Main Menu

সন্তানের প্রতি জ্ঞানবান পিতার উপদেশ

Originally posted 2013-07-31 17:16:55.

সন্তানের প্রতি জ্ঞানবান পিতার উপদেশ

সন্তানের প্রতি জ্ঞানবান পিতার উপদেশ

আল্লাহ তা‘আলার এমন বাণী যা মুহাম্মাদ (সা.)-এর উপর অবতীর্ণ হয়েছে, মাসহাফের মাঝে লিপিবদ্ধ রয়েছে, সন্দেহাতীতভাবে ধারাবাহিক সূত্র পরম্পরায় আমাদের নিকট পৌঁছেছে, তাকেই পবিত্র কুরআন বলা হয়।
আমরা এই কুরআন পেয়েছি তাঁর নির্বাচিত বান্দা মুহাম্মাদ (সা.)-এর মাধ্যমে। এতে রয়েছে আদেশ, নিষেধ, উপদেশ, কাহিনী, জ্ঞান-বিজ্ঞানের শাখা-প্রশাখা।
প্রিয় পাঠক! আজ আমি যে, জ্ঞান ও উপদেশের কথা বলবো, তা হচ্ছে; হযরত লুকমান তাঁর সন্তানকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, কিন্তু আমরা অনুসরণ করবো এই জন্য যে, উক্ত কথাগুলো পবিত্র কুরআনুল কারীমের তথা মহান আল্লাহ তা‘আলার কথা।
মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন; আমি অবশ্যই লুকমানকে মহাজ্ঞান দান করেছিলাম, (এবং বলেছিলাম) আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। (সূরা লুকামন: ১২) অর্থাৎ আল্লাহর হুকুম পালন করা, তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা জ্ঞানীর পরিচয়। আর বর্তমান সমাজে জ্ঞানী তাদেরকেই বলা হয়, যারা আল্লাহর বেশি না শুকরি করে। যেমন একজন ধনীর সম্পদ আছে, কিন্তু তার জ্ঞান তাকে বলে, যদি এই সম্পদের যাকাত দাও, তোমার সম্পদ কমে যাবে, সুতরাং জ্ঞানীর পরিচয় হলো; ‘জমা কর বেশি হবে’। আর হযরত লুকমান বুঝেছিলেন যে, দুনিয়াতে আমার যত সম্পদ আছে, তার একমাত্র দাতা হচ্ছেন, মহান আল্লাহ তা‘আলা। সুতরাং তাঁরই কৃতজ্ঞতা আদায় করতে হবে। আর এটা আল্লাহ তা‘আলা অত্যন্ত পছন্দ করেছিলেন।

মহান আল্লাহ বলেন; আর যে শুকরিয়া আদায় করে, সে তার নিজের কল্যাণের জন্যই কৃতজ্ঞ হয়, আর যে অকৃতজ্ঞ হয়, (জেনে রাখুন) নিশ্চয়ই আল্লাহ অভাবমুক্ত এবং চির প্রশংসিত। সূরা লুকমান: ১২)
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা কারো প্রশংসার মুখাপেক্ষী না। কেউ আল্লাহর প্রশংসা করে তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধি করতে পারে না। আবার দুনিয়ার সমস্ত মানুষও যদি আল্লাহর প্রশংসা না করে, তাহলেও আল্লাহর মর্যাদা একটুও কমবে না। তাইতো জ্ঞানীরা তাদের নিজের স্বার্থেই আল্লাহর প্রশংসা করে। আসুন আমরা জ্ঞানবান লুকমানের উপদেশগুলো শুনি এবং সে মতে আমল করার জন্য মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করি।
