মসজিদ আল্লাহর নিকটে সর্বাধিক প্রিয় স্থান। (মুসলিম হা/১৫৬০;মিশকাত হা/৬৯৬) সেখানে কেবল তাঁরই ইবাদত করতে হবে। আল্লাহ্ তাআলা বলেন, আর মসজিদ গুলো কেবল মাত্র আল্লাহরই জন্য,কাজেই তোমরা আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে ডেক না (সুরাজিন ১৮ )। মসজিদ মুসলমানদের ইবাদতের স্থান। এখানে আগতদের উদ্দেশ্য হলো কেবল আল্লাহর ইবাদত করা। সুতরাং এখানে প্রবেশের জন্য বিশেষ কিছু আদব রয়েছে এর কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হল।
১- মসজিদে গমনের পথে দোআ :
মসজিদে গমনের পথে রাসূল (ছাঃ) দোআ পড়তেন। আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন,অতঃপর তিনি ছালাতের জন্য বের হলেন। তখন তিনি এ দোআ করছিলেন হে আল্লাহ! আমার হৃদয়ে নূর সৃষ্টি করে দাও,আমার দৃষ্টি শক্তিতে নুর সৃষ্টি করে দাও,আমার পিছন দিকে নুর সৃষ্টি করে দাও,আমার সামনের দিকে নুর সৃষ্টি করে দাও,আমার উপর দিক থেকে নুর সৃষ্টি করে দাও এবং আমার নীচের দিক থেকেও নুর সৃষ্টি করে দাও। হে আল্লাহ! আমাকে নূর দান করো। মুসলিম হা/৭৬৩
২- ওযূ করে মসজিদ অভিমুখে গমন করা :
সুন্দররূপে ওযূ করে মসজিদে যাওয়া উত্তম স্বভাব। রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ) বলেন,যে ব্যক্তি বাড়ী থেকে পাক-পবিত্র হয়ে অর্থাৎ ওযূ করে কোন ফরয ছালাত আদায় করার জন্য হেঁটে আল্লাহর কোন ঘরে অর্থাৎ কোন মসজিদে যায় তার প্রতিটি পদক্ষেপে একটি পাপ ঝরে পড়ে এবং একটি করে মর্যাদা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়।মুসলিম হা/৬৬৬ ১৫৫৩।
৩ – মসজিদে গমনকালে ধীর-স্থিরভাবে চলা :
ছালাতের জন্য মসজিদে গমনকালে তাড়াহুড়া না করে ধীরে-সুস্থে যাওয়া উত্তম। নবী করীম(ছাঃ) বলেছেন,যখন তোমরা এক্বামত শুনতে পাবে,তখন ছালাতের দিকে চলে আসবে,তোমাদের উচিত স্থিরতা ও গাম্ভীর্য অবলম্বন করা। তাড়াহুড়া করবে না। ইমামের সাথে যতটুকু পাও তা আদায় করবে,আর যা ছুটে যায় তা পূর্ণ করবে।বুখারী হা/৬৩৬; মুসলিম হা/৬০৪। তিনি আরো বলেন,ছালাতের এক্বামত হলে আমাকে না দেখা পর্যন্ত তোমরা দাঁড়াবে না। তোমাদের জন্য আবশ্যক হল স্থিরতা অবলম্বন করা।বুখারী হা/৬৩৮।হাসান (রহঃ) হতে বর্ণিত,আবু বকর (রাঃ) বর্ণনা করেন যে,
একদা আল্লাহর নবী রুকূতে থাকাবস্থায় তিনি মসজিদে প্রবেশ করলেন। বর্ণনাকারী বলেন,আমি কাতারে না পৌঁছেই রুকূ করে নিলাম। নবী করীম(ছাঃ) (আমাকে) বললেন,আল্লাহ তোমার আগ্রহ আরো বাড়িয়ে দিন,তবে পুনরায় এরূপ করো না।আবু দাউদ হা/৬৮৩-৬৮৪ সনদ ছহীহ।
৪- মসজিদে প্রবেশ ও বের হওয়ার দোআ পাঠ করা :
