اَلْحَمْدُ للهِ الَّذِيْ دَبَّرَ عِبَادَهُ فِيْ كُلِّ أُمُوْرِهِمْ أَحْسَنَ تَدْبِيْرٍ* وَيَسَّرَ لَهُمْ أَحْوَالَ الْمَعِيْشَةِ وَأَمَرَهُمْ الْاِقْتِصَادَ وَنَهَاهُمْ عَنِ الِإسْرَافِ وَالتَّقْتِيْرِ* وَأَشْهَدُ أَنْ لاَّ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ * لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الُحَمْدُ، وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٍ* وَأَشْهَدُ أَنَّ نَبِيَّنَا وَسَيِّدَنَا مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ * اَلْبَشِيْرُ النَّذِيْرُ، وَالسِّرَاجُ الْمُنِيْرُ * اللهم صَلِّ وَسَلِّمْ وَبارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ* وَعَلَى آلِهِ وَأَصْحَابِهِ الَّذِيْنَ سَلَكُوْا طُرُقَ الْاِعْتِدَالِ وَالتَّيْسِيْرِ*
أَمَّا بَعْدُ :أَيُّهَا الْإِخْوَةُ الْمُسْلِمُوْنَ: اِتَّقُوْا اللهَ تَعَالَى بِتَرْكِ مُجَاوَزَةِ الْحَدِّ فِيْ كُلِّ الْأُمُوْرِ، وَسُلُوْكِ طَرِيْقِ الْاِقْتِصَادِ فِيْ الْمَيْسُوْ رِ وَالْمَعْسُوْرِ، فَقَدْ قَالَ تَعَالَى: وَالَّذِينَ إِذَا أَنفَقُوا لَمْ يُسْرِفُوا وَلَمْ يَقْتُرُوا وَكَانَ بَيْنَ ذَلِكَ قَوَامًا
و قال سبحانه: وكُلُواْ وَاشْرَبُواْ وَلاَ تُسْرِفُواْ إِنَّهُ لاَ يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ
সম্মানিত মুসাল্লিয়ানে কেরাম! আজকের খুতবার আলোচ্য বিষয় হলো: ইসলামের দৃষ্টিতে অপচয় ও অপব্যয়। موضوع الخطبة وَلاَ تُسْرِفُواْ
অপচয় ও অপব্যয়,ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এ কারণে ইসলামে অপচয় ও অপব্যয় উভয়ই নিষিদ্ধ। বাংলায় অপচয় ও অপব্যয় শব্দ দুটি অনেক ক্ষেত্রে সমার্থক হিসেবে ব্যবহৃত হলেও এ দুইয়ের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি মাত্রায় ব্যয় করার নামই অপচয়, যা আরবীতে ‘ইসরাফ’ বলা হয়। অপচয় সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন: وكُلُواْ وَاشْرَبُواْ وَلاَ تُسْرِفُواْ إِنَّهُ لاَ يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ অর্থাৎ, তোমরা খাও, পান কর, কিন্তু অপচয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপচয় পছন্দ করেন না।
অন্যদিকে,অপব্যয় হচ্ছে অন্যায় ও অযৌক্তিক উপায়ে সম্পদের অপব্যবহার,যাকে আরবীতে ‘তাবযীর’ বলা হয়। পবিত্র কুরআনে তাবযীর বা অপব্যয় সম্পর্কে অনেকগুলো আয়াত রয়েছে। সূরা বনী ইসরাইলের ২৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
وَلَا تُبَذِّرْ تَبْذِيرًا– إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِرَبِّهِ كَفُورًا
আর অপচয় কর না ‘নিশ্চয় অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই। শয়তান তার প্রতিপালকের প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ।’
সম্মানিত উপস্থিতি! ইসলামে অপচয় ও অপব্যয় উভয়ই নিষিদ্ধ। ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ কল্যাণকামী জীবন ব্যবস্থার নাম। তাই এতে অপচয় ও অপব্যয়ের মতো কৃপণতাও নিষিদ্ধ। কারণ কৃপণতাও মানুষের একটি মন্দ স্বভাব ও নির্দয়তার লক্ষণ। কুরআন মজিদ ও হাদীসে ক্ষুধার্তকে খাদ্যদান, বস্ত্রহীনকে বস্ত্রদান, অভাবগ্রস্তকে সাহায্য দান, অনাথ-ইয়াতীমদেরকে লালন-পালন, নিঃস্ব ব্যক্তির উপার্জনের ব্যবস্থা করা, বিপদগ্রস্ত মানুষকে সহায়তা করা মুসলিমদের কর্তব্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
