মিথ্যা সব পাপাচারের মূল (গুনাহের জননী)

মিথ্যাকে না বলুন

মিথ্যা বলা বা মিথ্যাচার জঘন্যতম ঘৃণিত অভ্যাস। মিথ্যা বলার চেয়ে অপরাধ আর নেই। তাই মিথ্যাবাদীকে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুল আদৌ পছন্দ করেন না। পবিত্র কোরআনে মিথ্যুক এবং মিথ্যাবাদীর ভয়ানক পরিণতির কথা বলা হয়েছে। মিথ্যা বলার পাপ অতিমারাত্মক।

মিথ্যা একটি চারিত্রিক ব্যাধি: মিথ্যা বলা বা মিথ্যাচার জঘন্যতম ঘৃণিত অভ্যাস। মিথ্যা বলার চেয়ে অপরাধ আর নেই। তাই মিথ্যাবাদীকে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুল আদৌ পছন্দ করেন না। পবিত্র কোরআনে মিথ্যুক এবং মিথ্যাবাদীর ভয়ানক পরিণতির কথা বলা হয়েছে। মিথ্যা বলার পাপ অতিমারাত্মক। মিথ্যা ভাষণ, মিথ্যাচারের ঘৃণ্যতা ও দুরবস্থার কথা হযরত রাসুলে কারীম (সা) বর্ণনা করেছেন। মিথ্যা ভাষণে, মিথ্যাচারে যে বা যারা অভ্যস্ত থাকে, কোনো মানুষ কোনো দিন তার সামান্য কথা, উক্তি বিশ্বাস করে না, কেননা, এসব লোকের খপ্পরে পড়লে প্রতারিত হতে হয়। মিথ্যা বিষয়টি এমনই একে সত্য বলে প্রমাণ করতে গিয়ে হাজারও ছলচাতুরি এবং আরও বহু মিথ্যা কথা বলার প্রয়োজন হয়। মিথ্যা এমনই এক বদঅভ্যাস যার মধ্যে মিথ্যা বলার প্রবণতা ঢুকেছে আর উপায় নেই। পরিত্যাগ করা বড়ই কঠিন। মিথ্যুক, মিথ্যা ভাষণ, মিথ্যাচার করে যারা বেড়ায় তারা সংসারে, পরিবারে, সমাজে এবং দেশে মহাদুর্যোগ সৃষ্টি করতে পারে। মিথ্যুকের মিথ্যা বলার খপ্পরে পড়ে অনেক নিরীহ মনুষ প্রতারিত হয়েছে, ঠকেছে এবং মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়েছে। মিথ্যাবাদীর ওপর মহান আল্লাহ তা’আলার অভিশাপ বর্ষিত হয়। যে বা যারা মিথ্যা বলার অভ্যাস করেই ক্রমে তার মানসিক শক্তি এবং সত্ সাহস লোপ পেতে আরম্ভ করে, সত্য কথাকে যেমন আল্লাহ তা’আলা অসম শক্তি দান করেছেন, আবার মিথ্যাকে অত্যন্ত দুর্বল ও মানুষের কাছে ঘৃণিত পরিত্যাজ্য করে দিয়েছেন। এ জন্যই সত্য কথা, ভাষণ সদা সবল, ডর-ভয় নেই। আপন সত্যবাদিতায় বলীয়ান এবং আল্লাহর প্রাপ্ত ব্যক্তি। মিথ্যা বলা সব পাপাচারের মূল। যে মিথ্যাকে বর্জন করে সে কোনোরূপ পাপই করতে পারে না।

মিথ্যা একটি সুস্পষ্ট জুলুম: সে যে ক্ষেত্রেই হোক না কেন, সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে যা সত্য, সেটিই হক্ব এবং সেটিই তার প্রকৃতি। মিথ্যা সে হক্বকে খর্ব করে। মিথ্যার কারণে সত্য তার সুন্দর প্রকৃতি অনুযায়ী প্রস্ফুটিত হতে পারে না। এ সত্যের আলো থেকে অন্যরাও বঞ্চিত হয়। যেমন, আল্লাহ এক ও একক। তিনি লা-শরীক, তার কোনো শরীক নেই। এটি একটি সত্য ও স্বাভাবিক কথা এবং এটি প্রকৃতির দাবীও। এটি আল্লাহর হক। এ হক থেকে বঞ্চিত করা জুলুম।

