যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিন ও আরাফা দিবসের ফযীলত

যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিন ও আরাফা দিবসের ফযীলত

যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিন ও আরাফা দিবসের ফযীলত

আমরা কিভাবে যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিনকে স্বাগত জানাবো? স্বাগত জানাতে হবে খাঁটি মনে তাওবা করে:

খাঁটি মনে তওবা করা

তওবার অর্থ প্রত্যাবর্তন বা ফিরে যাওয়া ফিরে আসা। যে সকল কথা ও কাজ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অপছন্দ করেন তা থেকে যে সকল কথা ও কাজ আল্লাহ পছন্দ করেন তাঁর দিকে ফিরে আসার নাম তওবা— হোক এ সকল কাজ প্রকাশ্যে বা গোপনে। সাথে সাথে অতীতের এ ধরনের কাজ থেকে অনুতপ্ত হতে হবে, কাজগুলো ত্যাগ করতে হবে ও দৃঢ় সংকল্প করতে হবে যে ঐ ধরনের কাজ আর কোন দিন করব না। আরো সংকল্প করতে হবে যে, আল্লাহ তাআলার পছন্দনীয় কাজ যেমন আদায় করব তেমনি তার নিষিদ্ধ কাজগুলো পরিহার করব।

যখনই কোন পাপ কাজ সংঘটিত হবে তখন সাথে সাথে তা থেকে তওবা করা একজন মুসলিমের জন্য ওয়াজিব।

যিলহজ্জের প্রথম দশকের ফযীলত:

ক. সাহাবী ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন:

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رضي الله عنهما قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : مَا مِنْ أيَّامٍ العَمَلُ الصَّالِحُ فِيهِنَّ أحَبُّ إلى اللهِ مِنْ هَذهِ الأيَّامِ العَشْرِ، فقالُوا يا رسولَ اللهِ: وَلَا الجِهَادُ في سَبِيلِ اللهِ؟

 فقال رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ولَا الجِهَادُ في سَبِيلِ اللهِ، إلَّا رَجُلٌ خَرجَ بِنَفْسِهِ ومَالِهِ، فَلَمْ يَرْجِعْ من ذَلِكَ بِشَيْءٍ. رواه البخاري

যিলহজ্ব মাসের প্রথম দশ দিনে নেক আমল করার মত প্রিয় আল্লাহর নিকট আর কোন আমল নেই। তারা প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর পথে জিহাদ করা কি তার চেয়ে প্রিয় নয়? রাসূল (সা.) বললেন : না, আল্লাহর পথে জিহাদও নয়। তবে ঐ ব্যক্তির কথা আলাদা যে তার প্রাণ ও সম্পদ নিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদে বের হয়ে গেল অতঃপর তার প্রাণ ও সম্পদের কিছুই ফিরে এল না। (বুখারী ও তিরমিযী)

খ. আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত; রাসূল (সা.) বলেছেন:

مَا مِنْ أَيَّامٍ أَعْظَمُ عِنْدَ اللهِ وَلَا أَحَبُّ إِلَيْهِ مِنَ الْعَمَلِ فِيهِنَّ مِنْ هَذِهِ الْأَيَّامِ الْعَشْرِ فَأَكْثِرُوا فِيهِنَّ مِنَ التَّهْلِيلِ وَالتَّكْبِيرِ وَالتَّحْمِيدِ – رواه أحمد

এ দশ দিনে (নেক) আমল করার চেয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে প্রিয় ও মহান কোন আমল নেই। তোমরা এ সময়ে তাহলীল (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ) তাকবীর (আল্লাহু আকবার) তাহমীদ (আল-হামদুলিল্লাহ) বেশি করে পাঠ কর। (আহমদ)

এ দুই হাদীসের অর্থ হল- বছরে যতগুলো পবিত্র দিন আছে তার মাঝে এ দশ দিনের প্রতিটি দিন হল সর্বোত্তম। যেমন- এ দশ দিনের অন্তর্গত কোন জুমআর দিন অন্য সময়ের জুমআর দিন থেকে উত্তম বলে বিবেচিত।

গ. যিলহজ্ব মাসের প্রথম দশকে রয়েছে আরাফা ও কুরবানীর দিন। আর এ দুটো দিনের রয়েছে অনেক বড় মর্যাদা। যেমন- হাদীসে এসেছে;

