আল-কুরআনের সম্মানজনক নাম

কুরআনুল হাকীম

কুরআনুল আযীম

আমরা মহান আল্লাহকে শুধু ‘আল্লাহ’ বলি না। আল্লাহর সাথে সম্মানসূচক কিছু শব্দ যোগ করে বলি। যেমন  আল্লাহু আকবার, আল্লাহ পাক, আল্লাহ তায়ালা, আল্লাহ সুবহান, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইত্যাদি। তেমনিভাবে মহান মুনিবের সুমহান বাণী আল-কুরআনকেও সম্মানসূচক শব্দে ভূষিত করা আমাদের উচিৎ। কুরআনের সাথে কেউ লাগান শরিফ,কেউ বা হাকিম আবার কেউ মাজিদ। বাংলাদেশের বেশির ভাগ ছাপাখানায় ‘শরিফ’ শব্দটিই ছাপা হচ্ছে। তাই বাংলাভাষী মুসলমানেরা ‘শরিফ’ বলায় অভ্যস্ত। অথচ আরব বিশ্ব থেকে আসা সব কুরআনে দেখেছি কুরআন মাজিদ, কুরআন হাকিম বা কুরআন কারিম লেখা রয়েছে। শব্দ প্রয়োগের এই ভিন্নতা থেকেই আমার মনে নানা রহস্য দানা বাঁধে। আসলে কোনটা সঠিক? আমাদের জীবন পরিচালনার একমাত্র গাইড বুক হলো আল কুরআন। এতে রয়েছে মানবজীবনের সব সমস্যার সামাধান। তাই আল্লাহ-প্রদত্ত আল-কুরআনের সম্মানজনক উপাধি কী? এ প্রশ্নটি নিয়ে যুক্তিতর্কে না গিয়ে সরাসরি সাহেবে কুরআন তথা মহান আল্লাহ তায়ালার বাণী থেকে জেনে নিলেই সর্বোৎকৃষ্ট সমাধান পাওয়া যাবে। পবিত্র কুরআনের সূরা মায়েদার ১৫ নম্বর আয়াতে এসেছে

,قَدْ جَاءَكُم مِّنَ اللَّهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُّبِينٌ * المائدة  15

অর্থাৎ ‘তোমাদের কাছে একটি উজ্জ্বল জ্যোতি এবং একটি সমুজ্জ্বল গ্রন্থ এসেছে।’ এখানে কুরআনের উপাধি বর্ণিত হয়েছে ‘মুবিন’।এর আভিধানিক অর্থ হলো সুস্পষ্ট, সমুজ্জ্বল,প্রকাশকারী,ব্যাখ্যাকারী ইত্যাদি। এ আয়াতের অনুসরণে ‘কুরআন মুবিন’ বলা যেতে পারে।সূরা আনআমের ১৫৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন,

﴿وَهَٰذَا كِتَابٌ أَنزَلْنَاهُ مُبَارَكٌ فَاتَّبِعُوهُ وَاتَّقُوا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ﴾

অর্থাৎ ‘এটি এমন একখানা গ্রন্থ, যা আমি অবতীর্ণ করেছি খুব মঙ্গলময়। কাজেই তোমরা এর অনুসরণ করো এবং তাকওয়ার নীতি অবলম্বন করো, হয়তো তোমাদের প্রতি রহম করা হবে৷’ বর্ণিত আয়াতাংশে আল্লাহ কুরআনকে ‘মুবারাক’ উপাধি দিয়েছেন। যার আভিধানিক অর্থ হলো মঙ্গলময়, কল্যাণময়, বরকতপূর্ণ ইত্যাদি। এভাবে আমরা বলতে পারি ‘কুরআন মুবারক’ বা ‘মুবারক আল কুরআন’।  সূরা হিজরের ৮৭ নম্বর আয়াতে এরশাদ হয়েছে,

الْمَثَانِي وَالْقُرْآنَ الْعَظِيمَ﴾    ﴿وَلَقَدْ آتَيْنَاكَ سَبْعًا مِّنَ

 অর্থাৎ আমি তোমাকে এমন সাতটি আয়াত দিয়ে রেখেছি,যা বারবার আবৃত্তি করার মতো এবং তোমাকে দান করেছি মহান কুরআন৷এখানেও কুরআনের আরেকটি উপাধি বর্ণিত হয়েছে ‘আজিম’। এর অর্থ মহান,বড়।

