হজরত ইব্রাহিম আ:-এর মহান উত্তাধিকারী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর প্রধান কতর্ব্য ছিল খাঁটি তাওহিদকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং কাবাগৃহকে অপবিত্রতা থেকে মুক্ত করা।অষ্টম হিজরির ১০ রমজান নবীকুল শিরোমণি হজরত মুহাম্মদ সা: ১০ হাজার সৈন্যসহ মক্কা অভিমুখে রওনা হলেন। পথিমধ্যে আরব গোত্রগুলো এসে রাসূল সা:-এর সেনাদলে মিলিত হতে লাগল। মাররুজ জাহ্রান নামক স’ানে শিবির স’াপন করা হলো। সৈন্যরা বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ল। এ স’ানটি ছিল মক্কা মোকাররমা থেকে এক মঞ্জিল অথবা তার চেয়েও কম দূরত্বে অবিস’ত।
রাসূল সা:-এর নির্দেশে সৈন্যরা আলাদা আলাদাভাবে আগুন জ্বালালেন। তাতে সমগ্র মরুভূমি আলোয় ঝলমল করে উঠল। সৈন্য আগমনের মৃদু আওয়াজ কোরাইশদের কানে ইতোমধ্যেই পৌঁছেছিল। সঠিক খবর অনুসন্ধানের জন্য তারা হজরত খাদিজা রা:-এর ভ্রাতুষ্পুত্র হাকিম ইবনে হিজাম, আবু সুফিয়ান ও বুদাইল ইবনে ওয়ারাকাকে পাঠালেন।
আবু সুফিয়ানের ইতঃপূর্বেকার সব কৃতকর্ম সবার সামনে দিবালোকের মতো স্পষ্ট। তার অতীতের প্রত্যেকটি কর্মই তাকে হত্যার দাবিদার। ইসলামের সাথে শত্রুতা, মদিনা আক্রমণ, আরব গোত্রগুলোকে উসকানি দেয়া, রাসূল সা: কে গোপনে হত্যার চক্রান্ত ইত্যাদির প্রত্যেকটিই তার খুনের মূল্য হতে পারে। কিন’ এসবের ঊর্ধ্বে ছিল রাসূলুল্লাহ সা:-এর দয়ার্দ্র হৃদয় ও ক্ষমাশীল মন। তিনি আবু সুফিয়ানের কানের কাছে মুখ নিয়ে অনুচ্চস্বরে বললেন, ‘এটা ভয়ের স’ান নয়’।
নবী করিম সা: ক্ষমা, শান্তি ও নিরাপত্তার বৃত্ত এই দিন প্রসারিত করে দেন। ফলে মক্কার লোকদের মধ্যে কেবল সেসব লোকই ধ্বংস হতে পারত যারা নিজেরাই শান্তি ও নিরাপত্তা পেতে ইচ্ছুক কিংবা আগ্রহী নয় এবং নিজের জীবনের প্রতি যারা হতাশ কিংবা বীতশ্রদ্ধ হয়ে গেছে। তিনি ঘোষণা দেন : ‘যে আবু সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ, যে নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে অবস’ান করবে সে-ও নিরাপদ, আর মসজিদুল হারামে যে প্রবেশ করবে সে-ও নিরাপত্তা লাভ করবে।’ রাসূলুল্লাহ সা: সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন, মক্কায় প্রবেশকালে কেবল তাদের ওপর হাত তোলা জায়েজ যারা তাদের পথে বাধা সৃষ্টি করবে কিংবা তাদের মোকাবেলায় দাঁড়াবে। তিনি এ-ও নির্দেশ দিয়েছিলেন, মক্কার লোকদের সহায়-সম্পদের ব্যাপারে সংযম প্রদর্শন করতে হবে, এ বিষয়ে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করা যাবে না।
নবী করিম সা: এমন বেশে মক্কায় প্রবেশ করেন যখন তার মস্তক মোবারক আল্লাহর প্রতি দাসত্বসুলভ, ভয় ও বিনয়ের আধিক্যে একেবারে ঝুঁকে পড়েছিল। মনে হচ্ছিল, নবী করিম সা:-এর থুতনি উটনীর পিঠের কুঁজ স্পর্শ করবে। এ সময় তিনি কুরআন শরিফের সূরা ফাত্হ তিলাওয়াত করছিলেন।
বিজয়ের এই দিনে জনৈক ব্যক্তি নবী করিম সা:-এর সাথে কথা বলতে গিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তিনি তার এই অবস’া অনুভব করে তাকে অভয় প্রদান করেন এবং বলেন, ভয় পেয়ো না, শান্ত হও। আমি কোনো বাদশাহ নই। আমি এমন এক কুরাইশ মহিলার সন্তান যিনি শুকনো গোশত ভক্ষণ করতেন।
এ দিন আনসারদের পতাকা ছিল তাদের অধিনায়ক হজরত সা’দ ইবন উবাদা রা:-এর হাতে। অপর দিকে তিনি ছিলেন খায়রাজ গোত্রের সর্দার। তিনি সে সময় আবু সুফিয়ানের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। আবু সুফিয়ানের দিকে নজর পড়তেই বলে ওঠেন, ‘আজ ঘোরতর যুদ্ধের দিন, প্রবল শোণিতপাতের দিন। আজ কা’বা শরীফ প্রাঙ্গণে সব কিছুই অনুমোদিত ও বৈধ বিবেচতি হবে। আল্লাহ তায়ালা আজ কুরাইশদের অবনমিত করেছেন।’ অতঃপর রাসূলুল্লাহ সা: তাঁর বাহিনীর মধ্যে আবু সুফিয়ানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় আবু সুফিয়ান রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে হজরত সা’দ ইবন উবাদা রা:-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করলেন এই বলে, ইয়া রাসূলুল্লাহ্। এই মাত্র সা’দ কী বলল তা কি আপনি শুনেছেন? রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, কী বলল সা’দ? এ কথা শুনতেই তিনি সা’দ রা:-এর কথার পুনরাবৃত্তি করলেন। নবী করিম সা: সা’দ-এর কথা খুবই অপছন্দ করলেন এবং বললেন, ‘না, আজ ক্ষমা ও করুণা প্রদর্শনের দিন। আল্লাহ তায়ালা আজ কুরাইশদেরকে সম্মানিত করবেন এবং কা’বার মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন।রাসূলুল্লাহ সা: যখন মক্কায় আপন জায়গায় পৌঁছে গেলেন এবং লোকেরাও নিশ্চিত হয়ে গেল তখন তিনি বাইরে তাশরিফ নিলেন এবং রায়তুল্লাহর দিকে রওনা হলেন। সেখানে গিয়ে বায়তুল্লাহ শরীফ তাওয়াফ করলেন এবং এসময় তাঁর পবিত্র হাতে একটি ধনুক ছিল। কা’বার ভেতর সে সময় ৩৬০টি মুর্তি ছিল। তিনি ধনুকের সাহায্যে মূর্তিগুলোকে খোঁচা দিচ্ছিলেন এবং বলছিলেন, ‘সত্য সমাগত আর মিথ্যা দূরীভূত; মিথ্যা তো দূরীভুত হওয়ার জন্যই তিনি কা’বার দেয়ালগাত্রে কিছু ছবি লটকানো দেখতে পান যেগুলো তাঁরই নির্দেশে নামিয়ে ফেলা হয় এবং দূরে নিক্ষেপ করা হয়।
(সমাপ্ত)