আমি কেন ইসলাম গ্রহণ করলাম?

আমি কেন ইসলাম গ্রহণ করলাম

ইসলাম গ্রহণের কাহিনী

পূর্বে প্রকাশিতের পর:

৮ম পর্ব

 এ প্রসঙ্গে আবদুস সোবহান ভট্টচার্য, দ্বীন মুহাম্মাদ গাঙ্গুলী, ইসমাইল খাঁ মুখার্জি, আবদুস সামাদ গোস্বামী, আব্দুল্লাহ বানার্জি, নুরুল ইসলাম অধিকারী, আবদুর রহমান বানার্জি, আমিনুল ইসলাম রায়, আবদুর রহমান গোপ, স্বামী  আনন্দ প্রকাশ গোলাম মোহাম্মদ, লর্ডহেডলী আল-ফারুক, আবদুল্লাহ ফ্রানসীস, মিঃ রশিদ শাপ, মিঃ আবদুল্লাহ কার্ডেল বায়ান, মিঃ মাইকেল মোবারক আহমেদ, মিস হেদায়েত বাড প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।  উল্লেখ্য যে অনেকের নাম আমার জানা নেই, আর যারা নামের সাথে অতীতের পদবী বা পরিচয় জ্ঞাপক কোন শব্দ ব্যবহার করেননি তাদের নাম এখানে তুলে ধরা হয়নি।  উল্লেখ্য যে, আমার নামের শেষে ভট্টাচার্য পদবীটি থাকার কারণেই আমি যে উচ্চ শ্রেণীর ব্রাহ্মণ থেকে ইসলাম গ্রহণ করেছি, অন্য ধর্মের মানুষেরা সহজেই যেন সে কথা বুঝতে সমর্থ হয় এবং একজন ব্রাহ্মণ হয়েও আমি কেন এ কাজ করেছি, সেকথা জানার, জন্যে তাদের মনে আগ্রহ জাগে।  আমার উত্তর শুনে তাদের অনেকেই ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং কেউ কেউ ইসলাম গ্রহণও করে।  আশা করি বিষয়টি সম্পর্কে বিশেষভাবে ভেবে দেখা হবে এবং অতঃপর ভট্টাচার্য পদবী রাখার জন্যে আর আমাকে বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হতে হবে না।

পূর্বেই বলেছি যে, যেখানেই আমি যাই আমি যে একজন নবদীক্ষিত মুসলমান সে কথা জানার সাথে সাথে উপস্হিত প্রায় সকলেই আমার ইসলাম গ্রহণের কারণ জানার জন্যে আগ্রহ প্রকাশ করে থাকেন।  তাঁদের এ আগ্রহ মিটানো আমার একটি নৈতিক দায়িত্ব।  আর সেই দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যেই ‘আমি কেন ইসলাম গ্রহণ করলাম’ বইটি লিখিত হয়েছে।  অর্থাভাব বশত পুস্তকের কলেবর ইচ্ছা এবং প্রয়োজনানুযায়ী বাড়ানো সম্ভব না হওয়ায় সকল কারণগুলো তুলে ধরা গেল না।  আল্লাহর কৃপা হলে পরে এ সম্পর্কে উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।

বিশেষভাবে বলা প্রয়োজন যে, আমি কবি, সাহিত্যিক বা লেখক প্রভৃতি কোনটাই নই।  তাছাড়া মাতৃভাষার পরিবর্তনীয় বা পরিবর্তনযোগ্য কোন শব্দ নির্বাচনেও আমি সক্ষম নই।  বাংলা ভাষার বৈশিষ্ট্য এবং স্বাতন্ত্র্য রক্ষা বা বিশুদ্ধিকরণের জন্যে সে ভাষার সাথে সুদীর্ঘকাল যাবৎ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত এবং সকল মহলে সহজ ও সাবলীলভাবে প্রচলিত আরবী, ফাসর্ী, ইংরেজী ভাষার শব্দগুলোকে বাদ দিয়ে দুর্বোধ্য, সংস্কৃত ও হিন্দি ভাষার শব্দকে টেনে এনে জুড়ে দেয়ার তাৎপর্য উপলব্ধি করার মত জ্ঞান বুদ্ধিও আমার নেই।

অতএব ভাষার লালিত্য, ছন্দের মাধুর্য, শব্দের গুরুত্ব প্রভৃতি কোন দিকে লক্ষ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠেনি।  বিশেষ করে এ বয়সে বই লিখে নাম ক্রয় করার বা প্রশংসা অর্জনের লোভ এবং আশা এর কোনটাই আমার নেই বলে ওসব দিকে নযর দেয়ার কোন প্রয়োজনও আমি বোধ করিনি।

আমি শুধু একটি বিষয়ের প্রতিই আমার লক্ষ্যকে কেন্দ্রীভূত রেখেছি।  আর তা হলো “আমার দিন শেষ হয়ে এসেছে, অতএব যে কোনভাবে অনন্ত আমার মৃত্যুর পূর্বে আমার এ কথাগুলোকে সর্বসাধারণ ভ্রাতাভগ্নীদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে।  অতএব আমার মনের দিকে চেয়ে সকল প্রকারের ভুল-ত্রুটিগুলো ক্ষমা করা হলে আমি কৃতার্থবোধ করবো এবং যে উদ্দেশ্যে আমার এ প্রয়াস ও পরিশ্রম, তার একটি ক্ষুদ্র অংশকেও সফল এবং সার্থক করে তোলা হলে আমার জীবন ধন্য হয়েছে বলে মনে করবো।

