সম্মানিত মুসাল্লিয়ানে কেরাম! আজকের খুতবায় আমরা আলোচনা করবো বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ছিলেন “বিশ্বশান্তির অগ্রদূত হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম” এই বিষয়ের উপর। মহান আল্লাহ বলছেন: وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ অর্থাৎ আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্যে রহমত স্বরূপই প্রেরণ করেছি।
তিনি উম্মতের জন্য দয়াবান ছিলেন: তিনি উম্মতের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে সিজদায় গিয়ে কেঁদে কেঁদে বলতেন:
إِن تُعَذِّبْهُمْ فَإِنَّهُمْ عِبَادُكَ ۖ وَإِن تَغْفِرْ لَهُمْ فَإِنَّكَ أَنتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ ﴿١١٨
যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি দেন, তবে তারা আপনার দাস এবং যদি আপনি তাদেরকে ক্ষমা করেন, তবে আপনিই পরাক্রান্ত, মহাবিজ্ঞ। (সূরা আম্বিয়া: ১১৮)
উক্ত আয়াতটি তেলাওয়াত করে করে রাত কাটিয়ে দিয়েছেন। আরামের ঘুমকে হারাম করে উম্মতের নাজাতের জন্য তিনি রাতভর আল্লাহ সমিপে সিজদায় পড়ে থাকতেন।
মহান রাব্বুল আলামীনের প্রিয় বন্ধু রাসূলে কারীম (সা.)-কে তিনি পৃথিবীর বুকে শান্তি ও দয়ার দরিয়া হিসেবে প্রেরণ করেছেন। আজকের খতুবায় রাসূলে কারীম (সা.)-এর দয়ার সমুদ্র হতে কিঞ্চিত উদাহরণ আলোচনা করা হবে:
রাসূলে কারীম (সা.) ছিলেন, বিশ্বশান্তির অগ্রদূত, এবং সারা পৃথিবীর সৃষ্টি জীবের জন্য রহমত। তাঁর পবিত্র অস্তিত্ব, স্বভাব-প্রকৃতি, আচার-আচরণ সব কিছুই ছিল সেই অফুরন্ত রহমতের অনন্য ধারায় সিক্ত। তিনি মানুষের জন্য যে পূর্ণাঙ্গ দ্বীন নিয়ে এসেছিলেন, তার প্রতিটি পরতে পরতে সর্বক্ষেত্রে সুপ্রবাহিত হয়েছে অনন্ত রহমতের বারিধারা। পৃথিবীর সর্বস্তরের মানুষের ব্যক্তি জীবনের সীমিত গন্ডি থেকে আরম্ভ করে পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক জীবনের পরিব্যপ্তিতেও উপচে পড়েছে রহমত ও দয়ার সিঞ্চিত ধারা। তাঁর রহমত ও দয়ার হতে বাদ পড়েনি চতুষ্পদ জন্তুও।
সৃষ্টিকুলের এমন অঙ্গন নেই যেখানে প্রবাহিত হয়নি তাঁর রহমতের ফল্গুধারা, স্থাপিত হয়নি তাঁর দয়ার নিদর্শন। মহাকাশ স্বাক্ষী,পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব আখেরী নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত এমন কোন সত্তাকে পৃথিবী দেখেনি, যার জীবন স্রোতের প্রতিটি বিন্দু সমগ্র জগতবাসীর জন্য বয়ে আনে রাশি রাশি রহমত ও দয়ার বারিধারা। এ প্রসঙ্গে স্বয়ং আহকামুল হাকেমীন পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন:
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِّلْعَالَمِينَ ﴿١٠٧
“আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি। (সূরা আম্বিয়া: ১০৭)