১নং উপদেশ: যখন লোকমান উপদেশচছলে তার পুত্রকে বলল: হে বৎস, আল্লাহ্র সাথে শরীক করো না। নিশ্চয় আল্লাহ্র সাথে শরীক করা মহা অন্যায়। (সূরা লুকমান: ১৩) পবিত্র কুরআনের উক্ত নির্দেশটি যদিও লুকমান, তাঁর ছেলেকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, কিন্তু আমাদেরকেও উক্ত উপদেশটি গ্রহণ করতে হবে, আমাদের পরকালের স্বার্থে। কারণ মাহন আল্লাহ অন্যত্র বলেন; “এটি আল্লাহ্র হেদায়েত। ¯¦ীয় বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা, এপথে চালান। যদি তারা শেরেকী করত, তবে তাদের কাজ কর্ম তাদের জন্যে ব্যর্থ হয়ে যেত। (সূরা আনআম ৮৮)
অর্থাৎ শিরককারীর জন্য জান্নাত হারাম, তাদের ঠিকানা জাহান্নাম, এমনকি তাকে পুনরায় সুপারিশ করেও কেউ জান্নাতে নিতে পারবে না। আর উক্ত শিরকী অপরাধের কারণে পূর্বে ব্যক্তি যদি কোন নেক আমল করেও থাকে, তাও বাতিল হয়ে যাবে। প্রিয় নবী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম বলেন: বিচারের দিনে কোন বান্দা যদি পাহাড় সমান সমান গুনাহও থাকে, আর এর মধ্যে লোকটি শিরক মুক্ত হয়ে থাকে, তবে আল্লাহ পাহাড় পরিপাণ রহমত নিয়ে আসবেন অর্থাৎ ব্যক্তিকে ক্ষমা করে দিবেন। তাইতো লুকমান আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানের কারণে সন্তানকে আগে শিরকের অপকারিতা সম্পর্কে উপদেশ দিলেন। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম বলেন; আমি তোমাদের জন্য ছোট শিরকে আশঙ্কা করছি সর্বপেক্ষা বেশি, আর ছোট শিরক হচ্ছে; লোক দেখানো আমল। অতএব আসুন আমরাও লুকমানের উপদেশ গ্রহণ করি, শিরকমুক্ত আমলের প্রতিজ্ঞা করি।
২নং উপদেশ: পিতা-মাতার আনুগত্য কর; পিতা-মাতা যদি তোমাকে আমার সাথে এমন বিষয়কে শরীক স্থির করতে পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান তোমার নেই; তবে তুমি তাদের কথা মানবে না এবং দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে সহঅবস্থান করবে। যে আমার অভিমুখী হয়, তার পথ অনুসরণ করবে। অত:পর তোমাদের প্রত্যাবর্তন আমারই দিকে এবং তোমরা যা করতে, আমি সে বিষয়ে তোমাদেরকে জ্ঞাত করবো। (সূরা লুকমান ১৫) এখানে কত চমৎকারভাবে আয়াতে বিন্যাস করা হয়েছে; যেমন আগের আয়াতে লুকমান তার সন্তানকে আল্লাহর বড়ত্ব বর্ণনা করছেন, যে তাঁর সঙ্গে কাউকে শিরক বা অংশীদার কায়েম করা যাবে না। পরের আয়াতে আল্লাহ সন্তানকে নির্দেশ দিচ্ছেন, মাত-পিতার সঙ্গে ভালো আচরণের। কারণটাও বলে দিলেন যে, তোমার জননী তোমাকে অনেক কষ্ট করে গর্ভ ধারণ করেছেন। ছোট বেলায় লালন-পালন করে বড় করেছেন, দু’বছর দুধ পান করিয়েছেন। ছোট বলায় তোমার আরামের জন্য তাঁরা উভয়ে তাদের আরামকে বিসর্জন দিয়েছেন। সুতরাং হে সন্তান! যে মহান আল্লাহ তাদের অন্তরে তোমার প্রতি মুহাব্বত করলেন, তাদের প্রতিও কৃতজ্ঞ হও। যদি না হও, মনে রেখ, প্রত্যাবর্তন তো আমার নিকট করবে। অর্থাৎ জন্য তোমাকে জবাবদিহি করতে হবে। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লামকে প্রশ্ন করা হলো, খেদমত করবো কার? তিনি জবাবে তিনবারই বললেন তোমার মায়ের। চতুর্থবার বললেন; তোমার পিতার।
