Main Menu
أكاديمية سبيلي Sabeeli Academy

আমি কেন ইসলাম গ্রহণ করলাম?

১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট; বৃটিশ সরকার কর্তৃক পাকিস্তান সৃষ্টির ঘোষণা বাণী প্রচারিত হলো।  যদিও বেশ কিছুকাল ধরে পাকিস্তান সৃষ্টি একরূপ অবধারিত বলে জানা গিয়েছিল, তথাপি ইংরেজ এবং অখণ্ড ভারতের দাবীদারদের ষড়যন্ত্র কারসাজি শেষ পর্যন্ত সব কিছুকে ভন্ডুল করে দিতে পারে, এমন একটা আশঙ্কা মুসলমানদের মন-মস্তিষ্ককে ভারাক্রান্ত করে রেখেছিল।

পাকিস্তান, মুসলমানদের দেশ

পূর্বে প্রকাশিতের পর

১৩ পর্ব

পাকিস্তানের জন্ম ঃ

১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট; বৃটিশ সরকার কর্তৃক পাকিস্তান সৃষ্টির ঘোষণা বাণী প্রচারিত হলো।  যদিও বেশ কিছুকাল ধরে পাকিস্তান সৃষ্টি একরূপ অবধারিত বলে জানা গিয়েছিল, তথাপি ইংরেজ এবং অখণ্ড ভারতের দাবীদারদের ষড়যন্ত্র কারসাজি শেষ পর্যন্ত সব কিছুকে ভন্ডুল করে দিতে পারে, এমন একটা আশঙ্কা মুসলমানদের মন-মস্তিষ্ককে ভারাক্রান্ত করে রেখেছিল।

এই ঘোষণার দ্বারা সেই আশঙ্কা দূরীভূত হলো এবং নতুন করে আর একবার প্রমাণিত হলো যে, শোচনীয়রূপে সংখ্যালঘু একটি জাতি সঙ্কল্পের দৃঢ়তা, ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন এবং ত্যাগ ও তীতিক্ষার বলে কি করে নিজেদের ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত অধিকারকে আদায় করে নিতে পারে।

এখানে উল্লেখ্য যে, ‘ধারণা প্রকাশক বিভাগ’ (National Division) অনুযায়ী মালদেহ জিলা পূর্ব পাকিস্তানের ভাগে পড়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটা টিকবে কিনা তা নিয়ে মুসলমানদের মনে কিবছুটা সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছিল।  বিত্তশালী হিন্দুগণ কর্তৃক গোপনে গোপনে বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ এবং অন্যান্য কার্যক্রম থেকে এই সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়ে উঠেছিল।

অন্ততঃ মালদহ জিলাকে হিন্দুস্তানের অঙ্গীভূত করার জন্যে এরা যে কোন পন্হা অবলম্বনে বদ্ধপরিকর, এমনকি প্রয়োজন হলে কোন ঘৃণ্য অবলম্বনেও এরা যে পিছপা হবে না, অনেকের কাজে এটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।

এই কারণে বৃটিশ সরকার কর্তৃক পাকিস্তান সৃষ্টির ঘোষণাকে মালদহের মুসলমানগণ বিশেষ ধৈর্য্য, সতর্কতা এবং গাম্ভীর্যের সহিত গ্রহণ করেছিলেন।  এ সম্পর্কে একটিমাত্র ঘটনার বিবরণই যথেষ্ট হবে বলে মনে করি।

ঘোষণানুযায়ী প্রত্যুষে সকল সরকারী এবং বে-সরকারী ভবনে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের কথা।  কিন্তু অধিকাংশ মুসলমানই এই কাজ থেকে নিজেদেরকে বিরত রেখেছিলেন।  তাঁদের যুক্তি এই ছিল যে, পতাকা উত্তোলন বড় কথা নয়।  কিন্তু শেষ পর্যন্ত আবার যদি সেই পতাকাকে নামিয়ে ফেলে সেখানে হিন্দুস্থানের পতাকা উত্তোলন করতে হয় তবে সেটা মুসলমানদের জন্য শুধু গভীর মর্মবেদনার কারণই হবে না নিদারুণভাবে অবমাননার কারণও হয়ে দাঁড়াবে।