আল্লাহর রাসূল বলেছেন:
عن عبد الله بن سلام رضي الله عنه أن النبي صلى الله عليه و سلم قال : أَفْشُوا السَّلَامَ ، وَأَطْعِمُوا الطَّعَامَ، وَصِلُوا الأَرْحَامَ ، وَصَلُّوا بِاللَّيْلِ وَالنَّاسُ نِيَامٌ ، تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ بِسَلامٍ. (رواه الترمذي)
আবদুল্লাহ ইবন সালাম থেকে বর্ণিত যে,রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘হে লোকসকল! তোমরা সালামের প্রসার ঘটাও,খাবার খাওয়াও,আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা কর এবং মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন নামায পড়। (এগুলো করে) তোমরা নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ কর।’ (তিরমিযী)
কিন্তু কৃপণরা তা করে না। কৃপণতা মানুষকে আল্লাহ তাআলা তথা জান্নাত থেকে দূরে সরিয়ে শয়তান তথা জাহান্নাম পর্যন্ত পৌঁছে দেয়।
এ প্রসঙ্গে আল কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন,
مَا سَلَكَكُمۡ فِي سَقَرَ ٤٢ قَالُواْ لَمۡ نَكُ مِنَ ٱلۡمُصَلِّينَ ٤٣ وَلَمۡ نَكُ نُطۡعِمُ ٱلۡمِسۡكِينَ ٤٤ [المدثر: ٤٢، ٤٤]
তোমাদেরকে কিসে জাহান্নামে নিক্ষেপ করেছে? তারা বলে, আমরা মুসল্লীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না এবং আমরা অভাবগ্রস্তদের আহার্য দান করতাম না। [সূরা আল-মুদ্দাসসির,আয়াত: ৪২-৪৪]
এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«وَالبَخِيلُ بَعِيدٌ مِنَ اللَّهِ بَعِيدٌ مِنَ الجَنَّةِ بَعِيدٌ مِنَ النَّاسِ قَرِيبٌ مِنَ النَّارِ، وَالْجَاهِلُ السَّخِيُّ أَحَبُّ إِلَى اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ مِنْ عَابِدٍ بَخِيلٍ»
কৃপণ ব্যক্তি আল্লাহ থেকে দূরে, জান্নাত থেকে দূরে এবং মানুষ থেকে দূরে থাকে। কিন্তু জাহান্নামের নিকটবর্তী থাকবে।’ (সুনান তিরমিযী, হাদীস নং ১৯৬১, হাদীসটি যয়ীফ)
সম্মানিত মুসাল্লিয়ানে কেরাম! ব্যয়ের ক্ষেত্রে কৃপণতা যেমন দোষণীয় তেমনি অপচয়-অপব্যয়ও দোষণীয়। সম্পদ কমে যাবে এ চিন্তায় নিঃস্ব ও বিপদগ্রস্ত মানুষকে সহায়তা না করার জন্য কৃপণরা দোষী। আর অপচয়কারীরা দোষী এ কারণে যে,তারা নিজের অপ্রয়োজনে ব্যয় করছে, অথচ নিঃস্ব ও বিপদগ্রস্তদের প্রয়োজন মেটাতে সহায়তা করছে না। মানুষ তখনই মানুষ হয়, যখন সে অন্য মানুষের দুঃখ-কষ্টে সহানুভূতি দেখায়,বিপদ-আপদে সহায়তা করে। কিন্তু কৃপণ, অপচয় ও অপব্যয়কারীরা তা করতে পারে না কিংবা করে না। তাদের হৃদয় মানুষের দুঃখে কাঁদে না, বরং তাদের দ্বারাই মানুষ কষ্ট পায়। আর এই কারণেই ইসলামে তা নিষিদ্ধ।
রাসূল (সা.)কে কেন্দ্র করে হযরত খাদীজা (রা.)এর বাণী:
স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি আমাদের প্রিয় নবী মহামানব মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই ‘মানুষের জন্য’। নবুওয়্যত প্রাপ্তির পরে তো বটেই, নবুওয়্যত প্রাপ্তির পূর্বেও ছিলেন সব ধরনের মানবীয় গুণে গুণাম্বিত। আমরা জানি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেরা গুহায় প্রথম ওহী লাভের পর কিছুটা বিচলিত হয়ে গিয়েছিলেন। ঘরে ফিরে গিয়ে শুয়ে পড়লেন এবং প্রিয় সহধর্মিণী তৎকালীন মক্কার অবিসংবাদিত বিদূষী ও পবিত্র নারী খাদিজাতুল কুবরাকে আহবান জানালেন তাঁকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দিতে। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা তাঁর প্রাণাস্পদের এই বিহ্বলতা দেখে সান্ত্বনা দেন এই বলে যে, আপনি আত্মীয়ের প্রতি সদাচার করেন, অসহায় ব্যক্তির বোঝা বহন করেন, নিঃস্ব ব্যক্তির জন্য উপার্জনের ব্যবস্থা করে দেন, মেহমানদের আপ্যায়ন করেন এবং বিপদগ্রস্ত মানুষের প্রতি সহায়তা দান করেন। সুতরাং আপনার বিচলিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। অর্থাৎ আপনার জীবন ও কর্ম যেহেতু মানুষের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য নিবেদিত, সেহেতু আপনার বিচলিত বা অস্থির হওয়ার কিছু নেই।
সুতরাং অপচয় ও অপব্যয় না করে তা মানব কল্যাণে ব্যয় করাই হচ্ছে প্রকৃত মানুষ ও প্রকৃত মু‘মিন-মুসলিমের কাজ। কুরআন মজিদে আল্লাহ্ তা‘আলার খাঁটি বান্দাদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন,
وَٱلَّذِينَ إِذَآ أَنفَقُواْ لَمۡ يُسۡرِفُواْ وَلَمۡ يَقۡتُرُواْ وَكَانَ بَيۡنَ ذَٰلِكَ قَوَامٗا ٦٧ [الفرقان: ٦٦]
“এবং যখন তারা ব্যয় করে তখন অপচয় করে না এবং কার্পণ্যও করে না, বরং তারা আছে এতদুভয়ের মাঝে মধ্যম পন্থায়। [সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ৬৬]
কুরআন মজিদে মহান আল্লাহ আরো বলেন,
﴿ وَكُلُواْ وَٱشۡرَبُواْ وَلَا تُسۡرِفُوٓاْۚ إِنَّهُۥ لَا يُحِبُّ ٱلۡمُسۡرِفِينَ ٣١ ﴾ [الاعراف: ٣١]
“এবং আহার করবে ও পান করবে। কিন্তু অপচয় করবে না। তিনি অপচয়কারীদেরকে পছন্দ করেন না”। [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ৩১]
অপচয়ের মতো অপব্যয়কে নিষিদ্ধ করে কুরআন মজিদে বর্ণিত হয়েছে,
﴿ وَلَا تُبَذِّرۡ تَبۡذِيرًا ٢٦ إِنَّ ٱلۡمُبَذِّرِينَ كَانُوٓاْ إِخۡوَٰنَ ٱلشَّيَٰطِينِۖ وَكَانَ ٱلشَّيۡطَٰنُ لِرَبِّهِۦ كَفُورٗا ٢٧ ﴾ [الاسراء: ٢٦- ٢٧]
“আর কিছুতেই অপব্যয় করবে না। যারা অপব্যয় করে তারা শয়তানের ভাই এবং শয়তান তার প্রতিপালকের প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ”। [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ২৬-২৭]
সম্মানিত উপস্থিতি! কুরআন ও হাদীসে অপচয় ও অপব্যয়কে নিষিদ্ধ করা হলেও মানুষ এ থেকে বিরত থাকছে না। আমরা আমাদের চারপাশ কিংবা জীবনের যেদিকেই তাকাই না কেন কেবল অপচয়ের সমাহার দেখতে পাই। অপচয় শুধু আমাদের পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও কর্মক্ষেত্রেই দেখতে পাই না, ধর্মীয় ক্ষেত্রেও এর জৌলুসপূর্ণ অবস্থান দেখতে পাই। মানুষের জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বিনোদন। এগুলো ছাড়া মানুষ জীবনধারণ করতে পারে না, তাই এগুলোকে মানুষের মৌলিক চাহিদা বলা হয়। ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ, সাদা-কালো, ছোট-বড় সকলেরই তা প্রয়োজন। সামাজিক ও আর্থিক ভিন্নতার কারণে সকল মানুষ সমভাবে এসবের প্রয়োজন মেটাতে পারে না। সামাজিক অবস্থান ও ধন-সম্পদ মানুষের ভোগের হার নির্ধারণ করে বিধায়, কারো ভোগের পেয়ালা উপচে পড়ে, আবার কারো ভোগের হাঁড়ি শূন্য থাকে । যাদের পেয়ালা উপচে পড়ছে তারা যদি শূন্য হাঁড়িতে তাদের অতিরিক্ত সম্পদ ঢেলে দেয়, তাহলে একদিকে যেমন উপচে পড়া তথা অপচয় বন্ধ হবে, তেমনি অপরদিকে কোনো হাঁড়িও আর শূন্য থাকবে না। এই জন্যই ইসলাম কৃপণতা, অপচয় ও