মসজিদে প্রবেশ ও বের হওয়ার সময় দোআ পড়া সুন্নাত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,তোমাদের কেউ যখন মসজিদে প্রবেশ করে সে যেন এই দোআ পড়ে আল্লা-হুম্মাফ্তাহলী আবওয়া-বা রাহমাতিকা। অর্থ-হে আল্লাহ্! তুমি আমার উপর তোমার রহমতের দরজাগুলো খুলে দাও। আর যখন বের হয় তখন বলবে,আল্লা-হুম্মা ইন্নী আসআলুকা মিন ফাযলিকা।অর্থ-হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে তোমার অনুগ্রহ কামনা করছি।মুসলিম হা/৭১৩ ১৬৮৫; মিশকাত হা/৭০৩।
৫- তাহিইয়াতুল মসজিদ ছালাত আদায় করা :
মসজিদে প্রবেশ করে বসার পূর্বে দুরাকআত ছালাত আদায় করা সুন্নাত,যাকে তাহিইয়াতুল মসজিদ বলে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,তোমাদের কেউ মসজিদে প্রবেশ করলে দুরাকআত ছালাত আদায় করার পূর্বে বসবে না। অন্যবর্ণনায় রয়েছে সে যেন বসার পূর্বে দুরাকআত ছালাত আদায় করে নেয়।বুখারী হা/১১৬৩;মুসলিম হা/১৬৮৭।
৬- মসজিদে ক্রয়-বিক্রয় না করা ও হারানো জিনিস না খোঁজা :
মসজিদে বেচাকেনা করা ও হারানো জিনিস খোঁজা নিষেধ। রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ) বলেছেন,তোমরা মসজিদের ভিতরে কোন লোককে ক্রয়-বিক্রয় করতে দেখলে বলবে,আল্লাহ তাআলা যেন তোমার ব্যবসায় কোন লাভ প্রদান না করেন। আর মসজিদের মধ্যে কোন লোককে হারানো জিনিসের ঘোষণা দিতে দেখলে বলবে,তোমার হারানো জিনিসকে যেন আল্লাহ তাআলা ফিরিয়ে না দেন।তিরমিযী হা/১৩২১;মিশকাত হা/৭৩৩;ইরওয়া হা/১৪৯৫,
৭- পোষাক ও সাজসজ্জা :
মসজিদে সাধ্যপক্ষে সুন্দর পোষাক পরিধান করে গমন করবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,হে আদম সন্তান! প্রত্যেক ছালাতের সময় তোমরা সাজসজ্জা গ্রহণ কর। আর খাও,পান কর কিন্তু অপচয় করো না,অবশ্যই তিনি অপচয়কারীদের পসন্দ করেন না(আরাফ ৭/৩১)।রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ) বলেন,তোমাদের কেউ যখন ছালাতে দাঁড়াবে সে যেন সুন্দর পোষাক পরিধান করে।, সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৩৬
৮- রসুন-পিঁয়াজ বা অনুরূপ দুর্গন্ধযুক্ত কোন কিছু খেয়ে মসজিদে না যাওয়া :
কাঁচাপিঁয়াজ-রসুন বা এ জাতীয় দুর্গন্ধযুক্ত কোন জিনিস খেয়ে মসজিদে যাওয়া নিষেধ।নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন যে ব্যক্তি পিঁয়াজ,রসুন বা পিঁয়াজ জাতীয় সবজি খাবে সে যেন আমার মসজিদের কাছেও না আসে। কেননা মানুষ যেসব জিনিস দ্বারা কষ্ট পায় ফেরেশতাগণও সেসব জিনিস দ্বারা কষ্ট পায়। বুখারী হা/৮৫৪;মুসলিম হা/৫৬১ অন্যত্র নবী করীম (ছাঃ) বলেন,যে ব্যক্তি এই জাতীয় বৃক্ষ হতে অর্থাৎ কাঁচা রসুন খায় সে যেন অবশ্যই আমাদের মসজিদে না আসে।বুখারী হা/৮৫৪
৯- আযানের পরে মসজিদ থেকে বের না হওয়া :
বিনাওযরে আযানের পরে মসজিদ থেকে বের হওয়া ঠিক নয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন,যখন মুওয়াযযিন আযান দেয়,তখন কেউ যেন ছালাত আদায় না করে মসজিদ থেকে বের না হয়।ছহীহুল জামে হা/২৯৭;মিশকাত হা/১০৭৪
১১- মুছল্লীর সম্মুখ দিয়ে অতিক্রম না করা : নবী করীম (ছাঃ) বলেন,