অন্যদিকে প্রিয় নবী (সা.)-এর জানী দুশমন আবু সুফিয়ান যখন মদীনায় গেলেন, তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। রাসূল (সা.) আবু সুফিয়ানের সাথে কথা বললেন না। কিন্তু উম্মে হাবীবাকে বললেন, পিতার হক আদায় কর। অথচ আবু সুফিয়ান তখনও মুশরিক ছিল। এ থেকে বুঝা যায় ধর্ম পরিবর্তণ হলেও পিতা-মাতা পরিবর্তণ হয় না। আল্লাহ তা‘আলা পিতা-মাতার এতো মর্যাদা দেওয়ার পরও বলছেন, তাঁরা যদি তোমাকে আমার সাথে শিরক করতে বলে, সে ক্ষেত্রে তাদের কথা মানা যাবে না। হাদীসে রাসূল (সা.) এরশাদ করেন; যেখানে ¯্রষ্টার অবাধ্যতা হয় সেখানে কোন সৃষ্টির আনুগত্য করা যাবে না।
যেমন কোন মা যদি বলে, “বাবা আমি তোমার ব্যাপারে একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছি, আমার মন মানছে না, চলো উমক মাজারে একটি মুরগী দিয়ে আসি, স্বপ্নের খারাপী চলে যাবে।” এই ক্ষেত্রে মায়ের উক্ত কথা শোনা যাবে না। কারণ গাইরুল্লাহর নামে, কিংবা কোন মাজারে মান্নত করা শিরক। মা যদি বলেন, তোমার শ্বাসকষ্ট চলে যাবে উমক পীরের কাছ থেকে একটি তাবিজ গলায় ঝুলিয়ে রেখ। এক্ষেত্রেও মায়ের উক্ত কথা মানা যাবে না। কারো যদি বাবা মারা গিয়ে থাকে, আর তার মা যদি বলে, প্রতি বছর তোমার বাবার মৃত্যুবার্ষিকী করবে, তাহলে তোমার বাবার আত্মা শান্তি পাবে। আর আমিও খুশী হবো। মায়ের এসব আদেশও মানা যাবে না। কিন্তু এসবের কারণেও তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করা যাবে না। মাথা ঝাকি দিয়ে মুখ মলিন করে কথা বলা যাবে না। কারণ আল্লাহর নির্দেশ; তিনি বলেন: “প্রত্যাবর্তণ আমারই নিকট” অর্থাৎ যদি তুমি মা-বাপের আদেশ মেনে শিরক করো, অথবা এই অন্যায় আদেশের অপরাধে তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার কর, জেনে রেখ আমার নিকট তোমাকে আসতে হবে, জবাবদিহি করতে হবে। সুতরাং হে সন্তান সাবধান!!!
৩ নং উপদেশ: নেককারদের পথে চলো। “এবং বিশুদ্ধচিত্তে যে আমার অভিমুখী হয়েছে, তার পথ অবলম্বন কর। (সূরা লুকমান: ১৫) হযরত লুকমান তার সন্তানকে উপদেশ দিচ্ছেন, যে তুমি সৎলোকদের সঙ্গে চলো। প্রবাদ আছে “সৎসঙ্গে স্বর্গবাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ” সৎলোক তথা নেককারদের সঙ্গে চললে তুমিও নেককার হতে পারবে। তাই রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট কেউ দোয়া চাইলে তিনি বলতেন: তোমার সাথী যেন নেককার ছাড়া কেউ না হয়। তোমার খাদ্য যেন নেককার ছাড়া কেউ না খায়। কারণ নেককার লোক খেয়ে দোয়া করবে, তাতে বরকত হবে। আর বদকার লোক খেয়ে দোয়া করবে না। নেককার ব্যক্তি কারো বাড়িতে মেহমান হলে, তিনি খাওয়া দাওয়া শেষ করার পর বলেন; হে আল্লাহ! তুমি তাদেরকে যে রিযিক প্রদান করেছ, তাতে বরকত দান কর, তাদের গুনাহ মাফ কর, তাদের প্রতি অনুগ্রহ কর, হে আল্লাহ যে আমাকে আহার করালো, তুমিও তাকে আহার করাও, যে আমাকে পান করালো, তুমিও তাকে পান করাও। তেমনিভাবে যতবেশি নেককার লোকদের সাথী হওয়া যাবে, ততবেশি নেকী হবে। অবশ্য এমন উপদেশ জ্ঞানীরাই দিয়ে থাকেন।
