এ‘তেকাফের তাৎপর্য ও মাসায়েল

এতেকাফের তাৎপর্য ও মাসায়েল

এতেকাফের তাৎপর্য ও মাসায়েল

এ‘তেকাফ শব্দের আভিধানিক অর্থ অবস্থান করা বা কোন স্থানে নিজেকে আবদ্ধ রাখা। শরীয়তের পরিভাষায় এ‘তেকাফ বলা হয়, আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য এক বিশেষ সময় এবং বিশেষ নিয়মে নিজেকে মসজিদে আবদ্ধ রাখা।
পবিত্র মাহে রমযানের বিশেষ আমলসমূহের মধ্যে অন্যতম একটি হলো এ‘তেকাফ করা। এ‘তেকাফ মানুষকে দুনিয়ার ঝামেলা ত্যাগ করার অভ্যাস শিক্ষা দেয় এবং অল্পকালের জন্য হলেও আল্লাহর সাথে তার সম্পর্ক জুড়ে দেয়। এতে দুনিয়ার মুহাব্বত হ্রাস পায় আর আল্লাহর মুহাব্বত বৃদ্ধি পায়। এ‘তেকাফকারীর উদাহরণ হচ্ছে; সেই কয়েদী ব্যক্তির ন্যায়, যে কোন মহান ব্যক্তির দরবারে হাত জোড় করে বলে, যে পর্যন্ত আমার সমস্যা পূর্ণ করা না হবে সে পর্যন্ত আমি এই দরবার ত্যাগ করবো না।
অতএব নিজ অন্তঃকরণ পরিশুদ্ধির লক্ষ্যে দিবা-রজনী আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকা উচিৎ। এবং নিজের আত্মার উন্নতির জন্য পরনিন্দা অনর্থক কথা-বার্ত, কাজ-কর্ম, অপচয়সহ সব ধরণের পাপকর্ম বর্জন করে নফল নামায, যিক্র-আযকার, কুরআন তেলাওয়াতের মত পূণ্যের কাজে মনোনিবেশ করা।
বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ মাস হল মাহে রমযান। এই মাসেই আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ করেছেন। মাহে রমযানের প্রথম বিশ দিন অপেক্ষা শেষ দশ দিন বেশি ফযীলতপূর্ণ। কেননা এই দশকে লাইলাতুল ক্বদর রয়েছে। সে রাত্রিকে আল্লাহ তা‘আলা হাজার মাস থেকে উত্তম ঘোষণা করেছেন। এই দশকে আল্লাহর রহমত বৃষ্টির ন্যায় পৃথিবীবাসীর উপর বর্ষণ হতে থাকে। তাই নবী করীম (সাঃ) রমযানের শেষ দশ দিন এ‘তেকাফ করে গ্রষ্টার অফুরন্ত কল্যাণ অর্জনে আত্মনিয়োগ করতেন। এবং নিজ পরিবার ও উম্মতগণকে এ কাজে অধিক উৎসাহিত করতেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন; রাসূলে কারীম (সাঃ) বরাবর রমযানের শেষ দশকে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত এ‘তেকাফ করেছেন। এবং তাঁর স্ত্রীগণও এ‘তেকাফ করেছেন। (বুখারী ও মুসলিম)
একবার তিনি অসুস্থতার কারণে এ‘তেকাফ করতে পারেন নি। তাই জীবনের শেষ এ‘তেকাফ বিশ দিন করেছিলেন। (বুখারী)
উল্লেখিত হাদীসের আলোকে বুঝা যায় এ‘তেকাফের গুরুত্ব অপরিসীম ও তা শরীয়তের বিশেষ আমল। কেননা রাসূল (সাঃ) প্রতি রমযানে দশ দিন এ‘তেকাফ করতেন। যে বছর তিনি ইন্তেকাল করেন, সেই বছর বিশ দিন এ‘তেকাফ করেছেন। (বুখারী, আবু দাউদ, ইবনে মাযাহ) তাঁর সাহাবী ও স্ত্রীগণ তাঁর সাথে এবং তাঁর মৃত্যুর পরও এ‘তোকাফ করেছেন।
এ‘তেকাফের প্রকারভেদ:
এ‘তেকাফ তিন প্রকার: সুন্নত, ওয়াজিব ও মুস্তাহাব। (ক) যে এ‘তেকাফ একজন মুসলমান নিজের স্বাধীন ইচ্ছানুযায়ী আল্লাহর নৈকট্য লাভ, সাওয়াব অর্জন এবং রাসূল (সাঃ) -এর অনুকরণ ও অনুসরণের উদ্দেশ্যে করে সেটাই সুন্নত এ‘তেকাফ। সুন্নত এ‘তেকাফ রমযানের শেষ দশ দিনে করাটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কেউ কেউ রমযানের শেষ দশ দিন এ‘তেকাফ করাটা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা বলেছেন। কারণ রাসূল (সাঃ) এ‘তেকাফ বার বার করেছেন। তবে কেউ কেউ আবার এ‘তেকাফকে সুন্নাতে মুয়াক্কাদ আলাল কেফায়া বলেছেন। অর্থাৎ মসজিদের অধিবাসীদের মধ্যে কেউ এ‘তেকাফ করলে সকলে জিম্মাদারী থেকে অব্যহতি পাবে।
