মালিকের চাহিদা অনুযায়ী সবধরণের প্রযুক্তি ব্যবহার করে নির্দিষ্ট সময়ে নিখুতভাবে সম্পাদন করা, কোন প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি ছাড়া। সুতরাং আমরা যারা এখানে অন্যের অধিনে কর্মরত আছি, তা মালিক কর্তৃক আমানত মনে করে দক্ষতার সাথে নিপুণভাবে সম্পাদন করে যেতে হবে।
প্রতিটি মানুষ বা শ্রমিক আদিষ্ট হয়েছে নিপুণভাবে কাজ সম্পাদন করার জন্যে । নিখুতভাবে কাজ করা ইসলামী শরীয়াহ শ্রমিকের উপর ওয়াজিব করে দিয়েছে। সুতরাং শ্রমিকের উপর মালিকের পক্ষ থেকে কাজ একটি আমানত। কাজটি ছোট হোক কিংবা বড় হোক তা মালিকের পক্ষ থেকে শ্রমিকের উপর আমানত। এই বিষয়ে আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর পক্ষ থেকে বেশ কিছু হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহর রাসূল এরশাদ করেন:
إِنَّ اللَّهَ تَعَالى يُحِبُّ إِذَا عَمِلَ أَحَدُكُمْ عَمَلاً أَنْ يُتْقِنَهُ أخرجه أبو يعلى والطبراني
নিশ্চয় আল্লাহ সেই কাজটি পছন্দ করেন, যখন ব্যক্তি তা নিখুতভাবে সম্পাদন করে।
এখানে ইতকানুল আমল এর অর্থ হলো: এখলাস ফিল আমল। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা ব্যক্তির আমল এখলাস ছাড়া কবূল করেন না। আর ব্যক্তি যে কোন আমল করবে নিয়ত থাকবে যে, এর দ্বারা আল্লাহর সৃষ্টিজীব উপকৃত হবে। আর এই বিষয়টিও লক্ষ্য রাখবে যে, শুধু শ্রম অনুযায়ী কাজ করবে না বরং যেভাবে করলে সুন্দর হয় সেটাই করবে।
রাসূলে কারীম (সা.) এরশাদ করেছেন:
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ يَقُولُ : سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ ، الْإِمَامُ رَاعٍ وَمَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ ، وَالرَّجُلُ رَاعٍ فِي أَهْلِهِ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ ، وَالْمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ فِي بَيْتِ زَوْجِهَا وَمَسْئُولَةٌ عَنْ رَعِيَّتِهَا ، وَالْخَادِمُ رَاعٍ فِي مَالِ سَيِّدِهِ وَمَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ صحيح البخاري
আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। কাজেই প্রত্যেকেই নিজ অধীনস্তদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। যেমন- জনগণের শাসক তাদের দায়িত্বশীল, কাজেই সে তাদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। একজন পুরুষ তার পরিবার পরিজনদের দায়িত্বশীল, কাজেই সে তাদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। স্ত্রী স্বামীর ঘরের এবং তার সন্তানের দায়িত্বশীল, কাজেই সে তাদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। আর গোলাম আপন মনিবের সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণকারী। কাজেই সে বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। শোন! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। কাজেই প্রত্যেকেই আপন অধীনস্তদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। (বুখারী ও মুসলিম)
