মাদের ধর্ম? তারা বললো, তোমাদের ধর্ম মুহাম্মাদের ধর্ম চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং সত্যের পতাকাবাহী।”
ভাববার বিষয়: মানুষের মান যখন দুনিয়ার বৈষয়ীক স্বার্থের দিকে ঝুকে যায়, তখন তার নিজস্ব ধর্ম, কৃষ্টি-কালচার সব বিসর্জন দিতেও পিছপা হয় না। তা না হলে ইহুদীরা কিতাবধারী হওয়ার পর কি করে মুশরিকদের ধর্ম সঠিক বলে সায় দেয়, এবং বাতিলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সত্যের পতাকাবাহীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। আজকের দুনিয়ায় আমরা ইহুদীদের চেয়েও জঘন্য চরিত্র দেখতে পাচ্ছি তথাকথিত এক শ্রেণীর নামধারী মুসলমানদের ভিতর। ইহুদীরা তো মুশরিকদের সাথে মিলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়েছে। আর আজকে ঐ মুসলমানরা ইহুদী ও মুশরিকদের সাথে হাত মিলিয়ে নিজের জাতি ভাই সত্যের নিশানাবাহীদের বিরুদ্ধে গোপন ও প্রকাশ্য ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। হত্যা করছে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। এটা আল্লাহর নিকট কত বড় জঘন্য কাজ তা আমরা বুঝতে পারবো সূরা নিসার ৫১ – ৫৫ নম্বর আয়াত পর্যন্ত অনুধাবন করলে। যেখানে ইহুদীদের কার্যকলাপের পরিণতির কথা আল্লাহ তুলে ধরেছেন। “ তুমি কি সেই কিতাবধারীদের দেখনি, যারা কিতাবের কিছু অংশ প্রাপ্ত হয়েছে, যারা মান্য করে প্রতিমা ও শয়তানকে এবং কাফেরদেরকে বলে যে, এরা মুসলমানদের তুলনায় অধিকতর সরল সঠিক পথে রয়েছে। এরা হলো সে সমস্ত লোক, যাদের উপর লা‘নত করেছেন আল্লাহ্ তা’আলা ¯¦য়ং। বস্তুতঃ আল্লাহ্ যার উপর লা‘নত করেন তুমি তার কোন সাহায্যকারী খুঁজে পাবে না। তাদের কাছে কি রাজ্যের কোন অংশ আছে? তাহলে যে এরা কাউকেও একটি তিল পরিমাণও দেবে না। নাকি যাকিছু আল্লাহ্ তাদেরকে ¯¦ীয় অনুগ্রহে দান করেছেন সে বিষয়ের জন্য মানুষকে হিংসা করে। অবশ্যই আমি ইব্রাহীমের বংশধরদেরকে কিতাব ও হেকমত দান করেছিলাম আর তাদেরকে দান করেছিলাম বিশাল রাজ্য। অতঃপর তাদের কেউ তাকে মান্য করেছে আবার কেউ তার কাছ থেকে দূরে সরে রয়েছে। বস্তুতঃ (তাদের জন্য) দোযখের শিখায়িত আগুনই যথেষ্ট।” (সূরা নিসা: ৫১-৫৫)
ইহুদীদের পক্ষ থেকে এমন প্রস্তাবের পর কুরাইশরা এটাকে একটা সুবর্ণ সুযোগ হিসেবেই লুফে নিলো। অবশেষে ইহুদী ও কুরাইশদের সবগোত্র মিলে প্রায় ১০ হাজার লোকের একটি বিরাট বাহিনী গঠিত হলো।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা আক্রমণের এই বিপুল আয়োজনের সংবাদ জানতে পেরে তৎক্ষণাত সাহাবীদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। বিখ্যাত সাহাবী সালমান ফারসী (রা.) পরামর্শ দিলেন যে, এত বড় বাহিনীর সাথে খোলা ময়দানে মুকাবিলা করা সমীচীন হবে না। আমাদের সৈন্যদেরকে কোন নিরাপদ স্থানে থাকতে হবে এবং শত্রুরা যাতে সরাসরি আক্রমণ করতে না পারে, সে জন্য পরিখা (খন্দক) কেটে নিতে হবে। এ অভিমতটি সকলের পছন্দ হলো।

যুদ্ধের জন্য মুসলমানদের প্রস্তুতি