৪ং উপদেশ: হে বৎস! তা যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয়, এবং তা যদি থাকে শিলাগর্বে অথবা আকাশে কিংবা ভূগর্বে আল্লাহ ওটা হাজির করবেন। (সূরা লুকমান: ১৬)
উক্ত উপদেশ অন্তর থেকে বিশ্বাস করলে আল্লাহর উপর ভরসা বাড়ে, সাথে সাথে পরকালে জবাবদিহিতার ভয়ও মনে জাগে। আজকে রুজির জন্য, ক্ষমতার জন্য এমন কোন অপরাধ নাই যা মানুষ করে না! এমন কোন অপরাধ নাই যে মানুষ একে অপরের চাপায় না। টার্গেট একটাই, অর্থ আর ক্ষমতা। অথচ হাজার হাজার বছর আগে লুকমান তাঁর সন্তানকে যে উপদেশ দিয়েছেন, তা আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে জানিয়ে দিলেন। তোমার রুজি যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয়, আর যেখানেই থাকুক না কেন, আল্লাহ তা তোমার পেটে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিবেন। আমরা অনেকেই (আমি নিজেও) কল্পনাও করতে পারি নাই যে কুয়েতে কিংবা সৌদী আরব যাব, আল্লাহ তাকদীরে লিখে দিয়ে ছিলেন বলেই আর এসব দেশে রিজিক ছিলো বলেই আল্লাহ এদেশে আসার একটা সুযোগ সৃষ্টি করে দিলেন, তাই আমরা কেউ কুয়েতে আবার কেউ সৌদীতে আসতে পেরেছি। যদি এই বিশ্বাস আমাদের মজবুত হয়, তাহলে ঈমানের ছয়টি রুকনের একটি তাকদীরের ভালো-মন্দ রোকনটিও আমাদের বৃদ্ধি হবে।
সাথে সাথে আয়াতের উপদেশের দ্বিতীয় দিকটিও মনে রাখতে হবে। রুজি অন্বেষণে যদি কোন ছলচাতুরী করি তাহলে পাপ হবে। তা যদি ছোট পাপও হয় অর্থাৎ শরিষার দানা পরিমাণও হয়, যদি পাপটি গোপনেও হয়, যেখানেই করি না কেন, আল্লাহ সেটা হাজির করবেন। কারণ আল্লাহ যে সূক্ষ্মদর্শী খবর রাখেন সব বিষয়ের। লুকমান: ১৬
৫নং উপদেশ: সালাত আদায় কর; আমরা জানি সকল নবীর সময়ে তাঁর উম¥তের জন্য সালাতের হুকুম ছিল। কিন্তু দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত শুধু উম্মাতে মুহাম্মদী তথা আমাদের জন্য।
সালাত হচ্ছে নৈতিক ইবাদত। একজন মানুষ যখন আল্লাহর কাছে আনুগত্যের মস্তক অবনত করে, ঐ মস্তক কিন্তু আর শয়তানের কাছে অবনত করে না। আর এ জন্য শয়তান সালাতকে বেশি ভয় করে। একটু আসপাশের পরিবেশের দিকে নজর দিলে দেখা যায় যে, সালাত আদায় করলে পয়সা খরচ হয় না, কারো রাজ নৈতিক, অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় না। তারপরও ফাসেক প্রকৃতির লোকগুলি নামাযী সাথী ভাইকে দেখলে টিটকারী মারে, তার ক্ষতি করার সুযোগ খুঁজে, টিটকারী করে আল্লা বিল্লা পার্টি বলে। অথচ এই নামাযীর কারণে তার কোন ক্ষতি হয় না, তার মানে ঐ ফাসেক