নামায ইসলামের ভিত্তি:
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমার হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি স্তম্ভের উপর রাখা হয়েছে।
১. সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই, আর মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল।
২. নামায কায়েম করা।
৩. যাকাত আদায় করা।
৪. আল্লাহর ঘরের হজ্জ করা।
৫. রমযান মাসের রোযা রাখা। (বুখারী ও মুসলিম)
হাদীসটিতে ইসলামের মূল ব্যবস্থার একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেশ করা হয়েছে। বস্তুত কালিমায়ে তাইয়্যেবার প্রতি ঈমান আনার সঙ্গে সঙ্গে নামায, রোজা, হজ্জ, যাকাত এই চারটি কাজও মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য। এভাবেই ইসলাম পূর্ণত্ব লাভ করে। হাদীসের কথাটি দৃষ্টান্তমূলক। একটি তাঁবু দাঁড় করাতে হলে উহার চার দিকে চারটি এবং মাঝখানে একটি- এই পাঁচটি খুঁটির আবশ্যক। এই খুঁটি না হলে তাঁবু দাঁড় করানো যাবে না। তেমনিভাবে ইসলাম ও এই পাঁচটি জিনিস ছাড়া রূপলাভ করতে পারে না। এই পাঁচটি হলো ইসলামের খুঁটি বিশেষ। খুঁটিগুলো সরাইলে যেমন তাঁবুটি নীচে পড়ে যাবে, এই পাঁচটি না হলেও ইসলাম খতম হয়ে যাবে।
নামাযের অবস্থান:
নামায এমন একটি ইবাদত যা কথা এবং কাজের সমন্বয়ে সম্পাদিত হয়। নামায আরম্ভ হয় তাকবীরের দিয়ে, সমাপ্ত হয় সালাম দিয়ে।
নামাযের মর্যাদা অপরিসীম। এর সমকক্ষ অন্য কোন ইবাদত নেই। নামায হচ্ছে দ্বীনের ভিত্তি। নামায ছাড়া দ্বীন প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে না। ক্ষমতার মূল হল ইসলাম, আর নামায হল তার ভিত্তি। নামায এমনই একটি ইবাদত যা সরাসরি মে’রাজ রজনীতে মহান আল্লাহ ফরজ করেন। আর কিয়ামতের দিন সর্ব প্রথম নামাযেরই হিসাব নেয়া হবে। নামাযের হিসাব ঠিক থাকলে অন্যান্য আমলও ঠিক থাকবে। আর যদি নামযের হিসাব ভুল হয় তাহলে অন্যান্য আমলেও ভুল হবে। নামায এতো গুরুত্ব রাখে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত বলেছিলেন; নামায! নামায!! এবং তোমাদের দাস-দাসী সম্পর্কে সাবধান থাকেব। নামায ধ্বংস হলে সমস্ত ইবাদতই নিস্ফল।
মহান আল্লাহ নামাযকে কখনো আল্লাহর স্মরণের সাথে উল্লেখ করেছেন; আল্লাহ বলেন: “নিশ্চয়ই নামায বিরত রাখে অশ্লীল ও মন্দ কাজ হতে। আল্লাহর স্মরণই সর্বশ্রেষ্ঠ।” (সূরা আল আনকাবুত: ৪৫) আল্লাহ আরো বলেন; “এবং তদ্বীয় প্রতিপালকের নাম স্মরণ করে ও নামায আদায় করে।” (সূরা আ’লা: ১৫) আল্লাহ অনত্র বলেন; এবং আমার স্মরণার্থে নামায কায়েম কর। (সূরা ত্বাহা: ১৪)
আবার কখনো যাকাতের সাথে নামাযের আলোচনা করা হয়েছে; আল্লাহ বলেন: “আর তোমরা নামায প্রতিষ্ঠিত কর ও যাকাত প্রদান কর।” (সূরা বাকারা: ১১০)
আবার কখনো ধৈর্যের সাথে নামাযের আলোচনা করা হয়েছে; আল্লাহ বলেন: “এবং তোমরা ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর।” (সূরা বাকারা: ৪৫)
