মানবতার কল্যাণে জাকাত

jaltaka[1]যাকাত আরবি শব্দ, তাজকিয়া থেকে এর উত্পত্তি। অর্থাত্ পরিশুদ্ধ ও বর্ধিত করা। যাকাত দান ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের একটি। এটি ফরজ। নির্দিষ্ট পরিমাণ (সামর্থ্যবানদের) অর্থ থেকে একটি অংশ বছরান্তে গরিব-দুঃখীদের মধ্যে যথার্থভাবে হিসাব করে দিতেই হবে। এতে কার্পণ্য বা শৈথিল্য দেখানোর আদৌ কোনো অবকাশ নেই। এ সম্পর্কে আল্লাহপাক বলেছেন, ‘ওয়াক্কিমুছছালাতা ওয়াতুযযাকাতা’ অর্থাত্ নামাজ কায়েম কর এবং যাকাত দান কর। একবার নয় পবিত্র কালামে ৮২ বার উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহপাক আরও বলেছেন, অ-ইউক্কিমুনাছ ছালাতা ওয়া মিন্না রাজাকনাহুম ইউনফিক্কুন অর্থাত্ যারা সঠিকভাবে নামাজ আদায় করে এবং ওই লোকদের যাদের সামর্থ্যবান বানিয়েছি তারা যথার্থভাবে হিসাব করে যাকাতের অর্থ দুস্থ-নিঃস্ব, গরিব-এতিম, অসহায় মানুষদের বিলিয়ে দেয় তারা আমার কাছ থেকে অঢেল পুরস্কৃত হবে। এছাড়া বিত্তবান, অর্থশালী যারা তাদের স্মরণ রাখতে হবে—যারা চরম দরিদ্র দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছে, অর্থের অভাবে ডাক্তার দেখাতে, ওষুধের জোগান দিতে, হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছে না বিশেষ করে আশ্রয়হীন, বস্ত্রাভাবী নারী-পুরুষ-শিশুদের প্রতি মানবতার শুভ দৃষ্টি দিয়ে যাকাতের অর্থ বণ্টন করলে তারা নিঃসন্দেহে মানবতার সেবা ও কল্যাণে নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করল এবং আল্লাহর নির্দিষ্ট ফরজ কাজটি যথার্থ আদায় করে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং অসহায় মনুষের দোয়াপ্রাপ্ত হলো। আল্লাহপাক এ সম্পর্কে আরও বলেছেন, তোমরা যে (ধন সম্পদের হিসাব করে) যাকাত প্রদান করবে তার বিনিময়ে সর্বশক্তিমান আল্লাহপাক যাকাতদাতাদের অধিক পুরস্কৃত করবেন এবং উত্তম রুজি-রোজগারে পরিপূর্ণ করে দেবেন। নিকটতম অতি দরিদ্র আত্মীয়-স্বজন, দুস্থ, নিঃস্ব-এতিম-গরিব, পঙ্গু, অন্ধ, প্রতিবন্ধীসহ আরো যারা মানবেতর জীবনযাপন করছে তাদের কল্যাণে যাকাত-সদকা, ফেতরা দান করা প্রত্যেক বিত্তবান, অর্থ-বৈভবে পূর্ণ সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের অবশ্য অবশ্য যাকাত প্রদান করা কর্তব্য।

