১৫তম পর্ব
আশার ছলনা
এর প্রায় দু বছর পরে মা গাইবান্ধায় এসে তাঁর সাথে দেখা করার জন্যে আমার কাছে টেলিগ্রাম করেছিলেন। আমি তখন ময়মনসিংহে। ময়মনসিংহে উল্লেখযোগ্য কোন আত্মীয় না থাকায় তথাকার ভিসা তিনি পাননি।
বহু দূরের পথ ছিল না। ইচ্ছা করলে গাইবান্ধা গিয়ে তাঁর সাথে দেখা করতে পারতাম। কিন্তু আমি যাইনি যেতে পারিনি। সেবার তিনি বলেছিলেন- ‘পাকিস্তানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম প্রধানমন্ত্রীর রক্ত দিয়ে ইসলামী রাষ্ট্রের যাত্রা শুরু হলো নাকি। ’
এবারের হয়তো বলবেন- ‘এতবড় একটা খুন হয়ে গেল- তার বিচার তো দূরের কথা একটা তদন্ত পর্যন্ত হলো না। খুনী ব্যক্তিরা সদম্ভে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর ইসলামী রাষ্ট্রের ইসলাম প্রিয় নাগরিকেরা নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে’- টেলিগ্রাম খানা হাতে না পেলে আমার স্নেহশীলা জননী অব্যক্ত বেদনা বুকে নিয়ে কোলকাতায় ফিরে গিয়েছিলেন।
প্রিয় পাঠকবর্গ! একথা শুনে হয়তো আপনারা আশ্চর্যান্বিত না হয়ে পারবেন না যে, এর পরে মৃত্যু শয্যায় মা আমাকে শেষবারের মতো দেখতে চাচ্ছেন একথা জানতে পেরেও তাঁর সাথে দেখা করতে যাইনি- যেতে পারিনি।
শেষবারের মতো তাঁকে একবার দেখার জন্যে মনটা আমার ভীষণভাবে আকুলি বিকুলি করেছে। কিন্তু তাঁর ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের কাছে গিয়ে লজ্জায় মাথা হেঁট করে দাঁড়াতে হবে একথা মনে হতেই আমি ভীষণভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছি।
আমার এই লজ্জার কারণটা কি তা অনেকেই হয়তো সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন না। তাই অতি সংক্ষেপে বলা প্রয়োজন যে- কি কারণে আমার নগণ্য শক্তি নিয়ে আমি পাকিস্তান আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেছিলাম, ইতিপূর্বে সে সম্পর্কে কিছুটা আভাস দেয়া হয়েছে। এখানে একটু বিস্তৃতভাবে বলতে হচ্ছে যে, এই আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করার সময়ে পার্থিব কোন লোভ-লালসা আমার ছিল না। নিজে ব্রাহ্মণ ছিলাম, সুতরাং হিন্দু সমাজে মন-মানব, আবেগ-অনুভূতি, ধারণা-বিশ্বাস প্রভৃতির সাথে আমার যে পরিচয় তা জন্মগত, প্রত্যক্ষ এবং বাস্তব।
কিছু সংখ্যক সম্মানজনক ব্যতিক্রমবাদে গোটা হিন্দু সমাজ এমনকি তাদের সমাজের মুচী-মেথর, ডোম, চাড়াল প্রভৃতিরাও মুসলমানদেরকে কতখানি ঘৃণা করে সেকথা বেশ ভালভাবেই আমার জানা ছিল। আর জানা ছিল বলেই অখন্ড ভারতে বিপুলভাবে এত জঘন্য এবং এত শোচনীয় মুসলিম হত্যা হচ্ছে সেকথা ভেবে আমি ভীষণভাবে শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম।
