ইসলামই মধ্যম পন্থা। যার মধ্যে বাড়াবাড়ি, চরম পন্থা, সীমা লঙ্ঘন, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা অনৈতিকতা ইত্যাদি নেতিবাচক কোন দিক নেই। এবং তা পছন্দও করে না। ইসলামী জীবনাদর্শ একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবনাদর্শ, যেখানে ধনী-গরীব, সাদা-কালো, নারী-পুরুষ, ছোট-বড় সকলের মর্যাদা অক্ষুন্ন রেখেছে। ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় রয়েছে, ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ, রয়েছে জাতি-গোষ্ঠীর মাঝে শান্তিপূর্ণ সহ—অবস্থান ও সম্প্রীতিপূর্ণ ব্যবহার। মধ্যম পন্থা অবলম্বর করা একজন প্রকৃত মুসলমানের চরিত্রের অনুপম বৈশিষ্ট। যেখানে নেই কঠোরতা ও গোঁড়ামি ও বাড়াবড়ির মত মারাত্মক ব্যাধি। রাসূল (সা.) এরশাদ করেন: ‘তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে অতিরঞ্জন করা থেকে দুরে থাকো। কারণ দ্বীনের ব্যাপারে অতিরঞ্জন তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেদের ধ্বংস করেছে।।’ (আহমাদঃ ১৮৫৪, ইবনে মাজাহ ৩০২৯ নং, হাকেম প্রমুখ)
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! ইসলাম এটি মধ্যম পন্থার জীবন ব্যবস্থার নাম। এই মর্মে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন:
وَكَذَٰلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا لِتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ وَيَكُونَ الرَّسُولُ عَلَيْكُمْ شَهِيدًا
অর্থাৎ: এমনিভাবে আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী সম্প্রদায় করেছি যাতে করে তোমরা সাক্ষ্যদাতা হও মানবমন্ডলীর জন্যে এবং যাতে রসূল সাক্ষ্যদাতা হন তোমাদের জন্য।
ইসলামই অন্যের মতের গুরুত্ব দিয়েছে, তাই অন্যের উপর কোন কিছু জোর জবরদস্তি বা বাধ্যতামূলক কোন আচরণ করার পক্ষকে প্রশ্রয় দেয় না। মহান আল্লাহ এরশাদ করেন: لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ ইসলামে কোনো জোর-জবরদস্তি ও কঠোরতা নেই।’ (সূরা আল-বাকারা: ২৫৬)
মানবসমাজে অশান্তির যাবতীয় পথ,বোমাবাজি, বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য, হানাহানি, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও জানমালের নিরাপত্তায় বিঘ্ন সৃষ্টি করার মতো ঘৃণ্যতম কাজকে ইসলাম অনুমোদন করে না। বিশৃঙ্খলা তৈরি, বাড়াবাড়ি করা, গোঁড়ামি প্রদর্শন, চরম পন্থা অবলম্বন মূলত বিভ্রান্তদের কারসাজি। সন্ত্রাস, বোমাবাজি ও চোরাগোপ্তা হামলা এবং রক্তপাত করে নিরপরাধ মানুষ হত্যার অপচেষ্টা কোনো পুণ্য কর্ম নয়। বরং যে ব্যক্তি-দল বা সংগঠন একজন নিরীহ মানুষ বা পথচারীকে হত্যা করবে, তার আমলনামায় জগতের সব নরহত্যার গুনাহ বা মহাপাপ লেখা হবে। কেননা, মানুষের জীবনের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আল্লাহর কালামে পাকে ঘোষিত হয়েছে,
مَنْ قَتَلَ نَفْسًا بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍ فِي الْأَرْضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيعًا وَمَنْ أَحْيَاهَا فَكَأَنَّمَا أَحْيَا النَّاسَ جَمِيعًا ۚ
‘নরহত্যা বা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি ছাড়া কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ার সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে হত্যা করল; আর কেউ কারও প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন পৃথিবীর সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে প্রাণে রক্ষা করল।’ (সূরা আল-মায়িদা: ৩২)
