আমি কেন ইসলাম গ্রহণ করলাম

Originally posted 2013-06-03 08:53:32.

আমি কেন ইসলাম গ্রহণ করলাম

ইসলাম গ্রহণ

 ৫ম পর্ব

স্বাভাবিকতার পথ ধরেই বিদায়ের দিন ঘনিয়ে এসেছে। বিজ্ঞ পণ্ডিত মন্ডলীর হিসাবানুযায়ী বাংলাদেশী মানুষদের গড়-পড়তার যতদিন বেঁচে থাকার কথা, বেশ কিছুকাল পূর্বেই আমার সে বয়স অতিক্রান্ত হয়েছে।  অতএব যে কোন মুহূর্তে বাড়তি সময়টুকুর অবসান ঘটিয়ে সেই চরম দিনটির আগমন মোটেই অস্বাভাবিক নয়।  অথচ ভাবলে আশ্চর্য হতে হয় যে, এই চরম দিনটির আগমন যে অবশ্যম্ভাবী এবং নিকটবর্তী সেকথা জানার পরেও তাকে সাগ্রহে বরণ করার মত কোন প্রস্তুতি আজও আমি গ্রহণ করতে পারিনি।

 এই সুদীর্ঘ জীবনে বহু ঘাত-প্রতিঘাত এবং চড়াই-উৎরাই-মোকাবিলা আমাকে করতে হয়েছে; আর তা থেকে অভিজ্ঞতা আমি লাভ করেছি অপরের তুলনায় তার পরিমাণ সামান্য, এমনকি নগণ্যও হতে পারে।  কিন্তু নগণ্য হলেও উপেক্ষণীয় নয় এবং উপেক্ষণীয় নয় বলেই তাকে যক্ষের ধনের মত আঁকড়ে থাকা বা কবরে নিয়ে গিয়ে পঁচিয়ে ফেলার কোন অধিকার আমার নেই।

তাছাড়া শৈশব থেকে শুরু করে যৌবনে পদার্পণ করা পর্যন্ত আমার চোখের সামনে ঘটে যাওয়া যে সব ঘটনা আমাকে সত্যের সন্ধানে ব্যাকুল করে তুলেছিল এবং যে সব কারণে ইসলাম গ্রহণ আমার কাছে অপরিহার্য বলে বিবেচিত হয়েছিল, অনন্ত সত্যানুসন্ধিৎসু মানুষেরা যাতে সেই ঘটনাবলী এবং কারণসমূহ থেকে কিছুটা সাহায্য পেতে পারেন তেমন কোন ব্যবস্থা না করে যাওয়াকে আমি অনন্ত আমার পক্ষে চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয়ক বলেই মনে করি।

এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, দায়িত্ব-জ্ঞান সম্পর্কে এরূপ সচেতন থাকার পরেও এই সুদীর্ঘকাল এ সম্পর্কে কোন উদ্যোগ কেন গ্রহণ করা হয়নি?

 এই প্রশ্নের উত্তর স্বরূপ বলা যেতে পারে যে, উদ্যোগ অবশ্যই গ্রহণ করা হয়েছিল এবং তাতে আন্তরিকতারও কোন অভাব ছিল না।  কিন্তু তা সত্ত্বেও নানা কারণে সেই উদ্যোগকে যথাযথভাবে চালিয়ে নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠেনি।

 কি উদ্যোগ আমি গ্রহণ করেছিলাম আর কেই বা তাকে চালিয়ে নেয়া সম্ভব হয়ে উঠেনি সে সম্পর্কে এখানে দু’কথা বলা প্রয়োজন।  অথচ অতীতের তুলনায় কিছুটা কম হলেও এ কাজে আজও যথেষ্টা বাঁধা-বিঘ্ন রয়েছে।  তদুপরি রয়েছে আত্ম-প্রচারণার পাপে সব কিছু ভন্ডুল হয়ে যাওয়ার প্রবল আশংকা।

 একথা আমার বেশ ভালভাবেই জানা রয়েছে যে, সেদিনের আমার গৃহীত উদ্যোগ প্রয়োজনের তুলনায় ছিল একান্তরূপেই অকিঞ্চিৎকর, সুতরাং উল্লেখের অযোগ্য।  আর তা করাও হয়েছিল কর্তব্যের তাকীদে; এমতাবস্থায় আত্ম-প্রচারণার প্রশ্নই উঠতে পারে না।