যারা আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোনো শক্তিকে শরীক করে তারা মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে। আর যে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে আল্লাহর সঙ্গে শরীক করে সে মূলত এক মস্তবড় জালেম। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন: নিশ্চয় শিরক একটা বড় জুলুম। (সূরা লোকমান: ১৩) এমনিভাবে কুফরীও একটি মিথ্যা। কুফরী মানে সত্যকে মিথ্যা দিয়ে আড়াল করা। যেমন, আরবীতে কৃষককে ভাবার্থে কাফের বলা হয়, কারণ কৃষক জমিতে বীজ বপনের পর হাল-চাষের মাধ্যমে বীজকে মাটি দিয়ে চাপা দেয় বা মাটিতে লুকায়। কাফের ব্যক্তিও আল্লাহকে অস্বীকারের মাধ্যমে একটি সত্যকে মিথ্যার মাধ্যমে আড়াল করে থাকে। তাই কুফরী একটি মিথ্যা। সুতরাং যারা কুফরী ও শিরক করে তারা মিথ্যারই আশ্রয় নেয়।

মিথ্যা একটি শক্তিশালী জীবাণু বোমার চেয়েও মারাত্মক। আণবিক বোমা একটা নির্দিষ্ট সময় এবং একটা নির্দিষ্ট আওতাধীন সবকিছুকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়। কিন্তু মিথ্যা আরো অধিক কার্যকর এবং আরো অধিক বিধ্বংসী। এটি এমন এক নীরব ঘাতক, যা দীর্ঘ সময় ধরে অধিকতর ব্যাপক স্থানজুড়ে সার্বিক ধ্বংসলীলা চালিয়ে যায়। শুধু তাই নয়, এটি আরো অসংখ্য নিত্যনতুন উপসর্গের জন্ম দেয়। যার দরুন মিথ্যার একান্তই কেনো ক্ষতি বা অপকারের কথা কেউ সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারবে না। দেখা যাবে মিথ্যুক একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে মিথ্যার বেসাতি ছড়িয়ে ছিল। কিন্তু মিথ্যাটি মিথ্যুকের কার্য বাস্তবায়ন ছাড়াও অসংখ্য নতুন নতুন অঘটন ঘটিয়েছে, যেগুলোর আশা মিথ্যুক কখনো করেনি। তাই মিথ্যার বিধ্বংসী ক্ষমতা কতটুকু তা নির্ণয় করা যেমন কঠিন, তেমনি এর ব্যাপকতার পরিমাপ করাও কঠিন। এটিকে কেন্দ্র করে কত দেশের পর দেশ, জনপদের পর জনপদ ধ্বংস হয়ে গেছে, কত লোক আহত-নিহত হয়েছে, কত ঘর মিথ্যার আগুনে পুড়ে গেছে, কত সুখের সংসার ভেঙে গেছে, কত অধিকার বিনষ্ট হয়েছে তার কি কোনো ইয়ত্তা আছে?

মিথ্যা সত্য-সুন্দরকে বিকৃত করে। ন্যায়-ইনসাফকে উল্টে দেয়। নৈতিক মূল্যবোধ বিনষ্ট হয়। চারিত্রিক সৌন্দর্যকে করে কলুষিত। মানবতা ও মনুষ্যত্ব বিপন্ন হয়। নিয়ম ও শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শিত হয়। গণতন্ত্রের দরজাকে বন্ধ করে দিয়ে মানুষের অধিকারকে হরণ করা হয়। সর্বত্র চালু হয় জুলুমতন্ত্র। সর্বক্ষেত্রে ভাঙন আর ভাঙনের রাজত্ব চালু হয়। সর্বোপরি প্রত্যেকটি জিনিসের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যকে বিগড়িয়ে দেয়।

মিথ্যা বলা কবীরা গুনাহ এবং সুস্পষ্ট জুলুম: রাসূল (সাঃ) বলেছেন : আমি কি তোমাদেরকে সর্ববৃহত কবীরা গুনাহ সম্পর্কে বলব না? তারা বলেন, হ্যাঁ। তিনি বললেন, আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা ও মা-বাপের নাফরমানী করা। তারপর তিনি ঠেস দিয়ে বসে বলেন,  ওহো! মিথ্যা কথা। তিনি বারবার তা বলতে লাগলেন আর আমরা ইচ্ছা করেছিলাম তিনি যদি চুপ হতেন। (বুখারী ও মুসলিম) অথচ এ মিথ্যাই আজ মানুষের ব্যক্তি ও সমাজব্যবস্থায় ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে। সমাজের নিম্নস্তর থেকে শুরু করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নেতৃত্ব ও শাসক মিথ্যা রোগে আক্রান্ত।

এ অবস্থার কারণ হিসেবে কুরআনের শিক্ষা থেকে দূরে থাকাকেই উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয়। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন: যারা আল্লাহর আয়াত ও নিদর্শনের ওপর ঈমান আনে না তারাই মিথ্যা-প্রতারণা করে এবং তারই মিথ্যাবাদী। (সূরা নাহল:১০৫) মনে রাখা প্রয়োজন যারা মিথ্যাচর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখে, আল্লাহ তাদেরকে কখনো হেদায়েতের আলো দান করেন না। আজীবন মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকেই মৃত্যুবরণ করতে হবে।

আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন : যে ব্যক্তি অপচয়কারী ও মিথ্যুক, আল্লাহ তাকে হেদায়েত করেন না। (সূরা মোমেন: ২৮)

মৃত্যুর পর আবার কঠিন আজাবের স্বাদ ভোগ করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন : কেয়ামতের দিন আপনি তাদের চেহারা কালো দেখতে পাবেন, যারা আল্লাহর ওপর মিথ্যারোপ করেছে। (সূরা জুমার-৬০)

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন : তোমরা সত্যবাদিতা অবলম্বন করো। সত্যবাদিতা নেকির দিকে পথপ্রদর্শন করে এবং নেকি জান্নাতের দিকে পথ দেখায়। ব্যক্তি সত্য বলতে বলতে এবং সত্যের ওপর টিকে থাকার চেষ্টা করতে করতে আল্লাহর কাছে সত্যবাদী হিসেবে লিখিত হন। তোমরা মিথ্যা থেকে বাঁচ। মিথ্যা গুনাহের পথ দেখায় এবং গুনাহ জাহান্নামে নিয়ে যায়। বান্দাহ মিথ্যা বলতে এবং মিথ্যার ওপর টিকে থাকার চেষ্টা করতে থাকলে আল্লাহর কাছে মিথ্যাবাদী হিসেবে লিখিত হয়। (বুখারী ও মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী)

রাসূল (সাঃ) দীর্ঘ এক হাদীসের এক স্থানে বলেছেন : এক রাতে স্বপ্নে আমি দুই ব্যক্তিকে দেখলাম, তারা আমার কাছে এসেছে (তারা ফেরেস্তা) তারা আমাকে বলল, আপনি যে লোকটির গাল চিরে দেয়া হচ্ছে দেখছেন, সে মিথ্যাবাদী। তারপর সে আবার মিথ্যা বলবে এবং সর্বত্র তা ছড়িয়ে পড়বে। তারপর আবার তার চোয়াল চিরে দেয়া হবে। এভাবে কেয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে। (বুখারী)

মিথ্যাবাদী একজন পরিপূর্ণ মুনাফিকও বটে। কারণ মিথ্যুক তার উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কপটতারই আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বলেছেন : মুনাফেকের লক্ষণ তিনটি। সে যখন কথা বলে, মিথ্যা বলে, সে যখন ওয়াদা করে, তা ভঙ্গ করে এবং তার কাছে আমানত রাখলে, তা খেয়ানত করে। (বুখারী) মুসলিম শরীফে আরো একটু বেশি বর্ণিত আছে, যদিও সে নামাজ, রোজা করে এবং নিজেকে মুসলমান মনে করে।

আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ)-এর কাছে মিথ্যার চেয়ে অন্য কোনো দোষ বেশি ঘৃণিত ছিল না। (মুসনাদে আহমাদ) আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বলেছেনন : কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তিন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলবেন না। তাদেরকে পবিত্র করবেন না এবং তাদের দিকে তাকাবেন না। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। সে তিন ব্যক্তি হলো : বৃদ্ধ যেনাকারী, মিথ্যুক রাজা ও অহঙ্কারী ফকির-মিসকিন। (মুসলিম)

হযরত আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন : আল্লাহর কাছে মিথ্যা জিহ্বা সবচেয়ে বড় গুনাহ এবং সর্বাধিক নিকৃষ্ট অপমান হচ্ছে কেয়ামতের দিনের অপমান। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন : মিথ্যা সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ না করা পর্যন্ত কেউ পূর্ণ মোমেন হতে পারবে না। এমন কি হাসি-ঠাট্টা ছলেও মিথ্যা না বলা উচিত। (মুসনাদে আহমাদ) আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, আমি রাসূল্লাহ (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি : মিথ্যা শপথের দ্বারা পণ্যসামগ্রী বিক্রি হয়ে যায় বটে; কিন্তু এতে বরকত বা কল্যাণ ধ্বংস হয়ে যায়। (বুখারী)

মুসলমানদের জীবনব্যবস্থা সত্য ও ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তাই মুসলমান কখনো মিথ্যাকে আশ্রয় দিতে পারে না। কাফের ও মুশরিকের জীবনব্যবস্থা মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত। তার দৃষ্টিতে মিথ্যা বলা অবৈধ নয়, কারণ তার বিশ্বাসই মিথ্যা। সুতরাং সে যত পারে মিথ্যা বলে যাক। কিন্তু প্রতিটি মুসলমানকে সর্বক্ষেত্রে মিথ্যাকে পরিত্যাগ করে সত্য ও ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে এবং সত্যের মৌখিক ও বাস্তব সাক্ষ্যদাতা হিসেবে দুনিয়াবাসীর সামনে নিজেকে উপস্থাপন করতে হবে। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে সত্য বলার এবং মিথ্যা থেকে বেচেঁ থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন!

Related Post