قَالَتْ عَائِشَةُ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا إِنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ مَا مِنْ يَوْمٍ أَكْثَرَ مِنْ أَنْ يُعْتِقَ اللهُ فِيهِ عَبْدًا مِنَ النَّارِ مِنْ يَوْمِ عَرَفَةَ وَإِنَّهُ لَيَدْنُو ثُمَّ يُبَاهِي بِهِمْ الْمَلَائِكَةَ فَيَقُولُ مَا أَرَادَ هَؤُلَاءِ. )رواه مسلم (1348

 আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসূল (সা.) বলেন: ‘আরাফার দিন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার বান্দাদের এত অধিক সংখ্যক মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন যা অন্য দিনে দেন না। তিনি এ দিনে বান্দাদের নিকটবর্তী হন ও তাদের নিয়ে ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করে বলেন তোমরা কি বলতে পার আমার এ বান্দাগণ আমার কাছে কি চায়? (মুসলিম: ১৩৪৮)

এই দশ দিনে আমল করলে দ্বিগুণ সাওয়াব লাভ হয়:

পৃথিবীর উত্তম দিন হলো যিলহজ্জের প্রথম দশদিন। এ মর্মে রাসূলে কারীম (সা.) বলেন:

عَنْ جَابِرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللهِ قَالَ: أَفْضَلُ أَيَّامِ الدُّنْيَا الْعَشْرُ»، يَعْنِي عَشْرَ ذِي الْحِجَّةِ. قِيلَ: وَلاَ مِثْلُهُنَّ فِي سَبِيلِ اللهِ؟ قَالَ: (وَلاَ مِثْلُهُنَّ فِي سَبِيلِ اللهِ إلاَّ رَجُلٌ عُفِّرَ وَجْهُهُ بِالتُّرَابِ) [رواه البزار بإسناد حسن، وأبو يعلى بإسناد صحيح،وابن حبان في صحيحه، وصححه الألباني]

হাদীসটি হযরত জাবের (রা.) হতে বর্ণিত রাসূলে কারীম (সা.) বলেছেন: দুনিয়ার উত্তম দিন হলো যিলহজ্জের প্রথম ১০ দিন। রাসূলকে জিজ্ঞেস করা হলো; আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা কি এর চেয়ে উত্তম না? তিনি বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করাও না! তবে যিনি তার চেহরাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছেন। (শহীদ হয়েছেন, তার কথা ভিন্ন)

নিয়মিত ফরজ ও ওয়াজিবসমূহ আদায়ে যত্নবান হওয়া:

অর্থাৎ ফরজ ও ওয়াজিবসমূহ সময়-মত সুন্দর ও পরিপূর্ণভাবে আদায় করা। যেভাবে আদায় করেছেন প্রিয় নবী স.। সকল এবাদতসমূহ তার সুন্নত, মুস্তাহাব ও আদব সহকারে আদায় করা। হাদীসে এসেছে—

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ اللهَ قَالَ: مَنْ عَادَى لِي وَلِيًّا فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالْحَرْبِ وَمَا تَقَرَّبَ إِلَيَّ عَبْدِي بِشَيْءٍ أَحَبَّ إِلَيَّ مِمَّا افْتَرَضْتُ عَلَيْهِ وَمَا يَزَالُ عَبْدِي يَتَقَرَّبُ إِلَيَّ بِالنَّوَافِلِ حَتَّى أُحِبَّهُ فَإِذَا أَحْبَبْتُهُ كُنْتُ سَمْعَهُ الَّذِي يَسْمَعُ بِهِ وَبَصَرَهُ الَّذِي يُبْصِرُ بِهِ وَيَدَهُ الَّتِي يَبْطِشُ بِهَا وَرِجْلَهُ الَّتِي يَمْشِي بِهَا وَإِنْ سَأَلَنِي لَأُعْطِيَنَّهُ وَلَئِنِ اسْتَعَاذَنِي لَأُعِيْذَنَّهُ وَمَا تَرَدَّدْتُ عَنْ شَيْءٍ أَنَا فَاعِلُهُ تَرَدُّدِي عَنْ نَفْسِ الْمُؤْمِنِ يَكْرَهُ الْمَوْتَ وَأَنَا أَكْرَهُ مَسَاءَتَهُ)  رواه البخاري (

 আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: আল্লাহ তাআলা বলেন,‘যে ব্যক্তি আমার কোন অলির সঙ্গে শত্রুতা রাখে,আমি তার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করি। আমার বান্দা ফরজ এবাদতের চাইতে আমার কাছে অধিক প্রিয় কোন এবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করতে পারে না। আমার বান্দা নফল এবাদত দ্বারাই সর্বদা আমার নৈকট্য অর্জন করতে থাকে। এমনকি অবশেষে আমি তাকে আমার এমন প্রিয়পাত্র বানিয়ে নেই যে, আমি তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শুনে। আমি তার চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দেখে। আর আমিই তার হাত হয়ে যাই,যা দিয়ে সে ধরে। আমি তার পা হয়ে যাই, যা দিয়ে সে চলে। সে আমার কাছে কোন কিছু চাইলে আমি অবশ্যই তাকে তা দান করি। আর যদি সে আমার কাছে আশ্রয় চায় আমি তাকে অবশ্যই আশ্রয় দেই। আমি যে কোন কাজ করতে চাইলে তাতে কোন রকম দ্বিধা-সংকোচ করি না, যতটা দ্বিধা-সংকোচ করি মোমিন বান্দার প্রাণ হরণে। সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে থাকে অথচ আমি তার বেঁচে থাকাকে অপছন্দ করি।’(বুখারী)

এ হাদীসে কুদসীতে অনেকগুলো বিষয় আলোচিত হয়েছে। এর মাঝে একটি হল, ফরজ এবাদতসমূহ আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়। আর নফল (যা ফরজ নয়) এবাদত আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম। যদি ফরজ ও নফল এবাদতসমূহ যত্নসহকারে যথাযথ নিয়মে আদায় করা যায় তবে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের এমন নৈকট্য অর্জন করা যাবে যা তিনি এ হাদীসে উল্লেখ করেছেন। আমরা তার এবাদতে কীভাবে যত্নবান হতে পারি এ সম্পর্কে এ হাদীসের ব্যাখ্যায় হাফেজ ইবনে হাজার রহ. বলেন : ফরজসমূহ যত্নের সাথে আদায় করার অর্থ হল : আল্লাহর নির্দেশ পালন করা, তার নির্দেশকে সম্মান করা, মর্যাদা দেয়া, তাঁর আইনের সামনে শ্রদ্ধায় মস্তক অবনত করা, আল্লাহর রবুবিয়্যতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও তার দাসত্বকে মনে প্রাণে মেনে নেয়া। আমলগুলো এভাবে যত্নসহকারে আদায় করতে পারলে আল্লাহর সেই নৈকট্য অর্জন করা যাবে যা তিনি এ হাদীসে বলেছেন।

ফরজ-ওয়াজিবসমূহ যত্নসহকারে নিয়ম মাফিক আদায় করা: এমন একটি গুণ যার প্রশংসা আল্লাহ তাআলা তার কালামে পাকে করেছেন। বলেছেন :—

وَالَّذِينَ هُمْ عَلَى صَلَاتِهِمْ يُحَافِظُونَ المعارج  এবং যারা নিজেদের সালাতে যত্নবান।’    

তাই আসুন! আমরা এ পবিত্র দিনগুলোতে আল্লাহর ভালোবাসা ও নৈকট্য লাভের কর্মসূচি বাস্তবায়নের অনুশীলন করে অধিক সওয়াব ও প্রতিদান লাভ করতে চেষ্টা করি।

বেশি করে নেক আমল করা:

নেক আমল সকল স্থানে ও সর্বদাই আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নিকট প্রিয়। তবে এই বরকতময় দিনগুলোতে নেক আমলের মর্যাদা ও সওয়াব অনেক বেশি।

