Main Menu

রাসূল (সা.)-এর জীবনী (জন্ম থেকে নবুয়্যাতের আগ পর্যন্ত )

 

রাসূল (সা.)-এর জীবনী (জন্ম থেকে নবুয়্যাতের আগ পর্যন্ত )

রাসূল (সা.)-এর জীবনী (জন্ম থেকে নবুয়্যাতের আগ পর্যন্ত )

পূর্বে প্রকাশিতের পর

মানব দরদী মুহাম্মদ  (সা.) 
মহাপুরুষদের জীবন-প্রভাত কতইনা বিচিত্র ও সুন্দর। তাঁদের সকল কথা, কাজ ও হাবভাবই কেমন যেন একটা অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা যায়। মুহাম্মদ (সাঃ)-এর দুধ-মাতা হালিমা বর্ণনা করেন, আমি এক আশ্চর্য ব্যাপার লক্ষ্য করতাম যে, শিশু মুহাম্মদ যখন আমার স্তন পান করতেন তখন তিনি একটি স্তনই পান করতেন, অন্যটি পান করতেন না। মনে হতো মুহাম্মদ যেন জেনে শুনেই অপর স্তনটি তাঁর দুধ-ভাই (হালিমার নিজ পুত্রের) জন্যে রেখে দিতেন। মুহাম্মদ (সা.) কোন দিনই তাঁর দুধ-মা ও দুধবোনকে ভুলতে পারেন নী। যত দিন তারা জীবিত ছিলেন, ততো দিন তিনি তাদের তত্ত্বাবধান করেছেন। হালিমা যখনই মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সহিত দেখা করতে আসতেন তখনই তিনি তাকে পরম শ্রদ্ধাভরে অভ্যর্থনা জানাতেন এবং যথোপযুক্ত উপহার দিয়ে স্ব-সম্মানে বিদায় দিতেন। খাদিজার (রাঃ)-এর সাথে বিবাহের সময় তিনি তাঁর দুধ-মা ও দুধ-বোনকে আনতে ভুলেন নী। আরবে একবার ভীষণ দুর্ভিক্ষ দেখা দিলো, হালিমা তখন মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নিকট সাহায্যের আবেদন করলেন। মুহাম্মদ (সা.) সন্তুষ্ট চিত্তে সর্বাত্মক সাহায্যের চেষ্টা করেন।
ঐতিহাসিক ইব্নে খালদুন বর্ণনা করেন, যায়েদ বিন হারেসাকে ছোট বেলায় যুদ্ধ বন্দী হিসাবে ওকাজের মেলায় বিক্রি করা হয়। যাকে ক্রয় করেছিলেন খাদীজা (রাঃ)-এর ভ্রাতুষ্পুত্র হাকীম বিন হাজাম। তিনি যায়েদ বিন হারেসা নামক ঐ গোলামটি মুহাম্মদ (সাঃ)-কে উপহার দেন। মুহাম্মদ (সাঃ)-এর বিশাল হৃদয় ও উন্নত চরিত্রের অধিকারী হওয়ায়, যায়েদ বিন হারেসাকে অতি প্রিয়জনের ন্যায় লালন-পালন করতে ছিলেন। ইত্যবসরে যায়েদের পিতা হারেসা ও চাচা কা’ব তার সন্ধানে মক্কায় আসে এবং যায়েদকে ফেরত দেয়ার অনুরোধ জানায়। মুহাম্মদ (সা.) তাদেরকে জানান যে, যায়েদ ফেরত যেতে চাইলে তাঁর কোন আপত্তি নেই। সে এখন মুক্ত। ইচ্ছা করলে এখনই যেতে পারে। বিনাপণে মুক্তিদান! তখনকার দিনে এযে একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার। যায়েদের পিতা ও চাচা অবাক হয়ে মুহাম্মদের পানে চেয়ে রইলেন। সন্তানকে ফিরে পাবার আসন্ন আনন্দে উভয়ের হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠলো। কিন্তু তাদের এ সাধ পূর্ণ হলো না। যায়েদ তাদের ¯পষ্ট জানিয়ে দেন, “আমি মুহাম্মদ (সা.) কে ছেড়ে কক্ষনো যাবো না; কারণ তিনি আমার কাছে আপন বাপ চাচার চেয়েও প্রিয়।” এতে যায়েদের পিতা ক্রুদ্ধ হয়ে বলেন, “তুমি কি স্বাধীনতার চাইতে গোলামিকে শ্রেয় মনে করো?” উত্তরে যায়েদ বলেন, “হ্যাঁ আমি তা-ই মনে করি। কারণ আমি মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মধ্যে এমন কিছু দেখেছি, যাতে তাঁর