যদি মুছল্লীর সম্মুখ দিয়ে গমনকারী ব্যক্তির জানা থাকত যে,তার উপর কি পাপের বোঝা চেপেছে,তবে চল্লিশ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকাকেও সে প্রাধান্য দিত। আবু নাছর বলেন,আমি জানি না তিনি চল্লিশ দিন,মাস নাকি বছর বলেছেন।বুখারী হা/৫১০;মুসলিম হা/৫০৭;মিশকাত হা/৭৭৬। অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,তোমাদের কেউ ছালাত আদায় করতে চাইলে যেন সুৎরা সামনে রেখে ছালাত আদায় করে এবং এর নিকটবর্তী হয়। সে যেন তার সামনে দিয়ে কাউকে অতিক্রম করতে না দেয়। অতএব যদি কেউ সামনে দিয়ে অতিক্রম করে,তাহলে সে যেন তার সাথে লড়াই করে। কারণ সে একটা শয়তান। আবু দাউদ হা/৬৯৪-৯৫;ইবনু মাজাহ হা/৯৫৪
১১- মসজিদকে রাস্তা হিসাবে গ্রহণ না করা :
তাসবীহ-তাহলীল,যিকর-আযকার ও ইবাদত ব্যতীত কেবল চলাচলের জন্য মসজিদকে রাস্তা হিসাবে গ্রহণ করতে রাসূল (ছাঃ) নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন তোমরা মসজিদকে রাস্তা হিসাবে গ্রহণ কর না। সেটা কেবল যিকর ও ছালাতের জন্য ।
১২- মসজিদে কণ্ঠস্বর উচ্চ না করা বা শোর-গোল না করা :
মসজিদ ইবাদতের স্থান। সেখানে উচ্চকণ্ঠে কথা বলা ঠিক নয়,যাতে অন্যের ইবাদতে বিঘ্ন ঘটে। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত,তিনি বলেন,রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মসজিদে ইতিকাফ কালে ছাহাবীদেরকে উচ্চৈঃস্বরে ক্বিরাআত পড়তে শুনে পর্দা সরিয়ে বললেন,জেনে রেখ! তোমাদের প্রত্যেকেই স্বীয় রবের সাথে গোপনে মুনাজাতে রত আছো। কাজেই তোমরা পরস্পরকে কষ্ট দিও না এবং পরস্পরের সামনে ক্বিরাআতে অথবা ছালাতে আওয়ায উঁচু করো না।হাকেম,ছহীহাহ হা/১০০১;ছহীহুল জামেহা/৭২১৫
ইবনু ওমর ও আব্দুল্লাহ ইবনু আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত,রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)একদল লোকের নিকট আগমন করলেন,সে সময় তারা ছালাত আদায় করছিল এবং উচ্চকন্ঠে কুরআন তেলাওয়াত করছিল। তা দেখে তিনি বললেন,ছালাত আদায়কারী ছালাতরত অবস্থায় তার প্রতিপালকের সাথে মুনাজাত করে। তাই তার উচিত সে কিরূপে মুনাজাত করে তার প্রতি লক্ষ্য রাখা।অতএব একজনের কুরআন তেলাওয়াতের শব্দ অন্যজনের কানে যেন না পৌঁছে। আবু দাউদ হা/১৩৩২;ছহীহাহ হা/১৫৯৭।
অনুরূপভাবে অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা,গল্প-গুজব,হৈচৈ থেকে বিরত থাকা যরূরী। সায়িব ইবনু ইয়াযীদ (রাঃ) হতে বর্ণিত,তিনি বলেন,আমি মসজিদে নববীতে দাঁড়িয়েছিলাম। এমন সময় একজন লোক আমার দিকে একটা কাঁকর নিক্ষেপ করল। আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে, তিনি ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)। তিনি বললেন,যাও,এ দুজনকে আমার নিকট নিয়ে এসো। আমি তাদেরকে নিয়ে তাঁর নিকটে আসলাম। তিনি বললেন,তোমরা কারা? অথবা তিনি বললেন,তোমরা কোথাকার লোক? তারা বলল,আমরা তায়েফের অধিবাসী। তিনি বললেন,তোমরা যদি মদীনার লোক হতে,তাহলে আমি অবশ্যই তোমাদের কঠোর শাস্তি দিতাম। কারণ তোমরা দুজনে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর মসজিদে উচ্চৈঃস্বরে কথাবলছ। মুওয়াত্ত্বা হা/২৬৪;মিশকাত হা/৮৫৬;ছহীহুল জামে হা/৩৭১৪