মদীনার তিন দিকেই ঘর-বাড়ি ও গাছা দ্বারা পরিবেষ্টিত মাত্র এক দিকে ছিল উন্মুক্ত। যে দিকটা উন্মুক্ত ছিলো সেদিকেই পরিখা খননের সিদ্ধান্ত হয়। মুসলমানেরা যাতে আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় এ কাজে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত হয় সে জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হাতে খননের কাজে অংশগ্রহণ করেন। ফলে মুসলমানরা ব্যাপকভাবে খনন কাজে অংশগ্রহণ করতে থাকে। কেবল কিছু সংখ্যক মুনাফিক নানা রকমের বাহানা দেখিয়ে কাজে ফাঁকি দিতে ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে না জানিয়ে বিনা অনুমতিতে চুপিসারে বাড়ি চলে থাকে। উল্লেখ্য যে খনন কাজে দশ জন করে গ্রুপ করা হয়। প্রত্যেক গ্রুপের অধিনে দশ করে ভাগ করে দেওয়া হয়। পরিখার দৈর্ঘ প্রায় সাড়ে তিন মাইল। প্রস্থ ও গভীরতা ৫ গজ করে। এটা কোন সহজ কাজ ছিলো না। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, খাদ্যের অভাব, যুদ্ধের হুঙ্কার ইত্যাদি প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আল্লাহর দ্বীনকে সমুন্নত রাখতে তারা দিন-রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। খাদ্যের অভাবে ক্ষুধায় কাতর অবস্থায় তারা পেটে পাথর বেঁধে শক্তি যোগানোর ব্যবস্থা করেছেন। স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও পেটে পাথর বেঁধে কাজ করেছেন। মুসলমানরা পূর্ণসহকারে আন্তরিকতার সাথে শুধু আল্লাহর রেজামন্দির জন্য নিরলসভাবে নিজেদেরকে বিলিয়ে দিয়েছেন। তাই তো আল্লাহর তায়ালা তাদের প্রতি রাজি হয়ে আয়াত নাযিল করেছেন।
“ মুমিন তো তারাই; যারা আল্লাহর ও রসুলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং রসূলের সাথে কোন সমষ্টিগত কাজে শরীক হলে তাঁর কাছ থেকে অনুমতি গ্রহণ ব্যতীত চলে যায় না। যারা আপনার কাছে অনুমতি প্রার্থনা করে, তারাই আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে। অতএব তারা আপনার কাছে তাদের কোন কাজের জন্যে অনুমতি চাইলে আপনি তাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা অনুমতি দিন এবং তাদের জন্যে আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, মেহেরবান।” (সূরা নূর: ৬২)
মুসলমানদের মধ্যে যারা নিষ্ঠাবান, সৎকমর্রে প্রতি আগ্রহী এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি অনুগত, তারাই এ আয়াতের আওতায় পড়বে। আর যারা সুযোগ সন্ধানী, সুযোগ পেলেই নানা অজুহাত দেখিয়ে বিপদকালীন সময় সরে যায়, আবার সযোগ মতো ভালো সময় সামনে এসে গেলে নিজেদেরকে একনিষ্ঠভাবে মুসলিম হওয়ার দাবী করে, তাদের এ হঠকারী কাজের পরিণতি কতটা ভয়াবহ হবে তাদের জন্য সে ব্যাপারেও আল্লাহ তা‘আলা আয়াত নাযিল করে তাদেরকে হুঁশিয়ারী দিয়েছেন এভাবে
