আবুল কালাম আযাদ চৌধুরী
ভূমিকাঃ সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আমাদের জন্য দ্বীন ইসলামকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। দরূদ ও সালাম অবিরাম ধারায় বর্ষিত হোক নবীকুল শিরোমণী মুহাম্মাদ (সাঃ) এবং তাঁর পবিত্র বংশধর ও সম্মানিত সাথীদের উপর।
ইসলাম একটি শান্তিময় জীবন বিধান। নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) এর মৃত্যুবরণ করার পূর্বেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই দ্বীনকে মুসলমানদের জন্য পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। একজন মানুষের জন্ম থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলাম সুন্দর সুন্দর বিধান প্রদান করেছে। নবজাতক শিশু জন্ম গ্রহণ করার পর সন্তানের পিতা-মাতা বা তার অভিভাবকের উপর আকীকার বিধান ইসলামের সৌন্দর্যময় বিধানসমূহের মধ্য হতে অন্যতম একটি বিধান। আমরা অত্র প্রবন্ধে ইসলামে আকীকার বিধান সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করব, ইনশা-আল্লাহ।
কুরবানী একটি স্বতন্ত্র ইবাদত, তেমনিভাবে আকীকাও একটি ভিন্ন ইবাদত
। কুরবানী ও আকীকা এক সঙ্গে আলোচনা করার বিষয় না। কিন্তু আমাদের দেশে কুরবানীর সাথে আকীকা দেওয়ার রেওয়াজটি চালু হয়ে গেছে। অথচ এই রেওয়াজটি সম্পূর্ণ প্রচলিত কিন্তু সহীহ নয়। তাই আমরা বিষয়টি এখানে আলোচনা উপস্থাপন করার প্রয়াস পেলাম।
আকীকার অর্থঃ ইসলামের পরিভাষায় সন্তান জন্ম গ্রহণ করার পর আল্লাহর শুকরিয়া ও আনন্দের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য যে পশু জবেহ করা হয়, তাকে আকীকা বলা হয়।
আকীকার হুকুমঃ অধিকাংশ আলেমের মতে সন্তানের আকীকা করা সুন্নাতে মুআক্কাদাহ। রাসূসুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি তার সন্তানের আকীকা করতে চায়, সে যেন উহা পালন করে”। (আহমাদ ও আবু দাউদ)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আরও বলেনঃ প্রতিটি সন্তানই আকীকার বিনিময়ে বন্ধক (দায়বদ্ধ) থাকে”। (আহমাদ, তিরমিযী ও অন্যান্য সুনান গ্রন্থ) আকীকার বিনিময়ে সন্তান আটক থাকার ব্যাপারে আলেমগণের কয়েক ধরণের বক্তব্য রয়েছে। এ ব্যাপারে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলের কথাটি সবচেয়ে সুন্দর ও বিশুদ্ধ। তিনি বলেন, কথাটি শাফাআতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অর্থাৎ আকীকা দেওয়া হয়নি, এমন শিশু সন্তান যদি মৃত্যু বরণ করে, কিয়ামতের দিনে সে শিশুর শাফাআত থেকে পিতা-মাতা বঞ্চিত হবে। আর হাদীসে একথা প্রমাণিত আছে যে, মুসলমানদের যে সমস্ত শিশু বাচ্চা প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পূর্বেই মৃতু বরণ করবে, তারা তাদের মুসলিম পিতা-মাতার জন্য আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করবে। উপরের আলোচনা থেকে প্রমাণিত হলো যে, সন্তানের আকীকা সুন্নাতে মুআক্কাদাহ। ওয়াজিব বা ফরজ নয়।
