রমযান মাসের সিয়াম সাধনা তাকওয়া অর্জনই প্রধান উদ্দেশ্য

আত্মশুদ্ধি

রমযান মাসের সিয়াম সাধনা তাকওয়া অর্জনই প্রধান উদ্দেশ্য

মহান রাব্বুল আলামিন তার বান্দাদের জন্য অত্যন্ত ক্ষমাশীল, দয়ালু এবং মেহেরবান। এ জন্য তার বান্দাদের সার্বিক মুক্তি ও কল্যাণের বিবেচনায় রহমতের ছায়াতলে আশ্রয় দেয়ার মানসে বান্দাদের জন্য অনেক সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন, যার অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে রমযান মাসে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন। আত্মিক এবং শারীরিক উন্নতি সাধনের এক অনন্য প্রশিক্ষণ হচ্ছে সিয়াম। মানবদেহে জড় উপাদানে সৃষ্টি, এর চাহিদাও অনেক বিচিত্র এবং ব্যাপকতর। পাওয়ার এবং ভোগের নেশা সর্বক্ষণ মানুষের আত্মিক অনুভূতিগুলোকে বিপর্যস্ত করে রাখে। অনুভূতিহীন করে দেয় আত্মাকে। ফলে উন্নততর মানবিক গুণগুলো অসার হয়ে পড়ে। মনুষ্যত্ব এবং মানবিকতার এ স্বভাবজাত ধ্বংসকে মোকাবেলা করে বিবেক এবং আধ্যাত্মিকতার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেই রমযান মাসের সিয়াম সাধনাকে অপরিহার্য করা হয়েছে। যেটি ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ এবং অত্যাবশ্যকীয় ফরজ ইবাদত।

রোযার ইতিহাস

রোযা ফারসি শব্দ। কুরআনের পরিভাষায় একে সাওম বলা হয়। আরবি ‘রমজ’ শব্দ থেকে রোযা বা রমজ শব্দটি উৎপন্ন যার অর্থ হচ্ছে জ্বালিয়ে দেয়া, দহন করা। আর সাওম শব্দের অর্থ হচ্ছে সংযম, নিবৃত্ত থাকা, বিরত থাকা, ইংরেজি ভাষায় যাকে fasting, যার অর্থ উপবাস থাকা।

ব্যাপকভাবে শরিয়তের পরিভাষায় মহান রবের সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে পূর্ণ নিয়তসহকারে সুবেহ সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও যৌন মিলন থেকে বিরত থাকার নাম সাওম বা রোযা।
সিয়াম ফরজ হয়েছে হিজরতের দ্বিতীয় বছরে। মক্কার বৈরী পরিবেশ থেকে সরে এসে শঙ্কামুক্ত এবং অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল অবস্থা যখন বিরাজ করছিল তখন সূরা বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতের মাধ্যমে রোযার বিধান নাজিল করা হয়, যেখানে আল্লাহ ঈমানদারদের ডেকে বলেন,

হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর সিয়াম ফরজ করা হয়েছে, যেমনিভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যেন তোমরা তাকাওয়া অর্জন করতে পার। এখানে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন দু’টি বিষয় বান্দাদের সামনে স্পষ্ট করেছেন- তার একটি হলো সিয়াম সাধনা শুধু রাসূলের (সা) উম্মতের ওপর নয়, বরং পূর্ববর্তী নবী-রাসূলদের উম্মতের ওপরও এই বিধান ছিল। দ্বিতীয়টি হলো এই সিয়াম সাধনার মূল উদ্দেশ্য হলো তাকওয়া অর্জন করা।

ইতিহাস থেকেও জানা যায়, বিভিন্ন নবী এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও রোযা পালন করতেন। যেমন ইহুদিরা প্রতি সপ্তাহে শনিবার এবং মহররম মাসের ১০ তারিখ রোযা পালন করতো। মূসা (আ)-কে ৪০ দিন রোযা পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। খ্রিষ্টানরা ৫০ দিন রোযা পালন করতেন। হযরত আদম (আ) থেকে হযরত নূহ (আ) পর্যন্ত চন্দ্র মাস হিসেবে ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ রোযা রাখতেন যাকে বলা হতো ‘আইয়্যামে বিজ’। তা ছাড়া হিন্দুদের মধ্যেও এক শ্রেণীর হিন্দুরা একাদশী উপবাস পালন করে থাকেন।