১৩- জুনুবী,হায়েয ও নেফাসওয়ালীদের মসজিদে অবস্থান না করা :
গোসল ফরয হওয়ার পর জুনুবী অবস্থায় এবং হায়েয-নেফাস অবস্থায় মসজিদে অবস্থান করা সমীচীন নয়। এমর্মে হাদীছে এসেছে,আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন,একদা নবী করীম (ছাঃ) আমাকে বললেন,মসজিদ থেকে আমাকে মাদুরটি এনে দাও। আমি বললাম,আমি হায়েযা বা ঋতুবতী। তিনি বললেন,তোমার হায়েয তোমার হাতে নেই। বুখারী হা/৪৭০।
১৪- ময়লা-আবর্জনা দ্বারা মসজিদকে অপরিচ্ছন্ন করা থেকে বিরত থাকা :
ময়লা-আবর্জনা ফেলে মসজিদ নোংরা বা অপরিচ্ছন্ন করা নিষেধ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,এ মসজিদ সমূহে পেশাব ও ময়লা দ্বারা অপবিত্রকরণের কোন কাজ করা জায়েয নয়। বরং এটা শুধু আল্লাহর যিকির,ছালাত ও কুরআন পাঠের জন্য।মুসলিম হা/২৯৮;আবু দাউদ হা/২৬১;অনুরূপভাবে থুথু ও কফ মসজিদে ফেলা নিষেধ। রাসূল (ছাঃ) বলেন,মসজিদে থুথু ফেলা পাপ,তার প্রতিকার হল তা মিটিয়ে ফেলা।বুখারী হা/১২২১;মুসলিম হা/২৮৫;অন্য বর্ণনায় এসেছে,আয়েশা (রাঃ) বলেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মসজিদের কিবলার দিকের দেওয়ালে শিকনী বা থুথু অথবা কফ লেগে থাকতে দেখে তা খুচিয়ে উঠালেন।বুখারী হা/৪১৫;মুসলিম হা/৫৫২ অন্য হাদীছে এসেছে,আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মহল্লায় বা জনবসতিপূর্ণ স্থানে মসজিদ নির্মাণ করার এবং তা পরিচ্ছন্ন ও সুগন্ধিময় রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।বুখারী হা/৪০৭;মুসলিম হা/৫৪৯;
১৫- মহিলাদের জন্য মসজিদে গমন ও কাতারবদ্ধ হওয়ার বিধান :
মহিলারা মসজিদে গিয়ে ছালাত আদায় করতে পারে। তবে তাদের জন্য কিছু বিধি-নিষেধ রয়েছে। যেমন (ক) সুগন্ধি না মাখা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,তোমাদের মধ্যে কোন নারী মসজিদে গেলে সে যেন সুগন্ধি ব্যবহার না করে। আবু দাউদ হা/৪৫৫;তিরমিযী হা/৫৯৪,(খ) বেপর্দা হয়ে না আসা এবং সৌন্দর্য প্রকাশ না করা (নূর ২৪/৩০;আহযাব ৩৩/৩৩)। (গ) পিছনের কাতারে দাঁড়ানো। রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ) বলেন ছালাতে পুরুষদের জন্যে সবচেয়ে উত্তম কাতার হল প্রথম কাতার এবং নিকৃষ্টতম কাতার হল পিছনের কাতার। আর মহিলাদের জন্য সবচেয়ে উত্তম কাতার হল পিছনের কাতার এবং সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাতার হল প্রথম কাতার।মুসলিম হা/৪৪৩ ১০২৫;মিশকাত হা/১০৬০।