আল্লাহর রাসূল (সা.) বিদায় হজ্জের ভাষণে ঘোষণা করেছেন: নিশ্চয়ই তোমাদের রক্ত ও মাল-সম্পদ, তোমাদের পরস্পরের উপরে এমনভাবে হারাম, যেমনভাবে তোমাদের আজকের এই দিন, এই মাস, এই শহর তোমাদের জন্য হারাম’ (অর্থাৎ এর সম্মান বিনষ্ট করা হারাম)।
চরম পন্থা অবলম্বন ইসলামি আকিদা, বিশ্বাস ও চেতনার সম্পূর্ণ বিরোধী। প্রকৃতপক্ষে ইসলাম হলো মধ্যম পন্থার মানবতাবাদী ধর্ম ও ভারসাম্যপূর্ণ শান্তিময় জীবনব্যবস্থা। ইসলামের অভ্যুদয় থেকে ১৪০০ বছরের ইতিহাসে ইসলামের মূলধারার কোনো আন্দোলন তলোয়ারের মাধ্যমে পরিচালিত হয়নি; বরং ইসলামের আদর্শিক মহানুভবতা, ক্ষমা, উদারতা ও নৈতিক শক্তির মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী শান্তির ও সম্প্রীতির ধর্ম ইসলাম ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে। ইসলাম প্রচার ও প্রসারে কোমল ব্যবহারের দাবি রাখে। কঠোর অবস্থানে জোরপূর্বক দাবি আদায় বা ইসলামি আইন বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা দাওয়াতের মূল উদ্দেশ্যকে বিনষ্ট করে দেয়। তাই সাময়িক উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে চরম পন্থা গ্রহণ বা বাড়াবাড়ির অবকাশ ইসলামে নেই। যে ব্যক্তি বা দল-মত চরম পন্থা অবলম্বন করে, সে ব্যক্তি-দল বা গোষ্ঠী কখনোই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে না। নবী করিম (সা.) বলেছেন, من يحرم الرفق يحرم الخير كله
‘যে ব্যক্তি কোমল ব্যবহার থেকে বঞ্চিত, সে কল্যাণ থেকে সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত।সহীহ আল-জামে : ৬৬০৬
يا عائشة ! إن الله رفيق يحب الرفق . ويعطي على الرفق ما لا يعطي على العنف . وما لا يعطي على ما سواه
হে আয়েশা! আল্লাহ কোমল ব্যবহারকারী, তিনি কোমলতা ভালোবাসেন, আর কোমলতার ফলে আল্লাহ তাআলা এমন কিছু দান করেন, যা চরম পন্থা অবলম্বনকারীকে দান করেন না।’ (মুসলিম: ২৫৯৩)
রাসূল তাঁর অনুপম আদর্শ চরিত্র মাধুরি প্রচারের মাধ্যমে বিশ্বময় শান্তি প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাই সন্ত্রাস, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, রক্তপাত ও সংঘাত, ইত্যাদি ইসলাম কখনই পছন্দ বা অনুমোদন করেনি। এখন সমাজে যা চলছে, ইসলামকে প্রকৃতভাবে না বোঝার কারণে অনেকে করছে। সঠিক অর্থে ইসলাম বুঝলে তারা এমন চরম পন্থা গ্রহণ করতো না।
তবুও সারা পৃথিবীময় চলছে চরম পন্থা, প্রতিনিয়ত প্রাণ হারাচ্ছে নিরীহ মানুষ। তাই পৃথিবীর প্রয়োজনে পারস্পরিক সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে ইসলামের শান্তিপূর্ণ ও কল্যাণধর্মী জীবনাদর্শ এখন সময়ের দাবি। ইসলামে চরম পন্থা, জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসবাদের কোনো স্থান নেই।