“রাসূল (সা.)-এরর আহবানকে তোমরা তোমাদের একে অপরকে আহ্বানের মত গণ্য করো না। আল্লাহ তাদেরকে জানেন, যারা তোমাদের মধ্যে চুপিসারে সরে পড়ে। অতএব যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা এ বিষয়ে সতর্ক হোক যে, বিপর্যয় তাদেরকে স্পর্শ করবে অথবা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তাদেরকে গ্রাস করবে। মনে রেখো নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে যা আছে, তা আল্লাহরই। তোমরা যে অবস্থায় আছ তা তিনি জানেন। যেদিন তারা তাঁর কাছে প্রত্যাবর্তিত হবে, সেদিন তিনি বলে দেবেন তারা যা করেছে। আল্লাহ প্রত্যেক বিষয়ই জানেন। (সূরা নূর: ৬৩-৬৪)
সামনে যুদ্ধের ময়দানে যাতে কেউ ঘোলাটে অবস্থার সৃষ্টি করতে সাহস না করে এজন্য আল্লাহ তা‘আলা আগেই সর্তক করে দিলেন।
সম্মিলিত বাহিনীর আক্রমণের প্রস্তুতি:
পরিখা খননের কাজ শেষ হতে না হতেই, ৫ম হিজরীর শাওয়াল মাসে সম্মিলিত শত্রুবাহিনী মদীনার উপকণ্ঠে এসে পৌঁছলো। ওদিকে ইহুদীদের প্ররোচনায় বনু কোরায়যা রাসূল (সা.)-এর সাথে যে চুক্তি ছিলো তা ভঙ্গ করে সম্মিলিত বাহিনীর সাথে একত্মতা ঘোষণা করায় মুসলমানরা আরো বিপদ আসন্ন বলে মনে করতে লাগলো। ইসলামের শত্রুরা বিপুল পরিমাণে থাকা সত্ত্বেও তারা পরিখা সম্পর্কে পূর্ব কোন ধারণাই ছিলো না।
এটা তাদের নিকট সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো। তা সত্ত্বেও সম্মিলিত বাহিনী তিন দলে বিভক্ত হয়ে তিন দিক হতে মদীনার উপর হামলা করার জন্য এগিয়ে আসলো। পরিস্থিতি ছিলো অত্যন্ত প্রচণ্ড ও ভয়াবহ। যা আল্লাহ পাক নিজেই বর্ণনা দিয়েছেন সূরা আহযাবের ১০-১১ আয়াতে। “যখন তারা (শত্রু) তোমাদের নিকটবর্তী হয়েছিল উচ্চভূমি ও নিম্নভূমি থেকে এবং যখন তোমাদের দৃষ্টিভ্রম হচিছল, প্রাণ কণ্ঠাগত হয়েছিল এবং তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে নানা বিরূপ ধারণা পোষণ করতে শুরু করছিলে। সে সময়ে মুমিনগণ পরীক্ষিত হয়েছিল এবং ভীষণভাবে প্রকম্পিত হচ্ছিল।” এটা ছিলো বাস্তবিকই অত্যন্ত কঠিন পরীক্ষার সময়। একদিকে প্রচণ্ড শীত, খাদ্য দ্রব্যের অভাব, উপর্যপরি কয়েক বেলা না খাওয়ায় ক্ষুধার তীব্র জ্বালা, রাতের নিদ্রা, দিনে বিশ্রামের কোন সুযোগ ছিলো না। প্রতিটি মুহূর্ত জীবনের ঝুকি। ছেলে সন্তান, সম্পদ দুশমনের আঘাতের মুখে আর সামনে বিশাল শত্রুবাহিনী। কথায় বলে ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ। মুনাফিকরা তাদের চেহারায় আত্মপ্রকাশ করলো। তারা বিপদকালীন অবস্থায় যা বলে ছিলো, আল্লাহ তা‘আলা সে কথা সূরা আহযাবের ১২ নম্বর আয়াতে উল্লেখ করেছেন এভাবে: “এবং স্মরণ করো সেই সময়ের কথা যখন মুনাফিক ও যাদের অন্তরে রোগ ছিল তারা বলছিল, আমাদেরকে প্রদত্ত আল্লাহ্ ও রসূলের প্রতিশ্রুতি প্রতারণা বৈ অন্য কিছু নয়।” অপর দিকে বনী কুরায়যা চুক্তি ভঙ্গ করে কাফেরদের সাথে যোগ দিলো। মাত্র তিন হাজার মুসলিম বাহিনীর মানসিক অবস্থা কী হতে পারে তা আজ অনুমান করা কঠিন। কিন্তু ঈমানের দাবীতে বলিয়ান, শাহাদাতের তামান্না যাদের অন্তরে, তারা কি বাতিলের হুঙ্কারে দমে যাবে? তা কখনও হতে পারে না। বরং এ কঠিন পরিস্থিতিতে তারা স্বতঃস্ফুর্তভাবে যা বলে ছিলো কথাগুলো আল্লাহ তা‘আলা সূরা আহযাবের ২২-২৩ আয়াতে তুলে ধরেছেন: “যখন মুমিনরা শক্রবাহিনীকে দেখল, তখন বলল, আল্লাহ্ ও তাঁর রসূল এরই ওয়াদা আমাদেরকে দিয়েছিলেন এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূল সত্য বলেছেন। এতে তাদের ঈমান ও আত্মসমর্পণই বৃদ্ধি পেল। মুমিনদের মধ্যে কতক আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা পূর্ণ করেছে। তাদের কেউ কেউ মৃত্যুবরণ করেছে এবং কেউ কেউ প্রতীক্ষা করছে। তারা তাদের সংকল্প মোটেই পরিবর্তন করেনি।”
