সামাজিক আচার আচরণ ও মেলামেশা মানবজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দুই ব্যক্তির মাঝে ফয়সালা, বিচার ও ঝগড়া মীমাংসা করা অন্যতম সামাজিক ব্যাপার। আর ন্যায়বিচার হলো সামাজিক শান্তি, স্থিতিশীলতা ও শৃঙ্খলার সোপান। ন্যায়বিচারের মাধ্যমেই সমাজবদ্ধ জীবনের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। যে দেশ ও সমাজে মজলুম মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয় সেখানে আল্লাহর আজাব ও আসমানী গজব অবশ্যই নাজিল হয়। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে ন্যায়বিচার যেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তেমনি বিচারকও প্রশাসন যন্ত্রের মূল উপাদান।
আব্দুর রহমান ইবনে আবী বাকরা হতে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বিচারক ও ন্যায়বিচারের গুরুত্বারোপ করতে গিয়ে বলেছেন : কোনো বিচারক রাগাম্ভিত অবস্থায় যেন কোনো রায় বা ফায়সালা পেশ না করেন। কারণ ক্রদ্ধাবস্থায় মানুষের অবস্থা স্বাভাবিক থাকে না। মেজাজ ঠিক থাকে না। ফলে সঠিক রায় ও ন্যায়বিচার তার পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়। যেকোনো দেশের আদালতই নিপীড়িত, বঞ্চিত ও দুর্বল শ্রেণীর সর্বশেষ আশ্রয়স্থল। সবল ও শক্তিশালী লোক তো সদা তৎপর থাকে দুর্বলের ওপর অত্যাচার ও জুলুম করার জন্য। জায়গাজমি জবরদখল ও সম্পদ লুট করার জন্য বরাবরই সক্রিয় থাকে। বিচারক যদি ন্যায়পরায়ণ ও নিরপেক্ষ না হয় তখন জালেমের জুলুম বাড়তেই থাকে এবং দুর্বল শ্রেণী অসহায় ও শোষণের শিকার হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়।
উল্লেখ্য, ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে রাজনীতির ইমারত দু’টি স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত। একটি হচ্ছে যোগ্য ব্যক্তির হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অর্পণ এবং অপরটি ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা। (ইবনে তাইমিয়া)
হাফিজ ইবনে কাইয়্যিম (রহঃ) বলেন : আল্লাহর দ্বীনের উদ্দেশ্য হলো জনগণের মাঝে ইনসাফ কায়েম করা এবং জনগণকে ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখা। (হাফিজ ইবনে কাইয়্যিম আলামুল মুকিইন)
তাই ন্যায়বিচারের সর্বোত্তম আদর্শ পুরুষ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে মহান রাব্বুল আলামীন নির্দেশ করে বলেছেন : বলুন, আল্লাহ যে কিতাব নাজিল করেছেন, আমি তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমি তোমাদের মধ্যে ন্যায়বিচার করতে আদিষ্ট হয়েছি। (সূরা শুরা-১৫)
অন্যত্র আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন : আর যখন তোমরা মানুষের কোনো বিচার মীমাংসা করতে আরম্ভ করো তখন ইনসাফের সাথে বিচার মীমাংসা করো। (সূরা নিসা-৫৮) এ ছাড়া আরো কিছু আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে তাগিদ দিয়েছেন।
বিচারক কখনো মনগড়া বিচার করতে পারেন না। সরকারের চাপে বা অর্থের মোহে প্রভাবিত হতে পারেন না। এটা আদৌ বিচারকের নীতি হতে পারে না। তাই তো ইমাম বুখারী (রহঃ) হাদীসের অধ্যায় কায়েম করেছেন এভাবে : মানুষ কখন বিচারকের যোগ্য হবে? অর্থাৎ, যে ব্যক্তি স্বীয় প্রবৃত্তির অনুসরণ করে না, মানুষকে ভয় করে না এবং ঘুষ গ্রহণ করে না তখনই সেই ব্যক্তি বিচারকের উপযুক্ত হয়।
এ ব্যাপারে তিনি উদ্ধৃতি দিয়েছেন হযরত হাসান বসরী (রহঃ)-এর উক্তি আল্লাহ তায়ালা সেসব বিচারককে বিচার দিবসে অবশ্যই শাস্তি প্রদান করবেন যারা বিচার করে মনগড়া এবং মানুষের চাপে (সরকার ও উপরস্থ কর্মকর্তা) ও অর্থের লোভে। (বুখারী)
