আরবি তাহাজ্জুদ ,শব্দের আভিধানিক অর্থ রাত জাগরণ বা নিদ্রা ত্যাগ করে রাতে নামায পড়া। শরিয়তের পরিভাষায় রাত দ্বিপ্রহরের পর ঘুম থেকে জেগে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যে নামায আদায় করা হয় তা-ই তাহাজ্জুদ নামায।
পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরজ হওয়ার আগে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর তাহাজ্জুদ নামায বাধ্যতামূলক ছিল। তাই তিনি জীবনে কখনো তাহাজ্জুদ নামায পড়া থেকে বিরত হননি। তবে উম্মতে মুহাম্মদির জন্য এটা সুন্নতে গায়রে মুয়াক্কাদা অর্থাৎ এ নামায আদায় করলে অশেষ পুণ্য লাভ করা যায়,কিন্তু আদায় করতে না পারলে কোনো গুনাহ হবে না।
আর রাতের তাহাজ্জুদ নামায হলো আম্বিয়া আলাইহিস সালামদের সুন্নাত,তাহাজ্জুদ নামায মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে বান্দার গভীর সম্পর্ক স্থাপন তথা নৈকট্য ও সন্তোষ অর্জনের অন্যতম পন্থা। তাহাজ্জুদের ফজিলত প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন,
﴿وَمِنَ اللَّيْلِ فَتَهَجَّدْ بِهِ نَافِلَةً لَّكَ عَسَىٰ أَن يَبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا مَّحْمُودًا﴾
আর রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ নামায কায়েম করুন; এটা আপনার জন্য এক অতিরিক্ত কর্তব্য। আশা করা যায়, আপনার প্রতিপালক আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন মাকামে মাহমুদে । (সূরা বনি ইসরাইল : ৭৯)। তিনি আরও বলেন,
*تَتَجَافَىٰ جُنُوبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ خَوْفًا وَطَمَعًا وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ*
তারা শয্যা ত্যাগ করে আকাঙ্ক্ষা ও আশঙ্কার সঙ্গে তাদের প্রতিপালককে ডাকে এবং আমি তাদের যে রুজি প্রদান করেছি,তা থেকে তারা দান করে। (সূরা সিজদা : ১৬)। তাহাজ্জুদ নামায নফসের রিয়াজাত ও তারবিয়াতের এক বিশেষ মাধ্যম। কারণ প্রভুর প্রেমে গভীর রাতে সুখশয্যা ত্যাগ করেই আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হতে হয়। এ নামায মন ও চরিত্রকে নির্মল ও পবিত্র করা এবং সত্য পথে অবিচল রাখার জন্য অপরিহার্য ও অতীব কার্যকর পন্থা। পবিত্র কোরআনের – সূরা মুজ্জাম্মিলে এর উল্লেখ করা হয়েছে
* إِنَّ نَاشِئَةَ اللَّيْلِ هِيَ أَشَدُّ وَطْئًا وَأَقْوَمُ قِيلًا *
,নিশ্চয়ই রাতে ঘুম থেকে ওঠা মনকে দমিত করার জন্য খুব বেশি কার্যকর এবং সে সময়ের কোরআন পাঠ বা জিকির একেবারে যথার্থ। (সূরা মুজাম্মিল : ৬। ) অন্যত্র বলা হয়েছে,* وَالَّذِينَ يَبِيتُونَ لِرَبِّهِمْ سُجَّدًا وَقِيَامًا*
আর আল্লাহর প্রিয় বান্দা তারা,যারা তাদের রবের দরবারে সিজদা করে এবং দাঁড়িয়ে থেকেই রাত কাটিয়ে দেয়। (সূরা ফুরকান : ৬৪)। ইসলামের প্রাথমিক যুগে কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়ী হওয়ার পেছনে মূল ভূমিকা ছিল যে তারা রাতের শেষ ভাগে আল্লাহ দরবারে চোখের পানি ফেলতেন আর ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। যেমন কোরআনে বলা হয়েছে,
* الصَّابِرِينَ وَالصَّادِقِينَ وَالْقَانِتِينَ وَالْمُنفِقِينَ وَالْمُسْتَغْفِرِينَ بِالْأَسْحَارِ*
তারা ছিল কঠিন পরীক্ষায় পরম ধৈর্যশীল,অটল-অবিচল,সত্যের অনুসারী,পরম অনুগত। আল্লাহর পথে ধন-সম্পদ উৎসর্গকারী এবং রাতের শেষ প্রহরে আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। (সূরা আলে ইমরান : ১৭)। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিসেও তাহাজ্জুদ নামাজের গুরুত্বের কথা উল্লেখ রয়েছে।,আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন আমি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি أَفْضَلُ الصَّلَاةِ بَعْدَ الْفَرِيضَةِ صَلَاةُ اللَّيْلِ- رواه مسلم *,
অর্থাৎ ফরজ নামাজের পর সবচেয়ে উত্তম নামায হলো তাহাজ্জুদের নামায।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত অন্য এক হাদিসে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন
عن أبي هريرة رضي الله عنه ، أن النبي صلى الله عليه وسلم قال: ” ينزل رَبُّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا حِينَ يَبْقَى ثُلُثُ اللَّيْلِ الآخِرُ يَقُولُ مَنْ يَدْعُونِي فَأَسْتَجِيبَ لَهُ مَنْ يَسْأَلُنِي فَأُعْطِيَهُ مَنْ يَسْتَغْفِرُنِي فَأَغْفِرَ لَهُ”أخرجه البخاري في صحيحه (1145) ومسلم (1261
,আল্লাহতায়ালা প্রতি রাতেই নিকটবর্তী আসমানে অবতীর্ণ হন যখন রাতের শেষ তৃতীয় ভাগ অবশিষ্ট থাকে। তিনি তখন বলতে থাকেন কে আছো যে আমায় ডাকবে,আর আমি তার ডাকে সাড়া দেব? কে আছো যে আমার কাছে কিছু চাইবে, আর আমি তাকে তা দান করব?কে আছো যে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে আর আমি তাকে ক্ষমা করব?(বুখারি ও মুসলিম)। শরহে সুন্নাহর বরাত দিয়ে মিশকাতুল মাসাবিহ গ্রন্থকার বর্ণনা করেন,হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত,রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,তিন ব্যক্তির প্রতি আল্লাহ খুশি হন।
এক- যে ব্যক্তি তাহাজ্জুদের জন্য ওঠে এবং নামায পড়ে। দুই- মুসল্লি যারা নামাজের জন্য সারিবদ্ধভাবে কাতারে দাঁড়ায়।তিন- মুজাহিদ যারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করার জন্য সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ায়। অনুরূপ আরেকটি হাদিস রয়েছে,হজরত জাবির (রা.) বলেন,আমি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি। রাতের মধ্যে এমন একটি মুহূর্ত আছে যদি কোনো মুসলমান তা লাভ করে এবং আল্লাহর কাছে ইহ ও পরকালের কোনো কল্যাণ চায় আল্লাহ নিশ্চয়ই তাকে তা দেন। (মুসলিম)। আসুন,আমরা তাহাজ্জুদ নামাজের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার অধিক থেকে অধিকতর নৈকট্য লাভ করি।