মুমিন অর্থ বিশ্বাসী। মহান আল্লাহ তায়ালার একক সত্তা, তাঁর প্রেরিত রাসূল, ফেরেশতা, কিতাব, পরকাল ও তকদিরের ওপর আন্তরিক বিশ্বাস স্থাপনকারী আল্লাহর গোলামকে ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় মুমিন বলা হয়। মুমিনের পরিচয়ে কুরআন মাজিদে বলা হয়েছে, ‘তারা তাওবাকারী, ইবাদতকারী, আল্লাহর প্রশংসাকারী, সিয়াম পালনকারী, রুকুকারী, সিজদাকারী, সৎকাজের আদেশদাতা, অসৎকাজের নিষেধকারী এবং আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা হিফাজতকারী। আর মুমিনদেরকে তুমি সুসংবাদ দাও।’ (সূরা তওবা, ১১২)
‘মুমিন তো তারাই যাদের সামনে আল্লাহর নাম স্মরণ করা হলে তাদের অন্তর প্রকম্পিত হয়ে ওঠে আর যখন আয়াত তিলাওয়াত করা হয় তখন তাদের ঈমান আরো বৃদ্ধি পেয়ে যায়।’ (সূরা আনফাল, ২)নুমান ইবনে বশির রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমরা মুমিনদের পারস্পরিক দয়া ভালোবাসা ও হৃদ্যতা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে একটি দেহের মতো দেখতে পাবে। দেহের কোনো অঙ্গ যদি পীড়িত হয়ে পড়ে তাহলে অপর অঙ্গগুলোও জ্বর এবং নিদ্রাহীনতাসহ তার ডাকে সাড়া দিয়ে থাকে।’ (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)
মানুষের মৃত্যুর পরবর্তী জীবনকে বলা হয় আখিরাত। কুরআনে বলা হয়েছে, ‘সেদিন অবশ্যই আসবে যখন মুত্তাকি লোকদের আমি মেহমানের মতো রহমানের দরবারে উপস্থিত করব। আর পাপী অপরাধী লোকদের পিপাসু জানোয়ারের মতো জাহান্নামের দিকে তেড়ে নিয়ে যাবো। সেই সময় লোকেরা কোনো সুপারিশ করতে সক্ষম হবে না তাদের ব্যতীত যারা রহমানের দরবার থেকে প্রতিশ্রুতি লাভ করেছে।’ (সূরা মারিয়াম, ৮৫-৮৭)
হাদিসে এসেছে, আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত, ‘আমি আল্লাহর নবীকে এ কথা বলতে শুনেছি যে, কিয়ামাতের দিন মানব জাতিকে খালি পায়ে, উলঙ্গ ও খাতনাবিহীন অবস্থায় একত্র করা হবে। আমি আরজ করলাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! এমতাবস্থায় তো নারী-পুরুষ পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকাবে। হুজুর সা: বললেন, হে আয়েশা! সেদিনকার অবস্থা এত ভয়াবহ হবে যে, পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকানোর কোনো কল্পনাই কেউ করবে না।’ (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)
মুুমিন সব সময় নিজেকে আল্লাহর ভালোবাসার চাদরে জড়িয়ে রাখতে চান। তার জীবনের সব চাওয়া-পাওয়া হয় একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে। তিনি তার রবের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য যেকোনো ত্যাগ শিীকার করতে রাজি হন। দুনিয়ার কোনো লোভলালসা তাকে গ্রাস করতে পারে না। তার শয়নে-স্বপনে-কর্মে সব সময় জাগরুক থাকে আল্লাহর ভয় ও তাঁর ভালোবাসা। দুনিয়ার স্বার্থকে তিনি বড় দেখেন না, বড় দেখেন শুধু আখিরাতের মনজিল। তাই তিনি অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যান তাঁর লক্ষ্যপানে পৌঁছতে, আর বাসনার রাজ্যে পরম তৃপ্তিতে ভাসতে থাকেন রবের হুকুম পালন করার মানসিকতা নিয়ে। কিভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়, সে ভাবনাই থাকে তার মনে সব সময়।
মুমিন জীবনের লক্ষ্য : সফল জীবন লাভের জন্য একটি চূড়ান্ত লক্ষ্য নির্ধারণ করা খুবই জরুরি। ইমাম গাজ্জালী রহ: বলেন, মানুষ অনাদি নয়, তাই চিরস্থায়ী। অর্থাৎ মানবজীবনের শুরু আছে শেষ নেই। তাই মানুষের উচিত এমন লক্ষ্য নির্ধারণ করা যা তার চিরস্থায়ী জীবনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। পার্থিব জীবন ক্ষণস্থায়ী, তাই যদি কেউ পার্থিব জীবনের মধ্যে তার জীবনের লক্ষ্য সীমিত রাখে, তাহলে তা হবে বুদ্ধিমত্তার পরিপন্থী।