আবার কখনো কুরবানীর সাথে নামাযের আলোচনা করা হয়েছে; আল্লাহ বলেন: “সুতরাং তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে নামায আদায় কর এবং কুরবানী কর।” (সূরা কাওসার: ২) মহান আল্লাহ আরো বলেন: “তুমি বলে দাও: আমার নামায, আমরা কুরবানী, আমার মরণ ও জীবন সব কিছু সারা জাহানের রব আল্লাহর জন্য।” (সূরা আন’আম: ১৬২)
ইসলাম নামাযকে এত গুরুত্ব দিয়েছে যে, বাড়িতে, ভ্রমণে, নিরাপদে, আশংকায়, সুস্থতায় অসুস্থতায় সর্বাবস্থায় নামায পড়তে হবে। আল্লাহ বলেন: “তোমরা নামাযসমূহ ও মধ্যবর্তী নামাযকে (আছর) সংরক্ষণ কর এবং বিনীতভাবে আল্লাহর উদ্দেশ্যে দন্ডায়মান হও। তবে তোমরা যদি (শত্রুর ভয়ের) আশংকা কর, সে অবস্থায় পদব্রজে বা যানবাহনাদির উপর (নামায সমাপন করে নেবে) পরে যখন নিরাপদ হও তখন তোমাদের অবিদিত বিষয়গুলো সম্বন্ধে আল্লাহ তোমাদেরকে যেরূপ শিক্ষা দিয়েছেন সেরূপে আল্লাহকে স্মরণ কর।” (সূরা বাকারা: ২৩৮-৩৯)
ভ্রমণাবস্থায় নামায সম্পর্কে আল্লাহ বলেন: “আর যখন তোমরা ভূ-পৃষ্ঠে পর্যটন কর, তখন নামায সংক্ষেপ (কসর) করলে তোমাদের কোন অপরাধ নেই…।” (সূরা নিসা: ১০২)
পক্ষান্তরে যারা নামাযে শৈথিল্য বা অবহেলা করবে তাদের ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে; আল্লাহ বলেন: তাদের পর আসলো অপদার্থ পরবর্তীগণ, তারা নামায নষ্ট করল ও লালসা পরবশ হল: সুতরাং তারা অচিরেই কুকর্মের শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে। (সূরা মারইয়াম: ৫৯)
আল্লাহ আরো বলেন: সুতরাং পরিতাপ সেই নামায আদায়কারীদের জন্য, যারা তাদের নামাযে অমনোযোগী।” (সূরা মাউন: ৪-৫)
হাদীসের আলোকে নামাযের ফযীলত ও গুরুত্ব
১. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : ” যদি কবীরাহ গুনাহ থেকে বিরত থাকা হয় তবে পাঁচ ওয়াক্ত নামায, এক জুমআ থেকে অন্য জুমআ, এক রমযান থেকে অন্য রমযানের মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহ মাফকারী। ” (মুসলিম)
২. হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন: বলতো তোমাদের মধ্যে কারো দরজার সামনে যদি একটি নদী থাকে এবং সে যদি তাতে প্রত্যেহ পাঁচবার গোসল করে, তবে তার শরীরে কোন ময়লা থাকতে পারে? তারা বললো, কোন ময়লা থাকতে পারে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন; পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের দৃষ্টান্ত এরূপ। আল্লাহ তা’আলা নামায দ্বারা বান্দার সমস্ত গুনাহ মোচন করে দেন। (মুসলিম)
এই হাদীসে পাঁচ ওয়াক্ত নামায নিয়মিত সঠিকভাবে পড়ার গুরুত্ব ও উহার উপকারিতা বুঝানোর জন্য রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন: কেউ যদি তার ঘরের সম্মুখ স্থল খালে দৈনিক পাঁচবার গোসল করে, তবে তাতে যেমন তার শরীরে কোন ময়লা থাকতে পারে না, অনরূপভাবে দৈনিক পাঁচবার নামায পড়লেও কারো মনে ও অন্তরে কোন পাপ চিন্তা ও পাপ কাজের কোন অভ্যাস থাকতে পারে না। বরং পাঁচবার গোসলের ফলে যেমন দেহের মলিনতা ধোয়ে মুছে পরিস্কার ও পরিচ্ছন্ন হয়ে যায়, অনুরূপভাবে পাঁচবার