আগামী দিনের নাগরিক কোটি মুসলমান শিশুর চেহারা সেদিন আমার মানস্পটে ভেসে উঠেছিল। সেই সোনার শিশুরা অখন্ড ভারতে সংখ্যালঘু হওয়ার অপরাধে চিরদিন হিন্দু সমাজের অধীন ও মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে, ঘৃণা ও লাঞ্ছনার জীবন-যাপন করবে সেকথা ভাবতেই আমার দেহ-মন ভীষণভাবে শিহরিত হয়ে উঠতো।
তখন পাকিস্তান সৃষ্টিকেই এই সমস্যার একমাত্র সামধান বলে বুঝতে পেরেছিলাম। কেননা, তাহলে ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানের নিজেদের জন্যে শুধু একটি স্বাধীন রাষ্ট্রই লাভ করবে না-ইসলামী শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে সেই রাষ্ট্রকে এমন একটি আদর্শ রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তুলতে সক্ষম হবে যা হবে পৃথিবীর অন্যান্য সকল দেশের জন্যে অনুকরণীয়।
বিশ্বের আদর্শ এবং অনুকরণীয় সেই রাষ্ট্রে আমার মানস্পটে ভেসে উঠা সেই কোটি কোটি সোনার শিশু সোনার গড়া ফুলের মতো দিনে দিনে ফুঠে উঠবে এবং নিজেদেরকে বিশ্বের আদর্শ ও অনুকরণীয় মানুষরূপে গড়ে তোলার সুযোগ পাবে। ফলে গোটা হিন্দু সমাজ বিশেষ করে আমার স্বজন-পরিজনকে কাছে আমি মাথা তুলে দাঁড়াতে সক্ষম হব। এক বুকভরা আশা নিয়েই সেদিন পাকিস্তান আন্দোলনে আমি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম।
শ্রদ্ধেয় বর্ষীয়ান পাঠকবর্গ! পাকিস্তান সৃষ্টির পরবর্তী কার্যকলাপের কথা স্মরণ করুন এবং ভেবে দেখুন সেই সব কার্যকলাপের দ্বারা আমার বুকভরা আশকে কিভাবে চূর্ণ-বিচুর্ণ করে দেয়া হয়েছে।
যেহেতু আমার মানস্পটে ভেসে উঠা সেদিনের সে সোনার শিশুরা যারা আজ যুবক ও তরুণ হয়ে বেড়ে উঠেছে এসব কার্যকলাপের কথা জানে না। অতএব তাদের অবগতির জন্যে ওসবের কিছুটা আভাস এখানে তুলে ধরতে হচ্ছে।
অখন্ড ভারতের দাবীদারগণ সর্বশক্তি নিয়োগ করেও যখন পাকিস্তান সৃষ্টিকে ঠেকাতে পারলো না, তখন তারা আতুর ঘরেই তাকে গলাটিপে হত্যা করার ষড়যন্ত্র মেতে উঠলো। নানারূপ শঠতা ও ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিয়ে তারা পাকিস্তানের ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত পাওনা শত শত কোটি টাকা,বিপুল পরিমাণঅস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, যন্ত্রপাতি ও আসবাপত্র প্রভৃতি থেকে বঞ্চিত করত পাকিস্তানকে ঠুটো জগন্নাথে পরিণত করলো।
এই ঠুটো জগন্নাথে পরিণত করেই সঙ্গে সঙ্গে কাশ্মীরে এক ভীষণ রক্ষক্ষয়ী সংগ্রাম শুরু করে দিল,অন্যায়ভাবে হায়দারাবাদ, জুনাগড়, মানভদর প্রভৃতি রাজ্য গ্রাস করলো। পাকিস্তানের উভয় সীমান্তে পুনঃ পুনঃ হামলা চালাতে লাগলো। চোরাকারবারী দলসমূহকে লেলিয়ে দিয়ে সেই ঠুটো জগন্নাথকে একেবারে নিঃশেষ ও নিঃসম্বল করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলো।
