Originally posted 2013-06-15 07:55:07.
৬ষ্ঠ পর্ব
একটি তিক্ত অভিজ্ঞতা :
এ থেকে আমি যে তিক্তা অভিজ্ঞতা লাভ করেছি সকলের অবগতির জন্যে এখানে তা তুলে ধরা অপ্রাসঙ্গিক হবে না বলেই মনে করি এবং আশা করি যে, ইসলাম-দরদী সুধী ব্যক্তিরা গভীরভাবে বিষয়টি ভেবে দেখবেন এবং কার্যকর ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসবেন।
আমাদের যুব সমাজ অর্থাৎ ভারত বিভক্ত হওয়ার পরে যাদের জন্ম হয়েছে বা সে সময়ে যারা ছোট ছিলেন, বিষয়টি সম্যকভাবে উপলব্ধি করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠবেনা বিধায় প্রথমে পটভূমিকা স্বরূপ বলতে হচ্ছে-
সেদিন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোন ব্যক্তির ইসলাম গ্রহণের সাথে সাথে উপরিউক্ত মহলের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান চঞ্চল হয়ে ছুটে এসেছে এবং নব দীক্ষিতের আত্মীয়-অভিভাবক প্রভৃতিকে উস্কানী, অর্থ লোভ ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে এই দীক্ষাগ্রহণের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করত মামলা দায়ের করতে বাধ্য করেছে।
মিথ্যা সাক্ষ্য প্রমাণাদি সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে মামলার যাবতীয় খরচপত্র এবং অন্যান্য দায়িত্ববহন করেছে এই সব প্রতিষ্ঠানই। ফলে অভিভাবকদেরকে মামলা চালাতে কোন অসুবিধার সম্মুখীন তো হতে হয়নি, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে আর্থিক দিক দিয়ে তারা বেশ লাভবানও হয়েছেন।
আর তাদের এই সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার ফলে অনেক নবদীক্ষিতকেই যে নতুন করে গবোর-চোলা খেয়ে শুদ্ধ হতে হয়েছে সেকথাও বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তিদের মোটেই অজানা নয়।
সে সময়ে এমন ঘটনাও মোটেই বিরল ছিল না যে, আট দশ বছর পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেছে এমন অনেক মহিলার বেলায়ও ফুসলানী, ছিনতাই বা বল প্রয়োগে মুসলমান করার মিথ্যা অভিযোগ এনে কোর্টের সহায়তায় তাদেরকে স্বামী সন্তান প্রভৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পূর্বতন অভিভাবক অথবা ক্ষেত্র বিশেষে মহিলাদের আবেদনক্রমে কোন নিরপেক্ষ হোম এ দীর্ঘদিন আটক রেখে ‘মস্তিষ্ক ধোলাইয়ের’ ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এ ব্যবস্থার ফলে দু’চারটি ছাড়া বাকী সকল ক্ষেত্রেই ধোলাইয়ের কাজে বেশ সুফল তারা পেয়েছেন। ফলে ঐসব ধোলাইকৃত মহিলাদের হতভাগ্য স্বামীদেরকে শুধু এমন জঘণ্য ধারণার মিথ্যা মামলার আসামী হয়ে ভীষণভাবে লাঞ্ছিত অপমানিত এবং সর্বস্বান্তই হতে হয়নি, দীর্ঘকাল ব্যাপী কঠোর কারাদণ্ডও ভোগকরতে হয়েছে।
যেখানে এ ধরনের মামলা মোকদ্দমার সুযোগ নেয়া সম্ভব হয়নি, সেখানে এসব সামপ্রদায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো সমবেত হয়ে অথবা পৃথক পৃথকভাবে নওমুসলিমদের উপর দিনের পর দিন নানা ধরণের নির্যাতন চালিয়ে গিয়েছে।
অতীব মর্মান্তিক এবং ভীষণভাবে লজ্জাজনক যে বিষয়টিকে তুলে ধরার জন্যে এখানে এসব ঘটনার কিছুটা অভাস দেয়া হলো, সে বিষয়টি এই যে, যখন এই সব শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানগুলোর সাহায্যপুষ্ট হয়ে উপরিউক্ত বিশেষ মহলটি অত্যাচারের ষ্টিম রোলার চালিয়ে যাচ্ছিল তখন ব্যক্তিগতভাবে দু’একজন ইসলাম দরদী ব্যক্তি ছাড়া- এই সর্বত্যাগী এবং চরমভাবে লাঞ্ছনা পীড়িত নওমুসলিমদের সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্যে তেমন কোন ইসলামী প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায়নি।
