বর্তমানে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে সমাজের সর্বস্তরে যে অস্থিরতা ও সহিংসতা বিরাজ করছে, তার মূলে রয়েছে ধৈর্য ও সহনশীলতার অভাব। মানুষ ধৈর্যহীন হয়ে পড়ার কারণেই যত সব অনাচার ঘটে চলেছে সমাজে। আল্লাহ পাক কুরআনে কারিমে ইরশাদ করেন, ‘আমি ধৈর্যশীলগণকে তাদের পুরস্কার তাদের শ্রম অপোও উত্তম রূপে দেবো।’ অর্থাৎ আল্লাহ পাকের কাছে সহনশীলতা অবলম্বনকারীদের মর্যাদা অনেক ঊর্ধ্বে। সহনশীলতা সফলতার চাবিকাঠি। সহনশীলতার মাধ্যমে আল্লাহ পাক বান্দার ঈমান পরীক্ষা করে থাকেন। দুর্ভি, মহামারী ও প্রাকৃতিক সব রকম দুর্যোগ আল্লাহর প থেকে অবতীর্ণ হয়ে থাকে। আল্লাহ পাক এসব বালা-মুসিবত দিয়ে মানুষের ঈমানি পরীক্ষা নিয়ে থাকেন।
যারা যেকোনো বিপদে ধৈর্যধারণ করতে পারে, তাদের জন্যই আল্লাহ পাকের তরফ থেকে ইহকালীন ও পরকালীন সুখ-শান্তির সুসংবাদ দান করেছেন। আর যারা সামান্য রোগ-শোকে ধৈর্যহারা হয়ে আল্লাহকে দোষারোপ করে, তাকদিরকে ধিক্কার দেয়, তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তির ঘোষণা। আমরা কি আল্লাহ পাকের দেয়া তাকদিরের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে ধৈর্যধারণ করে থাকি? আমরা কি আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালনে তৎপর? রাসূলে করিম সা: ইরশাদ করেন, ‘সহনশীলতা ঈমানের অর্ধেক।’ তাহলে সহনশীলতা ব্যতিরেকে আমরা কি পূর্ণ ঈমানের দাবি করতে পারি? না, পারি না।
আর পরিপূর্ণ ঈমান ছাড়া মুমিন হওয়া যাবে না। আর মুমিন না হলে কেউ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। তাহলে আমাদের কী উপায় হবে? জাহান্নামের কঠিন আজাব আমরা কি সহ্য করতে পারব? পৃথিবীর সামান্য আগুনের তাপ আমরা দূর থেকে সহ্য করতে পারি না, আর পৃথিবীর এ আগুনের চেয়ে হাজার গুণ বেশি তাপদীপ্ত আগুনের ভেতর আমরা কিভাবে প্রবেশ করে অনন্তকাল বাস করব এ চিন্তা কি আমরা কোনো সময় করেছি? আল্লাহ পাকের ঘোষণা তো মিথ্যা হওয়ার নয়। ৯ কোটি ৩০ লাখ মাইল দূরবর্তী সূর্যের তাপ আমরা সহ্য করতে পারি না, আর সেই সূর্য কেয়ামতের দিন হাশরের মাঠে যখন সোয়া হাত মাথার ওপর নেমে এসে তার ভেতরের সমস্ত তাপ উদগীরণ করতে থাকবে, তখন আমাদের এই আরাম-আয়েশের শরীরের কী অবস্থা হবে তা কি আমরা কোনো সময় কল্পনা করে দেখেছি?
আজ আমাদের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত একইভাবে অস্থিরতা ও অশান্তি বিরাজ করছে। কোনো কিছুতেই আমরা সহনশীলতার পরিচয় দিতে পারছি না। অথচ সহনশীলতার মাধ্যমে অতি সহজেই তাবৎ অশান্তির হাত থেকে আমরা মুক্তি পেতে পারি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, সামান্য একটি কথা বা তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনেক বড় দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। এর একমাত্র কারণ সহনশীলতার অভাব। কারো কথা কেউ সহ্য করতে পারে না। কারো মাধ্যমে যদি কেউ সামান্যতম তিগ্রস্ত হয়, তাহলে এর প্রতিশোধ নিতে অনেক বড় তির ঝুঁকি নিতেও দ্বিধাবোধ করে না। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, প্রতিহংসা প্রতিহিংসার জন্ম দেয়। আর বিনয় ও সহনশীলতা প্রতিহিংসার আগুনকে নির্বাপিত করে। কোনো ব্যক্তি যদি অজ্ঞতাবশত বা উত্তেজিত অবস্থায় কাউকে গালমন্দ করে, আর সে যদি সহনশীলতা অবলম্বন করে উত্তেজিত ব্যক্তির সাথে নম্র ব্যবহার করে এবং নিজে উত্তেজিত না হয়, তাহলে কোনোক্রমেই সংঘর্ষ সৃষ্টি হতে পারে না। উপরন্তু উত্তেজিত গালমন্দকারী ব্যক্তি তার ভুল বুঝতে পেরে লজ্জিত হবে, যার পরিণাম শুভ ও সুখময়। অবশ্য ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। অনেকে সহনশীলতা বা নম্রতাকে দুর্বলতা মনে করে থাকে, তবে তাদের সংখ্যা খুবই কম।