এই হাদীস থেকে বুঝা যায়, রাষ্ট্রের প্রধান হতে নিম্নের একজন সাধারণ কর্মচারীও দায়িত্বশীল। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী-এমপি, চেয়ারম্যান, মেম্বার, সমাজপতি,এরা যেমন দেশ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণে মনোযোগী হবেন, ঠিক তেমনিভাবে বাবা ও স্বামীর দায়িত্ব পরিবার ঠিক রাখা, আর মা ও স্ত্রীর দায়িত্ব ঘরের আভ্যন্তরীণ বিষয় ও সন্তান লালন পালনে ভূমিকা রাখা। তাই প্রত্যেককে নিজস্ব দায়িত্ব পালনে সচেতন থাকতে হবে।
সুন্দরভাবে কাজ সম্পাদন বিষয়ে আল্লাহর রাসূল (সা.) আরো এরশাদ করেন:
إِذَا قَتَلْتُمْ فَأَحْسِنُوا الْقِتْلَةَ، وَإِذَا ذَبَحْتُمْ، فَأَحْسِنُوا الذِّبْحَةَ، وَلْيُحِدَّ أَحَدُكُمْ شَفْرَتَهُ، وَلْيُرِحْ ذَبِيحَتَهُ
হযরত শাদ্দাদ ইবনে আওছ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহ তায়ালা সব কিছুর ওপর অনুগ্রহকে অপরিহার্য করেছেন। অতএব যখন তোমরা জবাই করবে- তো উত্তম পদ্ধতিতে জবাই করো। প্রত্যেকে তার ছুরিতে শান দেবে এবং তার পশুকে শান্তি দেবে। -সহিহ মুসলিম
অর্থাৎ কাজে নিপুণতার মানে হলো: যে কোন কাজ সুন্দরভাবে করা। এমনকি পশু জবাই করার সময়ও তাকে লক্ষ্য রাখতে হবে যে ছুরিতে ধার আছে কি না? পশুটি জবাই করতে যেনো কষ্ট না হয়।
حكم إتقان العمل ইতকানুল আমল তথা কর্মে দক্ষতার বিধান
সুন্দর ও নিখুতভাবে কাজ করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয। কেননা মুসলমানের প্রত্যেকটি কাজই ইবাদত। যখন ব্যক্তি খালেস নিয়তে আমানত ও দায়িত্বশীলতার সাথে তা সম্পাদন করে।
মহান আল্লাহ ঘোষণা করছেন:
وَقُلِ اعْمَلُوا فَسَيَرَى اللهُ عَمَلَكُمْ وَرَسُولُهُ وَالْمُؤْمِنُونَ ۖ وَسَتُرَدُّونَ إِلَىٰ عَالِمِ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ فَيُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ
আর তুমি বলে দাও, তোমরা আমল করে যাও, তার পরবর্তীতে আল্লাহ দেখবেন তোমাদের কাজ এবং দেখবেন রসূল ও মুসলমানগণ। তাছাড়া তোমরা শীগ্রই প্রত্যাবর্তিত হবে তাঁর সান্নিধ্যে যিনি গোপন ও প্রকাশ্য বিষয়ে অবগত। তারপর তিনি জানিয়ে দেবেন তোমাদেরকে যা করতে।
এই আয়াত থেকেও বুঝা যায় যে, কাজগুলো সুন্দরভাবে সম্পাদন করতে হবে। কেননা আল্লাহ এবং রাসূল ও মুমিনগণ কাজ দেখবেন। এবং এই কাজের উপর তার নেকী নির্ভরশীল। অর্থাৎ যার কাজ যত সুন্দর, তার নেকী ততবেশি। আল্লাহ আমাদের সকলকে সুন্দরভাবে যাবতীয় কাজ করার তাওফীক দান করুন। আমীন
أهمية إتقان العمل দক্ষতার সাথে কাজ করার গুরুত্ব:
روى أَبو مُوسَى الأَشْعَرِيِّ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ جَدِّهِ، قَالَ: قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: (عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ صَدَقَةٌ قَالُوا: فَإِنْ لَمْ يَجِدْ؟ قَالَ: فَيَعْمَلُ بِيَدَيْهِ فَيَنْفَعُ نَفْسَهُ وَيَتَصَدَّقُ، قَالُوا: فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ أَوْ لَمْ يَفْعَلْ؟ قَالَ: فَيُعِينُ ذَا الحَاجَةِ المَلْهُوفَ، قَالُوا: فَإِنْ لَمْ يَفْعَلْ؟ قَالَ: فَيَأْمُرُ بِالخَيْرِ،أَوْ قَالَ: بِالْمَعْرُوفِ، قَالَ: فَإِنْ لَمْ يَفْعَلْ؟ قَالَ: فَيُمْسِكُ عَنِ الشَّرِّ فَإِنَّهُ لَهُ صَدَقَةٌ
রাসূলে কারীম (সা.) বলেন: প্রত্যেক মুসলিমের উপর সাদকা করা ওয়াজিব। প্রশ্ন করা হলো যদি সাদকা করার জন্য কিছু না পায়, তিনি বললেন, তবে সে নিজ হাতে উপার্জন করবে এবং নিজে উপকৃত হবে ও সাদকরা করবে। পুনরায় জিজ্ঞাসা করা হলো যদি সে এতেও সক্ষম না হয় তবে কি হবে? তিনি বললেন, তাহলে সে অসহায় আর্ত মানুষের সাহায্য করবে। রাবী বলেন, আবার জিজ্ঞাসা করা হলো যদি সে এতেও সক্ষম না হয়? তিনি বললেন, তাহলে সৎকাজের কিংবা কল্যাণের আদেশ করবে। আবারো জিজ্ঞাসা করা হলো, যদি সে তাও না করে, তিনি বললেন: মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকবে। কেননা এটাও সদাকা। (মুসলিম)
এই হাদীস হতে জানা গেলো মুসলমানের সমস্ত নেক কাজগুলো সাদাকাহ। সুতরাং তাদের উচিত অন্যের উপকার হয় এমন কাজ করা।
এই হাদীসে একথার দিকেও ইঙ্গিত করা হয়েছে; যে অক্ষম ব্যক্তিকেও চেষ্টা সাধনা করতে হবে, নিজ হাতে কাজ সম্পাদন করতে হবে। নিজের জন্য খরচ করবে, পরিবারের পেছনে খরচ করবে, এবং সাধারণভাবে দান খয়রাত করবে।
এই হাদীস হতে একথাও জানা গেলো যে, কল্যাণের পথ অনেক। এক পথে কাজ না হলে অন্য পথ ধারণ করবে।
এসব ক্ষেত্রে লোক দেখানো আমল হতে বিরত থাকতে হবে। কারণ যে কোনো ভালো কাজ লোক দেখানো নিয়তে করলে তা নিষ্ফল হয়ে যায়। আল্লাহ আমাদেরকে খালেস নিয়তে আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন
ইসলামে ইতকানুল আমলের গুরুত্ব:
দক্ষতা ও নিপুণতার সাথে কাজ করা ইসলামে এর গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা এটি হালাল উপার্জনের একটি মাধ্যম। বরং এটি একটি স্বতন্ত্র ইবাদত। কেননা ইসলামী জীবন বিধান মানুষকে সুন্দর পথে ও কর্মের দিকে আহ্বান করে। অলসতা ও ব্যর্থতাকে নিরুত্সাহিত করে। আর কর্মে সফলতা আনতে হলে ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যেতে হবে। ইসলামী জীবন বিধানে উত্তম কাজগুলোকে ইবাদত হিসেবে শামিল করেছে।
যেমন মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে:
عَنْ جَابِرٍ رضي الله عنه قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَغْرِسُ غَرْسًا ، إِلَّا كَانَ مَا أُكِلَ مِنْهُ لَهُ صَدَقَةً ، وَمَا سُرِقَ مِنْهُ لَهُ صَدَقَةٌ ، وَمَا أَكَلَ السَّبُعُ مِنْهُ فَهُوَ لَهُ صَدَقَةٌ ، وَمَا أَكَلَتِ الطَّيْرُ فَهُوَ لَهُ صَدَقَةٌ ، وَلَا يَرْزَؤُهُ أَحَدٌ ، إِلَّا كَانَ لَهُ صَدَقَةٌ ” .