মাস হিসেবে রমযানের গুরুত্ব: ক্যালেন্ডারের পাতার হিসাবে প্রত্যেক মাসই সমান কিন্তু এর মধ্যেও কিছু ঘটনা বা উপলক্ষকে কেন্দ্র করে কোনো মাস বা দিন অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। বছর ঘুরে যখন সেই মাস বা দিনগুলো আসে মানুষ তখন সেই দিনগুলোকে তাদের আবেগ-অনুভূতি, কর্মপ্রেরণা বা সাহস, শৌর্য-বীর্যের উৎস হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করে। ঠিক একইভাবে রমযান মাস সমগ্র মুসলিম মিল্লাতের জন্য একটি তাৎপর্যপূর্ণ মাস হিসেবে বিবেচিত। যেটি স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সূরা বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে এইভাবে উল্লেখ করেছেন: ‘‘রমযান মাস, এ মাসে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মানবজাতির জন্য পথনির্দেশিকা, সুস্পষ্ট নির্দেশনা ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী।”
সুতরাং রমযান মাসের গুরুত্ব দুনিয়ার কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা বা উপলক্ষকে কেন্দ্র করে গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং রাসূল (সা)-এর মাধ্যমে কিয়ামত পর্যন্ত অনাগত মানুষের হিদায়াতের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যে আসমানি গ্রন্থ নাজিল করেছেন সেই মহাগ্রন্থ আল কুরআনের কারণে এই মাসটি মর্যাদাপূর্ণ। অর্থাৎ কুরআনের সম্মান এবং মর্যাদাই রমযান মাসকে তাৎপর্যপূর্ণ করেছে।

কুরআনকে যেমন রমযান মাসে নাজিল করা হয়েছে অন্য আসমানি কিতাবও রমযান মাসে নাজিল হয়, যেমন হযরত মূসা (আ)-এর ওপর তাওরাত নাজিল হয়েছে ৬ রমযানে। হযরত দাউদ (আ)-এর ওপর যাবুর নাজিল হয়েছে ১২ রমযান, হযরত ঈসা (আ)-এর ওপর ইঞ্জিল নাজিল হয়েছে ১৩ রমযান, হযরত ইব্রাহিম (আ)-এর ওপর সহিফা নাজিল হয়েছে রমযানের প্রথম রাত। সর্বশেষ রাসূল (সা)-এর ওপর মহাগ্রন্থ আল কুরআন নাজিল হয় ২৭ রমযান।

রমযানের তাৎপর্য: রমযান আমল করার মাস, এর প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের বিশেষ অনুগ্রহ লাভের বিরাট সুযোগ। রমযান মাসে বান্দাহ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছ থেকে অনেক নৈকট্য অর্জন করতে পারেন। হযরত সালমান ফারসি (রা) বর্ণিত একটি হাদিসে বলা হয়েছে, রমযান মাসে প্রতিটি নফল ইবাদতের সওয়াব অন্য মাসের প্রতিটি ফরজ আদায়ের সমান হয়ে যায়। আর প্রতিটি ফরজ ইবাদাতের সওয়াব সত্তর গুণ বাড়িয়ে দেয়া হয়। (মেশকাত শরীফ)

হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে এবং সওয়াবের বিশ্বাসে রমযানের রোযা রাখে তার পূর্ববর্তী সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। আর যে ব্যক্তি রমযানের রাত্রি জাগরণ করে ইবাদাতে লিপ্ত থাকে তারও পূর্ববর্তী সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি শবেকদরের রাতে ঈমান ও একিন সহকারে ইবাদাত করে তারও সকল গুনাহ আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। (বুখারী ও মুসলিম)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) বর্ণনা করেন, রাসূল (সা) এরশাদ করেন, রোযা এবং কুরআন আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে। রোযা বলবে হে আল্লাহ! এ ব্যক্তিকে আমি দিনের বেলায় খাদ্য-পানীয় এবং অন্য সকল প্রকার ভোগ সম্ভোগ থেকে সরিয়ে রেখেছি। সুতরাং তার জন্য আমার সুপারিশ কবুল করুন। কুরআন বলবে, এ ব্যক্তিকে আমি রাতের বেলায় নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছি। সুতরাং তার জন্য আমার সুপারিশ কবুল করুন। আল্লাহ উভয়ের সুপারিশ কবুল করবেন। (বায়হাকী)