(খ) মান্নতের এ‘তেকাফ আদায় করা ওয়াজিব। যেমন কেউ শর্তযুক্তভাবে মান্নত করল এই বলে; আমরা রোগকে যদি আল্লাহ মুক্তিদেন তবে এত দিন বা এতোটা সময় এ‘তেকাফ করবো। সহীহ বুখারীতে বর্ণিত আছে; যে, উমর (রাঃ) বলেন হে আল্লাহর রাসূল! আমি মসজিদুল হারামে এক রাত এ‘তেকাফ করার মান্নত করেছি। রাসূল (সাঃ) বললেন: তোমার মান্নত পূরণ করো। এতে বুঝা যায় এ‘তেকাফের জন্য মান্নত করলে তা পূরা করা ওয়াজিব।
(গ) নফল এ‘তেকাফ: যে এ‘তেকাফ বছরের যে কোন সময় (রমযানের শেষ দশ ব্যতীত) মান্নত ছাড়া আদায় করা হয়। এই এ‘তেকাফ স্বল্প সময়ের জন্যও হতে পারে।
* এ‘তেকাফের সময়: ওয়াজিব এ‘তেকাফের সর্ব নিম্ন সময় হলো এক দিন অর্থাৎ যতটুকু সময়ের জন্য মান্নতকারী মান্নত করেছে, ততটুকু সময়ের করতে হবে। যদি এক দিন বা তার বেশি সময়ের জন্য মান্নত করে থাকে, তবে ঠিক এক দিন বা তার বেশি (নির্দিষ্ট) সময়ের জন্য এ‘তেকাফ করতে হবে। আর যদি দিন নির্দিষ্ট করে মান্নত করে থাকে, তা হলে সেই দিনই এ‘তেকাফ করতে হবে। আর এ‘তেকাফ সুন্নাকে মুয়াক্কাদা আলাল কিফায়া মাহে রমযানের শেষ দশ দিনে আদায় করতে হয়। কেননা রাসূল (সাঃ) আমাদেরকে এ সময় আদায় করার শিক্ষা দিয়েছেন। হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত; রাসূল (সাঃ) রমযান মাসের শেষ দশ দিন এ‘তেকাফ করতেন। কিন্তু এক বছর তিনি তা করতে পারেননি। অতঃপর যখন পরবর্তী বছর আসলো তিনি বিশ দিন এ‘তেকাফ করলেন। (তিরমিযী, আবু দাউদ, ইবনে মাযাহ) এই হাদীস দ্বারা কেউ কেউ এ‘তেকাফ করা ওয়াজিব বলেছেন। মূলত সুন্নতই প্রমাণিত হয়। এই মর্মে আরেকটি হাদীস যা মা আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন যে, রাসূল (সাঃ) রমযানে বরাবর দশ দিন এ‘তেকাফ করেছেন। (বুখারী ও মুসলিম)
এখানে লক্ষনীয় হল: এ‘তেকাফকারী-কে বিশ রমযানের সূর্যাস্তের পূর্বে যে কোন সময়ে তার এ‘তেকাফের স্থানে প্রবেশ করতে হবে।
এ‘তেকাফের স্থান:
পুরুষদের জন্য এ‘তেকাফের উত্তম স্থান হলো জামে মসজিদ। তবে ইমাম আবু হানীফা, আহমদ, ইসহাক, আবু সাওরের মতে যে মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়া হয় ও জামাত অনুষ্ঠিত হয়, এমন মসজিদে এ‘তেকাফ শুদ্ধ হবে। কেননা রাসূল (সাঃ) বলেছেন: এমন প্রতিটি মসজিদে এ‘তেকাফ শুদ্ধ যে মসজিদে ইমাম ও মুয়াজ্জিন নিযুক্ত আছে। (দার কুতনী ও ফিকহুস সুন্নাহ)
আর মহিলাদের জন্য এ‘তেকাফের উত্তম স্থান হলো নিজ বাড়ির নিরিবিলি কক্ষ। কিন্তু অধিকাংশ আলেমদের মতে মহিলাদের জন্য তার বাড়িতে নামাজের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে এ‘তেকাফ শুদ্ধ হবে না। কেননা রাসূল (সাঃ)-এর স্ত্রীদের মসজিদে নববীতে এ‘তেকাফ করার পক্ষে বিশুদ্ধ প্রমাণ রয়েছে। (ফিকহুস সুন্নাহ)
