ঈমানদার নারী-পুরুষ যেখানে থাকুক, যা-ই করুক আর যা-ই হোক না কেন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যথারীতি আদায় করতেই হবে। যথারীতি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করলে এবং কবিরা গুনাহ মুক্ত থাকলে দুনিয়ার সুখ শান্তি যেমন নিশ্চিত তেমনি নিশ্চিত পরকালীন মুক্তিও। অনিয়মিত নামাজ আদায়কারীদের ব্যাপারে হাদিসে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারিত হয়েছে। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি যথারীতি নামাজ আদায় করবে, তা কিয়ামতের দিন তার জন্য মুক্তির অসিলা, আলোকবর্তিকা ও যুক্তি-প্রমাণ হবে। আর যে যথারীতি নামাজ আদায় করবে না, তার জন্য তা আলোকবর্তিকাও হবে না, যুক্তি-প্রমাণও হবে না এবং মুক্তির অসিলাও হবে না। অধিকন্তু সে কিয়ামতের দিন ফেরাউন, কারুন, হামান ও উবাই বিন খালাফের সঙ্গী হবে।
নামাজের ব্যাপারে সতর্কতা : নির্ধারিত সময়ে নামাজ পড়াই যথেষ্ট নয়, নামাজকে নিয়ম অনুযায়ী, যথাযথভাবে এবং সহিহশুদ্ধভাবে পড়াও জরুরি। কারণ নিয়মবহির্ভূত নামাজ পড়া, অশুদ্ধ নামাজ পড়া নামাজ না পড়ারই সমতুল্য। নামাজে দৌড়ে আসা : আজানের সাথে সাথেই মসজিদমুখী হওয়া, জামাত শুরুর আগেই মসজিদে উপস্থিত হওয়া, জামাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা প্রত্যেক মুসলমান পুরুষের জন্য জরুরি-অবশ্য কর্তব্য। কারণ নামাজ পড়া যেমন আল্লাহর আদেশ, জামাতে নামাজ পড়াও আল্লাহর আদেশ। সূরা বাকারার ৪৩ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, আর নামাজে অবনত হও তাদের সাথে যারা অবনত হয়। সালাতের একামাত হলে বা সালাত শুরু হলে অনেকে দৌড়ে আসেন। আবার কেউ কেউ অন্যদের দৌড়ে আসতে বলেন, যা ঠিক নয়। হাদিসে সালাতে দৌড়ে আসতে নিষেধ করা হয়েছে। বুখারি, মুসলিম, আবু দাউদে বর্ণিত হাদিস হচ্ছে, সালাতের ইকামত হলে তাতে দৌড়ে আসবে না, তাতে হেঁটে আসবে। স্থিরতা অবলম্বন করবে। যতটুকু পাবে ততটুকু সালাত আদায় করবে আর যা ফওত হয়ে যাবে তা পরে পূরণ করে নেবে মসজিদে প্রবেশের পর আগে সালাত আদায় করা ও পরে বসা : বুখারি শরিফে বর্ণিত হাদিস হচ্ছে, তোমাদের কেউ মসজিদে প্রবেশ করলে সে যেন বসার পূর্বে দুই রাকাত সালাত আদায় করে নেয়। স্বাভাবিকভাবে মসজিদে প্রবেশ করে আগে নামাজ পড়া এমনকি দুই মিনিট বাকি থাকলেও দুই রাকাত নামাজ পড়ে তারপর বসাই নিয়ম।