এ প্রসঙ্গের উপসংহারে বলতে হচ্ছে যে, একুশ বছর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করি; বর্তমানে একষট্টি চলছে।  ইসলামী জীবনের এই সুদীর্ঘ চল্লিশটি বছরে স্মৃতির পাতা পরতে পরতে কত কথা, কত ঘটনার ইতিহাস এবং কত মানুষের পরিচয় যে জমে উঠেছে তার ইয়ত্তা করা সম্ভব নয়।

ইসলাম গ্রহণের পূর্বে মুসলমানদের সাথে মিলা-মিশার সুযোগ খুব কমই হয়েছিল।  সুতরাং পূর্ব-সঞ্জাত ঘৃণা এবং অনভ্যাসের জন্যে ইসলাম গ্রহণের পরে বেশ কিছুদিন মুসলমানদের রান্না করা কোন কিছু খেতে পারিনি-একই কারণে মিলে মিশে একাকার হয়ে যেতেও পারিনি।

এই অবস্থায় যখন জানতে পারলাম যে, আমার স্বজন পরিজনেরা আমার কৃশ-পুত্তলিকাদাহ ও শ্রদ্ধ-পিন্ডদান প্রভৃতি অর্থাৎ মৃতের প্রতি তাঁদের করণীয় সব কিছুই সমাধা করেছেন- এক কথায়, তাঁদের দৃষ্টিতে আমি যে মৃত, সেকথা প্রমাণ করার কোন কিছুই তাঁরা বাকি রাখেননি।  অন্য কথায় বলা যেতে পারে যে, তাঁদের এবং তাঁদের বিষয় সম্পদের সাথে আমার যে আর কোন সম্পর্ক রইলো না, সেকথা শুধু আমাকেই নয় সাধারণভাবে সকল মানুষকে জানিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা তাঁরা করেছেন, তখন নিজকে বড় অসহায় বলে মনে হয়েছিল।

তবে সে অবস্থা ছিল খুবই স্বল্পস্থায়ী।  কেননা, কয়েক দিনের মধ্যেই বুঝতে পেরেছিলাম যে, মুসলমানদের সম্পর্কে শুধু অজ্ঞতাই নয়, আবাল্যপোষিত ভ্রান্ত বিশ্বাসও আমার এই অসহায়তা বোধের জন্যে বিশেষভাবে দায়ী।

সেই বিশেষ শ্রেণীটি বাদে ধনী, দরিদ্র, শিক্ষিত অশিক্ষিত এবং নর-নারী নির্বিশেষে যিনিই আমাকে নও-মুসলিম বলে জানতে পেরেছেন, আমি বিশেষভাবে লক্ষ্য করেছি যে, তিনিই অন্তর দিয়ে আমার এই অসহায়তার কথা উপলব্ধি করেছেন এবং কেউবা স্নেহ-মমতা, কেউবা সৌহার্দ-বাৎসল্য, আর কেউবা প্রীতি ও ভালোবাসা দিয়ে আমার স্বজন হারানোর সকল অভাব, সকল বেদনা এবং সকল দুঃখকে মিটিয়ে দিতে চেয়েছেন।

পরে একথাও বুঝতে পেরেছিলাম যে, যে কোন লোক ইসলাম গ্রহণ করুক, আর অতীত জীবনে তার সামাজিক মর্যাদা যাই থাক, ইসলাম গ্রহণের পরে তাকে নিগ্রোনেটিভ বা অচ্ছ্যুত বলে ঘৃণাভরে দূরে সরিয়ে রাখা হয় না।  কেননা, এতে সত্যকে ঘৃণা করা হয়-মানুষের ন্যায়সঙ্গত অধিকারকে অস্বীকার করা হয়; তাই ইসলাম এ কাজ সমর্থন করে না।  আর ইসলাম সমর্থন করে না বলেই মুসলমানগণও সকল নও-মুসলিমকে বুকে জড়িয়ে একাকার করে নেয়।

যাদের অকৃত্রিম স্নেহ ভালবাসায় আমি স্বজন হারানোর ব্যথা বুলতে পেরেছি, তাদের কাছে আমি অশেষভাবে ঋণী।  বিভিন্ন জিলায় যে সব ধর্মপ্রাণ মুসলমান আমার প্রতি সহনুভূতি প্রকাশার্থে সভা-সমিতির আয়োজন করত আমাকে ইসলাম সম্পর্কে দুকথা বলার সুযোগ করে দিয়েছেন এবং দিয়ে চলেছেন তাঁদের কাছেও আমার ঋণের পরিমাণ মোটেই কম নয়।  এমনিভাবে সারা জীবন ঋণ করেছি এবং দিনে দিনে সে ঋণ বেড়েই চলেছে।

অবসর মুহূর্তে যখনই স্মৃতির পাতাকে চোখের সম্মুখে তুলে ধরি তখনই রূপালী পর্দার মত অসংখ্য অগণিত ছবি সেখানে আমি দেখতে পাই; আর সবার কল্যাণ ও মঙ্গলের জন্যে বিশ্বেপতির উদ্দেশ্যে জানাই অন্তরের আকুল প্রার্থনা।

    ১ম পর্ব  এখানে   ২য় পর্ব এখানে ৩য় পর্ব  ৪র্থ পর্ব ৫ম পর্ব ৬ষ্ঠ পর্ব ৭ম পর্ব

Related Post