কুরআনকে তাই কুরআন আজিমও বলা যায়। সূরা ইয়াসিনের প্রথম আয়াতে তিনি বলেন, ‘ইয়াসিন, ওয়াল কুরআনিল হাকিম’ অর্থাৎ ইয়াসিন, প্রজ্ঞাময় কুরআনের শপথ।’ এ আয়াতে আল্লাহ কুরআনকে ‘হাকিম’ উপাধি দিয়েছেন। এর আভিধানিক অর্থ হলো  বিজ্ঞানময়, প্রজ্ঞাময়, প্রাজ্ঞ, তত্ত্বজ্ঞানী, শাসক ইত্যাদি। তাই আমরা বলতে পারি ‘কুরআন হাকিম’।
সূরা ওয়াকিয়ার ৭৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন, (إِنَّهُ لَقُرْآنٌ كَرِيمٌ)’ অর্থাৎ নিশ্চয়ই এটা সম্মানিত কুরআন।’ অত্র আয়াতে আল্লাহ তার কালামকে ‘কারিম’ উপাধিতে ভূষিত করেছেন। আভিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর অর্থ হলো  সম্মানিত, মর্যাদাবান, উত্তম, ভালো, উৎকৃষ্ট, মূল্যবান ইত্যাদি। মহান আল্লাহর পছন্দনীয় শব্দে আমরা বলতে পারি ‘কুরআন কারিম’।

সূরা বুরুজের ২১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,        بَلْ هُوَ’قُرْآنٌ مَّجِيدٌ  অর্থাৎ ‘বরং এটা মহান মর্যাদাপূর্ণ কুরআন।’ এখানে আল্লাহ কুরআনের উপাধি নির্ধারণ করেছেন ‘মাজিদ’। আর ‘মাজিদ’ শব্দের অর্থ হলো  মর্যাদাপূর্ণ, ইজ্জত, সম্মান, গৌরব, মহত্ত্ব, আভিজাত্য ইত্যাদি। অনুরূপভাবে আমরাও বলতে পারি ‘কুরআন মাজিদ’।
কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, ভারতীয় উপমহাদেশে পবিত্র কুরআনের সাথে ‘শরিফ’ শব্দটি যোগ করে যেভাবে সম্মান দেখানো হয়, কুরআন নাজিলের দেশসহ অপরাপর মুসলিম দেশগুলোয় এমনটি লক্ষ করা যায় না। ‘শরিফ’ শব্দটি সিফাতে মুশাব্বাহ অর্থাৎ স্থায়ী গুণবাচক শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হলো ভদ্র, পূত-পবিত্র, সম্মানজনক ইত্যাদি। যেকোনো বস্তুকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সম্মানিত করতেই মূলত ‘শরিফ’ শব্দটির ব্যবহার লক্ষণীয়। যেমন হাদিস শরিফ, কাবা শরিফ, মক্কা শরিফ, রওজা শরিফ, মদিনা শরিফ, আকসা শরিফ ইত্যাদি। ইদানীং আরো কিছু নতুন বস্তুতে এর ব্যবহার আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। যেমন  গঞ্জিকা শরিফ, গোসল শরিফ, পাদুকা শরিফ, মাজার শরিফ, ওরস শরিফ ইত্যাদি।

এসব আপত্তিকর শব্দ মাজারপন্থী কিছু বেদাতির দ্বারাই এ দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। শরিয়ার সাথে যার দূরতম সম্পর্কও নেই। অথচ এসব বিষয়ে ‘শরিফ’ শব্দটি সংযোজন করায় সাধারণ জনগণ মনে করেন,এর সাথে ইসলাম ধর্মের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। পাশাপাশি ধর্ম ব্যবসায়ীরা আয়োজন করছেন ফায়দা লোটার মহোৎসোব। ফলে ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে মানুষ যেমন বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি আমালিয়াত হয়ে যাচ্ছে ত্রুটিপূর্ণ। তাই এখনই আমাদের এসব শব্দ ব্যবহারে সাবধানী হতে হবে। আর যেহেতু ‘শরিফ’ শব্দটি একটি বিশেষ গোষ্ঠী একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে, সেহেতু মহাপবিত্র গ্রন্থ আল কুরআনের ক্ষেত্রে তা থেকে নিরাপদ দূরত্বে আমাদের সরে দাঁড়ানোই যৌক্তিক। হয়তো আরবি জানা অনেকেই বলবেন, ‘শরিফ’ শব্দটি তো মাজিদ, কারিম, আজিমেরই আরেকটি আরবি প্রতিশব্দ। তবু আমরা জানি এই শব্দটি কুরআনের উপাধি হিসেবে মহান আল্লাহ পাক আল কুরআনের কোনো স্থানে কখনো উল্লেখ করেননি। তাই বলি, আল্লাহর কালাম কুরআনকে আল্লাহর দেয়া উপাধিতে মর্যাদাবান করাই কি বান্দার উচিত নয়? আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা আমাদেরকে কুরআনুল কারিমের সঠিক সম্মন দান করার তৌফিক দান করুক । আমিন

 

Related Post