অনেক সংসারেও দেখা যায়, সামান্য কথা কাটাকাটি থেকে মা-বোনদের মধ্যে বিরাট ঝগড়ার সৃষ্টি হয়ে পুরো সংসারে অশান্তি নেমে আসে এবং পরিণতিতে অপূরণীয় তি সাধিত হয়ে থাকে। অথচ কথার পৃষ্ঠে কথা না বলে সহনশীল হলে সহজেই অশান্তির হাত থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। রাসূল সা: বলেছেন, ‘মানুষ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। শয়তান সব সময় মানুষের পেছনে লেগে থেকে কুমন্ত্রণার মাধ্যমে মানুষকে ভুল পথে চালিত করে থাকে, তাই তোমরা তোমাদের ভাইদের ভুল মা করে শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদ করো।’ সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! কতবার মা করতে হবে?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘প্রয়োজনে দিনে ৭০ বার মা করবে।’ অর্থাৎ কোনো অন্যায়কারীর প্রতি মা প্রদর্শনের অর্থই হলো ধৈর্যধারণ ও সহনশীলতা অবলম্বন করা।
এতে এক দিকে যেমন আল্লাহ পাকের আদেশ পালন করার মাধ্যমে তার মকবুল বান্দা হওয়ার সৌভাগ্য লাভ হয়, অন্য দিকে শয়তান ও নফসের জিহাদ করার মর্যাদার অধিকারী হওয়া যায়। কেননা এটি খুব কঠিন ও কষ্টসাধ্য কাজ হলেও অত্যন্ত মহৎ ও অনন্য একটি গুণ যা সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কল্যাণের জন্য অপরিহার্য। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শান্তি-শৃঙ্খলা ও কল্যাণকর জীবনযাপনের জন্য সবরের গুরুত্ব অপরিসীম। তাদের এ সহমর্মিতা ও সহনশীলতার প্রতিদান দেয়ার প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘বস্তুত ধৈর্যশীলদেরকে তো অপরিমিত পুরস্কার পুরোপুরিভাবেই দেয়া হবে।’ সূরা জুমার : ১০।
শক্তি ও অস্ত্র দিয়ে রাজ্য জয় করা যায়, কিন্তু মানুষের মন জয় করতে ধৈর্য ও সহনশীলতার চেয়ে বড় অস্ত্র আর কিছু নেই। মাসুন্দর দৃষ্টিতে মানুষের দোষগুণ বিচার করার মনমানসিকতা গড়ে তোলার নামই সহনশীলতা। সাহাবায়ে কেরাম রা: এবং পূর্ববর্তী বুজুর্গানে দ্বীন অসীম ধৈর্য ও সহনশীলতা প্রদর্শনের মাধ্যমেই আল্লাহর নৈকট্য লাভে সম হয়েছিলেন। ইহকালীন সুখশান্তি ও পরকালীন নাজাতের একমাত্র মূলমন্ত্র হলো অসীম ধৈর্য, অকান্ত পরিশ্রম ও অফুরন্ত ভালোবাসা। ধৈর্য, সহনশীলতা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে দুঃখকষ্টের অবসান হয়ে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয় এবং স্নেহ ও ভালোবাসার দ্বারা মানুষের হৃদয় জয় করে অভীষ্ট ল্েয পৌঁছা যায়। এ তিন বস্তুর মধ্যেই নিহিত আছে মানুষের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল, সুখ-শান্তি ও নাজাত। বর্তমানে আমাদের মাঝে এগুলোর অভাব খুব বেশি পরিলতি হচ্ছে।
সামান্য রোগ-শোকে আমরা ধৈর্যহারা হয়ে তাকদিরকে দোষারোপ করে থাকি। অথচ আল্লাহ তায়ালা ধৈর্যশীলদের ভালোবাসেন, ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন এমন অনেক বক্তব্য পবিত্র কুরআনে অহরহ বর্ণিত আছে। অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘তোমরা ধৈর্যধারণ করো এবং সহনশীল হও, তবেই তোমরা মুক্তি পাবে।’ আল্লাহ পাক শত্র“তার জবাব ধৈর্য ও সহনশীলতার মাধ্যমে দিতে বলেছেন। ইরশাদ হচ্ছে, ‘হে মুমিনগণ! সবর করো এবং শত্র“র বিরুদ্ধে ধৈর্যধারণ করো। তোমাদের মধ্যে যদি এক শ’ ধৈর্যশীল লোক থাকে তবে তারা দুই শ’ শত্র“কে পরাজিত করবে। আর যদি এক হাজার ধৈর্যশীল লোক থাকে, তবে আল্লাহর ফজলে দুই হাজার শত্র“কে পরাজিত করবে। কেননা ধৈর্যশীলদের সাথে আল্লাহ আছেন।’ অন্য আয়াতে এসেছে, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে (আল্লাহর নিকট) সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন। সূরা বাকারা : ১৫৩।
মানুষের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক জীবনেও ধৈর্য ও সহনশীলতার প্রয়োজন অনেক বেশি। সুতরাং রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ধৈর্যের চর্চা এবং ধৈর্যের ওপর অটল থাকার প্রয়োজনীয়তা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন অনেক বেশি। মহান আল্লাহ মানুষের শিা লাভের জন্য এমন বহু দৃষ্টান্ত দুনিয়ায় রেখে দিয়েছেন। হজরত আইয়ুব আ:-এর ঘটনা এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তাঁর সমস্ত শরীর ক্রিড়ায় খাওয়ার পরও তিনি যে পবিত্র জিহ্বা দিয়ে আল্লাহর জিকির করতেন সে জিহ্বাও ক্রিড়ায় খেতে শুরু করে। তবুও কিন্তু তিনি মহান আল্লাহর জিকির ও স্মরণ থেকে বিমুখ হননি। আল্লাহ আমাদের সেই ধৈর্য ও সহনশীলতা দান করুন।