শুধু তাই নয়, পবিত্র কোরআনে বিশেষ করে হাদিসে বহুবার তাগিদ ও হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়েছে—যারা যাকাত, সদকা, ফেতরা দিতে অবহেলা করবে, কার্পণ্য দেখাবে তাদের পরিণতি হবে ইহ ও পরকালীন জীবনে অত্যন্ত ভয়াবহ। অনেকের প্রচুর ধন-সম্পদ আছে পূর্ণ সামর্থ্যবান, অর্থের পাহাড় গড়ে তুলে স্বর্ণ-রৌপ্য গচ্ছিত রেখে বড়লোকির পোঁচ-পাঁচে রয়েছে এবং বড়াই করে চলেছে। আবার অন্যদিকে আরেকজন নিজে সমাজে কপর্দক হীনভাবে চলছে তাদের কথা-কার্য এমনই, তারা অর্থহীন দারুণ ভোগান্তির মধ্যে রয়েছে অথচ মানুষ জানে লোকটি অঢেল অর্থের মালিক, বহু আয় করছে অতি চুপিসারে। এসব লোকের কপাল-পাঁজর এবং পিঠে আগুনের ছেঁকা দেয়া হবে। অর্থাত্ চিহ্নিত করা হবে এরা যাকাত দানে অবহেলা করেছে। এ কথা পবিত্র কোরআনের স্পষ্ট বাণী।
আল্লাহ দরিদ্রসেবা, এতিম, মিসকিন, অনাথ, বিধবা, নির্যাতিত-নিপীড়িত, উপেক্ষিত গরিব-অসহায়দের কল্যাণে যারা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় বিশেষ করে যাকাতের অর্থের দ্বারা একেকজন অথবা বহুজনকে মিলিয়ে এমন এটি ব্যবস্থা করা, যার মাধ্যম তারা কায়িক পরিশ্রম করে বছরের পর বছর সংসার নিয়ে জীবন নির্বাহ করতে পারে। যাকাত দান বদান্যতা, মহানুভবতা, প্রেম, ভালোবাস সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি-সামাজিক সম্পর্ক বজায়ের এক পরম মাধ্যম। যারা ধনাঢ্য, বিত্তশালী, সামর্থ্যবান তাদের এই যাকাতের অর্থ গরিব-দুঃখীদের মধ্যে নিয়ম অনুযায়ী বণ্টন করার প্রতি মন-মানসিকতা গড়ে উঠলে তাদের বখেলি অর্থাত্ কৃপণ স্বভাব দূরীভূত এবং মানবসেবার প্রতি মন আকৃষ্ট হয়। আল্লাহপাক আরো বলেছেন, ‘তাখাল্লাকু বি আখলাকিল্লাহ’ অর্থাত্ তোমরা আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হও। যা কিছু সুন্দর, মহত্, কল্যাণকরসহ শ্রেষ্ঠতম গুণাবলি, যা আল্লাহর বান্দাদের মধ্যেও বিকশিত হয়ে ওঠে।
আল্লাহপাক রাসূলে করিমকে (সা.) বললেন, হে রাসূল। আপনি আপনার সামর্থ্যবান, ধনাঢ্য, অর্থভাণ্ডারে পরিপূর্ণ এমন ব্যক্তিদের নিকট হতে যাকাত আদায় করুন, যারা তাদের ধন-সম্পদে পরিশুদ্ধ হবে এবং তাদের যাকাত দানের বরকতে অধিক ধন-সম্পদ আরো বৃদ্ধি পাবে এবং দানশীল পরোপকারী ও মহত্ হওয়ার উত্সাহ জোগাবে এবং দরিদ্রে জর্জরিত, অসহায়-বিপন্ন মানুষের মানবতার কল্যাণে নিজেদের আত্মনিয়োগ করার এক মহাসুযোগ পাওয়া যাবে। স্মরণ রাখতে হবে, ধন-সম্পদ, অর্থ-বৈভব যা কিছ অর্জিত হয় তা শুধু নিজেদের উপভোগের জন্য নয়—আল্লাহপাক গরিব-অসহায়দেরও এর অংশীদারিত্ব সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। যারা দরিদ্র, অসহায়, নিঃস্ব মানুষদের অংশীদারিত্বের অংশের অর্থ যথাযথভাবে সঠিক হিসাব করে না দেবে, তাদের পরিণতি হবে অতি ভয়াবহ—যেহেতু এটা তাদের প্রাপ্য হকদার। যাকাতের অর্থ দরিদ্র, নিঃস্ব ও অসহায়দের দান বা সাহায্য নয় এটা তাদের হক বা অংশ। তাদের অর্থ যথাযথভাবে হিসাব করে পরিশোধ করাই ইসলাম অবশ্য কর্তব্য ফরজ বলে আখ্যায়িত করেছে। এর সামান্যতম ব্যতিক্রম করলে ইহ-পরকালে অশান্তি-দুঃখ, ভয়াবহ আজাব-গজবে নিপতিত হবে।
যাকাতের অর্থ নির্দিষ্ট লোকদের প্রাপ্যম যা পবিত্র কোরআনে পরিষ্কার বলে দিয়েছে তা হলো দুস্থ-নিস্ব, গরিব-দুঃখী, অসহায়, ফকির-মিসকিন, এতিম, আশ্রয়হীন, বস্ত্রাভাবী, পঙ্গু, বিকলাঙ্গ-অনাথদের কর্জ পরিশোধের জন্য যে কোনো মহত্ মানবসেবায় ও কল্যাণে প্রবাসী মুসাফিরের জন্য যাকাত দান করা আল্লাহপাকের নির্ধারিত ফরজ। অতি গরিব, নিকটতম-আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীদের প্রতিও সহানুভূতিশীল হতে হবে।