নামাজে আস্তে আস্তের পরিবর্তে মনে মনে তাকবিরে তাহরিমা কুরআন ও দোয়াদরুদ পড়া ঠিক নয় : অনেক নামাজিই নামাজের তাকবিরে তাহরিমার আল্লাহু আকবার, কিরাত ও দোয়াদরুদ এমনভাবে পড়েন যাতে ঠোঁট, জিহ্বা, মুখ নড়ে না। যেসব নামাজ আস্তে আস্তে পড়া নিয়ম সেসব নামাজে সূরা কিরাত এমনভাবে পড়তে হবে যাতে নিজ কানে নিজের পড়ার আওয়াজ শুনা যায়, পড়ার সময় ঠোঁট-জিহ্বা-মুখ নড়াচড়া করে, কিরাত পড়ার সময় জিহ্বা ও ঠোঁট ব্যবহারের মাধ্যমে হরফের সহিহ উচ্চারণ হয়। শুধু ধ্যান করে বা ঠোঁট-মুখ-জিহ্বা না নেড়ে মনে মনে তাকবিরে তাহরিমা আল্লাহ আকবার বললে এবং ক্বিরাত পড়লে তা আদায় হবে না এবং নামাজ হবে না। সহিহ বুখারি ফাতহুল বারিতে বর্ণিত হয়েছে, হজরত আবু মামার বলেন, আমরা হজরত খাব্বাব রা:কে জিজ্ঞেস করলাম, রাসূলুল্লাহ সা: কি জোহর ও আসরের নামাজে কুরআন পড়তেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আমরা প্রশ্ন করলাম আপনারা কিভাবে বুঝতেন? তিনি বললেন, তাঁর দাড়ি মোবারক নড়াচড়া দ্বারা। জামাতে নামাজ আদায়ের সময় কাতারের ফাঁক থাকলে শয়তান ঢোকে এবং আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হতে হয় : বুখারি শরিফে বর্ণিত হাদিস হচ্ছে আনাস রা: বলেন, সালাতের ইকামত হয়ে গিয়েছিল। রাসূলুল্লাহ সা: আমাদের সামনে মুখ ফিরালেন। বললেন, তোমরা তোমাদের কাতারসমূহ সোজা করবে এবং মিশে মিশে দাঁড়াবে। এক বর্ণনায় অতিরিক্ত আছে যে, আমাদের একজন স্বীয় কাঁধকে সঙ্গীর কাঁদের সাথে, পা-কে সঙ্গীর পায়ের সাথে মিলিয়ে দাঁড়াত। আবু দাউদ বর্ণিত হাদিস হচ্ছে, তোমরা তোমাদের কাতারগুলোতে মিশে মিশে দাঁড়াবে। ওই সত্তার কসম যার হাতে আমার প্রাণ, আমি দেখছি শয়তান তোমাদের মাঝে ফাঁক করে নেয় এবং ভেড়ার বাচ্চার মতো কাতারের ফাঁকে ফাঁকে ঢুকে পড়ে। জামাতে নামাজ আদায়ের সময় প্রত্যেকে ডানের এবং বামের জনের সাথে মিশে মিশে দাঁড়িয়ে আমরা হাদিসের নির্দেশকে বাস্তবায়নে সচেষ্ট হতে পারি।
কাতার সোজা করা : জামাতে নামাজ আদায়ের সময় কাতারে আমরা যেনতেনভাবে দাঁড়াই, কেউ আগে আবার কেউবা একটু পিছে। ইমাম ও খতিব সাহেব বললেও আমরা এ ব্যাপারে ভ্রুক্ষেপ করি না অথচ একটু সচেতন হলেই কাতার সোজা করা সহজ ও সম্ভব। কাতার সোজা করার ব্যাপারে বুখারি শরিফে বর্ণিত হাদিস হচ্ছে, তোমাদের কাতারগুলো সোজা করবে, কারণ কাতার সোজা করা সালাত পূর্ণাঙ্গ হওয়ার অঙ্গ। মুসলিম শরিফে বর্ণিত হাদিস হচ্ছে, তোমরা কাতার সঠিক করবে কেননা কাতার সঠিক করা সালাতে সৌন্দর্যের অঙ্গ ।
রুকু-সেজদার নিয়ম : ইমামের আগে রুকু-সেজদার ব্যাপারে হাদিসে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারিত হয়েছে। জামাতে নামাজ আদায়কালীন অনেকে এ কাজগুলো করে ফেলেন। আবার এরকম নামাজিও কম নন যারা ইমামের সাথে সাথে কাজগুলো করতে গিয়ে ইমামের আগেই কাজগুলো সেরে ফেলেন। বুখারি, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিজি ও নাসাঈতে বর্ণিত হাদিস হচ্ছে, ‘তোমাদের কেউ কি এ কথার ভয় করে না যে, ইমামের পূর্বে সে যদি তার মাথা রুকু ও সেজদা থেকে তুলে নেয় তবে আল্লাহতায়ালা তার মাথাকে গাধার মাথা বা তার চেহারাকে গাধার চেহারায় পরিণত করে দেবেন?