আকীকার গুরুত্ব: আকীকা শব্দের উৎপত্তি হলো (عق) ইক্কুন শব্দ থেকে। (عق) ইক্কুন অর্থ দূর করা। আকীকার মাধ্যমে শিশুর কষ্ট দূর করা হয় বলে এ ব্যবস্থার শর’ঈ নাম হলো আকীকা। আকীকা হলো মূলত কোন শিশুর জন্মের সপ্তম দিনে করণীয় তিনটি কাজের মধ্যে একটি।
হযরত সামুরা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন: প্রত্যেক শিশু তার আকীকার সাথে বন্ধক (দায়বদ্ধ) থাকে। জন্মের সপ্তম দিন তার পক্ষ থেকে জবেহ করতে হয়, তার নাম রাখতে হয় এবং মাথা কামাতে হয়। (তিরমিযী)
হযরত সালমা ইবনে আমের দাব্বী (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল (সা.)-কে বলতে শুনেছি: শিশুর (জন্মের পর) আকীকা করা আবশ্যক। অতএব তার পক্ষ থেকে তোমরা রক্ত প্রবাহিত করো (পশু জবেহ করো) এবং তার থেকে কষ্ট দূর করো। (বুখারী)
শিশু থেকে কষ্ট দূর করার অর্থ আকীকা দিয়ে শিশুর মাথা কামিয়ে তাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা। শিশু মায়ের থেকে যে চুল নিয়ে আসে, তা তার জন্য কষ্টদায়ক। এতে সে অপরিচ্ছন্ন থাকে। চুল কামানোর পর সে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয় এবং তার কষ্ট দূর হয়। তদুপরি আকীকা দেওয়াতে সে নানা প্রকার বালা-মুসিবত থেকে মুক্ত থাকে।
আকীকার জন্য পশুর সংখ্যা: আকীকা ইসলাম পূর্ব যুগেও প্রচলিত ছিলো। যদিও তার ধরণ ছিল ভিন্ন। এখনও ইহুদীদের মধ্যে আকীকার প্রচলন বিদ্যমান। তবে তারা পুত্র সন্তানের জন্য আকীকা করলেও কন্যা সন্তানের জন্য আকীকা করে না। ইসলামে তাদের এ প্রথাকে রহিত করা হয়েছে।
হযরত উম্মু কুরয আল কা‘বিয়া (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল (সা.)-কে বলতে শুনেছি: পুত্র সন্তানের জন্য সমবয়স্ক দু’টি ছাগল এবং কন্যা সন্তানের জন্য একটি ছাগল দিয়ে আকীকা করতে হয়। (আবু দাউদ)
আবু দাউদের অপর হাদীসে উল্লিখিত হাদীসের শেষে এটাও বর্ণনা করা হয়েছে যে, আকীকার জন্য ছাগল, খাসী অথবা ছাগী যাই হোক না কেন, তাতে কোন ক্ষতি নেই। প্রয়োজনে পুত্র সন্তানের জন্যও একটি ছাগল বা মেষ দিয়েও আকীকা দেওয়া যায়। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত: রাসূল (সা.) হাসান ও হোসাইন (রা.)-এর পক্ষ থেকে একটি করে মেষ আকীকা করেছেন। (আবু দাউদ)
মাসাইল
* শিশুর জন্মের সপ্তম দিনে আকীকা করা সুন্নাত। যেভাবে ঐদিন শিশুর মাথা কামানো এবং নাম রাখাও সুন্নাত। আকীকা শিশুর জন্মের সপ্তম দিনে দিতে না পারলে জন্মের চৌদ্দতম দিনে, তাও সম্ভব না হলে জন্মের একুশতম দিনে আকীকা দেওয়ার কথা মুস্তাদরাক হাকীমের বর্ণনা সূত্রে এক মওকুফ হাদীসে বর্ণিত রয়েছে। তবে হাদীসটি সহীহ বা যঈফ সম্পর্কে জানা যায় না। অবশ্য আকীকা নির্দিষ্ট সময়ে দেওয়া না হলে তা আর সুন্নাত পর্যায় থাকে না, বরং তা হয়ে যায় মুবাহ। অর্থাৎ যা করলে সাওয়াব হয় আর না করলে কোন ক্ষতি নেই। তবে শিশুর পক্ষ থেকে আকীকা করা হলে শিশুরই কল্যাণ হয়।