যারা এ দিনগুলোতে হজ্জ আদায়ের সুযোগ পেলেন তারা তো ভাগ্যবান—সন্দেহ নেই। আর যারা হজ্জে যেতে পারেননি তাদের উচিত হবে এ বরকতময় দিনগুলোকে মর্যাদা দিয়ে বেশি বেশি করে সালাত আদায়, কুরআন তেলাওয়াত, জিকির-আযকার, দোয়া-প্রার্থনা, দান-সদকা, মাতা-পিতার সাথে সুন্দর আচরণ, আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্ক গভীর করা, সৎকাজের আদেশ এবং অন্যায় ও অসৎ কাজের নিষেধ করাসহ প্রভৃতি ভাল কাজ সম্পাদন করা। যেমন ইতোপূর্বে হাদীসে আলোচিত হয়েছে যে বেশি বেশি করে নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের বিশেষ মহব্বত অর্জন করা যায়। (আমার বান্দা নফল এবাদত দ্বারাই সর্বদা আমার নৈকট্য অর্জন করতে থাকবে।)

আল্লাহ তাআলার জিকির করা:

এ দিনসমূহে অন্যান্য আমলের মাঝে জিকিরের এক বিশেষ মর্যাদা রয়েছে, যেমন হাদীসে এসেছে :—

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا-عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ – قَالَ مَا مِنْ أَيَّامٍ أَعْظَمُ عِنْدَ اللهِ وَلَا أَحَبُّ إِلَيْهِ مِنَ الْعَمَلِ فِيهِنَّ مِنْ هَذِهِ الْأَيَّامِ الْعَشْرِ فَأَكْثِرُوا فِيهِنَّ مِنَ التَّهْلِيلِ وَالتَّكْبِيرِ وَالتَّحْمِيدِ  رواه أحمد

আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম (সা.) বলেছেন: এ দশ দিনে (নেক) আমল করার চেয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে প্রিয় ও মহান কোন আমল নেই। তোমরা এ সময়ে তাহলীল (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ) তাকবীর (আল্লাহু আকবার) তাহমীদ (আল-হামদুলিল্লাহ) বেশি করে আদায় কর।

ইসলাম ধর্মের পূর্ণতা লাভ, বিশ্ব মুসলিমের প্রতি আল্লাহর নিয়ামতের পরিপূর্ণতা প্রাপ্তির দিন হাদীসে এসেছে—

قَالَتْ الْيَهُودُ لِعُمَرَ إِنَّكُمْ تَقْرَءُونَ آيَةً لَوْ نَزَلَتْ فِينَا لَاتَّخَذْنَاهَا عِيدًا فَقَالَ عُمَرُ إِنِّي لأَعْلَمُ حَيْثُ أُنْزِلَتْ وَأَيْنَ أُنْزِلَتْ وَأَيْنَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حِينَ أُنْزِلَتْ يَوْمَ عَرَفَةَ وَإِنَّا وَاللَّهِ بِعَرَفَةَ قَالَ سُفْيَانُ وَأَشُكُّ كَانَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ أَمْ لا:  الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ) (المائدة: 3) [رواه البخاري ومسلم]

ইমাম বুখারি রহ. তার নিজ সূত্রে তারিক বিন শিহাব রহ. থেকে বর্ণনা করেন যে ইহুদীরা উমর রা.-কে বলল : আপনারা এমন একটি আয়াত তেলাওয়াত করে থাকেন যদি সে আয়াতটি আমাদের প্রতি অবতীর্ণ হতো তাহলে আমরা সে দিনটিকে ঈদ হিসেবে উদযাপন করতাম। উমর রা. এ কথা শুনে বললেন : আমি অবশ্যই জানি কখন তা অবতীর্ণ হয়েছে, কোথায় তা অবতীর্ণ হয়েছে, আর অবতীর্ণ হওয়ার সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) কোথায় ছিলেন। হা,সে দিনটি হল আরাফাহ দিবস, আল্লাহর শপথ! আমরা সে দিন আরাফাতের ময়দানে ছিলাম। আয়াতটি হল: আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জীবন বিধান হিসেবে মনোনীত করলাম । (বুখারী: ৪৬০৬)

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে রজব রহ. সহ অনেক উলামায়ে কেরাম বলেছেন যে এ আয়াত নাযিলের পূর্বে মুসলিমগণ ফরজ হিসেবে হজ্জ আদায় করেননি। তাই হজ্জ ফরজ হিসেবে আদায় করার মাধ্যমে দ্বীনে ইসলামের পাঁচটি ভিত্তি মজবুত ভাবে প্রতিষ্ঠিত হল।

এ দিন হল ঈদের দিনসমূহের একটি দিন। হাদীসে এসেছে :