রাসূলুল্লাহ (সা.) কখনো একজন মানুষকে গুপ্তহত্যা করেননি; কারও বিরুদ্ধে কঠোরতা, বাড়াবাড়ি বা চরম পন্থার আশ্রয় নেননি। নবী করিম (সা.) সাবধান বাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘তোমরা কখনো আগে অস্ত্র উত্তোলন করো না বা অস্ত্রের ভয়ভীতিও প্রদর্শন করো না।’ হাদীসে আছে, ‘দুনিয়া ধ্বংস করে দেওয়ার চেয়েও আল্লাহর কাছে ঘৃণিত কাজ হলো মানুষ হত্যা করা।’ (তিরমিযী) পারস্পরিক দয়া, কোমলতা, সরলতা, প্রীতিপূর্ণ ব্যবহার, উত্তম আদর্শ,সুমধুর বাক্যালাপ ছিল মহানবী (সা.)-এর ইসলাম প্রচারের মূল হাতিয়ার। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, নবী করিম (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘আমাকে সরল পন্থা অবলম্বন করার জন্য পাঠানো হয়েছে, চরম পন্থা অবলম্বনের জন্য নয়।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘সহজ, সরল পন্থা অবলম্বন করবে, কঠোরতা প্রদর্শন করবে না। সুসংবাদ দাও, ঘৃণা ছড়িয়ো না।’ (বুখারি)
বর্তমান বিভিন্ন পর্যায়ে সভ্য সমাজে যেভাবে ফিতনা-ফ্যাসাদ ও সন্ত্রাসবাদ চলছে, সর্বস্তরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে, এতে যেমন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম ব্যাঘাত হয়, তেমনি সামাজিক কর্মকাণ্ডে দারুণভাবে ব্যাঘাত ঘটছে। অথচ উগ্রবাদী, বিপ্লবী ও চরমপন্থীরা বিভিন্ন দেশে নানা ধরনের সন্ত্রাস, বোমাবাজি, চোরাগোপ্তা হামলাসহ ইসলামবিরোধী মানবতাবিবর্জিত ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। চরম পন্থা অবলম্বন বা কঠোরতা প্রদর্শন ইসলামের জন্য শুধু ক্ষতিকর নয়, বরং এটা মানুষের মধ্যে ঘৃণা-বিদ্বেষ ও সহিংসতা সৃষ্টি করে ইসলামের শান্তির পথকে রুদ্ধ করে দেয়। এ জন্য জোর-জবরদস্তি ও চরম পন্থাকে সম্পূর্ণরূপে পরিহার করা এবং ফিতনা-ফ্যাসাদ প্রতিরোধে সাধ্যমতো সমঝোতার প্রচেষ্টা তথা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, আন্তধর্মীয় সংলাপ, কথা ও কলমের জিহাদ অব্যাহত রাখতে হবে। কেননা, সমাজে ফিতনা-ফ্যাসাদ, বিপর্যয়, নিরাপত্তাহীনতা ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করাকে হত্যার চেয়েও মহাপাপ সাব্যস্ত করে বলা হয়েছে, وَالۡفِتۡنَةُ اَشَدُّ مِنَ الۡقَتۡلِۚ ‘ফিতনা, হত্যা অপেক্ষা গুরুতর।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৯১)
ইসলামে চরম পন্থাকে কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও নবী করিম (সা.)-এর ঘনিষ্ঠ সাহাবি এবং ইসলামের তিনজন বিশিষ্ট খলিফার কাউকে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত অবস্থায়,কাউকে মসজিদের মধ্যে চরমপন্থী আততায়ীরা নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের আলেমসমাজ, ধর্মীয় নেতা, মাদ্রাসার শিক্ষক, মসজিদের ইমাম ও খতিবদের উদ্ভূত সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও চরমপন্থী বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে তাঁদের সোচ্চার প্রতিবাদ ও শান্তিপূর্ণ বলিষ্ঠ অবস্থান রেখে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা ও শান্তিপূর্ণ সমঝোতায় জনগণকে সম্পৃক্তকরণের মাধ্যমে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা সমাধানের একটি সহজ পথ। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম ধর্মপ্রাণ মানুষকে চরম পন্থা প্রতিরোধে সজাগ-সচেতন থাকার আহ্বান জানিয়ে শান্তির সপক্ষে মধ্যম পন্থা অবলম্বনের ব্যাপক প্রচারণামূলক জাতীয় ঐক্য ও সংলাপের কর্মসূচি হাতে নিয়ে অসাধারণ ভূমিকা রাখতে পারে।
সঙ্গে সঙ্গে ইসলামের শত্রুরা যেন চরম পন্থা, নৈরাজ্য, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে, আমাদের ইসলাম বা মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দিতে না পারে, সেদিকেও মুসলমানদের সজাগ থাকতে হবে। আল্লাহ আমাদের সকলকে সঠিকভাবে ইসলাম বুঝার তাওফীক দান করুন। আমীন