মানুষ নিজ জীবন সম্পর্কে প্রায়ই ভুল ধারণার বশবর্তী হয়। কখনো সে নিজেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বস্তু বলে সাব্যস্ত করে এবং অন্যদেরকে নিম্নস্তরের মনে করে তাদের আনুগত্য দাবি করে। আবার কখনো সে নিজেকে নিতান্ত অসহায় ভেবে যেকোনো শক্তিধর বস্তুর কাছে আপন সত্তাকে বিলীন করে দেয়। প্রকৃতপক্ষে এ দুয়ের মাঝামাঝি মানুষের অবস্থান। মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি। অত্যন্ত নিকৃষ্ট বস্তু দ্বারা তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে, তাই নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে অহঙ্কার করা মানুষের জন্য সমীচীন নয়। কিন্তু মানুষকে দুনিয়াতে পাঠানো হয়েছে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে। তাই মানুষ একমাত্র তাঁরই সামনে মাথা নত করবে, অন্য কারো সামনে নয়। কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আর স্মরণ কর, যখন তোমার রব ফেরেশতাদের বললেন, ‘নিশ্চয় আমি জমিনে একজন খলিফা সৃষ্টি করছি।’ (সূরা বাকারাহ : ৩০)
জীবনের সব ক্ষেত্রে আল্লাহর গোলামি করাই হচ্ছে সফল জীবনের লক্ষ্য। কারণ মানুষকে সৃষ্টি করাই হয়েছে তাঁর গোলামি করার জন্য। এ ব্যাপারে কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আর জিন ও মানুষকে কেবল এ জন্যই সৃষ্টি করেছি যে, তারা আমার ইবাদত করবে।’ (সূরা জারিয়াত : ৫৬) অর্থাৎ আল্লাহর ইবাদতই মানুষের জীবনের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য। এটিই মানুষের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।
দুনিয়ার জীবনে মুমিনের চাওয়া-পাওয়া : দুনিয়ার জীবনে মুমিন পেতে চায় তার রবের ইবাদত করার ব্যাপক সুযোগ। দুনিয়ার কোনো মোহ তার চাওয়া-পাওয়া হতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা মানুষসহ সব প্রাণীর আহারের দায়িত্ব নিজের কাছেই রেখেছেন। কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আর জমিনে বিচরণকারী প্রতিটি প্রাণীর রিজিকের দায়িত্ব আল্লাহরই এবং তিনি জানেন তাদের আবাসস্থল ও সমাধিস্থল। সব কিছু আছে স্পষ্ট কিতাবে।’ (সূরা হুদ : ৬)
মুমিনজীবনে ঈমানি পরীক্ষা : যুগে যুগে আল্লাহর মুমিন বান্দাদেরকে তাদের জান, মাল, ইজ্জত আব্রু কোরবানি করতে হয়েছে। আল্লাহ তাঁর দ্বীনের জন্য যাদের পছন্দ করেছেন, তাদেরকে বিভিন্ন সময় পরীক্ষা করেছেন। কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আর আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং জানমাল ও ফল-ফলাদির স্বল্পতার মাধ্যমে। আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও।’ [সূরা বাকারাহ, ১৫৫)
কুরআন মজিদে অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘নাকি তোমরা ভেবেছ যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে অথচ এখনো তোমাদের নিকট তাদের মতো কিছু আসেনি, যারা তোমাদের আগে বিগত হয়েছে। তাদেরকে স্পর্শ করেছিল কষ্ট ও দুর্দশা এবং তারা কম্পিত হয়েছিল। এমনকি রাসূল ও তাঁর সাথী মুমিনগণ বলছিল, ‘কখন আল্লাহর সাহায্য (আসবে)? জেনে রাখো, নিশ্চয় আল্লাহর সাহায্য নিকটবর্তী।’ (সূরা বাকারাহ, ২১৪)
দুনিয়ার জীবনে কোনো মুমিন বান্দাই পরীক্ষা থেকে রেহাই পাননি। কুরআনে বলা হয়েছে, ‘মানুষ কি মনে করে যে, আমরা ঈমান এনেছি বললেই তাদের ছেড়ে দেয়া হবে, আর তাদের পরীক্ষা করা হবে না? আর আমি তো তাদের পূর্ববর্তীদের পরীক্ষা করেছি। ফলে আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন, কারা সত্য বলে এবং অবশ্যই তিনি জেনে নেবেন, কারা মিথ্যাবাদী।’ (সূরা আনকাবুত, ২-৩)
জীবনযুদ্ধে মুমিনের সফলতা : দুনিয়ার জীবনযুদ্ধে একজন মুমিন তার ঈমানের দাবি পূরণে থাকেন সদা আপসহীন। সংগ্রামের পথে তিনি খুঁজে পান জীবনের সফলতা। কুরআনে এসেছে, ‘মুমিন কেবল তারাই যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছে, তারপর সন্দেহ পোষণ করেনি। আর নিজদের সম্পদ ও নিজদের জীবন দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছে। এরাই সত্যনিষ্ঠ।’ (সূরা হুজুরাত, ১৫)
