ফসলের ওশোর আদায়ের গুরুত্ব

Ushor

মাওলানা আবুল বাশার

মুসলমান মাত্রই এ কথা জানেন, ইসলাম ধর্মের ভিত্তি বা বুনিযাদ মোট পাঁচটি। এ ব্যাপারে রাসূল সা: বলেন,

عَنْ أَبِي عَبْدِ الرَّحْمَنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ:  سَمِعْت رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم يَقُولُ بُنِيَ الْإِسْلَامُ عَلَى خَمْسٍ: شَهَادَةِ أَنْ لَا إلَهَ إلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ، وَإِقَامِ الصَّلَاةِ، وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ، وَحَجِّ الْبَيْتِ، وَصَوْمِ رَمَضَانَ ( رَوَاهُ الْبُخَارِيُّ وَمُسْلِمٌ)

  ইসলামের ভিত্তি মোট পাঁচটি যথা

১. এ কথার সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং আরো সাক্ষ্য দেয়া যে, মুহাম্মদ সা: তাঁর বান্দা ও প্রেরিত রাসূল (ঈমান);

২. নামাজ প্রতিষ্ঠা করা;

৩. জাকাত আদায় করা;

৪. রমজান মাসে রোজা রাখা ও

৫. সামর্থ্যবানদের জন্য হজ পালন করা।

মুসলমান সমাজে ইসলামের বুনিয়াদগুলোর মধ্যে ঈমানের পর নামাজ আদায় ও রমজানের রোজা রাখার ব্যাপারে ব্যক্তিজীবনে গুরুত্বের সাথে কিছুটা বিবেচনা করা এবং বিত্তশালী মুসলমানেরা হজ করার ব্যাপারে উৎসাহ দেখালেও জাকাত আদায় করার বিষয়টি আজো নামাজ ও রোজার মতো সমান ফরজ হিসেবে গ্রহণ করার মানসিকতা গড়ে ওঠেনি। তবে এ ক্ষেত্রে সম্পদশালী মুসলমানেরা নিজের ইমেজ প্রচার কিংবা কোনো সময় সঠিক মানসিকতা নিয়ে যথাযথ হিসাব সহকারে অথবা হিসাব না করেই থোক বরাদ্দের মতো তাদের সম্পদের জাকাত আদায় করার চেষ্টা করে থাকেন। বিভিন্ন সময় এর ভয়াবহ পরিণতির নজির আমাদের দেশে লক্ষ করা যায়। যার হিসাব করার ভার সম্পূর্ণ মহান আল্লাহ তায়ালার হাতে ন্যস্ত । এ ক্ষেত্রে আমাদের সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে এ ধারণা বদ্ধমূল হয়েই আছে যে, জাকাত প্রদান করা ধনিক সমাজের কাজ আর আমরা যারা দরিদ্র কিংবা যাদের জাকাত দেয়ার মতো কোনো সম্পদ নেই তাদের ওপরে ইসলামী শরিয়া তথা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে জাকাত হিসেবে কোনো কিছুই ফরজ করা হয়নি। অথচ মহান আল্লাহ তায়ালা ধনী-গরিব সব মুসলমানের ওপর তাঁর উৎপন্ন ফসলের ওপর জাকাত বা ওশোর আদায় করা ফরজ করেছেন।

‘ওশোর’ আরবি শব্দ, যার বাংলা অর্থ হচ্ছে দশ ভাগের এক ভাগ। ইসলামী শরিয়ার পরিভাষায় মুসলমান কর্তৃক তার জমিতে উৎপন্ন ফসলের জাকাত হিসেবে দশ ভাগের এক ভাগ জাকাত আদায়ের নির্ধারিত খাতগুলো বণ্টন করাকে ওশোর বলা হয়। এ ক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে, যদি কোনো সেচ ছাড়াই প্রাকৃতিক উৎস থেকে প্রাপ্ত যেমন- নদীনালা, খাল কিংবা বৃষ্টির পানি দ্বারা ফসল উৎপন্ন হলে ওশোর বা দশ ভাগের এক ভাগ এবং কৃত্রিম উপায়ে সেচ দিয়ে ফসল উৎপন্ন হলে তার অর্ধ ওশোর বা বিশ ভাগের এক ভাগ জাকাত হিসেবে আদায় করতে হবে।