লোকটির ঘাড়ে শয়তান ভর করে তাকে প্ররোচনা দেয়। আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও যখন কাবার চত্বরে সালাত আদায় করতেন, তখন আবু জাহেলসহ অন্যান্য মুশরিকের কোন ক্ষতি হতো না। তারপরও তারা উটের নাড়িভুড়ি, রাসূলের ঘাড়ের উপর চাপিয়ে দিয়ে ছিলো। আর এই উম্মতকে শয়তানের দলে ভিরানোর একটা সহজ মাধ্যম হলো সালাত পরিত্যাগ করা। এ জন্যই দেখা যায় সালাতের আযান হলেই কাজের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। অতএব ঈমান বাঁচানোর তাগিদেই আমাদের সালাতের প্রতি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।

৬ নং উপদেশ: সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ: লুকমানের এই উপদেশটি আল্লাহ তা‘আলা আমাদের জানিয়ে দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন যে, তোমাকে পিতা মাতার খেদমত, সালাত আদায় করে, শির্কমুক্ত ইবাদত এ সকল কাজ করেই তোমার দায়িত্ব শেষ নয়, তোমাকে সমাজ সংশোধনের কাজও করতে হবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন; “তোমরাই শ্রেষ্ঠজাতি, তোমাদের উত্থান ঘটানো হয়েছে এই জন্য যে, তোমরা ন্যায়ের আদেশ করবে, এবং অন্যায়ে থেকে নিষেধ করবে, এবং আল্লাহর উপর ঈমান আনবে।” (আলে ইমরান: ১১০) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন: “তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত যারা মানুষকে কল্যাণের পথে আহ্বান করবে, আর ন্যায়ের আদেশ দিবে, অন্যায় থেকে নিষেধ করবে।” (আলে ইমরান: ১০৪)
কথা হচ্ছে ন্যায় অন্যায়ের মানদ- কি? ফেরাউন বলে ছিল; “আমি তোমাদের শুধু সৎপথই দেখিয়ে থাকি” (সূরা মুমিন বা গাফের: ২৯)
আমাদের নেতারাও ঠিক একই কথা বলে, আমরা যা করি জনগণের কল্যাণের জন্যই করি। তৎকালীন ফেরাউন আর বর্তমানের নেতারা যে, কি কল্যাণ করে তা একজন সাধারণ মানুষই বুঝে। তাই ন্যায়-অন্যায়ের মানদণ্ড একমাত্র পবিত্র কুরআন ও রাসূলের বিশুদ্ধ হাদীস।
রাসূল (সা.) বলেন: তোমাদের কেউ কোন গর্হিত কাজ দেখলে সে যেন তা হাত দিয়ে প্রতিহত করে, যদি তাও না পারে যবান তথা মুখ দিয়ে বাধা প্রদান করে, যদি তাও না পারে তবে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করবে, আর ইহা হলো ঈমানের সর্ব নি¤œ স্তর।
৭ নং উপদেশ: ছবর বা ধৈর্য: একজন মানুষ যখন সমাজ সংশোধনের কাজে নামে তখন তার উপর বিপদ আসে। তখন এই বিপদ মুহূর্তে তার করণীয় কি? জ্ঞানীর পরিচয় হলো; উক্ত মুহূর্তে সবর করা ও সাথে সাথে আল্লাহর সাহায্য চাওয়া, যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন; আমি তোমাদের পরীক্ষা করবো, যাতে তোমাদের মধ্যকার মুজাহিদ ও ধৈর্যশীলদের চিনে নিতে পারি। (সূরা মুহাম্মাদ: ৩১) আল্লাহ আরো বলেন: ধৈর্যশীলদেরকে অগণিত পুরস্কার পূর্ণভাব দেওয়া হবে। (সূরা যুমার: ১০)
