বিস্ময়কর মক্কা মুকাররমা

তওয়াফের বিধান

তওয়াফের বিধান


কালো গিলাফ। রোদে পুড়ে অনেকটা ধূসর। সোনালি দরজা উজ্জ্বল। পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানিত ঘর বায়তুল্লাহ। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা যে ঘরকে মানুষের নামাজের জন্য কিবলা হিসেবে নির্ধারণ করেছেন।
প্রতি বছর হজের আগেই বদলে ফেলা হয় গিলাফ। নতুন গিলাফ দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। কালো গিলাফের ওপর সোনালি রঙের ক্যালিগ্রাফি। কালো কাপড়ে ও বুননে অসাধারণ শৈল্পিক সৌন্দর্যে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে কিছু আয়াত।
বায়তুল্লাহর গিলাফ তৈরি করার জন্য মক্কা নগরীতেই রয়েছে আলাদা কারখানা। যেখানে বছরজুড়েই গিলাফ তৈরির কাজ করেন কর্মীরা। তাদের যতœ-ভালোবাসায় গড়ে ওঠা গিলাফ মক্কা মুকাররমায় জড়িয়ে দেন সৌদি বাদশাহ। যিনি আল্লাহর ঘরের খাদেম হিসেবে পরিচিত !
হজরত ইবরাহিম আ: তাঁর ছেলে হজরত ইসমাইল আ:কে সাথে নিয়ে ঘরটি পুনর্নির্মাণ করেছিলেন। সে ঘরটি পরে মূর্তিতে ভরে রেখেছিল মক্কার মানুষ। আল্লাহ তাঁর প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সা:কে দিয়ে সেই মূর্তির বিপক্ষে কঠোর ঘোষণা দিলেন। মক্কা মুকাররমাকে মূর্তিমুক্ত করা হলো। সেখানে আজান হলো। মুসলমানেরা নামাজে শামিল হতে থাকলেন।
মক্কা মুকাররমাকে শেষ নবীর উম্মতদের জন্য কিবলা নির্ধারণের আগে বায়তুল মুকাদ্দাস ছিল মুসলমানদের কিবলা। মাদিনাতুন নবীতে হজরত মুহাম্মাদ সা: মসজিদে নামাজরত অবস্থায় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা কিবলা বদল করে দেন। যে মসজিদে কিবলা পরিবর্তন করা হয়, সেটাকে বলা হয় মসজিদে জুল কিবলতাইন। হজযাত্রীরা সেই মসজিদে গিয়ে থাকেন এবং মসজিদে প্রবেশের পর সুন্নাত হিসেবে দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন।জীবনের যে স্বপ্নময় ইতিহাসের বর্ণনা কানে বেজেছিল বছরের পর বছর Ñ সে ইতিহাস নিজ চোখে দেখার দুর্লভ এক সুযোগ আরব দেশে। যেটি পরে বাদশাহ সাউদ তাঁর নামানুসারে সাউদি আরব করেছিলেন।
রুক্ষ মরুর দেশে আল্লাহ তাঁর রহমতের ধারা বইয়ে দিয়ে যে অসাধারণ বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছেন, তা এ দেশটি না দেখলে বোঝা যাবে না। মক্কা মুকররামায় ঢুকে নামাজ আদায় করে তাওয়াফ শুরুর করার অনুভূতি অসাধারণ। তার পাশে সাফা ও মারওয়া পাহাড়। বহুবার সায়ি করেছি। মা হাজেরা ছেলে হজরত ইসমাইল আ:-এর জন্য পানির খোঁজে দুই পাহাড়ে ছুটেছিলেন। এখানে সায়ি করার সময় জানিনি দুই পাহাড়ে সাতবার যাতায়াতে কতটা পথ পাড়ি দিতে হয়, পরে জানলাম সাড়ে তিন কিলোমিটার। এ পথ এখন হজযাত্রীরা পাড়ি দেন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায়। মা হাজেরা যখন ছুটেছিলেন সে সময় মক্কা নগরীর এ দু’টি পাহাড়ের মাটিতে পা দেয়ার অবস্থা নিশ্চয় ছিল না। যেরকম এখনো বায়তুল্লাহ চত্বরের বাইরে খালি পায়ে মাটিতে পা রাখার সাধ্য নেই। সে সময় প্রিয় সন্তানের পানির পিপাসা মেটানোর জন্য মা হাজেরার এ ছোটাছুটি কতটা কষ্টসাধ্য ছিলÑ মনে করলেই হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। সন্তানের প্রতি মায়ের এমন অপরিসীম টান, ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধের এর চেয়ে বড় কোনো উদাহরণ অজানা। আল্লাহ মা হাজেরার সন্তানের জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করে ছোটাছুটির প্রতিদান এবং তাঁর প্রিয়নবী হজরত ইসমাঈল আ:-এর জন্য বইয়ে দিলেন একটি কূপ। যে কূপের পানি জমজম হিসেবে পরিচিত। এ পানির কেবল তৃষ্ণা মেটানো নয়, খাদ্যগুণও রয়েছে। সেই হজরত ইসমাইল আ:-এর শিশুকালে যে কূপের সৃষ্টি, সেটি কেয়ামত পর্যন্ত জারি থাকবে ইনশাআল্লাহ। পৃথিবীর কোথাও যদি এক ফোঁটা পানযোগ্য পানিও না থাকে, এখানে থাকবে, যা আল্লাহর অশেষ এক নিয়ামত ।জীবনে বিশ্বের বহু দেশে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের এবাদতখানা দেখার সুযোগ হয়েছে, মক্কাতুল মুকাররমা দেখার পর মনে হয়েছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ও অসাধারণ যে ঘর এবং কাঠামো পর্যটন করলাম সেটি মক্কা মুকাররমা।
ঘরের চাকচিক্য নেই ঠিকই কিন্তু এ ঘর এমন একটা বাঁধন তৈরি করেছে, যে বাঁধন কেবল তার দিকে টানে। আল্লাহর প্রেমে মানুষকে অসাধারণ এক জীবনের খোঁজে টানে। সে টান পৃথিবীর সব আবেগ, ভালোবাসা, ক্ষমতার এবং সম্পদের টানের চেয়েও অসাধারণ।
আল্লাহর নির্দেশে ইবরাহিম আ: তাঁর প্রিয় ছেলে ইসমাঈল আ:কে তাঁর মা বিবি হাজেরার সাথে এ ঘরের কাছেই রেখে গিয়েছিলেন। সে সময় এই স্থাপনা দৃশ্যমান ছিল না। আল্লাহ হজরত ইবরাহিম আ:, হজরত ইসমাঈল আ: এবং বিবি হাজেরার আনুগত্যটাকে এতটাই পছন্দ করেছেন, যাদের স্মৃতিকে হজের আয়োজনে প্রধান করা হয়েছে।মক্কা মুকাররমায় তাওয়াফের সময় কখনো কান্তি আসে না, অনেকটা পথ হাঁটলে যেমন বুক শুকিয়ে আসে, কষ্ট হয়, পা ধরে আসে, পানির তৃষ্ণা হয়Ñ এমন অনুভূতি হয়নি কখনো। মনে হবেÑ জীবনের এ তাওয়াফে যদি অনন্তকাল ধরে আমরা সঙ্গী হতে পারতাম, তাহলে দুনিয়াতে আর অন্য কিছু চাইবার থাকত না।মক্কা মুকাররমার আঙিনায় যাওয়ার পর পৃথিবীর কোনো ভাবনা-চিন্তা আর মাথায় থাকে না। শরীরে কোনো ধরনের প্রাকৃতিক সঙ্কটও দেখা যায় না। জীবনে এ রকম বাস্তবতা দ্বিতীয়টি উপলব্ধি করার ঘটনা কখনো ঘটেনি। এমন জীবন, যে জীবনে মক্কা আল মুকররমার কাছে দাঁড়িয়ে আল্লাহর দরবারের কিছু চাইবার যে সামর্থ্য, সেটি যেকোনো বিবেচনায় বিশেষ নিয়ামত ছাড়া আর কিছু নয়।ইসলামে মানুষের পূজাকে হারাম করেছে, শিরককে কঠিনভাবে হারাম করা হয়েছে। সব গুনাহ মাফ করা হলেও শিরককে মাফের আওতায় আনা হয়েছে তখন, যখন বান্দাহ তাওবা করবে। কিন্তু না বুঝে আমরা অনেক শিরক করছি। যার জন্য হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, যে ঘরে কোনো জন্তু কিংবা প্রাণির ছবি থাকে, সে ঘরে রহমতের ফেরেশতা প্রবেশ করে না।