সূরা কিরাত শুদ্ধভাবে পড়া : নামাজে সূরা ক্বিরাত অশুদ্ধ পড়লে নামাজ ভঙ্গ হয়ে যায়। এ কারণে সূরা ফাতিহা এবং কমপক্ষে চারটি সূরা অথবা ছোট ছোট ১২টি আয়াত এবং নামাজ শুরুর আল্লাহু আকবর থেকে শুরু করে নামাজ শেষের আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ পর্যন্ত সহিহ শুদ্ধ করা এবং কুরআন শিক্ষা করা প্রত্যেক ঈমানদার নারী-পুরুষের জন্য ফরজ। অনেকে নামাজ যথারীতি আদায় করলেও সূরা ক্বিরাত সহিহ শুদ্ধ করার ব্যাপারে সম্পূর্ণরূপে উদাসীন। সব ধরনের লাজলজ্জা ত্যাগ করে কুরআন শেখার ব্যাপারে, কমপক্ষে নামাজ আদায়ের উপযোগী সূরা কিরাত শেখার ব্যাপারে প্রত্যেক নামাজিকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ, পদক্ষেপ নেয়া সব কাজের বড় কাজ, সব ধরনের ধর্মীয় কাজের আগের কাজ নিঃসন্দেহে। অথচ অনেকেই সব ফরজের বড় ফরজ পাঠ করাÑ কুরআন পড়া রেখে, আল্লাহর সর্বপ্রথম আদেশ (সূরা আলাক, আয়াত-০১) কুরআন শেখা ও পড়াকে খুব সামান্য গুরুত্ব দিয়ে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কুরআন শেখা ও পড়াকে উপেক্ষা করে আল্লাহর সর্বপ্রথম ও সর্ব প্রধান আদেশ রেখে অনেকে ধর্মীয় কাজ করেন, ধর্মের খেদমতে জীবন কাটান, আল্লাহওয়ালা কাজ করেন, নবীওয়ালা কাজ করেন। ফলে আল্লাহতায়ালার সর্বপ্রথম ও সর্ব প্রধান আদেশ পালন না করার কারণে, সহিহভাবে কুরআন না শেখার কারণে সহিহ শুদ্ধভাবে সূরা কিরাত, দোয়াদুরুদ না শিখে নামাজ আদায়কারী হয়েও কিছু নামাজি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে চোর সাব্যস্ত হচ্ছে, নামাজ আদায় করলেও নামাজির মুখের ওপর নামাজ ছুড়ে মারা হচ্ছে। আহমাদ বর্ণিত হাদিস হচ্ছে, সব চেয়ে বড় চোর হলো সেই ব্যক্তি যে নামাজে চুরি করে। জিজ্ঞাসা করা হলো, কিভাবে নামাজে চুরি করা হয়? রাসূল বললেন, যথাযথভাবে রুকু-সিজদা না করা এবং সহিহভাবে কুরআন না পড়া। হাদিসে আরো বর্ণিত হয়েছে, আর যখন নামাজে রুকু সিজদা ও কুরআন পাঠ সহিহভাবে করে না, তখন নামাজ তাকে বলে, তুমি যেমন আমাকে নষ্ট করলে, আল্লাহও তোমাকে নষ্ট করুক। অতঃপর তা অন্ধকারে আচ্ছন্ন অবস্থায় আকাশে উঠে যায়। তার জন্য আকাশের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। অতঃপর তাকে পুরনো কাপড়ের মতো গুটিয়ে নামাজির মুখের ওপর ছুড়ে মারা হয়।