অপব্যয়ের লাগাম টেনে ধরে তা নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। যাকাত, দান-খয়রাত, সাহায্য-সহযোগিতা, সহানুভূতি ও মানব কল্যাণকে অবশ্য পালনীয় করে দিয়েছে। যেহেতু প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যয়ই অপচয়, সেহেতু সবধরনের বিলাসিতাই অপচয়। তাই দামি খাবার, দামি পোশাক, সুরম্য অট্টালিকা, অপ্রয়োজনীয় শিক্ষা, চিকিৎসা ও বিনোদন অপচয়ের শামিল। এজন্যই নবী-রাসূল, ওলী-আল্লাহ ও পরহেজগার মুসলিমের জীবনে এতোটুকু বিলাসিতাও স্থান পায়নি। এ যুগের বাংলাভাষী কবি বলেছেন,
“যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি।
আশুগৃহে তার জ্বলিবে না আর নিশীথে প্রদীপ বাতি।”
আজ যে অপচয়কারী বিলাসী, কাল সে ভিখারী ও পরমুখাপেক্ষী। এটা যেমন ব্যক্তি জীবনে সত্য, রাষ্ট্রীয় জীবনেও সত্য। পিতৃসম্পদে সম্পদশালী ব্যক্তি যেমন বেহিসেবী জীবনাচারের মাধ্যমে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে দারিদ্রে পর্যবসিত হয়,তেমনি প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধশালী দেশও অপরিণামদর্শী ভোগ-বিলাসের কারণে দারিদ্রের দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না।
অপচয়ের মাত্রায় ধর্মীয় ক্ষেত্রগুলোও পিছিয়ে নেই। মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা কোথায় নেই অপ্রয়োজনীয় জৌলুস ও চাকচিক্য। বিচিত্র কারুকার্যে সুশোভিত ও সুসজ্জিত উপাসনালয়ের উপাসনায় না থাকে প্রাণ, না থাকে স্রষ্টার আনুগত্য। অথচ ইসলামের প্রথম মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল খেজুর পাতার ছাউনী দিয়ে; যাকে কুরআন মজিদে ‘তাকওয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত’ মসজিদ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
অযূ ও গোসলের নামে পানির অপচয় কে না করে? অথচ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নদীতে বসে অযূ করলেও অপচয় করতে নিষেধ করেছেন।
এ প্রসঙ্গে সাহাবি আবদুল্লাহ ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাআদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর এর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি অযূ করছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
«مَا هَذَا السَّرَفُ» فَقَالَ: أَفِي الْوُضُوءِ إِسْرَافٌ، قَالَ: «نَعَمْ، وَإِنْ كُنْتَ عَلَى نَهَرٍ جَارٍ».
“অপচয় করছো কেন! সাআদ বললেন, অযূতেও কি অপচয় হয়? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ, প্রবাহমান নদীতে বসেও যদি তুমি অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করো তা অপচয়”। (সুনান ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৪২৫)
অনুরূপভাবে এক সা’ (আনুমানিক তিন লিটার) পরিমাণ পানি দিয়ে ফরজ গোসল সমাধা করতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ দিয়েছেন এবং তিনি নিজেও তাই করেছেন। তারপরও অনেক ইবাদাতকারীকে দেখা যায়, অযূ ও গোসলের সময় অধিক পানি ব্যবহার করেন। আমার জানামতে বাংলাদেশের এক প্রখ্যাত ব্যক্তি এক অযূর সময় এক কলসেরও বেশি পানি ব্যবহার করতেন। তিনি এবং তাঁর অনুসারীরা এটাকে অপচয় মনে করতেন না। অথচ আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مِنْ حُسْنِ إِسْلَامِ المَرْءِ تَرْكُهُ مَا لَا يَعْنِيهِ».