ভেবে আশ্চর্যান্বিত না হয়ে পারা যায় না যে, বাইরের এই বিভিন্নমুখী আক্রমণে শিশু পাকিস্তানের যখন নাভিশ্বাস উপস্থিত, যে কোন মুহূর্তে সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার যখন প্রবল আশঙ্কা বিদ্যমান, ঠিক তেমনি সময়ে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে শুরু করা হয়েছে এক নারকীয় কাণ্ড কারখানা।
পাকিস্তান আন্দোলনের প্রথম সারিতে ছিলেন এমন ব্যক্তিদের কিছু সংখ্যক এই ‘ঘর পোড়ার সুযোগে খৈ খাওয়ার’জন্যে মত্ত হয়ে উঠলেন। অর্থাৎ নিজের মধ্যে গদি নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু করে দিলেন এবং এ জন্যে শঠতা, ষড়যন্ত্র, হত্যা, জুলুম প্রভৃতির আশ্রয় নিতেও কণামাত্র দ্বিধা করলেন না।
পাকিস্তান ধ্বংস হোক, তাদের এই জঘন্য কান্ড-কারখানা দেখে ইসলাম, ইসলামী রাষ্ট্র এমনকি তাদের নিজেদের সম্পর্কে সারা বিশ্বে নিন্দার ঝড় উঠুক, সেদিকে লক্ষ্য করার সুযোগ তাদেরনেই। সকল লক্ষ্য-সকল মনোযোগ এবং সকল কার্যক্রম গদী দখলের লড়াই এ তারা নিয়োজিত করেছেন।
বলাবাহুল্য, চারিদিকে নিন্দা ও সমালোচনার ঝড় উঠেছে। হয়তো গদী দখলের নেশায় মশগুল থাকায় সে সব শুনতে পাননি। কিন্তু আমাকে তা শুনতে হয়েছে এবং সাথে সাথে আশায় ভরা আমার বুকখানায় হতাশার তীব্র দহন আমি অনুভব করেছি।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে এই যে গদীর লড়াই শুরু হয়েছে, আজও তার অবসান ঘটেনি। মুসলিম লীগের প্রচেষ্টায় এ উপ-মহাদেশের বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত এবং পরস্পর শত্রুভাবাপন্ন হয়ে পড়া মুসলমানদের মধ্যে যে ঐক্য ও সংহতি গড়ে উঠেছিল, অন্য কথায় যে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের দ্বারা এই উপ-মহাদেশের মুসলমানেরা ভারত বিভক্তির মতো অসাধ্য সাধনে সক্ষম হয়েছিল, গদীর লড়াই সেই ঐক্য ও সংহতিকে ভেঙ্গে চুরমার করতে লাগলো; গদীর স্বার্থ দিনের পর দিন নানা ধরণের মারমুখো দল-উপদল গড়ে তোলার প্রতিযোগিতায় গদী শিকারীদেরকে ভীষণভাবে মাতিয়ে তুললো।
এসব কাণ্ড-কারখানা দেখে ভীষণভাবে মর্মাহত হলেও একেবারে ভেঙ্গে পড়েছিলাম না। কারণ তখনও আমার মানস্পটে ভেসে উঠা সেই কোটি কোটি শিশুর চেহারা মনের মাঝে ঝিলিক দিয়ে চলছিল। এই নিদারুণ হতাশার মাঝেও মনকে বুঝ দিচ্ছিলাম যে,একদিন না একদিন এই সোনার শিশুরা সোনার মানুষ হয়ে গড়ে উঠবে এবং এই দেশটাকেও সোনার দেশেষ পরিণত করবে।