رَوَى أَبُوْ دَاوُدَ عَنْ أَبِيْ أٌمَامَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: إِنَّ يَوْمَ عَرَفَةَ ، وَيَوْمَ النَّحْرِ ، وَأَيَّامَ التَّشْرِيقِ ، عِيدُنَا أَهْلَ الإِسْلامِ ، وَهِيَ أَيَّامُ أَكْلٍ وَشُرْبٍ صححه الألباني في صحيح أبي داود برقم 2114

ইমাম আবু দাউদ (রহ.) সাহাবি আবু উমামাহ (রা.) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: আরাফাহ দিবস, কুরবানির দিন, ও আইয়ামে তাশরীক (কোরবানি পরবর্তী তিন দিন) আমাদের ইসলামের অনুসারীদের ঈদের দিন। আর এ দিনগুলো খাওয়া-দাওয়ার দিন। (আবু দাউদ: ২১১৪) (হাজীদের জন্য আরাফার দিন ঈদ আর যারা হজ্জ করতে যাননি, তাদের জন্য রোযার বিধান রয়েছে।)

আরাফাহ দিবসের ফযীলত:

আরাফাহ দিবস হল এক মর্যাদাসম্পন্ন দিন। যিলহজ্জ মাসের নবম তারিখকে আরাফাহ দিবস বলা হয়।

এ দিনটি অন্যান্য অনেক ফযীলত সম্পন্ন দিনের চেয়ে বেশি মর্যাদার অধিকারী। যে সকল কারণে এ দিবসটির এত মর্যাদা তার কয়েকটি  নিচে আলোচিত হল :—

আরাফাহ দিবসের রোজা দু বছরের কাফ্ফারা: যেমন হাদীসে এসেছে—

 رَوَى مُسْلِمٌ عَنْ أَبِيْ قَتَادَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ، أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ. وَالسَّنةَ الَّتِي بَعْدَهُ

সাহাবি আবু কাতাদাহ রা. থেকে বর্ণিত যে রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে আরাফাহ দিবসের সওম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন: ‘বিগত ও আগত বছরের গুনাহের কাফ্ফারা হিসেবে গ্রহণ করা হয়ে থাকে।’(মুসলিম)

আরাফার দিন গুনাহ মাফ ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের দিন

যেমন হাদীসে এসেছে—

عن عَائِشَة رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ: إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ مَا مِنْ يَوْمٍ أَكْثَرَ مِنْ أَنْ يُعْتِقَ اللهُ فِيهِ عَبْدًا مِنَ النَّارِ مِنْ يَوْمِ عَرَفَةَ وَإِنَّهُ لَيَدْنُو ثُمَّ يُبَاهِي بِهِمْ الْمَلَائِكَةَ فَيَقُولُ مَا أَرَادَ هَؤُلَاءِ. رواه مسلم

আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন: ‘আরাফার দিন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার বান্দাদের এত অধিক সংখ্যক জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন যা অন্য দিনে দেন না। তিনি এ দিনে বান্দাদের নিকটবর্তী হন ও তাদের নিয়ে ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করে বলেন : ‘তোমরা কি বলতে পার আমার এ বান্দাগণ আমার কাছে কি চায় ?’(মুসলিম)

ইমাম নবভী রহ. বলেন : এ হাদীসটি আরাফাহর দিবসের ফযীলতের একটি স্পষ্ট প্রমাণ।

ইবনে আব্দুল বার বলেন : এ দিনে মুমিন বান্দারা ক্ষমাপ্রাপ্ত হন। কেননা, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন গুনাহগারদের নিয়ে ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করেন না। তবে তওবা করার মাধ্যমে ক্ষমা-প্রাপ্তির পরই তা সম্ভব।

উচ্চস্বরে তাকবীর পাঠ করা

এ দিনগুলোতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের মহত্ত্ব ঘোষণার উদ্দেশ্যে তাকবীর পাঠ করা সুন্নত। এ তাকবীর প্রকাশ্যে ও উচ্চস্বরে মসজিদ, বাড়ি-ঘর, রাস্তা-ঘাট, বাজারসহ সর্বত্র উচ্চ আওয়াজে পাঠ করা হবে। তবে মেয়েরা নিচু-স্বরে পাঠ করবে। তাকবীর হল :—