অথচ তেমন কোন প্রতিষ্ঠান থাকলে সেদিন আমাকে বা অন্য কোন নওমুসলিমকে এমনভাবে বিপন্ন হতে হতো না; হয়তো এই বিশেষ মহলটি এমনভাবে আদাজল খেয়ে নওমুসলিমদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালানোর সাহসই পেতো না।
এমন একটি সত্য, শাশ্বত এবং প্রচারমূলক ধর্ম হয়া সত্ত্বেও তার জন্যে কোনো শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের পরিচালনাধীনে সুযোগ এবং সমন্বিত প্রচার সংঘ না থাকা শুধু ইসলাম প্রচার এবং নওমুসলিমদের জন্যেই ক্ষতিকর হয়নি, সামগ্রিকভবে গোটা মুসলমান সমাজের জন্যেও ডেকে এনেছে নিদারুণ অবক্ষয়।
এমনি ধরনের শক্তিশালী কোন প্রতিষ্ঠান না গড়ার ফলে মুসলমান সমাজকে যে নির্মম পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে এবং আজও করতে হচ্ছে এই পুস্তকের ‘ভুলের মাশুল’ শীর্ষক নিবন্ধে সে সম্পর্কে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করা হয়েছে। অতএব এ নিয়ে আর আলোচনা না বাড়িয়ে আসুন আমাদের পূর্ব কথায় ফিরে যাই।
নানা অসুবিধা সত্ত্বেও সাহস করে ‘বিশ্বনবী (স.)-র বিশ্ব সংস্কারক’ নামক পাণ্ডুলিপিটি প্রেসে দিয়েছি। ছাপার কাজ চলছে, এমন সময়ে কিছু অর্থের প্রয়োজন হওয়ায় আমি গাইবান্ধার তদানীন্তন মহকুমা ম্যাজিষ্ট্রেট জনাব কলিম উদ্দীন সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করি। বই ছাপানো থেকে শুরু করে ইসলাম-প্রচার, নওমুসলিমদের নানা সমস্যা, ইসলাম প্রচারের জন্যে অনন্ত একখানা সাপ্তাহিক পত্রিকা থাকার প্রয়োজনীয়তা প্রভৃতি নানা বিষয়ে তাঁর সাথে আলাপ আলোচনা হয়।
কথা-প্রসঙ্গে জনাব কলিম উদ্দীন সাহেব বলেন যে, ‘গাইবান্ধা মহকুমায় অন্তত সাত হাজার মসজিদ রয়েছে; ফেৎরা এবং কুরবানীর বাবদ লক্ষ লক্ষ টাকা দান করা হয় অথচ এদ্বারা কোন গঠনমূলক কাজ হয়না। এই টাকার মধ্যে নওমুসলিমদের একটি অংশ রয়েছে। যদি প্রতিটি ঈদে প্রতিটি মসজিরে এলাকা থেকে মাত্র দু’টি করে টাকাও নওমুসলিমদের জন্যে সংগৃহীত হয়,তবে এক গাইবান্ধা মহকুমা থেকেই বছরে চৌদ্দ হাজার টাকা সংগৃহীত হতে পারে। আর প্রতি বছর অন্তত এই পরিমাণ টাকাও যদি পাওয়া সম্ভব হয় তবে আপনাদের সমস্যারও বেশ কিছুটা সমাধান হয়ে যেতে পারে।
তাঁর কথায় আমি এমনভাবে উৎসাহিত হই যে, পর দিনই স্থানীয় খানকাহ শরীফে একটি সাধারণ সভা আহবান করত বিষয়টির প্রতি উপস্থিত সুধীবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। সুখের বিষয়, সকলেই এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ার ব্যাপারে ঐক্যমত্যে উপনীত হন এবং সর্বসম্মতিক্রমে ‘নওমুসলিম তবলীগ জামাত’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তন করা হয়। সর্ব জনাব মাওলানা এ এ.কে. মনসুর আলী খান, প্রখ্যাত আইনজীবি সিরাজউদ্দীন বি.এল সাহেব, চৌধুরী ইমদাদ আলী সাহেব, মাওলানা মাছির উদ্দিন সাহেব প্রমুখকে উক্ত প্রতিষ্ঠানের কার্যকরী সদস্য এবং আমাকে সম্পাদক মনোনীত করা হয়। উল্লেখ্য যে দিল্লীতে অবস্থানকালে আগ্রাস্থ ‘নও-মুসলিম তবলীগ জামাত’ নামীয় প্রতিষ্ঠানটির সাথে আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটে। উক্ত প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা পাওয়ার আশায় আমাদের নবগঠিত এই প্রতিষ্ঠানটিরও একই নামকরণ করা হয়।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি অনুভব করি যে, এরূপে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ব্যাপারে আমার মধ্যে যোগ্যতার বহু অভাবই রয়েছে। তাছাড়া সমাজের অজ্ঞতা এবং একটি বিশেষ শ্রেণীর স্বার্থপরতার জন্য আমাকে নিদারুণভাবে হতাশও হতে হয়।