নামায পড়লে মনের সকল কুটিলতা, পাপ চিন্তা ও যাবতীয় গুনাহ খাতা দূরীভূত হয়ে যায়। পানি দ্বারা ধৌত করার ফল দৈহিক মনিলতা দূর হওয়া, আর পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়া হচ্ছে মানসিক ও বাস্তব পাপ দূর করার সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়। এখানে দেহের সাথে মনেরও পাঁচবার ধৌত করাকে পাঁচবার নামায পড়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে এই নামাযের ফল বুঝানোর জন্য বলা হয়েছে; নিশ্চয়ই নামায লজ্জাস্কর ও নিষিদ্ধ কাজ হতে বিরত রাখে। (সূরা: আনকাবুত- ৪৫)
৩. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: একদা আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাস করলাম; কোন আমল আল্লাহর নিকট সর্বাধিক পছন্দনীয়? উত্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন; ওয়াক্ত মত নামায আদায় করা। আমি বললাম তারপর কোনটি? তিনি বললেন: মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করা। আমি পূণরায় বললাম, অতপর কোনটি? তিনি বললেন: আল্লাহর পথে জেহাদ করা। (মুসলিম)
৪. আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; তোমাদের মধ্যে কেউ যখন নামায পড়তে দাড়ায়, তখন সে তার রবের সাথে কথোপকথন করে। সুতরাং তখন ডান দিকে থুথু নিক্ষেপ করবে না। বরং (অতি প্রয়োজনে) বাঁ পায়ের নীচে থুথু নিক্ষেপ করবে। (বুখারী)
* ইমাম মালেক আব্দুল্লাহ ইবনে উমারের দাস নাফে হতে বর্ণনা করেন। হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) তাঁর খেলাফতের আমলাদের প্রতি লিখে পাঠান যে, তোমাদের যাবতীয় ব্যাপারের মধ্যে আমার নিকট সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল নামায কায়েম করা। যে নামায রক্ষা করে ও উহার সংরক্ষণ দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করে, সে তার দ্বীনকে রক্ষা করলো। আর যে নামাযকে বিনষ্ট করে, সে এই নামায ছাড়াও অন্যান্য সবকিছু অধিক নষ্ট করে থাকে। (মুয়াত্তা মালেক)
উপরে বর্ণিত বাক্যটি রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখ নিঃসৃত বাণী নয়। বরং উহা হযরত উমার ফারূকের একটি ফরমান। এই ফরমান তিনি তাঁর বিরাট খিলাফতের সরকারী আমলাদের প্রতি লিখেছিলেন। তাঁর এই ফরমানটি দীর্ঘ ছিল, উহার প্রথমাংশ এখানে উদ্ধৃত করা হয়েছে। যদিও ইহা হযরত উমারের বলা বা লেখা কথা, মূলত ইহা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরই বাণী। হযরত উমার ফারূক রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথার উপর ভিত্তি করেই এই বাণীটি তৈয়ার করে ছিলেন। সুতরাং ইহাও হাদীস। কেননা হাদীস বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সাহাবীদের কথাও হাদীস নামে অভিহিত হয়।