চাইতে আর কাউকেই শ্রেষ্ঠ ভাবতে পারি না।” একথা শুনে মুহাম্মদ (সা.) বুঝতে পারলেন যে, এভাবে যায়েদকে নিজের কাছে রেখে দিলে লোকে তাকে ক্রীতদাসই বলবে; স্বাধীন মানুষের মতো উন্নত মস্তকে সে চলাফেরা করতে পারবে না। পক্ষান্তরে যায়েদের পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের মনে চিরদিন একটা প্রচ্ছন্ন গ্লানী ও হীনতার ভাব জেগে থাকবে। ইহা ভেবে তিনি যায়েদকে সঙ্গে নিয়ে তৎক্ষণাৎ কা’বা গৃহে যেয়ে সমবেত কোরেশ নেতাদের সামনে মুক্ত কন্ঠে ঘোষণা করলেন, “সকলে স্বাক্ষী থাকো, এই যায়েদ আমার পুত্র।” বিস্মিত জনম-লী অবাক হয়ে রইলো! কোথায় ক্রীতদাস, আর কোথায় জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ পয়গম্বরের পুত্র। দোযখ হতে একেবারে বেহেশ্তে উন্নয়ন! এ দৃশ্য দেখে যায়েদের পিতা ও চাচা তাকে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কাছে রেখে সন্তুষ্ট চিত্তে বাড়ি ফিরে যান। লাঞ্ছিত নিপীড়িত মানবতাকে এর চেয়ে বড় কী সম্মান দেয়া যেতে পারে..?
পরবর্তীকালে এই যায়েদই যুদ্ধ অভিযানে সেনাপতি পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। মানুষের মধ্যে কত শক্তি, প্রতিভা ও সম্ভাবনাই এমনি ভাবে লুকায়ে থাকে। সুযোগ ও সহানুভূতি পেলে কত অসহয় লোক এমনিভাবে বড় হতে পারে। মুহাম্মদ (সা.) যদি যায়েদকে এ সুযোগ না দিতেন তাহলে সে চিরদিন ক্রীতদাস হয়ে থাকতো, সেনাপতি হওয়া সম্ভব হতো না। এখানেই ইসলামের বিশেষত্ব। সব মানুষই আল−াহর সৃষ্টি। এরা সবাই বনী আদমের বংশধর। আর আদম (আঃ) কে তৈরী করা হয়েছে মাটি থেকে। সে দিক থেকে “সব মানুষই সমান” এই সাম্যবাণী দ্বারা মানুষের অন্তরের অপরিসীম শক্তি ও সম্ভাবনাকে ইসলাম স্বীকার করে নিয়েছে এবং তাদের আত্মপ্রকাশের পথকে উম্মুক্ত করে দিয়েছে। তাইতো পরবর্তীকালে আমরা দেখতে পাই, ক্রীতদাস হয়েও বেলাল (রাঃ) মুসলিম জাতির মুয়াজ্জিন হয়েছেন, কুতুবুদ্দিন ভারতের মতো বিশাল এক ভূখন্ডের প্রথম মুসলমান-সম্রাট হবার গৌরব অর্জন করেছেন। যুগে-যুগে কত অস্পৃশ্য, কত শূদ্র, কত পতিতই না ইসলামের শক্তি মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে জ্ঞানে-গুণে বিশ্ব বরেণ্য হয়েছেন এবং আজো হচ্ছেন। যার ধারাবাহিকতা রক্ষায় কুয়েতের ‘ইসলাম  প্রেজেন্টেশন কমিটি (ওচঈ) নিরলসভাবে সে  চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের অন্যতম কর্মসূচী হচ্ছে, কুয়েতে অবস্থানরত বিভিন্ন দেশের মুসলিম-অমুসলিমদের নিকট ইসলামের প্রকৃত রূপ বিশে−ষণ করে তাদের চিন্তার বিশুদ্ধিকরণ ও জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলামী জীবনাদর্শ অনুসরনের প্রয়োজনীয়তার অনুভূতি জাগ্রত করা এবং মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে, তাদেরকে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্য যোগ্যতা স¤পন্ন মুসলিম রূপে গড়ে তোলা। যার বাস্তব প্রমাণ বাংলা ভাষায় মাসিক ‘আল-হুদা’ ইসলামী  বই, ক্যাসেট , বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচী বাস্তবায়ন ও সহযোগিতা এবং নানা ধরনের কার্যক্রম তারা চালিয়ে  যাচ্ছেন। এটা আমাদের জন্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিরাট এক নেয়ামত। আমাদের সকলেরই উচিত এর জন্য শুকরিয়া আদায় করা এবং এদের বিভিন্ন কর্মসূচীতে যোগদানের মাধ্যমে নিজেদের ভিতর যে প্রতিভা লুকায়িত রয়েছে তা বিকশিত করে মুসলিম মিল্লাতের হারানো গৌরব ফিরে পাবার চেষ্টা করা। আল্লাহ আমাদের সে তাওফিক দান করুন। 
‘মুহাম্মদ’ নামের সার্থকতা
মুহাম্মদ-শব্দের, শাব্দিক অর্থ অধিক প্রশংসিত, প্রশংসনীয়। তিনি সত্যই অধিক প্রশংসিত বা প্রশংসনীয় ছিলেন কিনা তা আর আলোচনার অপেক্ষা রাখে না। যার সার্বিক প্রশংসা আল্লাহ পাক নিজেই করেছেন। সেখানে আমরা তাঁর প্রশংসা কতটুকুই করতে পারি। নবুয়্যতের ধারা  পবিত্র কুরআনে যার নামে (মুহাম্মদ নামে) আল্লাহ পাক একটি সূরাও নাযিল করেছেন। যেহেতু এখানে নবুয়্যতের আগের জীবনী সংক্ষিপ্তভাবে পর্যায়ক্রমে লেখা হচ্ছে, তাই আমরা এখানে নবুয়্যতের আগে জাহিলিয়াতের সময়ও তিনি প্রশংসিত ছিলেন কি-না তার যৎ সামান্যই এখানে উল্লেখ করার চেষ্টা করছি।
 প্রশংসিত হতে হলে সত্য, সুন্দর, পরোপকারী ও আদর্শবান হতে হয়।  কেননা, পূর্ণাঙ্গ আদর্শবান না হলে, কেউ কখনও অধিক প্রশংসিত হতে পারে না। যে যতোখানী সত্য ও সুন্দর সে ততোখানী শ্রেষ্ঠ ও প্রশংসার দাবীদার । আমরা যদি তাঁর শিশু কালের জীবনে ফিরে যাই, তাহলে সেখানে দেখতে পাই  যে, তাঁর শিশু কালের আচরণ সম্পর্কে কি ভূয়শী প্রশংসাই না হালিমা বর্ণনা করেছেন। কৈশরে তাঁর খেলার সাথীরা তাঁর প্রশংসা করেছে। ফুজ্জারের যুদ্ধে আরবদের শত শত পরিবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিলো। যা দেখে মুহাম্মদ  (সা.) অন্যদের সাথে নিজেও ‘হিলফুল ফযুল’ সংগঠনে যোগ দিয়ে আর্ত মানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। সেখানেও তাঁর ভূমিকা ছিলো প্রশংসনীয়। তিনি যখন ব্যবসা শুরু করলেন, তখন তাঁর  লেন-দেনের সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর কথা এবং কাজের অপূর্ব সমন্বয় দেখে তিনি মানুষের কাছে অত্যন্ত বিশ্বস্থ হিসেবে পরিচিত হলেন। লোকেরা তাদের মূলধন তাঁর নিকট জমা রাখতো। এ ছাড়াও মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ওয়াদা পালন, সদাচারণ, ন্যায়পরায়ণতা, বিশ্বস্থতা ইত্যাদির কারণেও তিনি মানুষের অত্যন্ত শ্রদ্ধা অর্জন করেন। এমন কি তিনি সেই জাহিলিয়াতের যুগের লোকদের দ্বারাই ‘আল-আমীন’ (সত্যবাদী) উপাধি লাভ করেন। এরপর আরবের সেই বিখ্যাত কোরেশ বংশের এক সম্ভ্রান্ত ও বিত্তশালী মহিলা খাদীজা (রাঃ)। তৎকালীন আরবে তাঁর মত সতী-সাধবী নারী আরবে দ্বিতীয়টি আর ছিলনা। সেই খাদীজা (রাঃ) মুহাম্মদ (সাঃ)-এর অসামান্য যোগ্যতা ও অতুলনীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে মুগ্ধ হন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে বিবাহের প্রস্তাব পাঠান। এমনিভাবে আরো অনেক ঘটনা রয়েছে, যার দ্বারা আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে, মহানবী (সাঃ)-এর মুহাম্মদ (অধিক প্রশংসিত) নাম সার্থক হয়েছে। আজ আমাদের অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে যে, আমাদের পিতা-মাতারা বড় আশা করে যে সকল আল্লাহর গুণবাচক নাম, নবী-রাসূল এবং বিখ্যাত সাহাবীদের নামে নাম রেখেছেন, সে নামসমূহের মর্যাদা কতটুকু রক্ষা করে চলছি। অর্থবহ সুন্দর নামসমূহের অমর্যাদা যারা ক্রমাগত ভাবে করেই চলেছেন তাদের এই লাগামহীন দৌরাত্ব এখনই বন্ধ করা উচিত। আমাদের সুন্দর নামসমূহের মর্যাদা রক্ষার মাধ্যমে পিতা-মাতার নিরাশার মন আশায় আলোকিত করি তাদের চক্ষু শীতল করি এবং সেই সাথে পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহ তা’য়ালার রেজামন্দি হাসিল করি। তাতেই আমাদের ইহকাল ও পরকালের জীবন হবে সুন্দর ও কল্যাণময়। এ জন্য আমাদের প্রথমেই চিন্তাগত প্রশিক্ষণের দরকার। কারণ, মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক ক্রমবিকাশে পরিবেশগত আনুকূল্য এবং শিক্ষাগত সুযোগ সুবিধার চেয়ে তার নিজের প্রচেষ্টার দখল থাকে অনেক বেশী। সে তার চিন্তা শক্তিকে কতটা কাজে লাগায়, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দ্বারা নতুন কি কি সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং কোন কোন সত্যকে জানতে চেষ্টা করে তার ওপরও তার বুদ্ধিবৃত্তিক ক্রমবিকাশ নির্ভর করে। আমরা এর বাস্তব উদাহরণ দেখতে পাই মুহাম্মদ (সঃ)-এর জীবনে। নবুয়্যত লাভের আগে তিনি সেই অন্ধকার যুগেও কিভাবে তাঁর চরিত্রকে পবিত্র রেখেছেন। এরপর সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মাঝে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। একটু চিন্তা করে দেখা দরকার যে, আজ আমাদের বিদ্যালয়সমূহে ও ঘরে রাত-দিন যে সব জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা হয় তার দাবী কি এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান ও আখেরাতের জবাবদিহির বিশ্বাস কি ধরনের জীবন দাবী করে? বিশ্বব্যাপী চলমান জড়বাদী সভ্যতার জমকালো পর্দার আড়ালে উঁকি দিয়ে দেখলে মানবতার এমন শোচনীয় দৃশ্য চোখে পড়ে  যে, মানুষ মাত্রেরই আত্মা কেঁপে ওঠে। এহেন পৃথিবীতে আমরা দুঃসহ জীবন নিয়ে বসবাস করছি। এর থেকে পরিত্রাণ পাবার কি কোন পথ নেই? হ্যাঁ, আছে। অবশ্যই আছে। এ পরিস্থিতি থেকে রেহাই পেতে হলে একটি পথই খোলা আছে। আর তা হলো মুহাম্মদ (সঃ)-এর জীবন চরিত্র সামনে রেখে ইসলামের ছায়াতলে সমবেত হয়ে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। কারণ, একমাত্র ইসলামই একদিকে মানুষের চিন্তাগত মান বৃদ্ধির জন্য বাইরের সব রকমের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করেছে। অন্যদিকে তার বুদ্ধিবৃত্তি ও চিন্তার অন্তর্গত যোগ্যতাকেও উদ্দীপ্ত করার চেষ্টা করেছে, যাতে মানুষ তার ভিতরের আল্লাহ প্রদত্ত চিন্তা ও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাকে কাজে লাগাতে শিখে। আল্লাহ আমাদের সে তাওফিক দান করুন। আমীন ! (চলবে…)

Related Post