“প্রয়োজনহীন (অসঙ্গত) কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকার মধ্যেই ব্যক্তির ইসলামের সৌন্দর্য নিহিত”। (সুনান তিরমিযী, হাদীস নং ২৩১৭)
সব ধরনের নেশা ইসলামে নিষিদ্ধ। নেশা মানুষের জীবনধারণের জন্য জরুরি নয়; বরং ক্ষতিকর ও জীবন বিনাশকারী। তাই ধূমপান, মদ ও অন্যান্য মাদকদ্রব্যের পেছনে যে অর্থ ব্যয় করা হয় তা অপব্যয়। এ ধরনের অপব্যয়ের জন্য দ্বিগুণ পাপ।
এক. অপব্যয়ের জন্য।
দুই. নিষিদ্ধ হারাম কাজ করার জন্য।
অপব্যয়ের কিছু উদাহরণ
কোনো অভাবী কিংবা ক্ষুধার্ত ব্যক্তির অভাব ও ক্ষুধা নিবারণের জন্য অর্থ ব্যয় না করে কেবল নিজের নাম প্রচারের জন্য কোনো মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকা ও মাজারের শোভাবর্ধনের জন্য অর্থদান অপব্যয়। অনুরূপভাবে নিজ গৃহদ্বারে অভাবী ও দরিদ্রদের সমবেত করে দাতা হিসেবে পরিচিতি লাভের জন্য দান করা অপব্যয়। কারণ এসব দান রিয়ার অন্তর্ভুক্ত। নাম ফলানো কিংবা দুনিয়ার অন্য কোনো স্বার্থসিদ্ধির জন্য দান করা ইসলাম পছন্দ করে না। ইসলামে দান হতে হবে নিঃস্বার্থ জনকল্যাণমূলক এবং আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি লাভের নিমিত্ত।
মানুষের জীবনে কিছু কিছু সময় আছে যখন সঞ্চয় করা জরুরি। তখন সঞ্চয় না করে ব্যয় করা অপচয়। যেমন বিবাহ করা, স্ত্রীর মোহর দেওয়া, সন্তানের ভরণ-পোষণ ও লেখাপড়ার খরচ নির্বাহ এবং নিজের বৃদ্ধ বয়সের আর্থিক নিরাপত্তার জন্য সঞ্চয় করা আবশ্যক। তাই এসব জরুরি ব্যয় নির্বাহের জন্য সঞ্চয় না করে ব্যয় করা অপচয়। অনুরূপভাবে রোগ, ব্যাধি, দুর্যোগ, দুর্বিপাক ইত্যাদি ধরনের আকস্মিক বিপদাপদের প্রতি লক্ষ্য রেখে কিছু সঞ্চয় করে রাখাও আবশ্যক। এসব দুর্বিপাকের কথা চিন্তা না করে ব্যয় করাও অপচয়। আবার সঞ্চিত অর্থ বিনিয়োগ না করে অলসভাবে রেখে দেয়াও অপচয়।
কোনো সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার না করা অপচয়। যেমন, একটি জমিতে তিনটি ফসল করা গেলেও তা না করে এক বা দু’টি ফসল করা উক্ত জমির অপচয়। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি যে কাজে অধিক পারদর্শী তাকে দিয়ে সে কাজ না করিয়ে অন্য কাজ করানো কিংবা অধিক পারদর্শী লোককে কোনো কাজে নিয়োগ না করে তুলনামূলক কম জানা ও অদক্ষ লোককে নিয়োগ করাও অপচয়।
কখন মানুষ অপচয় ও অপব্যয় করে?