৫. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রাঃ), রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা নামাযের প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করলেন। বললেন যে ব্যক্তি নামায সঠিক সময়ে যথাযথ নিয়মে আদায় করবে, তার জন্য কিয়ামতের দিন একটি নূর, একটি দলীল, এবং পূর্ণমুক্তি নির্দিষ্ট হবে। পক্ষান্তরে যারা নামায সঠিক সময়ে আদায় করবে না, তাদের জন্য কিয়ামতের দিন কোন নূর বা দলীল হবে না, এবং তাদের মুক্তির পথও হবে না। তাদের হাশর হবে ফেরউন, হামান, উবাই বিন খাল্ফের সাথে হবে। (আহমদ সনদ সহীহ)
যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লামের পরিবার অভাবগ্রস্ত হতেন তখন তিনি পরিবারের সকলকে ডেকে বলতেন হে আমার পরিবার! নামায আদায় কর, নামায আদায় কর। আল্লাহ তা’আলা তাঁর বান্দাদেরকে নামায ও ধৈর্যের মাধম্যে সাহায্য চাইতে বলেছেন; আল্লাহ তা’আলা বলেন: তোমরা ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর; অবশ্য তা কঠিন, কিন্তু বিনীতগণের পক্ষে নয়। (সূরা বাকার: ৪৫)
আল্লাহ আরো বলেন; হে বিশ্বসীগণ! তোমরা ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর, নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলগণের সাথে আছেন। (সূরা বাকার: ১৫৩)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম কোন প্রতিকূল অবস্থার মুখোমুখি হলে নামাযে দাঁড়িয়ে যেতেন; পরিবার-পরিজনকেও এই আয়াত তেলাওয়াত করে শান্তনা দিতেন: “আর তোমার পরিবারবর্গকে নামাযের আদেশ দাও ও তাতে অবিচল থাকো, আমি তোমার নিকট কোন জীবনোপকরণ চাই না, আমি তোমাকে জীবনোপকরণ দিই। এবং শুভ পরিণাম তো মুত্তকীদের জন্যই।” (সূরা ত্বা-হা: ১৩২)
আর নামাযের মাধ্যমে বান্দা তাকওয়া অর্জন করতে পারে, আর তাকওয়া তথা আল্লাহভীতি অর্জন হলে, ধারণাতীতভাবে জীবনোপকরণ আসতে থাকবে। আল্লাহ বলেন; যে কেউ আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার পথ করে দিবেন। আর তাকে ধারণাতীত উৎস হতে রিয্ক দান করবেন। (সূরা তালাক: ২-৩)
আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন: আমি সৃষ্টি করেছি জ্বিন ও মানুষকে এজন্য যে, তারা আমারই ইবাদত করবে। আমি তাদের নিকট হতে জীবিকা চাই না এবং এও চাই না যে তারা আমার আহার্য যোগাবে। আল্লাহই তো রিয্ক দান করেন এবং তিনি প্রবল, পরাক্রান্ত। (সূরা: যারিয়াত ৫৬-৫৮)
হাদীসে কুদসীতে আছে, আল্লাহ তা’আলা বলেন: হে আদমের সন্তান! আমার ইবাদতে মনোনিবেশ কর, তবে আমি তোমার বক্ষ সম্পদ দ্বারা পরিপূর্ণ করে দিব এবং তোমার অভাব দূর করে দিব। আর যদি তুমি তা না কর তবে তোমার অন্তরকে ব্যস্ততা দ্বারা পরিপূর্ণ করে দিব এবং তোমার অভাব দূর করবো না। (আহমদ, ইবনু মাযাহ)
নামায হলো ভয়-ভীতি দূরীকরণের মাধ্যম। সুতরাং নামাযী কখনও ভীতি হবে না, বখীল হবে না, কৃপণ হবে না, অধৈর্য হবে না, হৃদয় সংকীর্ণ হবে না, লোভী এবং কম ধৈর্যের হবে না।
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন: মানুষ তো সৃজিত হয়েছে অতিশয় অস্থিরচিত্তরূপে। যখন বিপদ তাকে স্পর্শ করে তখন সে হয়, হা-হুতাশকারী। আর যখন কল্যাণ তাকে স্পর্শ করে তখন সে হয় অতি কৃপণ; তবে নামাযীরা ব্যতীত! যারা তাদের নামাযে সদা নিষ্ঠাবান। (সূরা: মা’আরিজ ১৯-২৩)
ছাবেত (রাঃ) বলেন: নবীগণ বিপদগ্রস্থ হলে তৎক্ষনাত নামাযে মনোযোগী হতেন। আর মুমিনগণ কেনইবা নামাযে মনোযোগী হবে না? অথচ উহা তাদের দ্বীনের স্তম্ভ যেমন স্বয়ং নবী করীম (সাঃ) বলেছেন: নামায হচ্ছে দ্বীনের স্তম্ভ। (তিরমিযী)
কবীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকলে নামাযের দ্বারা ছোট গুনাহ মাফ হয়ে যায়:
হযরত বুরাইদা (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; অন্ধকারে পায়ে হেঁটে মসজিদে গমণকারীদেরকে কিয়মতের দিন পরিপূর্ণ নূরের সসংবাদ দাও। (আবু দাউদ ও তিরমিযী)
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম বলেছেন: পাঁচ ওয়াক্ত নামায, এক জুমুয়ার নামায হতে পরবর্তী জুমুয়ার নামায দ্বারা তার মধ্যবর্তী সময়ে সংগঠিত গুনাহসমূহের ক্ষতিপূরণ (কাফ্ফারা) হয়ে যায়, তবে শর্ত হলো কবীরা গুনাহ হতে বেঁচে থাকতে হবে। (তিরমিযী)
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত: রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; যে ব্যক্তি আপন ঘর থেকে পাক-পবিত্র হয়ে ফরয আদায়ের উদ্দেশ্যে আল্লাহর ঘরসমূহের মধ্য থেকে কোন একটি ঘরে দিকে যায়, তাহলে তার বিনিময়ে প্রতি কদমে একটি করে গুনাহ মাফ হয়ে যাবে, এবং অন্য পদক্ষেপে একটি মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। (মুসলিম)
ইসলামে নামায ত্যাগকারীর বিধান
যে ব্যক্তি ইচ্ছকৃতভাবে নামায ছেড়ে দিবে এবং নামায পড়া ফরজ অস্বীকার করবে, সকল মুসলমানের ঐক্যমতে সে কাফির। ইসলামের গন্ডি হতে সে বহিস্কৃত। আর যে ব্যক্তি নামায ফরয হওয়াকে অস্বীকার করে না, কিন্তু অলসতা বশত আদায় করছে না! যা শরীয়তে উযর হিসেবে গৃহীত নয়, এমন ব্যক্তিকেও কাফের অভিহিত করা হয়েছে, আর তাকে হত্যা করার কথা বলা হয়েছে।
হযরত জাবের (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; মানুষ ও কুফরের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে নামায। (মুসলিম)
হযরত বুরাইদা (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; আমাদের মাঝে এবং ইসলাম গ্রহণকারী সাধারণ লোকদের পরস্পরে নামাযের চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি রয়েছে। সুতরাং যে নামায ত্যাগ করবে সে যেন কুফরির পথ গ্রহণ করলো। (আহমদ)
এই হাদীস থেকে বুঝাগেল, কাফির ও মুসলমানদের মধ্যে পার্থক্যের মানদন্ড হচ্ছে নামায ত্যাগ করা। যে নামায পড়ে না সে ‘মুসলিম রূপে’ গণ্য নয়। আর যে নামায পড়ে তরক করে না সে মুসলমান। এ জন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলাম গ্রহণকারী লোকদের নিকট হতে নামায পড়ার ও তরক না করার প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করতেন। এ পর্যায়ে লোকদের সাথে যে চুক্তি গৃহীত হতো তার ভিত্তি ছিল নামায। কেননা নামায পড়াই ঈমানের ও মুসলমান হওয়ার বাস্তব প্রমাণ। এটাই ইসলামের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন।