 কিন্তু আজ লিখতে বসে একান্ত বাধ্য হয়েই সেই অকিঞ্চিৎকর এবং উল্লেখের অযোগ্য বিষয়কেই জন-সমক্ষে তুলে ধরতে হচ্ছে।  অতএব যিনি অন্তরের সব খবর জানেন, প্রথমেই অন্তর্যামী প্রভুর উদ্দেশ্যে আকুল প্রার্থনা জানাই তিনি যেন আত্মপ্রচারণার জগণ্য পাপ থেকে এ দিনকে রক্ষা করেন।

 অতঃপর আমার সেদিনের গৃহীত উদ্যোগ সম্পর্কে বলা যেতে পারে যে, আমার ইসলাম গ্রহণের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর পূর্বে ‘বিশ্বনবী (সাঃ) এর বিশ্ব সংস্কার এবং ‘রোজাতত্ত্ব’ নামে দু’খানা বই আমি লিখেছিলাম।  এর অব্যবহিত পরে ‘মরুর ফুল’ নামে একখানা কবিতার বইও লিখা হয়েছিল।  আর্থিক অনটন এবং অন্যান্য প্রতিকূলতা সত্ত্বেও কোনক্রমে বই তিনখানা মুদ্রিত আকারে জনসাধারণের হাতে তুলেও দিয়েছিলাম।

এছাড়া বিভিন্ন সভা-সমিতিতে বক্তৃতার মাধ্যমে আমার ইসলাম গ্রহণের কারণসমূহকে তুলে ধরার চেষ্টাও আমি করে যাচ্ছিলাম।  কিন্তু শেষ পর্যন্ত একান্ত বাধ্য হয়ে আমাকে নিরস্ত হতে হয়েছিল।  অথবা বলা যেতে পারে যে, আমাকে নির্মমভাবে নিরস্ত করা হয়েছিল।  কেন নিরস্ত হতে হয়েছিল অতঃপর সে কথাই বলা যাচ্ছে।

 বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, প্রথম থেকে লক্ষ্য করা গিয়েছিল যে, আমার এই কার্যকলাপের জন্য একটি বিশেষ মহল আমার উপরে অতিমাত্রায় রুষ্ট হয়ে উঠেছে।  অবশ্য তার কিছুটা কারণও ঘটে গিয়েছিল।  আর তা-ও ঘটেছিল ধর্মসভায় আমার জীবনের প্রথম বক্তৃতায় থেকেই।  সüদয় পাঠকবর্গের অবগতির জন্যে ঘটনাটা খুলে বলা যাচ্ছে।

মহিমাগঞ্জ (রংপুর জিলা) আলীয়া মাদ্রাসার ছাত্র থাকাকালে কোচাশহর ও প্রমুখ গ্রামদ্বয়ের মধ্যবর্তী এক মাঠে (যতদূর মনে পড়ে শোলাগাড়ী ঈদগাহ মাঠে) আয়োজিত একটি ধর্মসভায় দু’কথা বলার সুযোগ হয়েছিল।  আর সেটাই ছিল ধর্মসভায় আমার জীবনের প্রথমত বক্তৃতায়।

 বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, উক্ত সভায় দু’জন হিন্দু যুবক ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করে, এর অব্যবহিত পরবর্তী  সময়ে উক্ত যুবকদ্বয়ের একজনের (যার ইসলাম নাম গোলাম কাদের রাখা হয়েছিল) পিশিমাতাও ইসলামের সুশীতল ছায়ায় গ্রহণ করেছিলেন।

 বলা আবশ্যক যে, এই পিশিমাতা কিশোরী অবস্থায় বিধবা হন এবং পৌঢ়াবস্থায় যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন বিবাহের বয়স তার অতিক্রান্ত হয়েছে।  ইসলাম গ্রহণের কয়েক বছর পরে তিনি ইন্তেকাল করেন।  সুতরাং সারাটি জীবনই তাকে বৈধব্যর অভিশাপ বহন করতে হয়েছে।

 একথা খুলে বলার প্রয়োজন হয় না, ইসলাম গ্রহণের কারণে আমি যাদের বিরাগভাজন হয়েছিলাম বোধগম্য কারণেই তাঁরা নানাভাবে আমাকে নাজেহাল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।  তবু এটাকে একান্তরূপে ব্যক্তিগত ব্যাপার এবং একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে করে তাঁরা একেবারে অধৈর্য হয়ে উঠেছিলেন না।