এমন কি স্থানীয় কোর্ট বিল্ডিং এ পতাকা উত্তোলনের  সময়েও দেকা গিয়েছিল যে, জাতীয় পতাকা উত্তোলন করার মতো যে দু’একজন পদস্হ মুসলমান কর্মচারী ছিলেন, তাঁরা ওকাজে রাজি হলেন না, আর উচ্চপদস্হ হিন্দু কর্মচারীরাও নানা অজুহাতে অনুপস্থিত থাকলেন।  ফলে পাকিস্তান ইসলামী রাষ্ট্রের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের কাজটি সমাধা করলেন অফিসের ব্রাহ্মণ হেডক্লার্ক মহাশয়।

এ কথা খুলে বলার অপেক্ষা রাখে  না যে, স্থানীয় মুসলমানদের বেদনাক্লিষ্ট মন-মানব আমার মনের উপরেও যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল।  তাছাড়া মালদহে বহু দীনদার মুসলমান রয়েছে।  যাদের অনেকের সাথেই পরিচিতি হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।  সর্বোপরি বহু প্রসিদ্ধ অলী-আল্লাহর মাজার এবং মুসলমান আমলের ঐতিহ্য মন্ডিত বহু কীর্তি ও জিলার নানাস্থানে ছড়িয়ে রয়েছে।

এমন একটি জিলা পাকিস্তানের অঙ্গ বলে ঘোষিত হওয়ায় পরে আবার হিন্দুস্তানের অঙ্গীভূত হয়ে যাওয়ার আশংকা আমার মনকেও যে কম বেদনাক্লিষ্ট করেছিল না সে কথা অনুমেয়।

এদিক দিয়ে মন ভারাক্রান্ত থাকলেও অন্য দিকটির কথা মন জাগতেই আমার মনের মাঝে এক অনির্বচনীয় আনন্দের হিল্লোল বয়ে যেতো।  বলা বাহুল্য সেই অন্য দিকটা হলো পাকিস্তান লাভ।  অর্থাৎ বিশ্ববাসী বিশেষ করে হিন্দু সমাজের কাছে তুলে ধরার জন্যে ইসলামী আদর্শে এক অভিনব রাষ্ট্র গড়ে তোলার সুযোগ লাভ।

ইসলামী রাষ্ট্র গড়ার এই সুযোগদানের জন্যে করুণাময় বিশ্ব প্রভূর উদ্দেশ্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের প্রয়োজন তীব্রভাবে অনুভব করেছিলাম।  কিন্তু সেজন্যে প্রয়োজন একটি নির্জন ও নিরিবিলি স্থানের।

তাই অতি প্রত্যুষে নদীর পাড়ে গিয়েছিলাম।  ফিরে আসার সাথে কোর্ট সংলগ্ন খেলার মাঠটির প্রায় মাঝামাঝি স্থানে জনৈক হিন্দুর সাথে মুখোমুখি হতে হলো।

লোকটি আমার মাথার টুপির দিকে লক্ষ্য করত এমন জঘন্য একটি উক্তি করলো যে, আমি দুঃখ এবং বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়লাম।

পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পরেও একজন হিন্দুর কাছে এমন জঘন্য উক্তি শুনতে হবে সে কথা ভাবতেও মনটা বেদনায় টনটন করে উঠলো।  তার সেই উক্তিটি শুধু জঘন্যই ছিল না, প্রতিশোধ গ্রহণের একটা হুমকিও তার মধ্যে প্রচ্ছন্ন ছিল।  বহু চেষ্টা করেও সেই জঘন্য উক্তিটিকে শালীনতার খাতিরে আমি এখানে তুলে ধরতে পারলাম না।