এখন রাহমাতুল্লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রহমত ও মহানুভবতা সংক্রান্ত কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা হবে:
১। হিজরী অষ্টম সাল। প্রিয় মাতৃভূমি মক্কা বিজয়ের আনন্দ সবার মনে। যারা দীর্ঘদিন ছিল এ মাতৃভূমি থেকে অনেক দূরে। যেতে হয়ে ছিল মদীনায় মক্কার কাফেরদের নির্যাতনের কারণে। নির্যাতনকারীদের অন্যতম একজন ছিল হাব্বার বিন আসওয়াদ। সে রাসূলে কারীম (সা.)-কে অনেক কষ্ট দিয়েছে। বিশেষত রাসূল (সা.) এর কলিজার টুকরা হযরত যয়নব (রা.)-কে যে কষ্ট দিয়েছে তা বর্ণনাতীত।
কাফিরদের অত্যাচারে অন্যান্য মুসলমানদের মত হযরত যয়নব (রা.)ও হিজরত করে মক্কা থেকে মদীনায় যাত্র শুরু করেন। তখন হাব্বার বিন আসওয়াদ তাকে উট থেকে ফেলে দিয়ে প্রহার করেছিল। তাছাড়া অন্যান্য মুসলমানরাও তার নির্যাতনের হাত থেকে মুক্তি পায় নি। যখন মক্কা বিজয় হয় তখন তার নাম চিহ্নিত অপরাধীদের মধ্যে ছিল। রাসূলে আকরাম (সা.) এর পক্ষ থেকে এ নোটিশ জারী ছিল যে, তাকে যেখানেই পাওয়া যাবে সেখানেই হত্যা করা হবে।
হাব্বার বিন আওয়াদ মক্কার অবস্থা বিবেচনা করে পালিয়ে ইরানে যাওয়ার পরিকল্পনা করল এবং যারপরনাই চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। পরিশেষে বাধ্য হয়ে কোন মতে আত্মরক্ষা করে সোজা আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর পবিত্র দরবারে চলে এল। এসে সবিনয় আবেদন করল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি পালিয়ে ইরানে চলে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আপনার নম্রতা ও দয়ার প্রতিচ্ছবি সামনে আসায় পলায়ন ও দূরে থাকার ইচ্ছা পরিত্যাগ করেছি। আপনার নিকট আমার যে সকল অপরাধ ও অসঙ্গত কার্যকলাপের খবর এসেছে এবং আমার ভুল-ত্রুটির যে সংবাদ পৌঁছেছে তা বাস্তবিক সত্য ও যথার্ত। প্রকৃত পক্ষেই আমি দোষী এবং অপরাধী। আমি নিজের অপরাধ স্বীকার করছি। তবে এখন আমি আপনার নিকট ক্ষমাপ্রার্থী। এখন আমার জন্য কি নির্দেশ? তার কথা শ্রবণ করে তাকে ক্ষমা করে দিলেন। রাসূল (সা.)-এর এমন উন্নত চরিত্র দেখে সে সাথে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে জান্নাতী মানুষদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।
২। মক্কা বিজয়ের পর রাসূলে কারীম (সা.) যখন তায়েফ আবরোধ করে ছিলেন,তখনকার ঘটনা: রাসূলে কারীম (সা.) ও সাহাবায়ে কিরাম (রা.) তায়েফ ফিরে আসছেন। তখন হঠাৎ রাসূলুল্লাহ (সা.) এর উটনীর সাথে সাহাবী হযরত আবু রেহেম গেফারী (রা.)-এর উটনীর টক্কর লেগে গেলো। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পায়ে বেশ ব্যথা পেলেন। তাই তিনি চাবুক দিয়ে সাহাবীর পায়ে মৃদু আঘাত করে বললেন,পা সরাও আমার কষ্ট হচ্ছে। সাহাবী হযরত আবু রেহেম তো ভয়ে ব্যাকুল। আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দিলাম, মারাত্মক বে-আদবী হয়ে গেলো। এখন যদি আল্লাহ তায়ালার শাস্তি নেমে আসে!