মুসলমানের ওপর তার উৎপন্ন ফসলের ওপর জাকাত তথা ওশোর আল্লাহর পক্ষ থেকে ফরজ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আল কুরআনে স্পষ্ট নির্দেশ বিদ্যমান। যা অস্বীকার করার সুযোগ নেই এবং এর অস্বীকারকারীই কাফের হিসেবে পরিগণিত হবে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَنفِقُوا مِن طَيِّبَاتِ مَا كَسَبْتُمْ وَمِمَّا أَخْرَجْنَا لَكُم مِّنَ الْأَرْضِ * البقرة

 ‘হে ঈমানদারগণ তোমরা যা উপার্জন করো এবং আমি তোমাদের জন্য ভূমি থেকে যা উৎপন্ন করে দিই; তন্মধ্যে যা উৎকৃষ্ট তা ব্যয় করো।’ সূরা-বাকারা, আয়াত নম্বর-২৬৭।

আল্লাহ অন্যত্র আরো সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়ে বলেন,

وَهُوَ الَّذِي أَنشَأَ جَنَّاتٍ مَّعْرُوشَاتٍ وَغَيْرَ مَعْرُوشَاتٍ وَالنَّخْلَ وَالزَّرْعَ مُخْتَلِفًا أُكُلُهُ وَالزَّيْتُونَ وَالرُّمَّانَ مُتَشَابِهًا وَغَيْرَ مُتَشَابِهٍ ۚ كُلُوا مِن ثَمَرِهِ إِذَا أَثْمَرَ وَآتُوا حَقَّهُ يَوْمَ حَصَادِهِ ۖ وَلَا تُسْرِفُوا ۚ إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ  (سورة الأنعام 141)

‘তিনি উদ্যানগুলো সৃষ্টি করেছেন- তাও, যা মাচার ওপরে তুলে দেয়া হয় এবং যা মাচার ওপরে তোলা হয় না এবং খর্জুর বৃক্ষ ও শস্যক্ষেত্র- যেসবের স্বাদবিশিষ্ট এবং জয়তুন ও আনার সৃষ্টি করেছেন- একে অন্যের সাদৃশ্যশীল এবং সাদৃশ্যহীন। এগুলোর ফল খাও, যখন তার ফল উৎপন্ন হয় এবং ওই ফসলের হক আদায় করো যখন ফসল কেটে সংগ্রহ করবে। আর অপচয় করো না, নিশ্চয় তিনি (আল্লাহ) অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না।’ সূরা আনয়াম, আয়াত নম্বর-১৪১)।

বর্ণিত দু‘টি আয়াতের প্রথমটিতে উল্লিখিত ‘ব্যয়’ করো- ফসলের জাকাত আদায় করা ফরজ এ নির্দেশ প্রমাণ করে। এ কাজকে ঈমানের অনিবার্য দাবি হিসেবে আল্লাহ তায়ালা উপস্হাপন করেছেন। আল কুরআনের বহু আয়াতেই ‘ব্যয় করো বলে জাকাত দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

ইমাম আবু বকর আল জাসসাস বলেন : ব্যয় করো অর্থ জাকাত দাও। আর দ্বিতীয় আয়াতে হক আদায় করার যে নির্দেশ, তাও ফসলের জাকাত দেয়ার নির্দেশ এবং তা ফরজ। এ জাকাত হচ্ছে ওশোর- দশ ভাগের এক ভাগ অথবা অর্ধ ওশোর বা বিশ ভাগের এক ভাগ।