রোযা একটি ধৈর্যের প্রশিক্ষণ, ব্যক্তিজীবন গঠন, সমাজের উন্নয়নে, মানবতার সেবা, দ্বীনী দায়িত্ব পালনে পাহাড়সম বাধা মোকাবেলার জন্য প্রয়োজন অপরিসীম ধৈর্য, সেই জন্য রাসূল (সা) এ মাসকে ধৈর্যের মাস হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এটা সবরের মাস আর সবরের বিনিময় হচ্ছে জান্নাত।’ অন্য একটি হাদিসে বলা হয়েছে, হযরত আবু হুরাইরা (রা) বর্ণনা করেছেন : কেবল আহারাদি থেকে বিরত থাকার নাম রোযা নয়। অশ্লীল কথাবর্তা ও অশালিন আলোচনা থেকে দূরে থাকাই আসল রোযা। অতএব হে রোযাদার! যদি কেউ তোমাকে গালি দেয় বা তোমার সাথে অভদ্রতা করে তাহলে তাকে বলো: আমি রোযাদার। (ইবনে খোযায়মা ও ইবনে হিক্বাম)

সুতরাং রোযার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা পাশবিকতাকে দমন এবং নৈতিক উৎকর্ষ সাধনের সুন্দর ব্যবস্থা বিদ্যমান।

আজকে অশান্ত পৃথিবীর সর্বত্র খুন, রাহাজানি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, জুলুম-নির্যাতন, অশ্লীলতা বেহায়াপনায় সব কিছই মানুষের পশুপ্রবৃত্তির পরিণাম। বিশ্বব্যাপী অস্ত্রের প্রতিযোগিতা, দলিত-মথিত মানবতা, মজলুমের ফরিয়াদে ভারাক্রান্ত আকাশ-বাতাস। পারমাণবিক বোমার তেজস্ক্রিয়তায় বিকলাঙ্গ এবং পঙ্গু মানব সভ্যতা। অথচ আল্লাহতায়ালা পৃথিবীকে বাসের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আর রোযার আত্ম সংযমের প্রশিক্ষণই পারে মানুষের সেই পাশবিকতাকে দমন করতে।

রোযার পুরস্কার সম্পর্কে আল্লাহ নিজেই বলেছেন, ‘‘রোযা আমার জন্য আর এর পুরস্কার আমি দেবো।”

তাকওয়া অর্জনই প্রধান উদ্দেশ্য:সিয়াম ছাড়া অন্য ইবাদাত তাকওয়া সৃষ্টিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না।

তাকওয়া কী? তাকওয়া অর্থ হচ্ছে বাঁচা, আত্মরক্ষা করা, নিষ্কৃতি লাভ করা। অর্থাৎ আল্লাহর ভয় ও তার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যাবতীয় অপরাধ, অন্যায় ও আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজ, কথা ও চিন্তা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার নাম তাকওয়া।
একবার হযরত উবাই ইবনে কাব (রা)-কে ওমর (রা) তাকওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেন, হে ওমর (রা)! পাহাড়ের দুই ধারে কাঁটাবন, মাঝখানে সরু পথ। এমতাবস্থায় কিভাবে চলতে হবে? তিনি বলেন, গায়ে যেন কাঁটা না লাগে, সাবধানে পথ অতিক্রম করতে হবে। হযরত উবাই ইবনে কাব (রা) বললেন, এটাই তাকাওয়া। সুতরাং আজকের এই পাপ পঙ্কিলতাপৃর্ণ পৃথিবী, যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে পাপাচার, অনাচার, শিরক, কুফর, বিদায়াত যেখানে অক্টোপাসের মত ছড়িয়ে আছে, দুর্নীতি, ঘুষ আর সুদের কাঁটা থেকে একজন মুমিনকে আত্মরক্ষা করে সাবধানে জীবনের পথ অতিক্রম করতে হবে। তাকওয়াই হচ্ছে যাবতীয় কল্যাণের মূল উৎস।

তাকওয়ার সাথে রয়েছে মর্যাদা। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে সাদা-কালো ধনী-দরিদ্র আরব-অনারব প্রাচ্য-পাশ্চাত্য এর ভিত্তিতে মর্যাদার মূল্যায়ন হবে না। বরং মূল্যায়নের ভিত্তি কী হবে তা তিনি নিজেই বলেছেন “নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে যারা তাকওয়ার অধিকারী তারাই আল্লাহর নিকট অধিক সম্মানিত।” (সূরা হুজুরাত : ১৩)