কাফেলা যখন গন্তব্যে এসে থামলো, তখন সাহাবী আবু রেহেম উট চড়াতে মাঠে গেলেন, কিন্তু হৃদয় মাঝে ভয় লেগেই আছে। ফিরে এসে শুনলেন রাসূল (সা.) তাকে খোঁজ করছেন। ভায়ে ভয়ে তিনি নবীজী (সা.)-এর দরবারে উপস্থিত হলেন, কিন্তু কি অবাক ঘটনা! নবীজী (সা.) হেসে বললেন, আবু রেহেম! তখন তোমার অবশ্যই কষ্ট হয়েছে, এই বকরীগুলো নাও সেই কষ্টের পুরস্কার হিসেবে।
সাহাবী আবু রেহেম খুশিতে আত্মহারা। নবীজী (সা.) অসন্তুষ্ট হননি,তার সঙ্গে হেসে কথা বলছেন। এটাই তো তার পুরস্কার। তিনি আল্লাহ তায়ালার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলেন এবং বকরী নিয়ে ফিরে এলেন।
৩। ইয়াহুদী থেকে করয নেওয়ার ঘটনা: একবার এক গোত্রে অভাব অনটন দেখা দিল। তাদের সাহায্য করার জন্য রাসূল (সা.) এক ইয়াহুদী থেকে কিছু করয নিলেন। করয পরিশোধের তিন দিন পূর্বেই নবীজী (সা.) এর চাদর টেনে ধরে ইয়াহুদী লোকটি রূঢ় ভাষায় বলতে লাগলো হে মুহাম্মাদ! আমার করয পরিশোধ করছো না কেন? আসলে তোমরা আব্দুল মুত্তলিবের গোষ্ঠী, মানুষের হক মেরে খাওয়াই তোমাদের অভ্যাস।
আল্লাহ তায়ালার প্রিয় হাবীবের শানে এমন বে-আদবী! হযরত ওমর (রা.) রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে ইয়াহুদীকে কঠিন ধমক দিলেন। কিন্তু রহমতের দরিয়া রাসূল (সা.) কিছুই বললেন না, বরং ওমর (রা.)-কে শান্ত করে উপদেশ দিয়ে বললেন, ওমর! তাকে রাগ করা তোমার ঠিক হলো না। তুমি তাকে বুঝিয়ে বলতে, যেন সে সাবলীল ভাষায় তাগাদা করে, আর আমাকে বলতে যেন তাড়াতাড়ি করয পরিশোধ করে দেই। এটাই না ভালো হতো। এরপর তিনি ইয়াহুদীকে বললেন,ভাই! এখনো তিন দিন বাকি। চিন্তা করো না আজই তোমার করয পরিশোধ করে দিবো। ইনশা আল্লাহ,
ওমর (রা.) কে বললেন, হে ওমর! যাও তার পাওনা পরিশোধ করে দাও। আর তাকে যে ধমক দিয়েছো, সে জন্য বিশ সা‘ খেজুর বেশি দিয়ে দাও। ইয়াহুদীর নাম ছিলো যায়েদ বিন ছানা। তিনি মদীনার ইয়াহুদীদের বড় আলেম ছিলেন। রাসূলে কারীম (সা.)-এর এ ধরণের কোমল ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি তাওরাত কিতাবে শেষ নবীর যেসব নিদর্শনাবলী পড়েছি তা সবই আপনার মাঝে পেয়েছি। শুধু বাকি ছিলো, আপনার সহনশীলতা পরীক্ষা করা। তাই ইচ্ছা করেই আপনার সাথে এমন ব্যবহার করেছি। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি আল্লাহ তায়ালার সত্য নবী। নবীজী (সা.) এর সহনশীলতায় মুগ্ধ হয়ে ইয়াহুদী আলেম মুসলমান হয়ে গেলেন।
৪। ইয়ামামার গভর্ণর হযরত সুমামা এর ঘটনা: মক্কার মুশরিকরা নবীজী (সা.) ও তাঁর সাহাবীগণকে যে কি নির্যাতন করেছে,কত কষ্ট দিয়েছে তা সকলের জানা। সে যুগে মক্কায় সকল প্রকার খাদ্য সরবরাহের প্রধান কেন্দ্র ছিলো ইয়ামামা। ওখানকার খাদ্য দিয়েই মক্কাবাসীরা নিজেদের জীবিকার কাজ আঞ্জাম দিতো। কিন্তু ইয়ামামার গভর্ণর হযরত সুমামা (রা.)-কে আল্লাহ তায়ালা ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় দিলেন। ইসলাম গ্রহণের পর দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, মক্কার বেইমান মুশরিকরা- যারা আমার প্রিয় নবী ও তাঁর অনুগতদেরকে কষ্ট দেয় ও নির্যাতন করে, ইয়ামামা থেকে তাদের জন্য একটি শষ্যকণাও প্রেরণ করা হবে না।