اَللهُ أَكْبَرُ، اَللهُ أَكْبَرُ، لَاإِلَهَ إِلاَّ اللهُ، وَاللهُ أَكْبَرُ، اللهُ أَكْبَرُ وَلِلّٰهِ الحَمْدُ

আজকে আমাদের সমাজে এ সুন্নতটি পরিত্যাজ্য হয়েছে বলে মনে হয়। এর আমল দেখা যায় না। তাই আমাদের উচিত হবে এ সুন্নতটির প্রচলন করা। এতে তাকবীর বলার সওয়াব অর্জন হবে ও সাথে সাথে একটি মিটে যাওয়া সুন্নত জীবিত করার সওয়াব পাওয়া যাবে।

 

হাদীসে এসেছে :

قَالَ رَسَوْلُ اللهِ- صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ  : مَنْ أَحْيَا سُنَّةً مِنْ سُنَّتِي أُمِيتَتْ بَعْدِي كَانَ لَهُ مِنَ الأَجْرِ مِثْلُ مَنْ عَمِلَ بِهَا مِنْ غَيْرِ أَنْ يَنْقُصَ مِنْ أُجُورِهِمْ شَيْءٌ، رواه الترمذي 677 وابن ماجه 209

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : ‘আমার ইন্তেকালের পরে যে সুন্নতটির মৃত্যু হয়েছে তা যে জীবিত করবে সে ব্যক্তি এ সুন্নত আমলকারীদের সওয়াবের পরিমাণ সওয়াব পাবে এবং তাতে আমলকারীদের সওয়াবে কোন অংশ কম হবে না।’(তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ)

বুখারীতে এসেছে :

وَكَانَ ابْنُ عُمَرَ، وَأَبُو هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا: يَخْرُجَانِ إِلَى السُّوقِ فِي أَيَّامِ العَشْرِ يُكَبِّرَانِ، وَيُكَبِّرُ النَّاسُ بِتَكْبِيرِهِمَا. صحيح البخاري ،كتاب العيدين : باب فضل العمل في أيام التشريق.

সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. ও আবু হুরাইরা রা. যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশকে বাজারে যেতেন ও তাকবীর পাঠ করতেন, লোকজনও তাদের অনুসরণ করে তাকবীর পাঠ করতেন।  অর্থাৎ আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর এই দুই প্রিয় সাহাবি লোকজনকে তাকবীর পাঠের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন।

একটি জিজ্ঞাসা: রমযানের শেষ দশক অধিক ফযীলতপূর্ণ না কি যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিন বেশি ফযীলতসম্পন্ন ?

জবাব: যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিবস অধিক ফযীলতপূর্ণ, এ ব্যাপারে কোন মতভেদ নেই। কারণ, এ বিষয়ে অসংখ্য দলীল-প্রমাণ রয়েছে। তবে মতভেদের অবকাশ রয়েছে রাত্রির ফযীলত নিয়ে। অর্থাৎ, রমযানের শেষ দশকের রাত বেশি ফযীলতপূর্ণ না যিলহজ্জের প্রথম দশকের রাতসমূহ বেশি ফযীলতের অধিকারী ?

বিশুদ্ধতম মত হল, রাত হিসেবে রমযানের শেষ দশকের রাতগুলো ফযীলতের দিক দিয়ে অধিক মর্যাদার অধিকারী। আর দিবসের ক্ষেত্রে যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিবস অধিক মর্যাদার অধিকারী।

ইবনে রজব রহ. বলেন: যখন রাত্র উল্লেখ করা হয় তখন দিবসগুলোও তার মাঝে গণ্য করা হয়। এমনিভাবে, যখন দিবস উল্লেখ করা হয় তখন তার রাত্রিগুলো তার মাঝে গণ্য হয়; এটাই নিয়ম। এ ক্ষেত্রে শেষ যুগের উলামায়ে কেরাম যা বলেছেন সেটাই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হতে পারে। তাহল, সামগ্রিক বিচারে যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশকের দিবসগুলো রমযানের শেষ দশকের দিবসসমূহের চেয়ে অধিকতর মর্যাদাসম্পন্ন। আর রমযানের শেষ দশকের লাইলাতুল কদর হল সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন। আল্লাহ ভালো জানেন।

মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে যিলহজ্জ মাসের এই গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোতে সঠিকভাবে আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন

Related Post