খুব সম্ভব সুপরিকল্পিতভাবেই লোকটি এ কাজ করেছিল।  হয়তো সে ভেবেছিল যে, তার এই জঘন্য ও ভীষণভাবে অবমাননাকর উক্তিটি শুনে আমি উত্তেজিত হয়ে উঠবো এবং কঠোরভাবে প্রতিবাদ করে বসবো।  আমার এই উত্তেজনা এবং প্রতিবাদের সূত্র ধরে সে আমাকে আক্রমণ করে বসবে এবং এমন ভাবেই একটা হৈ-হল্লা শুরু করে দিবে যাতে শহরের গোটা হিন্দুসমাজ উত্তেজিত হয়ে একটি লঙ্কা কান্ড বাধিয়ে দেয়।  আর এতদ্বারা পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথেই মুসলমানেরা যে হিন্দুদের উপর জঘন্য ধরনের অত্যাচার-নির্যাতন শুরু করে দিয়েছে তার জাজ্বল্যমান প্রমাণ তারা খাড়া করতে পারবে।

কিন্তু সেই জঘন্য এবং অবমাননাকর উক্তি শুনেও আমি যখন কোন প্রতিবাদ বা উত্তেজনা প্রকাশ না করে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম, আর অন্যদিকে তিন চার জন্য পথচচারী মুসলমানকেও এদিকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল, তখন উক্ত হিন্দুটি অগত্যা রণে ভঙ্গ দিয়ে কঠোরভাবে আমার দিকে তাকালো এবং পাশ কাটিয়ে চলে গেলো।

ক্ষুন্ন, বেদনার্ত এবং অপমানাহত মন নিয়ে সম্মুখের দিকে এগিয়ে চললাম।  বারে বারে সেই জঘন্য উক্তিটি মনে পড়তে লাগলো।  পূর্বেই বলেছি প্রতিশোধ গ্রহণের একটা হুমকিও ঐ উক্তিটির মধ্যে প্রচ্ছন্ন ছিল।  চলতে চলতে এই প্রশ্নটাই আমার মনে জেগে উঠেছিলো যে, এই হুমকি দেয়ার মতো উৎসাহ এবং সাহস লোকটি পেল কোথা থেকে?

সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এবং সুপরিকল্পিতবাবে লোকটি একজা করেছিল বলে আমার এই ধারণা যে মিথ্যা ছিল না, পরবর্তী  সময়ের কতিপয় ঘটনা থেকে তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল।

উল্লেখিত যে, র‌্যাডক্লিফ রোয়েদাদ (Radeliffe award) ঘোষিত হওয়ার সাতে সাথে জানতে পারা গিয়েছিল যে, মালদহ জিলার পনেরটি থানার মধ্যে মালদহ টাউনসহ দশটি থানাকেই হিন্দুস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

এই অন্তর্ভুক্তির খবর আগে থেকেই হিন্দুদের জানা ছিল।  হয়তো এ কারণেই তাঁরা নিজেদের নিরাপত্তার নামে বেশ কিছু সংখ্যক সশস্ত্র ভাড়াটে গুন্ডাকে গোপনে গোপনে আমদানী করে রেখেছিলেন।

রোয়েদাদ ঘোষিত গওয়ার অব্যবহিত পরেই কোর্ট বিল্ডিং ও অন্যান্য স্থান থেকে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে সে সব স্থানে অশোকচক্র-খচিত হিন্দুস্তানী পতাকা উত্তোলনের আয়োজন করা হয়।

জনৈক ব্রাহ্মণ এস.ডি.ও কোর্ট বিল্ডিং এর উপরে উঠে পাকিস্তানের পতাকাটি নামিয়ে ছাদের উপরে রাখেন  এবং হিন্দুস্তানের পতাকাটি যথাস্থানে স্থাপন করেন।  সত্য মিথ্যা জানি না অবস্থা দৃষ্টে কতিপয় মুসলমানেরর মনে হয়েছিল যে, উক্ত এস.ডি.ও মহাশয় পাকিস্তানী পতাকাটির অবমাননা করেছেন, ফলে তারা এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করতে থাকেন।  এটাকে সুযোগ হিসাব গ্রহণ করতে আমদানীকৃত গুন্ডাবাহিনী তাদের অভিযান শুরু করে দেয়।

স্থানে স্থানে অগ্নিসংযোগ, মারপিট প্রভৃতি দ্বারা মুসলমানদের মনে ত্রাস ও অতঙ্ক সৃষ্টির প্রয়াস চলতে থাকে।  এমনটিতেই স্থানীয় মুসলমান মন মরা অবস্থায় কালাতিপাত করছিলেন।  তার উপরে এই গুন্ডামী তাঁদেরকে একেবরে দিশেহারা করে তুলেছিল।