সম্মিলিত শত্রুবাহিনী প্রায় একমাস মদীনা অবরোধ করে রইলো। যার ফলে মুসলমানদের দু’চার বেলা না খেয়ে কাটাতে হতো। শত্রুসৈন্য পরিখা পার হয়ে আক্রমণ করতে চাইলে, মুসলিম বাহিনী তা দৃঢ়তার সাথে রুখে দিতে লাগলো। কিছুতেই শত্রুসৈন্য পরিখা পার হতে না পেরে তারা পাথর ও তীর ছুড়তে লাগলো। মুসলিম মুজাদিদের পক্ষ থেকে তা প্রতিহত করা হতো। মাঝে মধ্যে দু’একটা বিক্ষিপ্ত আক্রমণ ও কাফেররা করতো যা প্রতিহত করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হতো। এমনকি এর ফলে দু’একবার নামায পর্যন্ত কাযা হয়ে যেত।
অবশেষে আল্লাহর সাহায্য:
অবরোধ দীর্ঘায়িত হতে থাকলো, সম্মিলিত শত্রুবাহিনীর হিম্মতে সাহস ক্রমান্বয়ে দুর্বল হতে লাগলো। তাছাড়া বিশাল বাহিনীর খানাপিনা তাদের জীব-জন্তুর সঠিক ব্যবস্থাপনার সমস্যা হতে লাগলো। এর সাথে প্রচণ্ড শীত। হঠাত একদিন প্রচণ্ড বেগে ধূলিঝড় শুরু হলো এবং সেই সাথে বৃষ্টি। শত্রুবাহিনীর আস্তানা সব লণ্ড-ভণ্ড হয়ে গেল। এটা যে তাদের জন্য আযাব হিসেবেই এসেছে তা বুঝতে বাকি রইল না। আর বাস্তবিকই এটা ছিলো আল্লাহর পক্ষ থেকে মুসলমানদের জন্য রহমত। আর কাফেরদের জন্য আযাব হিসেবেই আল্লাহ প্রেরণ করেছেন, যা সূরা আহযাবের ৯ নম্বর আয়াতে উল্লেখ করেছেন; “হে মুমিনগণ! তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহর নেয়ামতের কথা স¥রণ কর, যখন শত্রুবাহিনী তোমাদের নিকটবর্তী হয়েছিল, অতঃপর আমি তাদের বিরুদ্ধে ঝঞ্চাবায়ু এবং এমন সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেছিলাম, যাদেরকে তোমরা দেখতে না। তোমরা যা কর, আল্লাহ তা দেখেন।” এখানে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীবাহিনীর জন্য শিক্ষণীয় ব্যাপার যে, দীর্ঘ একমাস পর্যন্ত নিষ্ঠার সাথে সংগ্রামের সময় কিন্তু আল্লাহর সাহায্য আসে নি। বিপদ কালীন সময় কঠিনভাবে ধৈর্যের পরীক্ষা চলছিলো। মুজাহিদগণ তাদের সর্বস্ব বিলিয়ে দেওয়ার পর আল্লাহর সাহায্য এসেছে। নিষ্ঠার সাথে তাদের চেষ্টা যখন এগিয়ে চলেছে জান, মাল, সব উজাড় করে দিচ্ছে তখনই আল্লাহর সাহায্য আসবে। আল্লাহর শক্তির সাথে মোকাবালার সাধ্য আছে কার? তাই শত্রুরা ব্যর্থ হয়ে যার যার বাঁচার উপায় খুঁজতে লাগলো। প্রথমেই কু-প্ররোচনা দানকারী ইহুদীরা কেটে পড়লো, অবস্থা বেগতিক, তাই কুরায়েশরা মক্কাভিমুখে রাওয়ানা হলো।
অবশেষে মুসলমানদের উপর থেকে যে মহাবিপদ এসেছিলো তা কেটে গেল। সেময় যেমন আল্লাহর অদৃশ্য সেনাবাহিনী দিয়ে মুসলমানদের সাহায্য করেছেন। আজ এবং আগামীতেও আল্লাহর সাহায্য তাদের জন্য অব্যাহত থাকবে ইনশা আল্লাহ।

Related Post