মক্কা মুকাররমার আঙিনাজুড়েই আল্লাহর নবী আ:দের স্মৃতি। মহানবী হজরত মুহাম্মাদ সা:-এর জন্মভিটে, আবার ইসলামবিরোধীদেরও আঙিনা ছিল এখানে। আবু জাহেলের বাড়ি ছিল বায়তুল্লাহর কাছে। রাসূল সা:-এর জন্মভিটে লাইব্রেরি বানানো হয়েছে। আবু জাহেলের ভিটেকে করা হয়েছে ওয়াশরুম ।
রাসূল সা:-এর প্রথম স্ত্রী উম্মুল মুমেনিন খাদিজাতুল কুবরা রা:-এর কবর রয়েছে এ মক্কা নগরীতে। এ নগরীতেই রাসূল সা: জাবালে নূর পাহাড়ের হেরা গুহায় ধ্যান করেছেন। বিস্ময়কর একটা বিষয়। স্থলভূমি থেকে প্রায় ১ ঘণ্টা হেঁটে পাহাড়ের উপরে উঠলে হেরা গুহা। এ রকম এক জীবন রাসূল সা: বেছে নিয়েছিলেন, তাঁর উম্মাতের হেদায়াতের বার্তা বয়ে আনার জন্য, আর সে উম্মত এখন ধর্মের ব্যাখ্যা করে নিজের মতো আর পালন করে সুবিধা মতো। এর চেয়ে কষ্টের কিছু হতে পারে না।
রাসূল সা: বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছিলেন জাবালে রহমতে দাঁড়িয়ে। মানব ইতিহাসে এ ভাষণের সাথে কোনো ভাষণের তুলনা চলে না। এটি এমন এক ভাষণ, যেটি মানব ইতিহাসে মানুষের অধিকার আর ইনসাফের সমাজ গঠনের অনন্যসাধারণ দৃষ্টান্তমূলক নির্দেশনা হয়ে আছে। =সমাপ্ত=

Related Post