আমি যে আবাসিক হোটেলটিতে অবস্থান করতাম তার পাশেই ছিল জনৈক রাষ্ট্র বাহাদুর বাবুর দ্বিতল অট্টালিকা।  অবস্থা আঁচ করতে পেরে ভীষণভাবে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম।  নও-মুসলিম হিসেবে যে কোন মুহূর্তে আমি তাদের প্রতিশোধের করুণ শিকারে পরিণত হতে পারি।  কাজেই ভেবে চিন্তে শেষ পর্যন্ত পাশের বাড়ীর রায় বাহাদুর বাবুর সাথে দেখা করতে গেলাম।  কালেক্টরেটের নূর মোহাম্মদ নামীয় জনৈক কেরাণীও আমার সাথে ছিলেন।

রায় বাহাদুর বাবুর সাথে আমি পরিচিত ছিলাম না।  তাঁর বাড়ীতে গেলাম।  তিনি বৈঠকখানায় একখানা আরাম কেদারায় অর্থশায়িত অবস্থায় খবরের কাগজ পড়ছিলেন।

আমি আমার পরিচয় দিলাম এবং আমার প্রতি একটু লক্ষ্য রাখার অনুরোধ জানালাম।  আমার কথা শুনে চোখে-মুখে বেশ কিছুটা গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তুলে তিনি

—————————–

*বোধগম্য কারণেই ঘটনাটির হুবহু চিত্র তুলে ধরা হলো না-লেখক

বললেন – ‘দেখুন পি.আর. ও সাহেব।  ছেলেপেলেদের রক্ত হলো গরম।  ওদের ব্যাপারে আমি কিছুটা করতে পারি না। ’

এ কথার উত্তরে আমি বলেছিলাম, কি পারবেন আর কি পারবেন না সেকথা আমি জানি না।  আপনি রায় বাহাদুর মানুষ বিরাট খ্যাতি আপনার রয়েছে।  শুধু এই কথাটুকু আমি আপনাকে জানাতে এসেছি।  যদি সম্ভব হয় একটু লক্ষ্য রাখবেন।

রায় বাহাদুর ঃ আপনার সাথের এই ছেলেটি কে?

আমিঃ কালেক্টরেটের জনৈক কেরানী।

রায় বাহাদুর ঃ দেখুন।  আপনি অফিসার মানুষ, আপনার কথা স্বতন্ত্র।  আপনার সম্পর্কে আমি ভেবে দেখবো কিন্তু কেরানী-ফেরানীকে নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় আমার নেই।

আমিঃ আপনি শুধু আমার দিকে লক্ষ্য রাখলেই চলবে।

রয় বাহাদুর ঃ দু’ এক দিনের মধ্যে আপনি অন্যত্র অর্থাৎ মুসলমান পাড়ায় সরে যাবেন।  কেননা , দু এক দিনের বেশী লক্ষ্য রাখা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।

রায় বাহাদুরকে আদাব জানিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম।  বুঝতে পারলাম রায় বাহাদুরের সাহায্য চাওয়া আমার ঠিক হয়নি।  কেননা, কেউ যদি আক্রমণ করতে আসবে তবে সে তা তারা রায় বাহাদুরকে জিজ্ঞাসা করে আসবে না।  সোজা এসে আক্রমণ করবে।  আর আক্রমণের কথা জানতে পেরে রায় বাহাদুর যদি একান্তই দয়া পরবচশ হয়ে কোন ব্যবস্থা অবলম্বন করেনও তাঁর এই ব্যবস্থা অবলম্বনের পূর্বেই যা ঘটবার তা ঘটে যাবে।