* আকীকার জন্য ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা জাতীয় পশু নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এগুলো ব্যতীত গরু কিংবা উট দিয়ে আকীকা দিলে আকীকা হবে না। কেননা, মুস্তাদরাক হাকিমে ও এ‘লাউস সুনানের বর্ণনাসূত্রে হযরত কুরয (রা.)-এর পিতা-মাতা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আবু বকর (রা.)-এর বংশের এক মহিলা মান্নত মানলো যে, আব্দুর রহমানের স্ত্রীর কোন সন্তান হলে আমরা একটি উট জবেহ করবো। তখন হযরত আয়েশা (রা.) এ কথা শুনে বললেন, এটা হতে পারে না। বরং সুন্নাত হলো ছেলে সন্তানের জন্য দুটি সমবয়ষ্ক ছাগল আর মেয়ে সন্তানের জন্য একটি ছাগল আকীকা করা। সুতরাং ছাগল-ভেড়া ব্যতীত উট বা গরু দিয়ে আকীকা দেওয়া হলে আকীকার সুন্নাত আদায় হবে না।
* আকীকার পশুকে কুরবানীর গরুর সাত ভাগের একভাগ মনে করা উচিৎ নয়। আকীকার জন্য কুরবানীর সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করে কুরবানীর গরুর সাথে একভাগ কিংবা দুইভাগ আকীকা দেওয়া হলে ঐ আকীকা সহীহ হবে না। তার কারণ প্রথমত, আকীকার নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে যাওয়া, দ্বিতীয়ত, গরু আকীকার পশুর অন্তর্ভুক্ত না হওয়া।
* আকীকার জন্য একটি ছাগল বা দুটি ছাগল নির্দিষ্ট করে দেওয়াতে আকীকার অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ ঘরোয়া অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। সুতরাং যারা দুইয়ের অধিক ছাগল বা গরু দিয়ে বড় আকারে আকীকার অনুষ্ঠান করে এবং তাতে উপহার লাভের সুযোগ হয় তাদের এ আকীকা অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ বিদা’য়াত। এ অনুষ্ঠান সুন্নাত বর্জিত হওয়ার কারণে এতে সাওয়াব বা কল্যাণের আশা করা যায় না।
* আকীকার পশুর গোশত, চামড়া এবং বিতরণ সবকিছু কুরবানীর পশুর গোশত, চামড়া এবং বিতরণের হুকুমের ন্যায়। অর্থাৎ আকীকার গোশতও কুরবানীর গোশতের ন্যায় একভাগ ফকীর-মিসকীন, একভাগ আত্মীয়-স্বজন ও একভাগ নিজেদের জন্য এভাবে খাওয়ার ব্যবস্থা কিংবা বিতরণ করাই উত্তম।
* আকীকার গোশতের ব্যাপারে বিভিন্ন অঞ্চলে শরীয়ত বহির্ভূত যেসব আঞ্চলিক রসম-রেওয়াজ প্রচলিত আছে তাকে তুচ্ছ মনে করে উপেক্ষা করার কোন সুযোগ নেই। বরং তা সম্পূর্ণ পরিহার করাই কর্তব্য।
* আকীকা কিংবা শিশুর জন্মকে উপলক্ষ করে শিশুর নানার বাড়ির পক্ষ থেকে শিশুর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও উপহার সামগ্রী শিশুর পক্ষে দাবি করা কিংবা না দিলে খোঁটা দেওয়া (দোষ দেখিয়ে তিরষ্কার করা) তা যৌতুক দাবি করা বা যৌতুক নেওয়ার মতো একটি অপরাধ। ইসলামী শরীয়াতে এসবকিছু সম্পূর্ণ নিন্দনীয়।
(সূত্র: ফিকহুস সুন্নাহ, ফতওয়ায়ে আলমগীরী, মাসায়েলে মায়ারেফুল কুরআন)