লুকমান তার সন্তানকে এই জন্যই ধৈর্যধারণের উপদেশ দিলেন, কারণ বিপদ ও মুসিবতকে আল্লাহর দেওয়া পরীক্ষা মনে করে সবরের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য চাইলে আল্লাহ তাকে পুরস্কৃত করবেন ইহকালে অথবা পরকালে। রাসূল (সা.) বলেন: মুমিনের ব্যাপারটা আশ্চর্যজনক, তার সমস্ত কাজই কল্যাণকর। মুমিন ছাড়া অন্যের ব্যাপারে এমন নয়। তার জন্য আনন্দের কিছু হলে সে আল্লাহর শোকর আদায় করে। তাতে তার মঙ্গল হয়। আবার ক্ষতির কিছু হলে, সে ধৈর্যধারণ করে, এটা তার জন্য কল্যাণকর।
সবরের আরো কিছু প্রকার আছে, যেমন আনুগত্যের ছবর, অর্থাৎ জীবনের অনেকটা সময় আল্লাহর নাফরমানীতে কেটে গেছে এখন মনে আল্লাহর ভয় ঢুকেছে, সালাতের অভ্যস্ত ছিল না এখন সালাত শুরু করেছে, দাড়ি ছিল না এখন দাড়ি রেখেছে। পিছনের অনেকটা সময়ের দিকে না তাকিয়ে বর্তমানে যে আনুগত্য শুরু হয়েছে তা ছবরের সাথে আশা নিয়ে অব্যাহত রাখাকে আনুগত্যের সবর বুঝায়।
সবরের আরেকটা দিক হলো; গুনাহ হতে বিরত থাকার সবর। যেমন টেলিভিশনে সুন্দর একটা নাটক, গান, বা সিনেমা হচ্ছে; মন চায় সেগুলো দেখি, কিন্তু গুনাহর কথা চিন্তা করে না দেখে সবর করা। ফন্দি-ফিকির করে টাকা রোজগার করার সুযোগ আছে, কিন্তু গুনাহর কথা স্মরণ করে তা না করাই হলো গুনাহ হতে বিরত থাকার সবর। যুগযুগ আগে লুকমান তার সন্তানকে এই সবরের শিক্ষা দিয়েছেন।
৮ নং উপদেশ: অহঙ্কার করো না: মানুষ অহঙ্কারী করে অনেক কারণে, যেমন: অর্থের অহঙ্কার, ক্ষমতার অহঙ্কার, জ্ঞানের অহঙ্কার, এ জাতিয় সকল অহঙ্কারের পরিণাম জাহান্নাম। অনেক লোক আছে যারা প্রবাসে আসার পর টাকা পয়সার মালিক হয়েছে, আর এই টাকা পয়সা-ই তাকে অহঙ্কারী বানিয়েছে। সম্পদের যাকাত দেয় না, আবার গরীব লোক দেখলে একটু ভাব নিয়ে চলা-ফেরা করে। আত্মীয়-স্বজন প্রতিবেশীর হক যথাযাথ আদায় করে না। এই শ্রেণীর লোক পরকালে, অহঙ্কারের কারণে শাস্তি ভোগ করবে।
অনেক ক্ষমতাসীন ব্যক্তি ক্ষমতা পাওয়ার আছে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষুকের মতো হাত তো পাততোই মাথাটাও পেতে দিতো। আর বলতো আমার জন্য একটু দোয়া করবেন। জনগণ ভোট দিয়ে যখন এই লোকটিকে ক্ষমতায় বসায়, অমনি অহঙ্কারী হয়ে যায়। আগে পিছে ক্যাডার নিয়ে চলে। আগে তো ভাই বলে ডাকা যেত, এখন স্যার বললেও শোনেনা। আর গরীব লোকদেরকে পারলে তো পিসে পারে। ক্ষমতা তাকে এমন অহঙ্কারী বানায় যে সে মনে করে তার এই ক্ষমতা চিরকাল থাকবে! আবার কিছু লোক আছে, তারা জ্ঞানের অহঙ্কার করে। এটা মারাত্মক অপরাধ, কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যে তিন ব্যক্তিকে জাহান্নামের দিবেন, তাদের একজন হবে জ্ঞানী। কারণ সে চাইতো যে দুনিয়ার সবাই তাকে জ্ঞানী বলে ডাকুক। তাইতো আল্লাহ তা‘আলা অহঙ্কারীদেরকে লক্ষ্য করে বলেন: ভূপৃষ্ঠে দম্ভভরে বিচরণ করনা, তুমি কখনো পদভরে ভূপৃষ্ঠ বিদির্ণ করতে পারবে না। এবং উচ্চতায় তুমি কখনো পর্বত সমানও হতে পারবে না। (সূরা ইসরা: ৩৭)