এই ভুলের জন্যে মনে মনে তওবা করলাম।  কেঁদে কেঁদে সেই অগতির গতি সর্বশক্তিমান আল্লাহার সাহায্য চাইলাম।  রাত্রির অন্ধকার ভেদ করে স্থানে স্থানে আগুনের শিখা দেখা যাচ্ছিল এবং আর্তচিৎকার কর্ণকুহরে আঘাত হানছিলো ।  কিন্তু ভয় আমার ছিল না।  যে কোন অবস্থার জন্যে প্রস্তুত হয়ে প্রহর গুণে গুণে সেই কালরাত্রি অতিবাহিত হয়ে গেল।

বোধগম্য কারণেই দায়িত্বশীল জিলা কর্তৃপক্ষ উত্তেজন প্রশমনে আগ্রহী ছিলেন।  দু-তিন দিনের মধ্যেই প্রায় প্রতিটি মুসলমান পল্লীতে কড়া প্রহরার ব্যবস্থা করা হলো; তৃতীয় দিনে সুযোগ বুঝে নিকটস্থ এক মুসলমান পল্লীতে গিয়ে উঠলাম।

অতীব দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে, অফিসে আমার হিন্দু সহকর্মীদের মধ্যে তিনজন ছিল অত্যন্ত হীনমন্য, কুচক্রী এবং ভীষণভাবে সাম্প্রদায়িক।  আমাকে জব্দ করার একটা ফন্দি যে তারা আঁটছিলো তাদের হাব-ভাব দেখে সেটা আমি বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছিলাম।

নও-মুসলিম হিসাবে আমার প্রতি তাদের একটা জাত-ক্রোধ তো ছিলই, তদুপরি অন্য একটা ঘটনাও ঘটে গিয়েছিল; সে ঘটনা হলোঃ

মালদহে প্রচার বিভাগের একটি সিনেমা (টকী) ইউনিট ছিল।  যেহেতু নেশন্যাল ডিভিমন হিসাবে মারদহ পূর্ব পাকিস্তানের অংশ বলে ঘোষিত হয়েছিল, সেই কারণে পাকিস্তানের মাল হিসাবে সিনেমা ইউনিটকে মালদহে প্রেরণ করা হয়েছিল।

কিন্তু র্যাডক্লিক রোয়েদাদ অনুসারে মালদহের দশটি থানা হিন্দুস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়।  গোটা জিলাটি হিন্দুস্তানের অন্তর্ভুক্ত হলেও যেহেতু সিনেমা ইউনিটটি পাকিস্তানের মাল হিসাবে ভাগ হয়েছে।  অতএব কোন অবস্থায়ই হিন্দুস্তান তা দাবী করতে পারে না।  আর যদি দাবী করেও পাকিস্তান পড়া পাঁচটি থানার অংশ হিসাবে হিন্দুস্তানের সরকারকে এ মালের ১/৩ অংশ বা তার মূল্য পাকিস্তানকে অবশ্যই দিতে হবে।  ইউনিটের মালগুলোর মূল্য ছিল অন্তত পক্ষে দুই লাখ টাকা।

মালগুলোকে পাকিস্তান সীমান্ত পার করে দেয়ার একটা অজুহাত আমরা খুঁছছিলাম।  র্যাডক্লিফ রোয়েদাদ ঘোষিত হওয়ার পরে যখন প্রবল উত্তেজনা এবং ‘জ্বালাও’ পোড়াও’ শুরু হয়ে গেল, ততখন এ পিকে জানানো হলো যে ‘নৌকা সিনেমা ইউনিটের মালপত্র ছাড়াও যথেষ্ট পেট্রোল রয়েছে।  গুন্ডা-পাণ্ডারা যে কোন মুহূর্তে আগুন ধরিয়ে দিতে পারে।  অতএব চব্বিশ ঘন্টার জন্যে পুলিশ প্রহরার ব্যবস্থা করা হোক।

আমরা জানতাম সারা টাউনে যখন উত্তেজনা চলছে তখন নৌকা পাহারার কাজে পুলিশ লাগানো সম্ভব হবে না।  তাই গোপনে নৌকাটিকে নওয়াবগঞ্জে পাঠিয়ে দেয়া হলো।  তথাকার থানায় মালপত্র উঠিয়ে রেখে মালের তালিকা একটি মালদহে অন্যটি ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়া হলো এবং জানিয়ে দেয়া হলো যে, নিরাপত্তার অভাব দেখা দেয়ায় অগত্যা এই ব্যবস্থা করা হয়েছে।  যদি এ ব্যাপারে ডি.পি.আর. ও জন আবু সাঈদ সাহেবই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন, কিন্তু তিনি তখন ছিলেন তাদের নাগালের বাইরে, অর্থাৎ ইতোপূর্বেই রাজশাহী চলে গিয়েছিলেন।