এই উক্তি করে তিনি নিম্নোল্লিখিত কিছু আয়াত তেলাওয়াত করেন, যাতে আল্লাহ তায়ালা ন্যায়বিচার করার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা দাউদ (আঃ)-কে সম্বোধন করে বলেছেন : হে দাউদ! আমি তোমাকে জমিনে আমার প্রতিনিধি রূপে পাঠিয়েছি। সুতরাং তুমি মানুষের মাঝে হক ও ইনসাফের সাথে ফায়সালা করো এবং খেয়ালখুশির অনুসরণ করো না। তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয় তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। এ কারণে যে, তারা হিসাব দিবসকে ভুলে যায়। (সূরা ছোয়াদ-২৬)
অপর আয়াতে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন : আমি তাওরাত অবতীর্ণ করেছি। এতে হেদায়েত ও আলো রয়েছে। পয়গম্বর, দরবেশ ও আলেমরা এর মাধ্যমে ফায়সালা দিতেন। কেননা তাদেরকে এ খোদায়ী গ্রন্থের দেখাশোনা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল এবং তারা এর রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত ছিলেন। অতএব তোমরা মানুষকে ভয় করো না, আমাকে ভয় করো এবং আমার আয়াত গুলোর বিনিময়ে স্বল্পমূল্য গ্রহণ করো না। যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুযায়ী ফায়সালা করে না, তারাই কাফের। (সূরা মায়িদাহ-৪৪)
অন্যত্র এক আয়াতে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন : এবং স্বরণ করুন দাউদ ও সুলায়মানকে, যখন তারা শস্যক্ষেত্র সম্পর্কে বিচার করেছিলেন। তাতে রাত্রিকালে কিছু লোকের মেষ ঢুকে পড়েছিল। তাদের বিচার আমার সম্মুখে ছিল। (সূরা আম্বিয়া-৭৮)
হাসান বসরী (রহঃ)-এর উপরোল্লিখিত আয়াত উদ্ধৃতি দেয়ার উদ্দেশ্য হলো : আল্লহ সে আয়াতগুলো রাষ্ট্রপ্রধান ও বিচারকদের এমন কিছু আচরণ থেকে বেঁচে থাকার জন্য সতর্ক করেছেন, যা সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচারের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। যেমন, প্রবৃত্তির অনুসরণ করা, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা প্রভাবশালী লোকদের চাপে প্রভাবিত হওয়া ও ঘুষ গ্রহণ করা।
যে কোনো বিচারকের মধ্যে কিছু আচরণ বিদ্যমান থাকলে তিনি কখনো ন্যায়বিচার করতে পারবেন না। তার নিরপেক্ষতা নিঃসন্দেহে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। মজলুম অসহায় ও দুর্বল মানুষের হতাশা ও দুর্ভাগ্য হ্রাস পাবে না। এমন ব্যক্তির বিচারকের দায়িত্ব গ্রহণ করা হারাম। ন্যায়বিচারকের ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়। আর জালিম আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয়। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : বিচারকের সাথে আল্লাহ থাকেন যতক্ষণ না তিনি জুলুম করেন। যখনই তিনি জুলুম করেন আল্লাহর সাহায্য থেকে পৃথক হয়ে যান এবং তিনি শয়তানের খপ্পরে পড়ে যান। (কানজুল উম্মাল, ষষ্ঠ খণ্ড)
বিচারক তিন শ্রেণীর, তার মধ্যে দুই’শ্রেণী জাহান্নামী : হযরত বুরায়দা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন : বিচারক তিন শ্রেণীর, তার মধ্যে দু’শ্রেণীর বিচারক জাহান্নামী এবং এক শ্রেণীর বিচারক হবে জান্নাতী। প্রথম প্রকার বিচারক তাঁরা, যারা সত্যকে জানে এবং সত্যের সাথেই বিচার ফায়সালা করে, তাঁরা জান্নাতী। দ্বিতীয় প্রকার সেসব বিচারক, যারা সত্যকে জানে কিন্তু তদানুযায়ী বিচার-ফায়সালা করে না বরং জুলুম করে, তারা জাহান্নামী। তৃতীয় প্রকার সেসব বিচারক, যারা সত্যকে জানেও না এবং সে অজ্ঞতা নিয়েই মানুষের বিচার-ফায়সালা করে, তার জাহান্নামী। (আবু দাউদ)
ন্যায়বিচার এক প্রকার ইবাদত : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজে এবং খোলাফায়ে রাশেদীন বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন এবং অন্য সাহাবাদেরও বিচারক হিসেবে নিযুক্ত করেন। এ প্রসঙ্গে আল্লামা ইবনুল হাম হানাফী (রহঃ) বলেন, বিচারক নিয়োগ করা ফরজ এবং এ ব্যাপারে মুসলমানদের ইজমা কায়েম হয়েছে। (বদরুদ্দীন কাশানী, বাদাই আস সানাই, সপ্তম খণ্ড)