তাকওয়াই হচ্ছে জান্নাত লাভের অপরিহার্য শর্ত। কুরআনে যেখানে জান্নাতের আলোচনা করা হয়েছে, সেখানে তাকওয়ার উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা মরিয়ামে আল্লাহ বলেন, “সে জান্নাতের উত্তরাধিকারী আমি অবশ্য তাদেরকে বানাব, আমার বান্দাদের মধ্যে যারা তাকওয়ার অধিকারী।” (সূরা মরিয়াম ৬৩)

তাই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাকওয়ার গুণসম্পন্ন মুক্তাকি সৃষ্টির জন্য রমযান মাসের সিয়াম সাধনা অপরিহার্য করেছেন। অন্য কোন ইবাদাতে এই গুণ অর্জন সম্ভব নয়, যেভাবে সিয়ামের মধ্যে সম্ভব। প্রত্যেক ইবাদাতে লৌকিকতা তথা প্রদর্শনের সুযোগ রয়েছে। মানবিক দুর্বলতায় কারো মধ্যে হয়তো বা এমন প্রবণতা সৃষ্টি হতেও পারে। কিন্তু সিয়াম এমন হক ইবাদাত কেবলমাত্র আল্লাহর ভয় না থাকলে, আত্মশুদ্ধির চরম ইচ্ছা না থাকলে তা পালন সম্ভব নয়। রোযা রাখলাম কী রাখলাম না, এটি আল্লাহ ছাড়া কারো বোঝার কোনো উপায় নেই। ইসলামের মৌলিক ইবাদাতগুলোর মধ্যে যেমন নামাজের মাধ্যমে মানুষকে দেখানোর সুযোগ রয়েছে, জাকাতের মাধ্যমে মানুষ দেখতে পায়, অন্তত যাকে জাকাত দেয়া হল সে তো জানতে পারে।

হজ পালনে মানুষ বুঝতে পারে। কিন্তু রোযা যদি কেউ একান্তে গোপনে ঘরে নিভৃত কোণে বসে পানাহার করে তা কোনো মানুষ দেখতে পায় না, সেই ক্ষেত্রে কেবলমাত্র আল্লাহভীতি বা তাকওয়ার গুণাবলিই লোকচক্ষুর অন্তরালে ব্যক্তিকে আল্লাহর পক্ষ থেকে নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত রাখতে পারে। আর তাকওয়ার এই প্রশিক্ষণ শুধুমাত্র রমযান মাসের জন্য নয় বরং তার জীবন চলার পথে যাবতীয় অন্যায়, দুর্নীতি, পাপ, খারাপ কাজ থেকে লোক ভয় নয়, আল্লাহর ভয়ে বিরত থাকার এক উন্নততর প্রশিক্ষণ তৈরি করে দেয়।
সিয়াম পালনকারী ব্যক্তি এক দিকে নফসের যাবতীয় দাবি প্রত্যাখ্যান করে বিদ্রোহী ও অবাধ্য নফসকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। সমস্ত জুলুম-অনাচার, অত্যাচার ও পাশবিকতার বিরুদ্ধে হয়ে ওঠে সংগ্রামী।

সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নির্ণয়কারী আল কুরআন: যুগে যুগে মানুষের পথ চলার জন্য ঐশী গ্রন্থ ছাড়াও মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে তৈরি করেছে বিভিন্ন দর্শন এবং মতবাদ। ঐশীগ্রন্থগুলো বিভিন্ন সময় মানুষের সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করলেও তা আজ মানুষ তাদের প্রয়োজনে বিকৃত করে ফেলেছে। আর ঐশীগ্রন্থকে বাদ দিয়ে নিজেরা যে সকল দর্শন, মতবাদ আবিষ্কার করেছে তা শুধু মানুষকে মুক্তি দিতেই ব্যর্থ হয়নি বরং মানুষ সমাজ সভ্যতার ভাঙন এবং বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে।