তবে কারণ যা-ই হোক এই মাল পাচারের পরামর্শটা যে আমিই দিয়েছিলাম,এমন একটা বিশ্বাস ওদের মনে বদ্ধমূল হয়ে উঠেছিল।

সুতরাং ওদের সমস্ত ক্রোধটাই তখন পড়েছিল আমার উপরে।  একেতো নও-মুসলিম হওয়ার অপরাধ, তার সাথে দুই লক্ষাধিক টাকার মাল-পত্র পাকিস্তানে পাচার করার অপরাধ মিলিত হওয়ায় ওদের মানসিক উত্তেজনা যে কোন পর্যায়ে উঠতে পারে সে কথা সহজেই অনুমেয়।

আমার নিকট অফিসের চার্জ বুঝে নিয়ে “লাষ্ট পে সার্টিফিকেট” ইস্যু করার জন্যে ইতোপূর্বে লিখিতভাবে আবেদন করেছিলাম।  কিন্তু তার কোন এ্যাকশন নেয়া হচ্ছিল না।

এটা যে বিরুদ্ধবাদীদের কারসাজিরই ফল সেকথা বুঝতে পারা যাচ্ছিল।  এই ষড়যন্ত্র ও টীকা-টিপ্পনীর খপ্পর থেকে চুটে গিয়ে পাকিস্তানের মুক্ত আবহাওয়ায় নিঃশ্বাস নেয়ার জন্যে মনটা অধীর হয়ে উঠেছিল।

অগত্যা জিলা ম্যাজিষ্টেট বাবুর সাথে দেখা করলাম এবং তাড়াতাড়ি আমার আবেদনটি মঞ্জুর করার অনুরোধ জানালাম।  জিলা ম্যাজিষ্টেট বাবু ছিলেন এক নামকরা আচার্য পরিবারের সন্তান।  খুব উদার ও অমায়িক বলে তাঁর খ্যাতির কথাও ইতোপূর্বে শুনেছিলাম।  তাই ভেবেছিলাম ভট্টচার্য পরিবারের সন্তান হয়েও আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি একথা জানা সত্ত্বেও তিনি আমার প্রতি সুবিচার করবেন।

দুঃখের বিষয়-আমাকে অতি নিদারুণভাবে হতাশ হতে হয়েছিল।  আচার্য বাবু গম্ভীরভাবে বলেছিলেন- ‘আপনার বিরুদ্ধে অনেকগুলো কনফিডেন্সিয়াল রিপোর্ট রয়েছে; তাই আপনাকে খুব তাড়াতাড়ি রিলিপ করা সম্ভব হবে না।  সময় পেলে আমি রিপোর্টে উল্লেখিত অভিযোগগুলো তদন্ত করে দেখবো।  তার পরেই রিলিজ করার প্রশ্ন উঠতে পারে’।

তাঁর কথার উত্তরে এই বলে সেদিন আমি বিদায় নিয়েছিলাম যে, আমার বিরুদ্ধে কি কি অভিযোগ রয়েছে এবং কে বা কারা তা করেছে সে কথা আমি জানি না।  তবে আমি একথা জানি যে,ওসব মিথ্যা এবং আমাকে বিপদে ফেলা ও জব্দ করার উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে।  নিরপেক্ষ মন নিয়ে তদন্ত করলে এ মিথ্যা অবশ্যই আপনার কাছে ধরা পড়বে।  অতএব আমার অনুরোধ,আপনি দয়া করে যত শীঘ্র সম্ভব এটা তদন্ত করার ব্যবস্থা করুন।

অত্যন্ত ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আচার্য বাবুর অফিস থেকে বের হয়ে বাইরে এলাম।  মাথায় চিন্তার পাহাড়।  কোথায় যাবো, কি করবো, আমার বিরুদ্ধে কি অভিযোগ, কি তার পরিণাম? এমনি ধরনের নানা প্রশ্ন, মাথাটা যেন গুলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো।