জাবির (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে কোন মুসলিম ফলজ (এমন গাছ যা ফল দেয়) বৃক্ষ রোপন করবে তা থেকে যা কিছু খাওয়া হয় তা তার জন্যে দান স্বরূপ, যা কিছু চুরি হয় তাও দান স্বরূপ, বন্য জন্তু যা খেয়ে নেয় তাও দান স্বরূপ। পাখী যা খেয়ে নেয় তাও দান স্বরূপ। আর কেউ কিছু নিয়ে গেলে তাও তার জন্যে দান স্বরূপ। (বুখারী) (ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৩৮২৪, ইসলামিক সেন্টার ৩৮২৩)
ইতকানুল আমলের কিছু উপকারিতা:
১। সাওয়াব বা প্রতিধান অপেক্ষা করছে পরকালে, যারা দুনিয়ায় খালেস নিয়তে দক্ষতা ও নিপুণভাবে কাজ সম্পাদন করে।
২। একজন দক্ষ কারীগর সফলতার সুযোগ পেয়ে থাকেন। তার এই নিপুণতা তাকে সফলতার শীর্ষে উপনীত করে।
৩। কর্মে দক্ষ ব্যক্তি রিয়ামুক্ত হয়ে কাজ করে। এবং নেফাকী থেকে দূরত্ব বজায় রাখে। এবং প্রত্যেক কাজে তিনি আত্মসমালোচনা করেন।
পরিশেষে একটি ঘটনা বলে আজকের আলোচনা শেষ করবো ইনশা আল্লাহ
- এক রাজমিস্ত্রীর ঘটনা, যিনি দীর্ঘ সময় নিয়ে কোম্পানীতে নিপুণভাবে দক্ষতার সাথে ভবণ নির্মাণের কাজ করে যাচ্ছিল। বয়স বেশি হওয়ার কারণে কোম্পানীকে বললো, এখন আর আমার পক্ষে কাজ করা সম্ভব না। তাই আমি অবসর গ্রহণ করতে চাই। আমাকে হিসাব পত্র দিয়ে দিন। বাকী সময়টা পরিবারের সাথে কাটাতে চাই।
- কোম্পানীর ম্যানেজার তাকে এক শর্তে বিদায় দিতে রাজি হলেন। স্মৃতি হিসেবে একটি ভবণ তৈরি করবেন, তবেই আপনাকে বিদায় দেওয়া হবে।
- রাজমিস্ত্রী রাজি হলেন। মিস্ত্রী ভবণ নির্মাণ কাজে খুব তাড়াহুড়ো করলো, পূর্বের মত সুন্দরভাবে তৈরী করলো না। কারণ যত দ্রুত কাজ শেষ হবে, তত দ্রুতই অবসর গ্রহণ করা যাবে। এই ভেবে অল্প সময়ের মধ্যেই ভবণ নির্মাণের কাজ শেষ করে ফেললো।
- এবং নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করে ম্যানেজারকে বিল্ডিং হস্তান্তর করলো।
- ম্যানেজার খুশি হলেন এবং তাকে বললেন, আপনি সারা জীবন যে কাজ করে কোম্পানীকে লাভবান করেছেন, তার বিনিময়ে আপনাকে কোম্পানী এই ভবণ হাদিয়া হিসেবে প্রদান করেছে।
- ম্যানেজারের অফার শুনে মিস্ত্রী অনেক বড় ধাক্কা খেলো। এবং লজ্জিত হলো, আর বলতে লাগলো, হায় জীবনের শেষ উপার্জনটি সুন্দরভাবে তৈরী করলাম না!
সম্মানিত পাঠক! এভাবে আমাদের ইবাদতগুলো বেখায়ালে ও একাগ্রতা ছাড়া আদায় করা হয়, কে বলতে পারবে যে এটি আমার জীবনের শেষ এবাদত না। মনে রাখবেন যে, ব্যক্তির সমস্ত আমল শেষ পর্যন্ত নিজেরই থাকবে। আল্লাহ কারো ইবাদতের মুখাপেক্ষী না। প্রত্যেক ব্যক্তিই আমল ও সাওয়াবে মুখাপেক্ষী। সুতরাং এমনভাবে নামায পড়তে হবে যেন এটি আমার জীবনের শেষ নামায। আল্লাহ আমাদের সকলকে সেই তাওফীক দান করুন। আমীন