আল্লাহ তা’আলা বলেন: জান্নাতবাসীগণ জিজ্ঞাসাবাদ করবে অপরাধীদেরকে, তোমাদেরকে কিসে সাক্বার (জাহান্নাম)-এ নিক্ষেপ করেছে? তারা বলবে: আমরা নামাযীদের অন্তর্ভূক্ত ছিলাম না। (সূরা: মুদ্দাস্সির ৪০-৪৩)
মহান আল্লাহ আরো বলেন: সুতরাং পরিতাপ সেই নামায আদায়কারীদের জন্যে, যারা নামাযে অমনোযোগী। (সূরা মাউন ৪-৫)
জামাতের সাথে নামায:
* হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; জামাতের সাথে নামায একাকী নামায অপেক্ষা সাতাশ গুণ অধীক উত্তম ও মর্যদা সম্পন্ন। (বুখারী ও মুসলিম)
আলোচ্য হাদীসে জামাতের সাথে নামায পড়ার জন্য উৎসাহ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে একাকী নামাযের তুলনায় জামাতের সাথে নামায আদায় অধিক মর্যাদাসম্পন্ন। এই হাদীসে সাতাশ গুণ অধিক মর্যাদার উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু অন্য হাদীসে হযরত আবু হুরায়রা হতে বর্ণিত পঁচিশ গুণ অধিক মর্যাদার উল্লেখ করা হয়েছে। মূলত এই সংখ্যা পার্থ্যকের কোন গুরুত্ব নেই। কেননা এখানে বিশেষ কোন তফাৎ নেই। আর কুরআন ওহাদীসে আমলের ফযীলত প্রসঙ্গে যত সংখ্যারই উল্লেখ হয়ে থাকে উহার মূল লক্ষ্য, বিশেষ কোন সংখ্যা বুঝানো নয়, বরং পরিমাণ বা মাত্রার আধিক্য বুঝানোই উহার মূল উদ্দেশ্য।
* আবু হুরায়রা (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত; রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন নামাযে কিছু সংখ্যক লোককে জামাতে দেখতে পাননি। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন; আমি স্থিরভাবে মনস্থ করেছি যে, একজনকে জামাতের ইমাম বানিয়ে নামায পড়ানোর আদেশ দিয়ে আমি সেই সব লোকদের নিকট চলে যাবো, যারা নামাযে অনুপস্থিত থাকে। অতঃপর কাষ্ঠ একত্রিত করে জ্বালিয়ে দিতে বলবো। (বুখারী ও মুসলিম) এসব হাদীস দ্বারা জামাতের গুরুত্ব বুঝানো হয়েছে।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্ট প্রতীয়মান হলো যে, যারা নিজদেরকে মুসলমান বলে দাবী করে, তাদের নিয়মিত নামায আদায় করতে হবে। কারণ নামায প্রমাণ করবে ব্যক্তি মুসলমান নাকি সে কাফির। যারা নিয়মিত নামায আদায় করবে তারাই পরকালে সাফল্য লাভ করবে, তাদের স্থান হবে বেহেশতে শান্তির নীড়ে। পক্ষান্তরে যারা নামায আদায় করবে না, তারা পরকালে ক্ষতিগ্রস্থ হবে, আর তাদের বসবাসের স্থান হবে জাহান্নাম। আর যারা নামাযের হক ও দাবী সহ আদায় করে না, বরং কখনো পড়ে, কখনো পড়ে না! নামাযের মর্মও অনুধাবন করে না। পরকালে তাদের এই নামায কোন কাজে আসবে না। নামায আদায় করতে হবে খুশু-খুযুর সাথে অর্থাৎ বিনয়ী ও নম্রতার সাথে। এভাবে আদায় করতে পারলে আমরা নামাযের সুফল পাবো ইনশা-আল্লাহ।
প্রিয় ভাই ও বোনেরা! আসুন আমাদের প্রকৃত জীবনকে সাফল্য মন্ডিত করার জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামায যথাযথ সময়ে আদায় করি, আল্লাহ আমাদের সকলকে সেই তাওফীক ও শক্তি দান করুন। আমীন ॥