ভাবলাম, সবকিছু ভাল করে ভেবে দেখা দরকার।  নিরিবিলি স্থান হিসাবে মসজিদের দিকে পা বাড়ালাম।  লক্ষ্য করলাম, কেরানী নূর মোহাম্মদ কিছুটা দূরে থেকে এবং সতর্কতা সহকারে আমাকে অনুসরণ করছে।

মসজিদের একটি নিরিবিলি স্থান বেছে নিয়ে বাইরের দিকে লক্ষ্য করলাম।  দেখলাম নূর মোহাম্মদ বসে ওজু করছে এবং বারে বারে পথের দিকে লক্ষ্য করছে।  ওজু শেষে ও একবার ভাল করে দিক ওদিক দেখে মসজিদে এসে আমার পাশে বসলো এবং ভয় ও বেদনা জড়িত কন্ঠে অনুচ্চ স্বরে বললো পি.আর.ও সাহেব! আপনার বিরুদ্ধে একটু আগেই ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়েছে।  একবার ধরা পড়লো জীবনেও আর ছাড়া পাবেন কিনা সন্দেহ।

অশ্রুসজল চোখে ও আমার পা-ছুঁয়ে সালাম করলো এবং বললো- ‘আপনাকে পীরের মতো দেখেছি।  বিপদের দিনে এক সাথে রয়েছি।  হয়তো জীবনে আর দেখা হবে না।  আমার বাড়ী হিন্দুস্তানে পড়েছে।  সারাজীবন এবং বংশ পরস্পরায় আমাকে হিন্দুস্তানের গোলামী করতে হবে।  আপনি ভাগ্যবান, ‘পাকিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তুলবেন। ’ হিন্দুদের কাছে মুসলমানদের সত্যিকারের পরিচয়কে তুলে ধরবেন ‘আল্লাহ আপনার এই স্বপ্নকে সফল করুন, সারা জীবন এই দোআ করবো কিন্তু আপনার পা- এ ধরে বলছি আর একটি মুহূর্তও দেরী করবেন না।  গা ঢাকা দিয়ে যেমন করে পারেন পাকিস্তানে চলে যান। ’

এই বলে আমার বিপদের দিনের সাথে কেরানী নূর মোহাম্মদ (রায় বাহাদুর বাবু সেদিন যাকে কেরানী -ফেরানী বলে অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছিলেন। ) আবার আমার পা ছুঁয়ে সালাম করলো এবং উঠে দাঁড়ালো।  উৎকন্ঠার সাথে শেষবারের মতো বলে উঠলো ‘দোহাই আল্লাহর, আপন আর বসে থাকবে না ।  পুলিশ সক্রিয় হওয়ার আগেই যেন টাউন ছেড়ে যেতে পারেন’ এই বলে দ্রুত বেরিয়ে গেল।  পথে উঠার আগে আর একবার আমার দিকে ফিরে তাকালো, হাত দিয়ে ইশারা করলো- যার অর্থ ‘শীঘ্রই বেরিয়ে পড়ুন। ’

উঠে দাঁড়ালাম।  বিছানা-পত্র বাক্স-পেটরা সবই হোটেলে রয়েছে।  ওগুলো সাথে নিলে অর্থাৎ ধরা পড়তে হবে। ’ গড়ি দেখলাম।  ছুটে গেলে তখনো ট্রেনটা পাওয়া যেতে পারে।  টাকা পয়সাও রয়েছে হোটেলের বাক্সে।  পকেটের পয়সা হিসাব করে কিছুটা আশ্বস্ত হলাম। আল্লাহর মর্জি রাজশাহী পৌছবার মতো সম্বল রয়েছে।