লুকমান তাঁর সন্তানকে পরকালে মুক্তির স্বার্থেই অহঙ্কারী হতে নিষেধ করেছেন। আমাদেরও উচিত যে, যতো ধনীই হই না কেন, যত ক্ষমতাধর বা জ্ঞানী হই না কেন, অহঙ্কার ছেড়ে দিয়ে, এসবকে আল্লাহর নিয়ামত ও পরীক্ষা মনে করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা এবং পরীক্ষায় পাস করার চেষ্টা করা। তবেই আমরা সফলতা অর্জন করতে পারবো। ইনশা আল্লাহ।
৯ নং উপদেশ: দুনিয়াতে চলাচলে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করবে: জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থানীতি অবলম্বনে আল্লাহর সন্তুষ্টি রয়েছে, এমনকি ব্যক্তিরও কল্যাণ রয়েছে। যেমন উদার মন-মানসিকতা কারণে হাত পা ছেড়ে দিয়ে দান করে আহাল পরিবারের হক নষ্ট করে, আল্লাহর আদালতে আসামী হওয়া যাবে না। আবার টাকা পয়সা আছে বলে অতি বিলাসিতার কারণে দামী মোবাইল সেট, দামী ঘড়ি (অহঙ্কার বশত) পরে আল্লাহর আদালতে অপচয়কারী হিসেবে আসামী হওয়া যাবে না। পোশাক আশাক দুই তিন জোড়া হলেই যথেষ্ট, অযথা বেশি রাখা বিলাসিতার শামিল। আর বিলাসিতাকারী আল্লাহর কৃতজ্ঞতা করার সুযোগ পায় না।
ইবাদত বন্দেগীতে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করতে হবে। অত্যাধিক বাড়াবাড়ি করা নিষেধ। হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন; তিনজন ব্যক্তি রাসূল (সা.)-এর স্ত্রীগণের বাড়িতে আসলেন, রাসূল (সা.)-এর ইবাদত সম্পর্কে জানার জন্য। যখন তাদেরকে এ সম্পর্কে অবহিত করা হলো; তারা নিজেদের আমলকে সামান্য মনে করলেন। তারা বলতে লাগলেন; রাসূল (সা.) -এর তুলনায় আমরা কোথায়? তাঁর পূর্বের ও পরের সমস্ত গুনাহ মাফ করা হয়েছে। আমাদের তো আর মাফ করা হয়নি। তাদের একজন বললো, আমি সারা রাত নামাযে মগ্ন থাকবো, আরেক জন বললো, আমি অনবরত সিয়াম পালন করবো, আরেক জন বললো, আমি নারীদের থেকে দূরে থাকবো, কখনোই বিয়ে-শাদী করবো না। রাসূল (সা.) তাদের কাছে এসে বললেন, তোমরা কি এমন কথাগুলো বলেছ? আল্লাহর শপথ তোমাদের চাইতে আমি আল্লাহকে বেশি ভয় করি, বেশি তাকওয়া অবলম্বন করি, কিন্তু আমি রোযা রাখি এবং রোযা ভাঙ্গিও, নামায পড়ি এবং ঘুমাই, এবং বিয়ে-শাদীও করেছি। যে ব্যক্তি আমার নিয়ম পালন করবে না, সে আমার দলভুক্ত নয়। (বুখারী ও মুসলিম)
বুখারীর অন্য এক হাদীসে আছে; তোমরা মধ্যমপন্থা অবলম্বন করো ও সামর্থ অনুযায়ী আমল করো এবং সকালে ও রাতে চলো এবং শেষ রাতের কিছু অংশ ভারসাম্যপূর্ণ পন্থা অবলম্বন করো। মধ্যমপন্থা অবলম্বন করো, লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে। হাজার হাজার বছর আগে জ্ঞানবান লুকমান তার সন্তানকে লক্ষ্যে পৌঁছার কৌশল বলে দিলেন, একটি মাত্র কথায় যে, তুমি দুনিয়াতে চলাচলে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করো। আমরাও যদি লক্ষ্যে পৌঁছতে চাই অতিবিলাসিতা ছাড়তে হবে এবং অতি দরবেশিও ছাড়তে হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাওফীক দান করুন।