অপচয় ও অপব্যয়ের সাথে অবৈধ উপার্জনের একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। হাতে পর্যাপ্ত টাকা-পয়সা থাকলে কিংবা অনেক সময় ব্যয়টা নিজের পকেট থেকে না হয়ে অন্যের পকেট থেকে হলেই কেবল অপচয় বা অপব্যয় করা সম্ভব। বৈধ পথে অর্জিত সম্পদ দিয়ে প্রয়োজনের অধিক ব্যয় করা কষ্টকর। অধিক তো দূরের কথা অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যয়ই মেটানো সম্ভব হয়ে উঠে না। অতিরিক্ত ব্যয় কিংবা বিলাসপূর্ণ জীবন তারাই নির্বাহ করতে পারে যাদের অবৈধ আয় থাকে। ব্যবসা-বাণিজ্যে সব সময়ই প্রবল প্রতিযোগিতা বিরাজ করে। তাই সৎ ব্যবসায়ীর পক্ষে খুব বেশি অর্থ-সম্পদের মালিক হওয়া সম্ভব নয়। চাকরিজীবীর বেতন নির্ধারিত হওয়ায় কোনো রকমে বেঁচে থাকার মতো করে জীবনধারণ করে, অনেক ক্ষেত্রে তাও হয় না। সুতরাং সৎ চাকরিজীবীর পক্ষে কোনোক্রমেই অপচয় করা সম্ভব নয়। আর কৃষিজীবীদের তো পেটে ভাতেই হয় না। অপচয় করবে কোথা থেকে। সুতরাং কোনো ব্যবসায়ী কিংবা চাকরিজীবীকে অপচয় করতে দেখলে স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয়া যায় তার আয় অবৈধ। বাস্তবতার নিরিখে একথা সহজেই বলা যায়, অবৈধ আয় ছাড়া অবৈধ ব্যয় সম্ভব নয়। অপব্যয়ের আরেকটি ক্ষেত্র হচ্ছে, ব্যয়ে খরচকারীর নিজের সম্পদের কোনো সম্পৃক্ততা থাকে না। সরকারি অফিস-আদালত কিংবা কোম্পানীর কারখানার ব্যয় সরকার কিংবা কোম্পানীর মালিক বহন করে। তাই সরকারি অফিসে লাইট, ফ্যান, কাগজ-কলম, যানবাহন, কাঁচামালের ব্যবহারে অপচয় হয় বেশি। কেননা ব্যবহারকারীকে এসবের ব্যয় বহন করতে হয় না। আর এই একই কারণে গৃহকর্তার চেয়ে গৃহভৃত্যের অপচয়ের পরিমাণ বেশি। শহুরে জীবনে গ্যাস, লাইট, পানি ও অন্যান্য দ্রব্যের অপচয় গৃহভৃত্যদের দ্বারাই বেশি হয়।
অপচয় ও অপব্যয় নিয়ে আরো একটু বিশ্লেষণ:
পানাহারের অপচয় : প্লেটভর্তি খাবার নিয়ে খাওয়ার শেষে কিছু অংশ না খেয়ে প্লেটে রেখে দেয়াটা একটি ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলোতে এ অপচয় খুব বেশি দেখা যায়। একটি ভাত বা এক টুকরো তরকারি নষ্ট করার আগে আমরা একবারও ভেবে দেখি না যে, কতগুলো হাতের খাটুনির সুবাদে এ খাবার আমাদের কাছে পৌঁছেছে। আর সেই খাবার আমরা অবলীলায় ফেলে দিচ্ছি!