কিছুটা গা ঢাকা দেয়ার জন্যে মাথার টুপিটা পকেটে নিলাম।  রুমালটাকে এমন করে মাথায় দিলাম যাতে মুখের কিচুটা অংশ ঢাকা পড়ে যায়।  পাজামাটা গ্রাম্য চাষী মানুষদের কায়দায় উঁচু করে নিলাম।  উর্ধ্বশ্বাসে যখন ষ্টেশনে গিয়ে পৌঁছেছি ঠিক তখন ট্রেনটা ছেড়ে দিয়েছে।  লাফ দিয়ে ট্রেনে উঠেই পায়খানায় ঢুকে দরওযাজা বন্ধ করে দিলাম।  ভয়, উত্তেজনা আর পরিশ্রমে থরথর করে শরীরটা কাঁপছিলো।  মনে হলো, অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবো।  তাড়াতাড়ি বসে পড়লাম।  কল খুলে অনেকক্ষণ ধরে মাথায় পানি দিতে লাগলাম।

এমনিভবে চারটি কি পাঁচটি ষ্টেশন পার হয়ে যাওয়ার পরে বাইরে এলাম।  যাত্রীদের হতাভাব লক্ষ্য করলাম।  বুঝলাম, ভয়ের কিছু নেই।  তবু সাবধানতার জন্যে বাঙ্কের উপর উঠে বিপরীত দিকে মুখ করে শুয়ে রইলাম।

হোটেলের কামরায় পড়ে থাকা মালপত্রগুলোর চেহার মাঝে মাঝে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতো।  মনের মাঝে তীব্র একটা বেদনা অনুভব করলতাম।  তখন মনটাকে এই বলে বুঝ দিতাম, জীবন ও সম্মানের চেয়ে মালপত্রের মূল্য বেশী নয়- তার পরিমাণ যত বেশীই হোক।  পাকিস্তানের জন্যে বড় বড় বিত্তশালী হাজার হাজার মানুষকে পথের ভিখারী হতে হয়েছে।  সে তুলনায় আমার মালপত্রের কথাটা মনে করাই অন্যায়।  মসালের লোভে পড়ে থাকলে নির্ঘাৎ ধরা পড়তে হতো, আর ওরা মনের সাধ মিটিয়ে আমার ইসলাম গ্রহণের প্রতিশোধ গ্রহণ করতো- অবস্থাটা চিন্তা করতেই গা’টা আমার শিউরে উঠতো।

ট্রেনটা পাকিস্তানের সীমানায় প্রবেশ করতেই আমার মনা যে কিভাবে উদ্বেল হয়ে উঠেছিল, আজ এতদিন পরে ভাষার সাহায্যে সে কথা বুঝানোর সাধ্য আমার নেই।  আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাথাটা একেবারে নুইয়ে পড়েছিল।  আর মনে মনে বলেছিলাম ঃ

‘এই আমার স্বপ্নের দেশ পাকিস্তান।  এই পাকিস্তানের কথা বলার জন্যে আমার গলাটিপে ধরা হয়েছিল, বক্তৃতার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারী করতঃ আমার কন্ঠরোধ করা হয়েছিল।  এই পাকিস্তানের মমতায়ই আমার যথা-সর্বস্ব হোটেলের কামরায় ফেলে রেখে আমি আসতে পেরেছি। ’

এই দেশকে একটি আদর্শ ইসলামী রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলার কাজে অংশ গ্রহণ করতে গিয়ে আমি আমার জীবেনর সকল সাধনা, সকল শ্রম এবং সকল উদ্যমকে ঢেলে দিব।

একে ইসলামী রাষ্ট্ররূপে গড়ে তোলার কাজ কিছুটা এগিয়ে যেতেই যেমন করেই হোক ছুটে গিয়ে অন্তত আমার স্নেহশীল জননীকে নিয়ে আসবো এবং বলবো ‘আসল মুসলমান বলতে কি বুঝায় তা চোখ বরে দেখে নাও এবং তোমার বিবেককে জিজ্ঞেস কর তোমার ছেলে ইসলাম গ্রহণ করে ভাল কাজ করেছে কিনা। ’

১ম পর্ব    ২য় পর্ব য় পর্ব  ৪র্থ পর্ব ৫ম পর্ব ৬ষ্ঠ পর্ব ৭ম পর্ব   ৮ম পর্ব  ৯ম পর্ব ১০ম পর্ব  ১১ পর্ব ১২তম পর্ব

Related Post