এ‘তেকাফের শর্তাবলী: এ‘তেকাফের শর্ত হলো, এ‘তেকাফকারীকে মুসলামন এবং ন্যায় ও অন্যায় বাছ বিচারের ক্ষমতা সম্পন্ন হবে হবে। ঋতু ও প্রসবোত্তর গ্রাব থেকে এবং জুনুবী (গোসল ফরজ হয় এমন অবস্থা) অপবিত্র থেকে মুক্ত হতে হবে। সুতরাং কোন কাফেরের, অপরিণত বুদ্ধি বালকের ও অপরিত্র ব্যক্তির এ‘তেকাফ শুদ্ধ হবে না।
এ‘তেকাফের স্তম্ভ:
এ‘তেকাফের মূল সত্তা হলো আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে বা নিয়তে মসজিদে অবস্থান করা। মসজিদে অবস্থান না করলে কিংবা আল্লাহর ইবাদতের নিয়ত না করলে এ‘তেকাফ হবে না। নিয়ত যে অপরিহার্য তার প্রমাণ আল্লাহ বলেন; তাদেরকে একমাত্র একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করার আদেশ দেওয়া হয়েছিল। (সূরা বাইয়্যিনাহ: ৫) এবং রাসূল (সাঃ) বলেন যাবতীয় কাজ নিয়ত অুনযায়ী বিবেচিত হয়ে থাকে। (বুখারী)
লক্ষণীয় বিষয়:
মসজিদ আল্লাহর ঘর। দুনিয়ার সবচেয়ে পবিত্র ও উত্তম স্থান। তাই এই মসজিদের আদব রক্ষা করে চলা প্রতিটি মুমিনের ঈমানী দায়িত্ব। অতএব মসজিদে অবস্থানের সময় দুনিয়ার বেহুদা কথা-বার্তা, হট্টগোল করা উচিত নয়।
এ‘তেকাফের মাসায়েল:
১) এ‘তেকাফের নিয়ত করতে হবে। ২) মসজিদ হতে বিনা কারণে বের হওয়া যাবে না। ৩) পেশাব-পায়খানা, ফরজ গোসলের জন্য বাইরে যাওয়া যাবে। ৪) জুমুয়ার নামাযের জন্য বাইরে যাওয়া যাবে। ৫) এ‘তেকাফকারীকে মসজিদের আদব রক্ষা করে চলতে হবে। ৬) সুন্নাতে মুয়াক্কাদা আলাল কেফায়া আদায়ের জন্য রোযা শর্ত।
পরিশেষে একটি প্রশ্নের জবাব দিয়ে প্রবন্ধের যবনিকা টানছি: একটি জিজ্ঞাসা: রমযানের শেষ দশক অধিক ফযীলতপূর্ণ নাকি যিলহজ্ব মাসের প্রথম দশ দিন বেশি ফযীলত সম্পন্ন ?
জবাব: যিলহজ্ব মাসের প্রথম দশ দিবস অধিক ফযীলতপূর্ণ, এ ব্যাপারে কোন মতভেদ নেই। কারণ, এ বিষয়ে অসংখ্য দলীল-প্রমাণ রয়েছে। তবে মতভেদের অবকাশ রয়েছে রাত্রির ফযীলত নিয়ে। অর্থাৎ, রমযানের শেষ দশকের রাত বেশি ফযীলতপূর্ণ না যিলহজের প্রথম দশকের রাতসমূহ বেশি ফযীলতের অধিকারী ?
বিশুদ্ধতম মত হল, রাত হিসেবে রমযানের শেষ দশকের রাতগুলো ফযীলতের দিক দিয়ে অধিক মর্যাদার অধিকারী। আর দিবসের ক্ষেত্রে যিলহজ্ব মাসের প্রথম দশ দিবস অধিক মর্যাদার অধিকারী।
ইবনে রজব রহ. বলেন: যখন রাত্র উল্লেখ করা হয় তখন দিবসগুলোও তার মাঝে গণ্য করা হয়। এমনিভাবে, যখন দিবস উল্লেখ করা হয় তখন তার রাত্রিগুলো তার মাঝে গণ্য হয়; এটাই নিয়ম। এ ক্ষেত্রে শেষ যুগের উলামায়ে কেরাম যা বলেছেন সেটাই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হতে পারে। তাহল, সামগ্রিক বিচারে যিলহজ্ব মাসের প্রথম দশকের দিবসগুলো রমযানের শেষ দশকের দিবসসমূহের চেয়ে অধিকতর মর্যাদাসম্পন্ন। আর রমযানের শেষ দশকের লাইলাতুল কদর হল সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন।
মহান আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করি হে মহান প্রভূ! আমাদের সকলকে এ‘তেকাফ করে মাহে রমযানের পূর্ণ বরকত হাসিল করার তাওফীক দান করুন। আমীন

Related Post