হজরত ইমাম আবু জাফর আত-তাবারী হজরত আনাস ইবনে মালেক রা:-এর বর্ণনা উদ্ধৃত করে বলেন, এ ‘হক’ অর্থ জাকাত। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: থেকে বহু সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, ফল ও ফসলের যে জাকাত দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তা আসলে ওশোর বা অর্ধ ওশোর।

ইমাম সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যবি, মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়া, কাতাদাহ, কুরতুবি, ইমাম শাফেয়ি ও ইমাম মালেক র: এবং ইমামে আজম আবু হানিফা র: ও তার সঙ্গীদের ভাষ্য মতে- আয়াতে বর্ণিত ‘হক’-এর অর্থ হচ্ছে জাকাত- ফরজ জাকাত বা ওশোর, অর্ধ ওশোর। কথা বিভিন্ন হলেও মূল উদ্দেশ্য ও বক্তব্য এক ও অভিন্ন।

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেছেন, ‘বৃষ্টি ও খাল-নদীর পানিতে যে জমি সিক্ত হয় অথবা যা মাটির রসে সাধারণত সিক্ত থাকে, তাতে উৎপন্ন ফসলের দেয় (জাকাত) ওশোর বা দশ ভাগের এক ভাগ। আর যাতে সেচকাজ করতে হয়, তাতে উৎপন্ন ফসলের দেয় (জাকাত) অর্ধ ওশোর বা বিশ ভাগের এক ভাগ।’ (মুসলিম, আবু দাঊদ, তিরমিজি, ইবনে মাজাহ)।

হজরত জাবির রা: থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূল সা: থেকে বর্ণনা করে বলেন, ‘যা খাল-নদী ও মেঘের পানিতে সিক্ত হয়, তাতে ওশোর ধার্য হয়েছে। আর যা সেচের মাধ্যমে সিক্ত হয়, তাতে অধ ওশোর।’ (আহমদ, মুসলিম)। এ ছাড়াও কৃষি ফসল ও ফলাদির নিসাব নির্ধারণ ও জাকাত আদায়ের জন্য আদায়কারী প্রেরণ পর্যায়ে বহুসংখ্যক হাদিস উদ্ধৃত হয়েছে। (ইসলামের জাকাত বিধান, প্রথম খণ্ড)।

ওশোর ফরজ হওয়ার শর্তাবলি : ‘ওশোরদাতাকে মুসলমান হতে হবে, উৎপাদিত ফসলের ওপর তার মালিকানা থাকতে হবে এবং জমি ওশোরযোগ্য হতে হবে। অতএব কোনো অমুসলিম ব্যক্তির ওপর ওশোর ধার্য হবে না। ওশোর ধার্য হওয়ার জন্য জমির মালিক হওয়া শর্ত নয়,বরং উৎপাদিত ফসলের মালিক হলেই ওশোর দিতে হবে। একই জমিতে বছরে একাধিকবার ফসল উৎপন্ন হলে প্রতিবারই ওশোর দিতে হবে। এমনিভাবে নাবালেগ,পাগল ও এতিম সবার মালিকানাভুক্ত ফসলের ওশোর দিতে হবে।

কোনো ব্যক্তি যে পরিমাণ ফসলের মালিক হলে তার ওপর ওশোর প্রদান বাধ্যতামূলক হয়, সেই পরিমাণ ফসলকে নিসাব বলে। সাহাবি, তাবেয়িন ও সব আলেম মত প্রকাশ করেছেন, পাঁচ অসাক (বর্তমান মেট্রিক পদ্ধতির ওজনে ৯৪৮ কিলোগ্রাম) পরিমাণ না হওয়া পর্যন- কৃষি ফল ও ফসলের ওপর জাকাত (ওশোর) ধার্য হয় না। তাদের দলিল মূলত রাসূল সা:-এর বাণী, ‘পাঁচ অসাকের কম পরিমাণের ওপর জাকাত হয় না।’ (বুখারি ও মুসলিম)।