সুমামা (রা.)-এর নির্দেশের সাথে সাথে মক্কার মাঝে খাদ্যাভাব দেখা দিলো। মানুষের মাঝে হাহাকার শুরু হয়ে গেলো। শিশু-কিশোর, যুবক-বৃদ্ধ সকলের হাহাকার আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠলো। মক্কার মুশরিকদের এহেন করুণ অবস্থা রহমতের দরিয়া রাহমাতুল্লিল আলামীন মেনে নিতে পারলেন না। তৎক্ষণাত হযরত সুমামার প্রতি নির্দেশ দিয়ে পাঠালেন, যাতে মক্কার মুশরিকদের থেকে খাদ্য প্রেরণের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়।
উল্লেখিত ঘটনাগুলো ছাড়াও আরো অসংখ্য এমন ঘটনা রয়েছে, যেগুলো দ্বারা রহমতের দয়িরা রাসূলে কারীম (সা.)-এর উপমাহীন দয়া ও অনুগ্রহের প্রমাণ পাওয়া যায়।
৫। তাফের ঘটনা: নবীজী (সা.) তায়েফে যখন ইসলামের দাওয়াত নিয়ে গেছেন, তখন দুষ্ট তায়েফবাসী নবীজী (সা.)-কে বিদ্রূপ করেছে, পাথর মেরে রক্তাক্ত করেছে। রক্তে জুতা মুবারক পায়ের সাথে লেগে গেছে। পাহাড় নিয়ন্ত্রণাধীন ফিরিশতা তায়েফবাসীকে দুই পাহাড়ের মাঝে রেখে পিষে ফেলার অনুমতি প্রার্থনা করছেন। কিন্তু দয়ার দরিয়া রউফুর রাহীম রাসূলে কারীম (সা.) তাদেরকে ধ্বংসের অনুমতি তো দূরের কথা, তাদের বিরুদ্ধে বদদোয়া পর্যন্ত করেননি বরং তাদের হিদায়াতের জন্য দোয়া করেছেন।
اللهم اغْفِرْ لِقَوْمِي فَإِنَّهُمْ لَا يَعْلَمُونَ
তিনি শুধু মানবজাতির জন্যই দয়ালু ছিলেন না বরং সকল জীবজন্তুর জন্যও দয়ালু ছিলেন:
ইমাম আহমাদ ও তাবারানীতে রহ. বর্ণিত বিশুদ্ধ সনদে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদা মিম্বরে দাঁড়ানো অবস্থায় বলেন:
اِرْحَمُوْا تُرْحَمُوْا وَاغْفِرُوا يُغْفَرُ لَكُمْ
‘তোমরা দয়া করো, দয়া পাবে। ক্ষমা করো, ক্ষমা পাবে’ (আহমদ)।
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. থেকে বর্ণিত এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
الرَّاحِمُوْنَ يَرْحَمُهُمُ الرَّحْمَنُ تَبَارَكَ وَتَعَالَىْ : اِرْحَمُوْا مَنْ فِيْ الْأَرْضِ يَرْحَمْكُمْ مَنْ فِيْ السَّمَاءِ
রহমকারীদের প্রতি মহান দয়াময় আল্লাহ রহম ও দয়া করেন। দুনিয়াতে যারা আছে তাদের প্রতি তোমরা দয়া করো, তাহলে আসমানে যিনি আছেন, তিনি তোমাদের রহম করবেন’ (আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযী ও হাকেম)।
জারীর ইবনে আবদুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, সহীহ মুসলিমে এসেছে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
مَنْ لَا يَرْحَمِ النَّاسَ لَا يَرْحَمْهُ اللهُ عَزَّ وَجلَّ
‘যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি রহম করে না আল্লাহ তাআলা তার প্রতি রহম করেন না’ (মুসলিম)।
শুধু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথাই নয়। আল্লাহ তাআলা রাসূলের সাহাবীদেরও প্রশংসা করেছেন পরস্পরে রহম বা দয়া চর্চাকারী বলে। ইরশাদ হয়েছে :
مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ
‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল এবং তার সাথে যারা আছে তারা কাফিরদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর পরস্পরের প্রতি সদয়’ (সূরা আল ফাতহ : ২৯)।
এভাবেই তিনি তাঁর বান্দাদের প্রতি রহম,দয়া,মায়া,অনুগ্রহ করেছেন। তাই আমাদেরও উচিত এই রহমতের গুণে নিজদেরকে গুণান্বিত করে তোলা। সহীহ বুখারীতে আনাস ইবনে মালেক রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
يَسِّرُوْا وَلَا تُعَسِّرُوْا، وَبَشِّرُوا وَلَا تُنَفِّرُوا
‘তোমরা সহজ করো,কঠিন করো না। সুসংবাদ দাও,ঘৃণা সৃষ্টি করো না’ (বুখারী)।
এক গ্রাম্য বেদুইন যখন মসজিদে পেশাব করেছিল, তখন তাকে ক্ষমা করে দিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন :
(إِنَّمَا بُعِثْتُمْ مُيَسِّرِيْنَ)
‘সহজ ও দয়া-অনুগ্রহ করার জন্যই তোমাদেরকে পাঠানো হয়েছে’।
আবূ দাউদ বর্ণিত সহীহ হাদীসে এসেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَمْ يَرْحَمْ صَغِيْرَنَا وَيَعْرِفْ شَرَفَ كَبِيْرِنَا
সে আমাদের দলভুক্ত নয়,যে আমাদের ছোটদের প্রতি রহম করে না আর আমাদের বড়দের মর্যাদা জানে না’ (আবু দাউদ)।
সহীহ মুসলিমে এসেছে আবূ হুরাইরা রাযি. থকে বর্ণিত,রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
مَثَلُ الْمُؤْمِنِينَ فِي تَوَادِّهِمْ وَتَرَاحُمِهِمْ وَتَعَاطُفِهِمْ، مَثَلُ الْجَسَدِ إِذَا اشْتَكَى مِنْهُ عُضْوٌ تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ الْجَسَدِ بِالسَّهَرِ وَالْحُمَّى
‘ভালোবাসা, দয়া, সহানুভূতির দিক দিয়ে মুমিনদের দৃষ্টান্ত হল একটি দেহের ন্যায়। দেহের একাংশ আক্রান্ত হলে সমগ্র দেহ জ্বরগ্রস্থ ও নিদ্রাহীন হয়ে পড়ে’ (মুসলিম)।
এমনিভাবে একজন মুসলিম যখন বিশ্বের যে কোনো স্থানে আক্রান্ত হয়, বিপদে পড়ে, তখন অন্যসকল মুসলিমের কর্তব্য হল, তার প্রতি রহম ও ইহসান করা। তার ব্যথায় ব্যথিত হওয়া। তার সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আজ আমাদের মধ্যে এ গুণটি একেবারে অনুপস্থিত। বরং এর উল্টো বিষয় আমরা লালন করে থাকি। বিশ্বের কোনো স্থানে কাফির-মুশরিক কর্তৃক মুসলিমরা জুলুমের শিকার হলে আমরা জালেমের পক্ষ অবলম্বন করি।
আল্লাহ আমাদের হিদায়েত দান করুন। সকল মুসলমানকে তাদের মধ্যে পারস্পারিক রহম, মায়া-মমতা, করুণা ও ইহসান করার তাওফীক দান করুন।
সহীহ বুখারীতে এসেছে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
دَخَلَتْ امْرَأَةٌ النَّارَ فِيْ هِرَّةٍ حَبَسَتْهَا حَتَّى مَاتَتْ، فَلَا هِيَ أَطْعَمَتْهَا وَلَا هِيَ تَرَكَتْهَا تَأْكُلُ مِنْ خَشَاشِ الْأَرْضِ
এক মহিলা একটি বিড়ালের কারণে জাহান্নামে গিয়েছে। সে তাকে আটকে রেখেছিল ফলে সে মারা যায়। সে তাকে খাবারও দেয়নি, আবার ছেড়েও দেয়নি যাতে সে জমিনের কীটপতঙ্গ খেয়ে বাঁচতে পারে’ (বুখারী)।
এ মহিলা বিড়ালটির প্রতি দয়া-মায়া ও রহম করেনি। এ কারণে তাকে জাহান্নামে যেতে হয়েছে। সহীহ বুখারীতে আরো এসেছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رضي الله عنه عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وآله وسلم: أَنَّ امْرَأَةً بَغِيًّا رَأَتْ كَلْبًا فِي يَوْمٍ حَارٍّ يُطِيفُ بِبِئْرٍ، قَدْ أَدْلَعَ لِسَانَهُ مِنْ الْعَطَشِ، فَنَزَعَتْ لَهُ بِمُوقِهَا فَغُفِرَ لَهَا -رواه مسلم
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: এক পতিতা মহিলা পিপাসার্ত কুকুরকে পানি পান করানোর কারণে জান্নাতে প্রবেশ করেছে। (মুলিম)
মোদ্দাকথা: রহমতের দরিয়ার দয়া ও ভালোবাসা প্রতিটি সৃষ্টি জীবের রন্দ্রে রন্দ্রে বিদ্যমান। মুহাম্মাদ (সা.)-এর মত দয়া ও অনুগ্রহ পৃথিবীর সূচনা লগ্ন থেকে এ পর্যন্ত কেউ স্থাপন করতে পারেনি, এবং কিয়ামত পর্যন্ত পারবেও না। তাই আমাদের জন্য কর্তব্য হলো, রহমতে আলম (সা.)এর দয়া ও অনুগ্রহ সম্পর্কে অবহিত হওয়া এবং তাঁর পবিত্র মতাদর্শ অনুযায়ী নিজের জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাজনৈতিক জীবন রাষ্ট্রীয় জীবন এক কথায় সর্বদা তাঁর আদর্শ অনুযায়ী পরিচালিত করা। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। আমীন