ইসলাম এমন এক পরশপাথর, যার পরশে শুধু লোহাই সোনা হয় না, কর্দমাক্ত মাটিও হীরকখণ্ডে পরিণত হতে পারে, যদি তাকে সেভাবে গ্রহণ করা হয়, যেভাবে গ্রহণ করা উচিত। নইলে ষষ্ঠ শতকের আরবের সেই জাহেলিয়াত অসভ্য একটি জাতি কিভাবে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত হলো? সেই অকারাচ্ছন্ন সমাজ থেকে কিভাবে বেরিয়ে এল হযরত আবুবকর (রাঃ), হযরত ওমর (রাঃ), হযরত ওসমান (রাঃ), হযরত আলী (রাঃ)-এর মতো শ্রেষ্ঠ জননন্দিত ন্যায়পরায়ন শাসক। মাইকেল এইচ হার্টের মতো একজন খ্রিস্টান মনীষী তার ‘ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ একশত জন মনীষী’ নামের জীবনী গ্রন্থে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর পাশাপাশি হযরত ওমর (রাঃ)-এর নাম স্থান দিতে বাধ্য হয়েছেন। মহামানব হযরত মুহাম্মাদ মুস্তাফা (সাঃ)-এর প্রভাব ও ইসলামের সুমহান আদর্শের জন্যই এটা সম্ভব হয়েছে।
একটি ভারসাম্যপূর্ণ সুষম জীবনব্যবস্থার প্রভাবের কারণেই বিশ্ববাসী উপহার পেয়েছে আল বাত্তানী, আল ফারাবী, ইবনে সিনা, ওমর খৈয়াম, ঈমাম গাজ্জালী, আবু হানিফা, আল বেরুনী, ইবনুন নাফিস, শেখ সাদী, আল্লমা ইকবালের মতো মহাজ্ঞানী, বিজ্ঞানী ও দার্শনিক। ইসলাম নিছক কোনো ধর্ম বা মতবাদের নাম নয়। এটা একটা পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। বিশ্বমানবতার মুক্তির জন্য ইসলাম এবং হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর আনীত জীবন আদর্শের বিকল্প কোনো মতাদর্শ অদ্যাবধি কেউ আবিস্কার করতে পারেনি আর পারবেও না। একমাত্র ইসলামই পারে এই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ অশান্ত পৃথিবীকে শান্ত করতে। পৃথিবীর সাড়ে ৬০০ কোটি লোক যদি একটি আদর্শ বিশ্বব্যবস্থা কায়েম করতে চায় তাহলে অবশ্যই ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে হবে। বিগত দেড় হাজার বছর ধরে দার্শনিক, চিন্তাবিদ, বৈজ্ঞানিক এবং রাজনীতিবিদরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মতবাদ নিয়ে মানুষের সামনে হাজির হয়েছেন। কেউ এসেছেন বস্তুবাদ বা পুঁজিবাদের শ্লোগান নিয়ে, কেউ এসেছেন নাস্তিক্যবাদ বা কমিউনিজমের শোভাযাত্রা নিয়ে আবার কেউ আবির্ভূত হয়েছেন ধর্মনিরপেক্ষতার মোড়কে ধর্মহীনতার বিজয়োৎসব সহকারে। কিন্তু সবাই ক্ষুধামুক্ত সুখ-সমৃদ্ধপূর্ণ পৃথিবী গড়তে ব্যর্থ হয়েছেন। আর মানবসৃষ্ট কোনো মতাদর্শ পারেনি খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজিজ, হারুন-অর-রশিদ, সুলতান মাহমুদ, আওরঙ্গজেব কিংবা বাদশা ফয়সালের মতো এক একজন ন্যায়পরায়ণ, প্রজাবৎসল, মানবহিতৈষী ও যোগ্য রাষ্ট্রনায়ক উপহার দিতে। সব মতবাদই মানবসমস্যার পুঙ্খানুপুঙ্খ সমাধান দিতে অক্ষমতা প্রকাশ করেছে। এজন্যই বর্তমান বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক ও দার্শনিক জর্জ বার্নাড বলেছেন : ‘ইসলামই একমাত্র ধর্মব্যবস্থা, যা পৃথিবীর সব যুগের সব সমস্যার সমাধান দিতে সক্ষম।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘অদূর ভবিষ্যতে ইউরোপবাসী ইসলামকেই তাদের একমাত্র ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করবে বলে আমার বিশ্বাস।’
ইসলাম বরাবরই অন্যায়, অবিচার ও বর্বরতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে আসছে। ইসলামে কোনো জাত, ধর্ম, বর্ণ এবং সম্প্রদায়গত বিদ্বেষ নেই। সব সময়ই ইসলাম অত্যাচারীর বিপক্ষে এবং মজলুমের পক্ষে অবস্থান নেয়। এটাই ছিল মহানবী (সাঃ)-এর আদর্শ। দুনিয়া থেকে বিশৃঙ্খলা, ফেতনা, ফাসাদ, অসততা, মিথ্যা, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, জুলুম, অনিয়ম, সাম্প্রদায়িকতা ও প্রতিহিংসা বন্ধ করতেই ইসলামের আবির্ভাব। আর সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে এসব অপকর্ম দূর করতে যুগে যুগে মুসলিম সমাজে আবির্ভাব ঘটেছে মহানায়কদের। খালিদ বিন ওয়ালিদ, সাদ বিন আবু ওয়াক্কাস, তারিক বিন যিয়াদ, মুহাম্মাদ বিন কাসিম, সালাহউদ্দিন আইয়ুবি, মোহাম্মদ ঘোরি, বখতিয়ার খিলজি, নবাব সিরাজউদ্দৌলা, সাইয়্যেদ আহমাদ বেরলভি, জামাল উদ্দিন আফগানী এবং জওহার দুধায়েভের মতো সিপাহসালাররা সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে কীটদের অপতৎপরতা বন্ধ করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছেন যুদ্ধের ময়দানে। কেউ কামিয়াব হয়েছেন, আবার কেউ শাহাদাতের পেয়ালা পান করেছেন। তাই দেখা যায়, ইসলাম থেমে থাকার ধর্ম নয়, দুনিয়ার আদিতে হযরত আদম (আঃ)-এর মাধ্যমে এর যে শুভযাত্রা শুরু হয়েছিল আজও সে গতি অব্যাহত আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত চিরন্তন গ্রহণযোগ্য জীবনদর্শন হিসেবে এগিয়ে চলবে অপ্রতিহত গতিতে।
ইসলাম সার্বজনীন ধর্ম। এখানে জন্মসূত্র, বর্ণসূত্র, গোত্র বা সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত, রাষ্ট্র বা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ এমন কোনো ধারণা নেই। এখানে সবকিছু নির্ধারিত হয় কর্মের ভিত্তিতে। যেকোনো জাতি এবং যেকোনো মানুষ সানন্দে ‘ইসলাম’ কবুল করতে পারে। সবার জন্য এটা উন্মুক্ত। ইসলাম মানুষের স্বভাবজাতধর্ম। প্রত্যেক মানুষ মুসলমান হয়ে জন্মলাভ করে। অভিভাবক, সমাজব্যবস্থা ও পরিবেশ তাকে অমুসলমান বানায়। এজন্যই পোল্যান্ডের বিশিষ্ট আইনজীবী, সাংবাদিক, চিন্তাবিদ ইহুদী পণ্ডিত লিওপোলড উইস (আল্লামা মুহাম্মাদ আসাদ) ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর একে তিনি ‘স্বগৃহে’ ফিরে আসা বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। তাই আজ সময় এসেছে বিশ্বের মানব জাতিগুলোর মূলের কাছে ফিরে আসার। ইসলামের পতাকাতলে হাজির হলে যে কারো মুক্তি অবধারিত। অন্যদিকে এ অগ্নিগর্ভ, যুদ্ধবিধ্বস্ত ও পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়ায় আক্রান্ত পৃথিবী নামের ভূখণ্ডটিকে রাহুগ্রাসমুক্ত করতে হলে কুরআনী অর্থনীতি, সমাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতিকেই গ্রহণ করতে হবে। মদীনা সনদের সেই ঐতিহাসিক ধারা গুলো অনুসরণ করলে একটি সহনশীল বিশ্ব গড়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন : আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে (জীবন বিধান) পূর্নাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অবদান সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন (জীবন বিধান) হিসেবে পছন্দ করলাম। (সূরা মায়িদা-০৩)
বিজ্ঞানের নানা আবিষ্কার, পরিবর্তন ও বিবর্তন আধুনিকতায় অল্প বিস্তর প্রভাব ফেলেছে বটে। তবে মূলত আধুনিকতা ও প্রগতির নির্ভেজাল সৌকর্য-শোভার অগ্রযাত্রার সূচনা করেছে শাশ্বত ধর্ম ইসলাম। একমাত্র ইসলামই তাবৎ কলুষতা ধ্বংস করে। উত্তম, সিদ্ধ পবিত্র এবং ইহ ও পরকালের জন্য কল্যাণকর সব কিছুর দিকনির্দেশনা দেয় ইসলাম। ইসলামই প্রকৃত আধুনিকতা ও প্রগতির ভিত্তি স্থাপন করেছে। যা কোনো কালের সীমায় আবদ্ধ থাকেনি। বরং সেই সপ্তম শতাব্দী থেকে আজ অবধি সমানভাবে বহমান রয়েছে এবং অনাগতকাল পর্যন্ত বহমান থাকবে। ইসলাম চির আধুনিক ও চির প্রগতিশীল। ইসলাম হচ্ছে ফিতরাত স্বভাবজাত ধর্ম। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সময়ের শ্রষ্টা। যে কারণে তার দেওয়া জীবন ব্যবস্থা নির্দিষ্ট সময়কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না, সেটা সর্বকালে উন্নতিশীল, প্রগতিশীল। ইসলাম যা কিছু ভালো তাকে গ্রহণ করতে বলে। যা কিছু মন্দ তা বর্জন করতে বলে।
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন : তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল হোক যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে এবং সৎকাজের আদেশ করবে আর অসৎ কাজে নিষেধ করবে। আর তারাই তো সফলকাম। (সূরা আল ইমরান-১০৪)
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যখন এই পৃথিবীতে আগমন করেন তখন পৃথিবীটা অজ্ঞতা, কুসংস্কার, অন্ধকার, শিরক, কুফর, নৈরাজ্য ও নৈরাজ্যের ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। আধুনিকতা প্রগতি, সভ্যতা ও সংস্কৃতির জন্য যে সুশোভিত সৌকর্য বৈভব থাকার কথা যে সুনৈতিকতা, সুশীলতা শ্লীলতা থাকার কথা তখন তা মোটেই ছিল না। সর্বত্র বিরাজ করছিল অসভ্যতা, অশ্লীলতা ও অপসংস্কৃতি। অনৈতিকতা, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, জুলুম, নির্যাতন, বঞ্চনা, গঞ্জনা এই পৃথিবীকে বসবাসের অনুপযোগী করে তুলেছিল। সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবীতে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর শুভাগমন ছিল অন্ধকার থেকে আলোয়, বর্বরতা থেকে আধুনিকতায়, পশ্চাৎপদতা থেকে প্রগতির পথে কাঙ্ক্ষিত উত্তরণ। তিনি যে আধুনিকতা ও প্রগতির পথ দেখালেন তা সর্বকালের সব মানুষের জন্য। যা কখনো পুরনো হয় না, কখনোই প্রগতি থেকে দূরে থাকে না। বরং আধুনিকতা ও প্রগতির নামে যে সব অশ্লীলতা, বেলেল্লাপনা, অন্যায় অসভ্যতার অপচেষ্টা হয় তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। আধুনিকতা ও প্রগতির প্রধান উপাদান হচ্ছে জ্ঞান-বিজ্ঞান। ইসলাম জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনুশীলন ও চর্চার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে : পাঠ কর তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। (সূরা আলাক-১) আরও ইরশাদ হয়েছে : নিশ্চয়ই আসমানসমূহ ও জমিন সৃষ্টির মধ্যে এবং রাত-দিনের পরিবর্তনের মধ্যে বুদ্ধিমানদের জন্য রয়েছে নিদর্শন। (আল ইমরান-১৯০) এ ধরনের আয়াতগুলোতে যেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের গোড়াপত্তনই করা হয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন : হে ঈমানদারগণ! তোমরা পুরোপুরি ইসলামে প্রবেশ করো এবং শয়তানের অনুসারী হয়ো না, কেননা সে তোমাদের সুস্পষ্ট দুশমন। (সূরা বাকারা-২০৮) অর্থাৎ, কোন প্রকার ব্যতিক্রম ও সংরক্ষন ছাড়াই, কিছু অংশকে বাদ না দিয়ে এবং কিছু অংশকে সংরক্ষিত না রেখে জীবনের সমগ্র পরিসরটাই ইসলামের আওতাধীন করো। তোমাদের চিন্তা-ভাবনা, আদর্শ, মতবাদ, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা, আচরণ, ব্যবহারিক জীবন, লেনদেন এবং তোমাদের সমগ্র প্রচেষ্টা ও কর্মের পরিসরকে পুরোপুরি ইসলামের কর্তৃত্বাধীনে আনো। তোমাদের জীবনের কিছু অংশে ইসলামী অনুশাসন মেনে চলবে আর কিছু অংশকে ইসলামী অনুশাসনের বাইরে রাখবে, এমনটি যেন না হয়।
আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে সঠিক জ্ঞান অর্জন করার তাওফীক দান করুন। আমীন