বিচারক নিয়োগ সম্পর্কে কুরআন-হাদীস পর্যালোচনা পূর্বক ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞরা বিচারক হওয়ার আটটি শর্ত বর্ণনা করেছেন। তা হলো : ১. ঈমান ২. বয়ঃপ্রাপ্তি ৩. বুদ্ধি ৪. স্বাধীনতা ৫. পুরুষ হওয়া ৬. ন্যায়-নিষ্ঠা ও সততা ৭. ইসলামী আইনে পারদর্শিতা ৮. শারীরিক সুস্থতা। ষষ্ঠ শর্ত সম্পর্কে তথা ন্যায়-নিষ্ঠা ও সততা সম্পর্কে ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ হলো বেশির ভাগ ইমাম বলেন, ফাসেক ব্যক্তিকে বিচারক নিয়োগ করা জায়েজ নেই এবং তার রায় কার্যকর হবে না। হানাফি ঈমামদের অভিমত হলো, ফাসেক ব্যক্তিকে বিচারক নিয়োগ করা নাজায়েজ। তবে তার রায় অবশ্যই গ্রহণযোগ্য হবে। যদি তার ফায়সালা কুরআন সুন্নাহ ও ইজমার পরিপন্থী না হয়।
উল্লেখ্য, ফাসেক বলা হয় ওই ব্যক্তিকে যে কবিরা গুনাহ ও অশ্লীলতা হতে বিরত না থাকে এবং ফরজ-ওয়াজিবের তোয়াক্কা না করে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে বোঝায় নির্বাহী বিভাগের অযথা হস্তক্ষেপমুক্ত থাকা এবং স্বাধীনভাবে বিচার বিভাগ কাজ করতে পারা। তা ছাড়া ন্যায় প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। আদালতের কাজে প্রশাসনের ছোট-বড় কোনো কর্মকর্তার হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই। এমনকি প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধেও যদি কোনো নাগরিক কোনো অভিযোগ উত্থাপন করে তাহলে অন্য আদালতে অপর বিচারক কর্তৃক তার শুনানি হবে এবং আইন মোতাবেক ব্যবস্থা গৃহীত হবে। ইসলামের ইতিহাসে বিপুলসংখ্যক নজির পেশ করা যাবে যেখানে রাষ্ট্রপ্রধান সাধারণ মানুষের মতো আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের জবাব দিয়েছেন। বিচার বিভাগের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতার ফলে নিপীড়িত মানুষ নায্য বিচার পেয়েছে। ধর্ম, বর্ণ, কৌলিন্য ও আভিজাত্য ন্যায়বিচারের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারেনি। বলা বাহুল্য, শতকরা নব্বই ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত আমাদের বাংলাদেশ মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ হিসেবে পরিচিত। এতদসত্তে ও আমাদের দেশের বিচার বিভাগ কি উপরোল্লিখিত গুণে গুণান্নিত? এবং বিচার বিভাগে উপরিউক্ত শর্ত কি যথাযথভাবে বিদ্যমান? দেশের চলমান পরিস্থিতি নিরপেক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করলে দিবালোকের মতো প্রতিভাত হয়, বাংলাদেশের আদালতে রাজনীতিকে ইস্যু করে যত মামলা করা হয় এর বেশির ভাগই ওপরের নির্দেশ ও চাপেই করা হয় এবং রায় প্রদানে সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে। বিশেষত প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রায়ই মিথ্যা মামলা দেয়া হয়ে তাকে দুর্বল বা রাজনীতি থেকে নির্বাসন করার উদ্দেশ্যে। এসব মামলার রায় প্রদানে বিচারক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার চাপে প্রভাবিত হন বলেই সাধারণের ধারণা। ফলে নিরপরাধ আসামির সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ইনসাফ ও হক বিচার আড়ালে থেকে যাচ্ছে। অপরাধ পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ বিচার বিভাগের আসল উদ্দেশ্য অপরাধ নির্মূল করা ও শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু বিচার বিভাগের নীতিহীনতা, অস্থিতিশীলতা, পক্ষপাতিত্ব ইত্যাদি আচরণ গোটা দেশের অস্বস্তিকর পরিবেশ, অশান্তি, হানাহানি, খুনোখুনি ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অতএব চলমান নাজুক পরিস্থিতি, রাজনৈতিক সহিংসতা ও অরাজকতা থেকে দেশকে বাঁচানোর মূল উপায় হলো ন্যায়পরায়ণ ও স্বাধীন বিচার বিভাগ কায়েম করা। আদালতে সততা, নিষ্ঠা ও নিরপেক্ষতার পরিবেশ সৃষ্টি করা। মামলা করার ক্ষেত্রে আত্মীয় ও দলীয় পরিচয় পদদলিত করে অপরাধকেই প্রাধান্য দেয়া। অপরাধী যে দলেরই হোক বিচারের সমুখীন করা। তখনই দেশের উন্নতি, অগ্রগতি ও কাজের গতিশীলতা ফিরে আসবে। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে ইসলামের সঠিক জ্ঞান অর্জন করার তাওফীক দান করুন। আমীন…