১০ নং উপদেশ: গলার আওয়াজকে নিচু করবে, গাধার মত শব্দ করবে না: সমাজে প্রবাদ বাক্য চালু আছে ‘নরমে যা হয়, গরমে তা হয় না।’ একই কথা উঁচু আওয়াজে বললে এক অর্থ দাড়ায়, আবার নিচু আওয়াজে বললে অন্য অর্থ হয়। আর এই উঁচু আওয়াজ আদবের খেলাপ। তাছাড়া উপরের সবগুলো যে কোন ব্যক্তির জীবনে বাস্তবায়ন করতে হলে গলার আওয়াজ অবশ্যই নরম করতে হবে। যেমন তাওহীদ ভিত্তিক জীবন যাপন, মাতা-পিতার খেদমত, সমাজে নেককার মানুষের সঙ্গে চলতে হলে, এমনি সৎকাজের আদেশ ও মন্দ কাজের নিষেধ অর্থাৎ দাওয়াতি কাজ করতে হলে সর্ব প্রথম নরম মেজাজের অধিকারী হতে হবে। তাকে বুঝতে হবে তিনি যেন রোগীর সঙ্গে লেনদেন করছেন। আর রোগীরা এমন হৃদয়ের মুখাপেক্ষী যা হয় দয়ালু ও রহমকারী। এ জন্যই মহান আল্লাহ তাঁর নবী মূছা (আঃ) ও হারূন (আঃ)-কে নির্দেশ করেছিলেন, ফিরাউনের কাছে গিয়ে সহজ ও নরম কথা বলার জন্য। আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর এই গুণটিকে আল্লাহ তা‘আলা প্রশংসা স্বরূপ এভাবে বলেছেন; অতএব আল্লাহর অনুগ্রহ এই যে, তুমি তাদের কোমল চিত্ত। এবং তুমি যদি কর্কশ ভাষী হতে, কঠোর হৃদয় হতে, তবে নিশ্চয়ই তারা তোমার সংস্পর্শ হতে দূরে চলে যেত। (সূরা আলে ইমরান: ৫৯)
প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর নিকট জিজ্ঞেস করা হলো; হে রাসূল! একজন মহিলা মসজিদ ঝাড়– দেয়, কিন্তু মুখের অত্যাচারে মানুষ বিরক্ত। অন্য এক মহিলা যিনি মসজিদ ঝাড়– দেয় না, কিন্তু তার আচরণে মানুষ সন্তুষ্ট, তাদের মধ্যে কে আগে জান্নাতে যাবে? রাসূল (সা.) বললেন, যার মুখের আচরণ ভালো সে আগে জান্নাতে যাবে।
পরিশেষে বলবো মহান আল্লাহ তা‘আলা সূরা লুকমানের ১২ থেকে ১৯ আয়াত পর্যন্ত সন্তানের প্রতি, পিতার কি দায়িত্ব তা একটি কাহিনীর মাধ্যমে জানিয়ে দিলেন। এবং তা অনুসরণ ও বিমুখতায় কি ফলাফল হবে তাও জানিয়ে দিলেন। এক্ষণে প্রতিটি মুমিন ব্যক্তির করণীয় হবে। উপদেশগুলো হৃদয় দিলে অনুধাবন করে নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করা এবং নিজের সন্তানদেরকেও উপদেশ দেওয়া। তাহলেই আমরা আল্লাহর কাছে জ্ঞানী বলে বিবেচিত হতে পারবো। সমাজে শান্তি আসবে। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা বৃদ্ধি হবে।
আল্লাহ যেন আমাদের সকল মুসলমান নর-নারীকে উপর্যক্ত উপদেশগুলো নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করার সুযোগ ও মানসিকতা তৈরি করে দেন। আমীন

Related Post