আর যাদের ওপর যাকাত প্রদান বৈধ নয় তারা হলো

—১. অমুসলিমকে

২. যার নেছাব পরিমাণ মাল-সম্পদ রয়েছে

৩. স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে

৪. রাস্তা-ঘাট, পুকুর-সাঁকোর জন্য

৫. মসজিদ-মাদ্রাসা

৬. মৃত্যু ব্যক্তির দাফনের জন্য

৭. সৈয়দ বংশীয় লোকদের

৮. পিতা-পিতামহ বা মাতা মাতামহ ঊর্ধ্বতম কাউকে

৯. পুত্র-দৌহিত্র, দৌহিত্রের অধস্তন পুরুষ-স্ত্রী

১০. ধন-সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের সন্তান-সন্ততিদের।

এতদ্ব্যতীত কোনো ব্যবসায়ীকে দ্রব্যসামগ্রীর পণ্য ব্যবসা-বাণিজ্যের নিয়তে গোলাজাত করে রাখা হলে তার যাকাত অবশ্যই প্রদান করতে হবে। যেসব মালের যাকাত দিতে হবে না তা হলো নিত্যব্যবহার্য মাল যেমন—চাল, ডাল, গমসহ যাবতীয় খাদ্যসামগ্রী ও ব্যবহারের আবসাবপত্র কিংবা মণি-মুক্তা-হীরা-জহরত, যা ব্যবসার জন্য রাখা হয়নি। শুধু নিজেদের ব্যবহারের জন্য রাখা হয়েছে।
উপসংহারে আমি বলতে চাই, আমাদের দেশের প্রায় চৌদ্দ কোটি মানুষের মধ্যে অগণিত সফল ব্যবসায়ী-বিত্তবান, ধনাঢ্য, শিল্পপতি গার্মেন্ট, যানবাহন, নৌযান মালিক, সামর্থ্যবান ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও দেশের এমন অর্থ-বৈভবে পরিপূর্ণ কোটি কোটি টাকা ব্যাংকে এখানে-সেখানে গচ্ছিত অবস্থায় ‘অলসভাবে’ বছরের পর বছর পড়ে রয়েছে, এসব জমাকৃত বিপুল অর্থের নিয়ম মতো যাকাতের অংশ দ্বারা এসব ধনাঢ্য ব্যক্তি দেশের নিরন্ন-দুস্থ, অসহায়দের জন্য স্থায়ী বাস্তবভিত্তিক কর্মসংস্থানের বিবিধ পরিকল্পনার মাধ্যমে যাকাতদানে এগিয়ে আসতে পারেন। এমনকি দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে বিশেষ করে ধনী-গরিবদের মধ্যকার বৈষম্য দূরীকরণে এ যাকাতের অর্থ যথাযথভাবে বণ্টন করা হলে দেশের অসহায় মানুষের সেবায় বিরাট সফলতা বয়ে আনত এবং আল্লাহপাক ও তাঁর নির্দেশিত ফরজ বিধান পালন করা হতো এবং এতে ইহ-পরকালে শান্তি ও মুক্তির নিশ্চয়তা পাওয়া যেত। দোকান, কুটিরশিল্প, সেলাই মেশিন, নৌকা, ট্রলারসহ বহুরকম কর্মসংস্থানের সত্ভাবে রোজগারের পথ খোলা রয়েছে—তারা যাতে তাদের যাকাতের অর্থের দ্বারা স্বাভাবিক জীবন নির্বাহ করতে পারেন, তার ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। যেসব ধনাঢ্য-সামর্থ্যবান, ধনী-অর্থশালীদের হাতে সারা বছরের ভরণ-পোষণ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় খরচাদি বাদে এবং ঋণ থাকলে সেই টাকা বাদে নেছাব পরিমাণ মাল স্বর্ণ হারে সাত ভরি, রৌপ্য ৫২ ভরি, পশু নির্দিষ্টসংখ্যক থাকলে তাকে ৪০ ভাগের ১ ভাগ যাকাত দিতে হয়। এগুলোর সমমূল্যের টাকা অথবা সর্বপ্রকার ব্যবসা-বাণিজ্য মূলধনের ওপর যাকাত হিসাব করে দিতে হবে। এমনকি জমির ক্ষেতের ফসলসমূহের ও ওসরদানের বিধান রয়েছে, যা যাকাত সম্পর্কিত বড় বড় মোহাক্কেক-ফকীহদের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থে সুনির্দিষ্ট করে দেয়া আছে।
অতএব যাকাতদানে আদৌ অবহেলা না করে হিসাব মতো যাকাত প্রদান করুন। দেখবেন, আপনার ধন-সম্পদ আরো বৃদ্ধি পাবে, দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে বিরাট সহায়ক হবে এবং যাকাতদাতাদের উদ্যোগ ও উত্সাহিত করে তুলুন—এটাই আমাদের ঐকান্তিক কামনা এবং ইহ-পরকালে পাবেন পরম শান্তি ও স্বস্তি।

Related Post