কিন্তু আসলে আমার এই আশাও বিরাট ধরণের একটা ছলনা বা মায়ামরীচিকা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। পাকিস্তান আন্দোলনের সময়ে যে কোটি কোটি শিশুর চেহারা আমার মানস্পটে ভেসে উঠেছিল তাদের যারা দিনে দিনে সোনায় গড়া ফুলের মতো পাকিস্তানের মাটিতে ফুটে উঠছে, তাদেকে সত্যিকারের ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা ছিল রাষ্ট্রে প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব।
কিন্তু আমি লক্ষ্য করলাম যে এই প্রথম ও প্রধান দায়িত্বটিকে অতি নির্মমভাবে পদদলিত করা হচ্ছে। গদী শিকারীরা দল প্রগতি ও আধুনিকতার নামে সুপরিকল্পিতভাবে এই সোনার শিশুদের কিছু সংখ্যককে ধর্মহীন, নাস্তিক এবং ঘোরতর ইসলাম বিরোধী করে গড়ে তুলছেন।
অন্য একদল ইসলামের নামে অপরিকল্পিতভাবে এই সোনার ‘শিশুদের কিছু সংখ্যককে কুপমণ্ডুক, অনুষ্ঠান সর্বস্ব, প্রথা-পদ্ধতির অন্ধ অনুসারী, ফতোয়াবাজ এবং যুগের অনুপযোগী করে গড়ে তুলছেন।
আর বাদবাকি যে সব শিশু সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তাদেরকে উভয়দলই ছেড়ে দিয়েছেন সম্পূর্ণরূপে ভাগ্যের উপর। ফলে এরাও ইসলামী আদর্শে গড়ে ওঠার কোন সুযোগ পেল না। এতদ্বারা আমি একথাই বুঝাতে চাচ্ছি যে, আমার সেই সোনার শিশুদেরকে সুপরিকল্পিতভাবে ইসলামী রাষ্ট্রের আদর্শ নাগরিক হিসবে গড়ে তেলার কোন প্রচেষ্টাই কোন পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হয়নি। তবে নিজস্ব প্রতিভার বলে এবং অধ্যবসায়ের গুণে যারা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে স্বতন্ত্রভাবে গড়ে উঠেছেন এখানে তাদের কথা বলা হচ্ছে না।
ইসলামের নামে সৃষ্ট এই দেশের ভবিষ্যত নাগরিকদের প্রায় বারো আনা অংশকে সুপরিকল্পিতভাবে ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ করে রাখা আর বাদবাকি চার আনা অংশকে-নাস্তিক, ইসলাম বিদ্বেষী বা ইসলাম সম্পর্কে ভ্রান্তধারণা পোষণকারীতে পরিণত করার পরিণাম দেশ ও জাতির পক্ষে কত ভীষণ ও ভয়াবহ হয়েছে, তার জাজ্বল্যমান প্রমাণ সকলের চোখের সম্মুখেই রয়েছে।
সে যা হোক, এই বিপুল সংখ্যক মানুষ যাদেরকে পুর্বতন শাসকেরা সুপরিকল্পিতভাবে ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ, বিদ্বেষ পরায়ণ এবং ভ্রান্তধারণা পোষণকারীতে পরিণত করেছিলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় এক শ্রেণীর লোক তাদের কিভাবে ব্যবহার করেছিলেন আসুন অতঃপর সে কথা স্মরণ করিঃ
(ক) এটা সকলেরই জানা রয়েছে যে, পশ্চিম পাকিস্তানী স্বৈরাচারী ও প্রতিক্রিয়াশীল চক্রটির দৌরাত্ম্য এবং শোষণ-নির্যাতন যখন সকল সীমা অতিক্রম করে, তখন অন্যোপায় হয়ে পূর্ব পাকিস্তানীদেরকে নিজেদের স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু করতে হয়।
১ম পর্ব ২য় পর্ব ৩য় পর্ব ৪র্থ পর্ব ৫ম পর্ব ৬ষ্ঠ পর্ব ৭ম পর্ব ৮ম পর্ব ৯ম পর্ব ১০ম পর্ব ১১ পর্ব ১২তম পর্ব ১৩তম পর্ব ১৪তম পর্ব
চলবে…