পানির অপচয় : পানির অপচয়কে অনেকে অপচয়ই মনে করেন না। তাদের ধারণা যে, পানি তো পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে। তাই বেশি খরচ করলে সমস্যা কী? এ ধারণাটি সঠিক নয়। কারণ অপচয় মানে বিনা প্রয়োজনে ব্যয় করা। রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘তুমি যদি সাগরপাড়ে বসেও পানি অতিরিক্ত ব্যবহার করো, তাও অপচয় হবে। যে অজুতে এক বদনা পানি লাগার কথা, সে অজুতে এক বালতিরও বেশি লেগে যায়। পানির টেপ ছেড়ে দিয়ে আমরা অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। দাঁত মাজা, হাত কচলানো ইত্যাদি কাজ চালু রাখতে দেখা যায়। এতে প্রচুর পানি খরচ হয়।
গোসলের সময় মাথায় মগভর্তি পানি ঢালি। কিন্তু অর্ধেক পানি মাথা হয়ে শরীরে পড়ে, আর বাকি অংশ সরাসরি মাটিতে পড়ে যায়। কাপড়-চোপড়, মাছ-তরকারি, থালা-বাটি ইত্যাদি ধোয়ার সময় দেখা যায় পানির কল চলতে থাকে, আর আমরা ধীরস্থিরে ধুয়ে যাই। এতে একটি জিনিস ধুতে যতটুকু পানি লাগার কথা তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি পানি অযথা নষ্ট হয়ে যায়। পানি রাখার সময় খেয়াল করে ঢেকে রাখা হয় না। পরে অবলীলায় সে পানি ফেলে দেয়া হয়। পানির মোটর ছেড়ে দিয়ে খেয়াল করা হয় না, ফলে ট্যাংকি ভর্তি হয়ে প্রচুর পানি অপচয় হয়। এভাবে পানি ব্যবহারে আরও কত ধরনের অপব্যবহার আমরা করে যাচ্ছি তার কোনো হিসাব নেই।
বিদ্যুতের অপচয়: বিদ্যুতের অপচয় আমাদের কাছে একটি সাধারণ বিষয় হয়ে গেছে। বলতে গেলে এটি একটি মহামারী আকার ধারণ করেছে। অফিস-আদালত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এ অপচয় বেশি হয়। অফিসিয়াল সিস্টেম রক্ষা করতে গিয়ে সব লাইট-ফ্যান একসঙ্গে চালু করে দেয়া হয়।
দোকানপাটের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য বা জিনিসপত্রের জৌলুস ও চমক বাড়ানোর জন্য যে হারে বিদ্যুতের অপব্যবহার করা হয়, তা কোনোভাবেই মার্জনীয় নয়। আলোকসজ্জার নামে বিভিন্ন মার্কেট, রেস্টেুরেন্ট ও বহুতল ভবনে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ অপচয় করা হয়, তা রীতিমতো বিস্ময়কর।
গ্যাসের অপচয়: গ্যাসের ক্ষেত্রে অপচয়ের সুযোগ থাকার কারণে আমরা অপচয় করি বেশি। ব্যবহারভিত্তিক বিল না হয়ে মাসিক নির্ধারিত বিল হওয়ার কারণে অধিকাংশ গ্রাহক মনে করেন,২৪ ঘণ্টাই তার গ্যাস চালানোর অধিকার আছে। এ ধারণা ভুল। মূলত একটি পরিবারে সাধারণত যতটুকু গ্যাস লাগে ততটুকু ব্যবহারের জন্যই সে কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে অনুমতিপ্রাপ্ত। সুতরাং এর বাইরে গ্যাস ব্যবহার করলে তা অপচয় হিসেবে পরিগণিত হবে। আমরা অনেকে কাপড় শুকানোর জন্য,শীতকালে বাসা গরম রাখার জন্য, আবার নতুন করে আগুন জ্বালানোর কষ্ট থেকে রেহাই পেতে এক বেলার কাজ শেষ হওয়ার পর আরেক বেলা পর্যন্ত চুলা জ্বালিয়ে রাখি। এ ধরনের অপচয় ও অপব্যবহারের ফিরিস্তির কোনো শেষ নেই।
সাজসজ্জার অপচয়: সাজসজ্জা করতে গিয়ে আমরা অনেক পোশাক কিনে থাকি। বর্তমানে পোশাক শরীরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির চেয়ে বেশি কাজে লাগছে শোভা বর্ধনের কাজে। তাই শরীরের প্রয়োজনে লাগুক আর নাই লাগুক শোভা বাড়ানোর যেহেতু প্রয়োজন আছে তাই মার্কেটে নতুন পোশাকের আমদানি হলেই কিনতে হয়। পোশাক কেনার ক্ষেত্রে কোন পোশাকটি আরামদায়ক তা বিবেচনায় না নিয়ে কোনটি পশ্চিমা স্টাইলে তৈরি, তা বিবেচনা করা হয়। শুধু দামের আধিক্যের বিবেচনায়ও পোশাক কেনা হয়। সঙ্গীদের সঙ্গে বড়াই করার জন্য অনেক দামি দামি পোশাক খরিদ করা হয়। শাড়িটা কেমন? এ প্রশ্নের চেয়ে শাড়ির দাম কত? এ প্রশ্নই বেশি করতে শোনা যায়। এ ধরনের অপচয় কি কোনোভাবে সমর্থনযোগ্য?
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে সব ধরণের অপচয় ও অপব্যয় হতে দূরে থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন