পাদ্রি সেদরিক রিব রুট এখন আহমদ আলী

নও মুসলিমের কাহিনী

নও মুসলিমের কাহিনী

ইউরোপে ইসলাম-বিদ্বেষী মহলগুলোর ততপরতা দিনকে দিন জোরদার হওয়া সত্ত্বেও সেখানে ইসলামে দীক্ষিতের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ফরাসি দৈনিক লা মন্ডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “ফ্রান্সে ইসলাম ও মুসলমানদের দমিয়ে রাখার জন্য উগ্র ইহুদিবাদী নানা গ্রুপ ও ডানপন্থী ফরাসি দলগুলোর ব্যাপক ততপরতা সত্ত্বেও এই দেশটিতে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় বইয়ের এবং সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের তালিকার শীর্ষে রয়েছে

পবিত্র কুরআন। কয়েকদিন আগে একজন ফরাসি সাংবাদিক পবিত্র কুরআনের একটি কপি কেনার জন্য দেশটির মার্সাই, স্ট্রাসবুর্গ ও তুলুস শহরের বইয়ের বাজারের কয়েকটি বিখ্যাত দোকানে গিয়ে দেখেন যে, সেখানে কুরআনের সব কপি বিক্রি হয়ে গেছে। ফরাসি লাইব্রেরিগুলোর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থ পবিত্র কুরআন এখন ফ্রান্সের সবচেয়ে বিখ্যাত ও সবচেয়ে বেশি বিক্রিত বই। “

ডক্টর সেদরিক রিব রুট ছিলেন একজন অর্থোডক্স খ্রীষ্টান পাদ্রি। তিনি একাধারে দক্ষ সঙ্গীত শিল্পী, পিয়ানো-বাদক, কবি ও সাহিত্যিক। সাহিত্য বিষয়ে তার লেখা কয়েকটি বইও প্রকাশিত হয়েছে। সবাইকে বিস্মিত করে ছয় বছর আগে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। মুসলমান হওয়ার পর নিজের জন্য আহমদ আলী নামটি বেছে নেন সাবেক সেদরিক।

সেদরিক কাজ করতেন খ্রীষ্ট ধর্ম সম্পর্কিত একটি গবেষেণা কেন্দ্রে। নানা ধর্ম সম্পর্কে পড়াশুনা করতে গিয়েই তিনি ইসলামের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হন এবং শেষ পর্যন্ত মুসলমান হন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন:

“খ্রীষ্ট ধর্ম সম্পর্কিত একটি গবেষণা কেন্দ্রের কর্মী হিসেবে সব ধর্মগ্রন্থগুলো সম্পর্কে পড়াশুনা করা আমার জন্য জরুরি হয়ে পড়েছিল। যখন পবিত্র কুরআনের অনুবাদ পড়লাম, মনে হল অনুবাদের মধ্যে মূল বক্তব্য হয়তো পুরোপুরি স্পষ্ট হয়নি। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, আরবি ভাষা শেখব এবং এভাবে আমার জ্ঞান বাড়ানোর পদক্ষেপ নেব। এভাবে ইসলাম সম্পর্কে আরও পড়াশুনা করে শেষ পর্যন্ত এ ধর্ম গ্রহণ করি। অবশ্য গত দুই শ বছরে ফ্রান্সে ইসলাম সম্পর্কে যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তা হল, এ ধর্মটি একটি হিংস্র ধর্ম। পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো ইসলামকে হিংস্রতা, হত্যাকাণ্ড, লুটপাট ও সন্ত্রাসে ভরপুর ধর্ম হিসেবে তুলে ধরছে।

আর এই চিত্র মোটেই প্রীতিকর নয়। অথচ এ সত্ত্বেও আমরা দেখছি যে ফরাসিরা ইসলামের সত্যতা বা বাস্তবতাগুলো সম্পর্কে ক্রমেই বেশি আগ্রহী হচ্ছে। অনেক ফরাসি নাগরিক পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমগুলোর অসততার বিষয়টি বুঝতে পেরে ইসলাম সম্পর্কে বাস্তব অবস্থা জানতে আগ্রহী হচ্ছেন। আমি নিজে ইসলাম সম্পর্কে বাস্তব অবস্থা জানতে পেরেছি, অর্থাৎ এ ধর্ম যে সত্য ধর্ম তা বুঝতে সক্ষম হয়েছি।”

পবিত্র কুরআন ইসলামের সত্যতার এক অপূর্ব সনদ। এর ভাষা ও বক্তব্যের যৌক্তিকতা এবং সৌন্দর্য এত দুনির্বার যে ইসলামের প্রাথমিক যুগে মক্কার মুশরিকরা কুরআনের তিলাওয়াত শুনতে ভয় পেত। তারা ভাবত, কুরআনের ‘যাদু-মাখা’ বক্তব্য শুনলেই তাদের হৃদয় বিগলিত হয়ে যাবে। কিন্তু তারপরও কুরআনের বক্তব্যের আকর্ষণ প্রতিরোধ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। পবিত্র কুরআনের বক্তব্যের সেই আকর্ষণ এখনও বজায় রয়েছে।

এখনও প্রতিদিন বহু অমুসলমান আকৃষ্ট হচ্ছেন কুরআনের অশেষ সৌন্দর্যের টানে। খ্রীষ্টান পাদ্রি রিব রুটও কুরআনের এই অশেষ সৌন্দর্যে অভিভূত হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন: “একজন খ্রীষ্টান পাদ্রি হিসেবে অন্য ধর্মের পবিত্র গ্রন্থগুলো পড়তে গিয়ে কখনও হৃদয়ে কোনো গভীর পরিবর্তন বা আলোড়ন অনুভব করিনি। কিন্তু কুরআনের আরবি লেখাগুলোর ওপর চোখ পড়তেই ও পড়ে দেখার পর পরই হৃদয়ে বড় ধরনের পরিবর্তন ও চিন্তা-চেতনায় আমূল পরিবর্তন অনুভব করেছি। ফলে এ ধর্ম সম্পর্কে আরও জানতে আগ্রহী হই এবং আরব দেশের অনেক আলেমের সঙ্গে কথা বলি ও শেষ পর্যন্ত ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করি।”

সাবেক খ্রীষ্টান পাদ্রি রিব রুট আরও বলেছেন,অন্য যে ঘটনা ইসলাম গ্রহণের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে তা হল জর্দানের একজন নাগরিকের দিক-নির্দেশন। ইসলামী বই-পুস্তকের ওপর তার ব্যাপক জ্ঞান ছিল। তিনি আমাকে সেইসব বই পড়তে উৎসাহ দেন। আধ্যাত্মিক রহস্যময় জ্ঞানের বই আমাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। এ সম্পর্কে আরও বেশি পড়াশুনা ও গবেষণা আমাকে এমন এক পর্যায়ে উপনীত করেছে যে এ পর্যায়ে আমি বিশেষ প্রশান্তি ও আধ্যাত্মিক আনন্দ অনুভব করছি। এই বিশেষ প্রশান্তি ও আনন্দ ভাষায় তুলে ধরা সম্ভব নয়। অথচ আমি বহু বছর ধরে এই প্রশান্তিরই সন্ধান করেছিলাম।”

মুসলমান হওয়ার কারণে নও-মুসলিম আহমদ আলীকে ছেড়ে চলে গেছেন তার অনেক সাবেক বন্ধু। কিন্তু এতে দমে যাননি তিনি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “আমি মুসলমান হওয়ার পর প্রথমেই তা প্রকাশ্যে সবাইকে জানাইনি। কারণ, আমার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা কি প্রতিক্রিয়া দেখান সে ব্যাপারে আমি উদ্বিগ্ন ছিলাম। কিন্তু পারিবারিক সমাবেশে বা বন্ধুদের সঙ্গে উৎসব অনুষ্ঠানে যখন ইসলামে নিষিদ্ধ খাদ্যগুলো পরিহার করতাম তখন আমার বাবা ও বন্ধুরা ঠাট্টা করে বলতেন: তুমি কি মুসলমান যে এসব খাচ্ছ না? আমি পরিপূর্ণ ধীর-স্থিরভাবে বলতাম, হ্যাঁ, আমি মুসলমান। আমি আমার ধর্মকে তাদের ওপর চাপিয়ে দিতাম না। বরং তাদেরকে ধীরে ধীরে এই পরিবেশ মেনে নেয়ার সুযোগ দেই। যদিও এটা মেনে নেয়া তাদের জন্য ছিল খুবই কঠিন।”

ফ্রান্সের এই শিল্পী ও গুণী ব্যক্তিত্ব এখন নিজের শিল্পকে ইসলামের সেবায় নিবেদিত করছেন। শিল্প পবিত্র কুরআনসহ ইসলামের সব শিক্ষা প্রচারের উপযুক্ত মাধ্যম। বিশেষ করে তিনি সঙ্গীত-শিল্পকে ইসলাম প্রচারে ব্যবহার করছেন। ইসলামের ছোঁয়া তার শিল্পকর্মকে করেছে গভীর অর্থপূর্ণ ও সুপরিসর। সঙ্গীত এখন তার হাতের ছোঁয়ায় কেবলই বিনোদনের বিষয় নয়। পবিত্র কুরআন ও ইসলাম আহমদ আলীর ওপর প্রভাব ফেলেছে বলেই এই অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হয়েছে।

সুত্র ইন্টারনেট 

Related Post