 কিন্তু সেই আমি যখন ইসলাম প্রচারের কাজও শুরু করলাম এবং ধর্মসভায় আমার জীবনের প্রথম বক্তৃতা শুনে তাঁদেরই সমপ্রদায়ভুক্ত তিনজন মানুষ ইসলাম গ্রহণ করলো তখন ধৈর্য্য রক্ষা করা তাঁদের পক্ষে একরূপ অসম্ভব হয়ে পড়লো।

এর পরবর্তী  তিন বছরে বিভিন্ন ধর্ম সভায় আমার বক্তৃতা শুনে অন্যান্য ধর্মের অন্যুন ষাট জন নর-নারীকে ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতে এবং আল্লাহর রহমতে ইসলাম গ্রহণ করতে দেখে শুধু তাদের ধৈর্যের বাঁধই ভেঙ্গে পড়েছিল না নিদারুণ ক্ষোভ এবং দুর্দমনীয় প্রতিশোধ স্পৃহাও তাদের অন্তরে জেগে উঠেছিল।  ঠিক এই সময়েই বিশ্বনবী (দঃ) এর বিশ্ব সংস্কার নামীয় আমার লিখিত প্রথম বইখানা কোনক্রমে ছাপা হয়ে জনসাধারণের মধ্যে বেশ কিছুটা আলোড়ন সৃষ্টি করে।  এমতাবস্থায় এই বিশেষ মহলটির মানসিক উত্তেজনা যে কোন পর্যায়ে উপনীত হতে পারে অনুমান করা কঠিন নয়।

 এই অবস্থা অর্থাৎ ক্ষোব এবং প্রতিশোধ স্পৃহা চরিতার্থ করণের জন্যে যে সব উপায় তাঁরা অবলম্বন করেছিলেন তার অন্যতম প্রধার উপায়টি ছিল তদানীন্তন সরকারের কাছে আমার বিরুদ্ধে সামপ্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানো এবং উত্তেজনা সৃষ্টির মিথ্যা ও স্বকপোলকল্পিত অভিযোগ আনয়ন।

 উল্লেখ্য যে,একেতো কুনীতিতে তাদের পারদর্শিতা সর্বজনবিদিত,উপরন্ত সংখ্যা শক্তিতেও তাঁরা ছিলেন অতীব প্রবল।  সুতরাং অভিযোগ যত মিথ্যা এবং স্ককপোলকল্পিতই হোক, সুফল পেতে তাদের মোটেই বিলম্ব হয়নি।

ফলে প্রথমে নোয়াখালী জিলা-কর্তৃপক্ষ বক্তৃতা প্রদান থেকে বিরত থাকার জন্যে আমার প্রতি এক কঠোর নির্দেশনামা জারী করেন, পরে ময়মনসিংহ জিলার কর্তৃপক্ষ কর্তৃকও অনুরূপ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

ওদিকে রংপুর জিলার উলিপুর থানার তদানীন্তন দারোগা সাহেব সেই বিশেষ মহলটির প্ররোচনায় কর্তৃপক্ষের নিকট আমার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ সম্বলিত এক গোপন রিপোর্ট প্রেরণ করেন।  উচ্চ মহল কর্তৃক উক্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে গোপনে গোপনে তদন্তের প্রহসনও চালানো হয়, আর এক্ষেত্রে তদন্তের ফলাফল কি হতে পারে সে কথাও সহজেই অনুমেয়।

 আল্লাহর অপার অন্যগুহে ঠিক এই পর্যায়ে কোনভাবেই হোক বিষয়টি কুড়িগ্রামের প্রখ্যাত আইনজীবী এবং তদানীন্তন এম.এল.এ জনাব নজির হোসেন খন্দকার সাহেবের গোচরীভূত হয়, অভিযোগটি যে মিথ্যা এবং বিদ্বেষ-প্রষূত, কর্তৃপক্ষকে সে কথা বুঝানোর জন্যে তিনি যথাসাধ্য চেষ্টাও করেন, কিন্তু তাঁকে নিদারুণভাবে ব্যর্থ হতে হয়।  শুধু তাই নয়, যে কোন মুহূর্তে আমাকে গ্রেফতার করা হতে পারে এমন আশংকা নিয়েই তিনি ফিরে আসেন।