মুমিনদের সফলতার ব্যাপারে কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘তাদের রবের কাছে তাদের পুরস্কার হবে স্থায়ী জান্নাত, যার পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত, সেখানে তারা থাকবে স্থায়ীভাবে। আল্লাহ তাদের ওপর সন্তুষ্ট হয়েছেন তারাও আল্লাহর ওপর সন্তুষ্ট হয়েছে। এটি তার জন্য, যে স্বীয় রবকে ভয় করে।’ (সূরা বায়্যিনাহ : ৮)
মুমিনের সকল কাজ হয়ে থাকে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। কুরআনে বলা হয়েছে, ‘সে তো শুধু তার মহান রবের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে কাজ করে। অবশ্যই তিনি (তার ওপর) সন্তুষ্ট হবেন।’ (সূরা লাইল, ২০-২১)
মুমিনের আসল ঠিকানা : একজন সত্যিকারের মুমিন মনে করেন, তার আসল ঠিকানা হলো আখিরাত। তাই সে আখিরাতের ঘর বানানোর কাজে সদা থাকেন সচেষ্ট। আর আখিরাতের ঘর হলো আল্লাহর সন্তুষ্টির জান্নাত। জান্নাতের আকাক্সী মুমিন বান্দা দুনিয়ার জীবনে এক মুহূর্তের জন্যও আখিরাতের আমল থেকে দূরে থাকতে চান না।
সময়ের প্রতিটি সেকেন্ড তার কাছে মহামূল্যবান। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পুরোটা সময়ই তিনি আল্লাহর ইবাদতে কাটিয়ে দিতে ভালোবাসেন। তার কর্মের প্রশংসা করে কুরআনে বলা হয়েছে, ‘সৎ কর্মশীল মুমিনদের জন্য রয়েছে নিয়ামতে ভরা জান্নাত। চিরকাল তারা তা উপভোগ করবে। এটা আল্লাহর ওয়াদা। আর তিনি মহাশক্তিশালী ও সুবিজ্ঞ।’ (সূরা লোকমান, ৮-৯)
মুমিনের আখিরাত প্রস্তুতি : আখিরাতে চিরসুখ ভোগ করতে একজন মুমিন দুনিয়ার জীবনে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে বিলিয়ে দেন আল্লাহর দ্বীনের পথে। দুনিয়ার কোনো বাধা, অর্থবিত্ত তার কাছে বড় মনে হয় না, বড় মনে হয় আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়ন করাকে। মুমিনের কর্মপ্রস্তুতি সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ মুমিনদের থেকে তাদের জান ও মাল ক্রয় করে নিয়েছেন (এর বিনিময়ে) যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে। অতএব তারা মারে ও মরে। তাওরাত, ইঞ্জিল ও কুরআনে এ সম্পর্কে সত্য ওয়াদা রয়েছে। আর নিজ ওয়াদা পূরণে আল্লাহর চেয়ে অধিক কে হতে পারে? সুতরাং তোমরা (আল্লাহর সাথে) যে সওদা করেছে, সে সওদার জন্য আনন্দিত হও এবং সেটাই মহাসাফল্য।’ (সূরা তাওবা, ১১১)
আখিরাতে মুমিনের অবস্থান : যারা দুনিয়ার সব চাওয়া-পাওয়াকে তুচ্ছ মনে করে, হাসি-আনন্দকে বিসর্জন দিয়ে হৃদয়ে স্থান দিয়েছেন আখিরাতের বাসনা, আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্য মহা পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন। কুরআনে এসেছে, ‘আল্লাহ মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের জান্নাতের ওয়াদা দিয়েছেন, যার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হবে নহরসমূহ, তাতে তারা চিরদিন থাকবে এবং (ওয়াদা দিচ্ছেন) স্থায়ী জান্নাতে পবিত্র বাসস্থানসমূহের। আর আল্লাহর পক্ষ থেকে সন্তুষ্টি সবচেয়ে বড়। এটাই মহাসফলতা।’ (সূরা তওবা, ৭২)
দুনিয়ার জীবনটাই শেষ নয়। মৃত্যুর পর শুরু হবে অনন্ত জীবন। সেখানে সবার পাপপুণ্যের হিসাব নেয়া হবে এবং দেয়া হবে আমলের ভিত্তিতে ফলাফল। আখিরাতে মুমিনদের জন্য রয়েছে মহা শান্তির স্থান জান্নাত। আর পাপীদের জন্য রয়েছে জাহান্নাম। কুরআনে এসেছে, ‘কিয়ামাতের সংবাদ কি তোমার কাছে এসেছে? সেদিন অনেক চেহারা হবে অবনত। কর্মকান্ত, পরিশ্রান্ত। তারা প্রবেশ করবে জ্বলন্ত আগুনে।
তাদের পান করানো হবে ফুটন্ত ঝর্ণা থেকে। তাদের জন্য কাঁটাবিশিষ্ট গুল্ম ছাড়া কোনো খাদ্য থাকবে না। তা মোটাতাজাও করবে না এবং ক্ষুধাও নিবারণ করবে না। সেদিন অনেক চেহারা হবে লাবণ্যময়। নিজদের চেষ্টা সাধনায় সন্তুষ্ট। সুউচ্চ জান্নাতে। সেখানে তারা শুনবে না কোনো অসার বাক্য।’ [সূরা গাশিয়া, ১-১১] এমন জান্নাত প্রত্যাশাই হোক মুমিনের কাম্য।