সতের শতকে ইতালিবাসীকে এক জাতীয়তাবাদের দিকে আহ্বান করে মুসলিনি খণ্ড-বিখণ্ড ইতালিকে একত্রিত করে স্বপ্নের সেই শান্তি দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। উনিশ শতকে অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলে মার্কস এবং অ্যাঙ্গেল সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নকে খণ্ড-বিখণ্ড করার মাধ্যমে সমাজতন্ত্রের অপমৃত্যু ঘটিয়েছেন। হিটলার জার্মানিতে নাৎসী বাহিনীর মাধ্যমে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছেন সেটি আজকে পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। চীন এবং জাপানকে কেন্দ্র করে যে শিল্প বিপ্লবের উত্থান তাও আজ প্রায় মৃত। সম্প্রতি গণতন্ত্রই একটি মুখরোচক শ্লোগান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও তা বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদ এবং পুঁজিবাদের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। একটু শান্তির আশায় মানুষ তৈরি করলো নানা রকম ধর্মীয়, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক মতবাদ। ধীরে ধীরে জন্ম নিল অসংখ্য দার্শনিক, তাত্ত্বিক ও বিশ্লেষক কিন্তু সবার তত্ত্ব, তথ্য, যুক্তি, দর্শন, দার্শনিক হেগেলের Diactilism, তথা দ্বন্দ্ববাদকে প্রতিষ্ঠিত করলো। অর্থাৎ পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, সংঘাত, বিশৃঙ্খলা ছাড়া এরিস্টেটল ও প্লেটোর আদর্শ রাজা ও দার্শনিক রাজার সেই কল্পিত রাজ্যের সন্ধান দিতে পারেননি। অথচ এই জ্ঞান গবেষণার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের শত শত বছর আগে মহান রাব্বুল আলামিন জীবন পরিচালনার একমাত্র বিধান আল কুরআন নাজিল করে ঘোষণা করেছেন, “রমযান মাস, যে মাসে নাজিল করা হয়েছে আল কুরআন, যাতে মানুষের জন্য রয়েছে নির্দেশাবলি এবং উজ্জ্বল হেদায়েত ও সত্য এবং মিথ্যার পার্থক্যকারী।” (সূরা কদর)

এটি এমন এক কিতাব যার মধ্যে রয়েছে মানুষের কল্যাণ উন্নতি, সমৃদ্ধির দিকদর্শন। অন্ধকারের অমানিশা যখন মানবতাকে ঢেকে নিয়েছিল, চারদিকে অসভ্যতা, নগ্নতা আর বর্বরতার বীভৎস তাণ্ডব চলছিল, সম্পূর্ণ বিবস্ত্র মানব-মানবীরা কাবা শরীফ তাওয়াফ করছিল। হত্যা, শরাব, ব্যাভিচার যখন প্রকাশ্য দিবালোকে সংঘটিত হচ্ছিল। জুলুম, অত্যাচার, নিপীড়নের আহাজারি আল্লাহর আরশকে কাঁপিয়ে তুলেছিল। মা, বোন, কন্যা পরিচয় হারিয়ে যখন তাদেরকে জীবন্ত পুতে ফেলার মাধ্যমে পাশবিকতার চরম অবস্থা বিরাজ করেছিল। মানবতার এক কঠিন দুর্দিনে লক্ষ কোটি জ্যোতিষ্কের আলোকবর্তিকা হাতে কুফরির জমাট বাঁধা অন্ধকারকে পায়ে ঠেলে অবতীর্ণ হল আল কুরআন। গোমরাহির কুৎসিত চেহারাকে মাটিচাপা দিয়ে তার ধ্বংসস্তূপের ওপর জ্বালিয়ে দিল হেদায়েত দীপ্ত মশাল।
“আলিফ লাম রা, হে মুহাম্মদ (সা)! আমি আপনার ওপর এ কিতাব নাজিল করেছি যেন এর মাধ্যমে আপনি মানুষকে গোমরাহির অন্ধকার থেকে হেদায়েতের আলোতে নিয়ে আসতে পারেন।” (সূরা ইবরাহিম : ১) কুরআন আমাদেরকে দুর্বল কিংবা হতভাগ্য করার জন্য প্রেরিত হয়নি। কুরআন এসেছে আমাদেরকে শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত করার জন্য। আল্লাহ নিজেই বলেছন, “তোমার প্রতি কুরআন এ জন্য নাজিল করা হয়নি যে, এটা পাওয়া সত্ত্বেও তুমি হতভাগ্য হয়ে থাকবে।” (সূরা ত্বহা : ২)

আজ সেই কুরআন থেকে দূরে সরে আসার কারণে মুসলিম মিল্লাত নির্যাতিত, নিষ্পেষিত ও নিপীড়িত। তাই এ বিষয়টিকেও উপলব্ধি করতে হবে। ‘কুতিবা আলাইকুমুস সিয়াম’ এ জন্য পালন করছি যাতে নির্মল মন, আত্মার পরিশুদ্ধতা, দৃঢ়চেতা ঈমান এবং আল্লাহর নির্ভরতা নিয়ে হক-বাতিলের সংঘাতে দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে সফল করার চেষ্টা করতে পারি। ‘আকিমুদ্দিন’ এর ফরজিয়াতকে উপলব্ধি করতে না পারলে রমযান, কুরআন এবং তাকওয়ার যে ফলাফল তা অর্জনের ক্ষেত্রে দুনিয়াতে যেমন ব্যর্থ হবো পরকালেও আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবো।

সুতরাং রমযান মাসে সিয়াম সাধনাকে শুধুমাত্র অনুষ্ঠানসর্বস্ব একটি ধর্মীয় ইবাদাতে পরিণত না করে বরং আত্মশুদ্ধি ও প্রশিক্ষণের যে সুযোগ আল্লাহ আমাদের জন্য রেখেছেন সেই টার্গেট বাস্তবায়নের চেষ্টা করতে হবে। নফসের গোলামি থেকে বের হয়ে নিজেকে পরিপূর্ণ আল্লাহর গোলাম এবং তার কাছে আত্মসমর্পণকারীদের কাতারে শামিল করতে, এই রোযা যেন আমাদেরকে ব্যর্থ এবং নিষ্ফল শুধুমাত্র উপবাসকারী হিসেবে পরিণত না করে।
রাসূল (সা) এবং জিবরাইল (আ)-এর পারস্পরিক আলাপে যেভাবে বলা হয়েছে, “যে ব্যক্তি রমযানকে পেল অথচ তার মাধ্যমে সে নিজের গুণাহসমূহ মাফ করিয়ে নিতে পারলো না, তার জন্য ধ্বংস।” আমরা যেন সেই শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত না হই। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আমরা প্রশিক্ষণের সেই মাপকাঠিতে উন্নীত হতে পারি, যেন রাসূল (সা)-এর নেতৃত্বে দ্বিতীয় হিজরি ১৭ রমযান ঐতিহাসিক বদরের প্রান্তরে ইসলাম এবং কুফরির প্রথম সংঘাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সংখ্যার স্বল্পতা, অস্ত্র রসদ এবং খাদ্য ঘাটতির পরও ঈমান, তাকওয়ার বদৌলতে হকের বিজয়কে নিশ্চিত করেছেন। ঠিক একইভাবে আজকে নব্য জাহেলিয়াত ইসলামের বিরুদ্ধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যড়যন্ত্র, ঈমান আকিদা পরিপন্থী সকল নীল নকশাকে প্রতিহত করার শক্তি অর্জন করতে হবে। শানিত করতে হবে ঈমানের তেজকে, টপকে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে বাধার সকল দেয়ালকে, গতি পরিবর্তন করে দিতে হবে অপসংস্কৃতি এবং নগ্নতার স্রোত ধারাকে। কুফরী এবং ফাসেকির ফানুসগুলোকে জ্বালিয়ে দিয়ে উড়াতে হবে দ্বীনের বিজয় কেতন।

তাহলেই কেবল সিয়াম সাধনার মাধ্যমে (লায়াল্লাকুম তাত্তাকুন) গুণাবলি অর্জন সম্ভব। হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসের শেষাংশে বর্ণিত এই বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জনের তৌফিক কামনা করছি।

রাসূল (সা) বলেছেন, ‘‘আল্লাহর রাহে মুজাহিদের উদাহরণ সেই ব্যক্তির ন্যায় যে রোযাও রাখে, রাতে নামাজও পড়ে এবং কালামে পাক তেলাওয়াত করে। কিন্তু রোযায় সে কাতর হয় না। নামাজেও তার শৈথিল্য আসে না। ফিরে না আসা পর্যন্ত আল্লাহর পথে জিহাদকারীর অবস্থাও অনুরূপ থাকে।” (বুখারী ও মুসলিম(

Related Post