অগত্যা সাময়িকভাবে হলেও গ্রেফতার এড়ানোর জন্যে অবিলম্বে কলকাতা যাওয়ার জন্যে তিনি আমাকে পরামর্শ দেন এবং শেষ প্রচেষ্টা হিসাবে বিষয়টির প্রতি মরহুম শ্রদ্ধেয় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (তদানীন্তন সরকারের সিভিল সাপ্লাই বিভাগের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী) সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করতে বলেন।

 তার পরামর্শানুযায়ী সেদিনই আমি কলকাতা রওয়ানা হই এবং সুযোগ মত একদিন শ্রদ্ধেয় সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করি।  এখানে উল্লেখ্য যে, শ্রদ্ধেয় সোহাওয়ার্দী সাহেবের সাথে পুর্ব থেকেই আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল এবং ইসলামের সৌন্দর্য বর্ণনা করা ছাড়া কারো বিরুদ্ধে কোনরূপ বিদ্বেষ ছড়ানো বা উত্তেজনা সৃষ্টিকে আমি যে অন্তরের সাথে ঘৃণা করি সে কথাও তিনি জানতেন।

 তাছাড়া, ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজ পবিত্র ইসলামে কঠোরভাবে নিসিদ্ধ ঘোষিত হওয়া সম্পর্কেও যে আমি অনবহিত নই সে কথাও তাঁর অজানা ছিল না।  আর অন্য ধর্মের কোন ব্যক্তি কর্তৃক ইসলামের সৌন্দর্য প্রচারকে তারা যে সামপ্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানো ছাড়া অন্য আখ্যা দিতে পারেন না এ সাধারণ কথাটা বুঝবার মত জ্ঞান সোহরাওয়ার্দী সাহেবের অবশ্যই ছিল।

আর ছিল বলেই তিনি আগ্রহে আমার সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন।  তবে এ ব্যাপারে তিনি কি ব্যবস্থা অবলম্বন করেছিলেন সে কথা আমি জানি না।  শুধু এটুকুই জানি যে, অতঃপর সেই বিশেষ মহলটির কতিপয় গণ্যমান্য ব্যক্তি বহু ছুটাছুটি করেও উক্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে আমাকে জড়ানোর কাজে সফল হতে পারেননি এবং দারোগা সাহেবকেও পদাবনতিসহ অনতিবিলম্বে বহু দূরবর্তী স্থানে বদলী হতে হয়েছিল।

 এভাবে ব্যর্থতা বরণের পরেও তাঁরা নিরস্ত হননি, বরং গুণ্ডা-পাণ্ডা লেলিয়ে দিয়ে আমাকে অপমান অপদস্হ করার কাজ দীর্ঘদিন যাবৎ চালিয়ে গিয়েছেন, কয়েক ব্যক্তির ইসলাম গ্রহণকে কেন্দ্র করে তাদের আত্মীয় অভিভাবক কর্তৃক দায়েরকৃত মামলা মোকদ্দমায় প্রধান অথবা অন্যতম আসামী হিসাবে আমাকে জড়ানোর প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে তৎপর একটি নাম করা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পাণ্ডা কর্তৃক উদ্দেশ্য মূলকভাবে প্রতিমা ভাঙ্গা, মন্দির অপবিত্রকরণ, ব্রিহ অপসারণ প্রভৃতি জঘন্য কাজগুলোকে অন্যায়ভাবে আমার ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা চালিয়ে দিয়েছেন।  এ সময় বন্ধু-বান্ধব এবং হিতাকাঙক্ষী ব্যক্তিদের অনেকে আমার প্রাণ নাশের আশঙ্কা করতে থাকেন এবং তাঁদের এ আশঙ্কা যে অমূলক নয় তেমন কতিপয় প্রমাণের উল্লেখ তাঁরা করেন।

এহেন অবস্থায় সাময়িকভাবে হলেও আমাকে যে কতখানি হতবুদ্ধি হতে হয়েছিল সেকথা সহজেই অনুমেয়।  আর এসব ঘটনার পরে প্রচার কায তথা আমার ইসলাম গ্রহণের কারণসমূহকে জনসাধারণ্যে তুলে ধরা কতখানি সম্ভব ছিল সেকথা বুঝতে পারও খুব কঠিন নয়।

   ১ম পর্ব  এখানে   ২য় পর্ব এখানে ৩য় পর্ব  ৪র্থ পর্ব

 

Related Post