ইমাম আবু হানিফা র:-এর মতে, ফসলের পরিমাণ কম হোক বেশি হোক, সবটাতেই জাকাত (ওশোর) ধার্য হবে। কেননা রাসূল সা:-এর কথাই সাধারণ অর্থবোধক বৃষ্টিতে সিক্ত সব জমির ফসলেই ওশোর হবে। সেহেতু এখানে এক বছর অতীত হওয়ার কোনো শর্তারোপ করেননি, তাই তার কোনো নিসাবও নেই। ইমাম ইব্রাহিম নখয়ি, ইবনে হাজাম, মুজাহিদ ও খলিফা উমর ইবনে আবদুল আজিজও এ মত সমর্থন করেন।

ইসলামী শরিয়ার ভিত্তিতে রচিত পাকিস্তানের জাকাত ও ওশোর অধ্যাদেশে এমন ব্যবস্তা রাখা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি নিসাব পরিমাণ শস্যের মালিক হলে সে তা থেকে উৎপাদন ব্যয় বাবদ ২৫ শতাংশ রেয়াত পাবে, অতঃপর অবশিষ্ট শস্যের দশ ভাগের এক ভাগ জাকাত (ওশোর) প্রদান করবে। এ অধ্যাদেশে ফসলের মূল্য নিরূপণ করে নগদ অর্থে ওশোর আদায়ের ব্যবস্তা রাখা হয়েছে।

আল কুরআনে বর্ণিত জাকাত ব্যয়ের খাতগুলোই ওশোর ব্যয়ের খাত এবং রাষ্ট্র বা তার প্রতিনিধি তা আদায় করবেন। যেখানে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্তা নেই সেখানে ওশোর দাতারা নিজ নিজ দায়িত্বে তা বণ্টন করবেন।

সুতরাং এ বিষয়টি স্পষ্ট যে, মুসলমান মাত্রই তার উৎপন্ন ফসলের ওশোর আদায় করতে হবে, যা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ফরজ করা হয়েছে এবং রাসূল সা: তার পরিমাণ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। জাকাত ও ওশোরের ক্ষেত্রে সর্বাধিক স্মরণযোগ্য বিষয়টি হচ্ছে, এটা ট্যাক্স, জরিমানা বা সরকারি দাবি নয়; বরং এটা নামাজ ও রোজার মতোই একটি স্থায়ী ইবাদত এবং আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভের মাধ্যম। এটি নৈতিক ও চারিত্রিক সংশোধন ও প্রশিক্ষণের খোদায়ী ব্যবস্তা এটি আদায়ের ক্ষেত্রেও নিজেকে বড় মনে করা কিংবা গরিব ও অসহায় লোকদের ওপর দয়া করছি, অনুগ্রহ দেখাচ্ছি, এই ভেবে নয় এবং গর্ব ও অহঙ্কারভরে নয়; বরং বিনয় সহকারে, নম্র ও সদয়চিত্ত, আন-রিকতার সাথে আদায় করতে হবে এবং নিজের পরিবর্তে জাকাত গ্রহণকারীকে উপকারী বন্ধু ভাবতে হবে।

জাকাত ও ওশোর আদায়ের সময় নিয়তের বিশুদ্ধতা অতীব জরুরি। আর তা এ জন্য যে, জাকাত ও ওশোর খুবই বড় ইবাদত। যথাযথ জাকাত ও ওশোর আদায়ের মাধ্যমে যেমন মহান আল্লাহর নির্দেশিত ফরজ ইবাদত সম্পন্ন করা হয়; একই সাথে সম্পদের সুষম বণ্টন, অর্থনৈতিক গতিশীলতা ও সামাজিক খাদ্য নিরাপত্তা বিধান করা সম্ভব।

মাওলানা রাশেদুল করিম, ব্যাংককার ও প্রবন্ধকার

Related Post