হুদাইবিয়ার সন্ধি-চুক্তি ভঙ্গ : হুদাইবিয়ার সন্ধি-চু্ক্তিতে আরব গোত্রগুলোকে এই অধিকার দেয়া হয়েছিলো যে, তারা মুসলমান এবং কাফিরদের মধ্যে যে কোনো পক্ষের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করতে পারবে। এই শর্তানুযায়ী বনু খোজা‘আ গোত্র মুসলমানদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হলো আর বনু বকর গোত্র মৈত্রী স্থাপন করলো কুরাইশদের সঙ্গে। এভাবে প্রায় দেড় বছর এই সন্ধি-চুক্তি পূর্ণভাবে পালিত হলো। কিন্তু তারপরই এক নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হলো। ইতঃপূর্বে খোজা‘আ ও বকর গোত্রদ্বয়ের মধ্যে বেশ কিছুকাল যাবত লড়াই চলে আসছিলো; এদের মধ্যে হঠাৎ একদিন বনু বকর গোত্র খোজা’আদেরকে আক্রমণ করে বসলো এবং এ ব্যাপারে কুরাইশগণ বনু বকরকে সাহায্য প্রদান করলো। কারণ খোজা’আ গোত্র তাদের মর্জীর বিরুদ্ধে মুসলমানদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়ায় কুরাইশরা আগে থেকেই তাদের ওপর খাপ্পা ছিলো। এভাবে উভয় পক্ষ মিলে খোজা‘আ গোত্রের লোকদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করতে শুরু করলো। এমন কি তারা কা’বা শরীফে আশ্রয় গ্রহণ করেও রেহাই পেলো না; বরং সেখানেরও তাদের রক্তপাত করা হলো। খোজা‘আগণ বাধ্য হয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে তাদের দুরাবস্থা সম্পর্কে অবহিত করলো এবং তাঁর সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী তারা সাহায্য প্রার্থনা করলো। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) খোজা‘আদের এই মজলুমী অবস্থার কথা শুনে অত্যন্ত মর্মাহত হলেন। তিনি এই নিষ্ঠুর আচরণ থেকে বিরত থাকার এবং নিম্নোক্ত তিনটি শর্তের মধ্যে যে কোনো একটি গ্রহণ করার আহবান জানিয়ে কুরাইশদের কাছে একজন দূত প্রেরণ করলেন :
১. খোজা‘আদের যে সব লোক নিহত হয়েছে, তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে অথবা
২. বনু বকরের সাথে কুরাইশদের সম্পর্কচ্ছেদ করতে হবে কিংবা
৩. হুদাইবিয়ার সন্ধি-চুক্তি বাতিল ঘোষণা করতে হবে।
দূত মারফত এই পয়গাম শুনে কোরতা বিন্ উমর নামক জনৈক কুরাইশ বললো : আমরা তৃতীয় শর্তটাই সমর্থন করি। কিন্তু দূত চলে যাবার পর তাদের খুব আফসোস হলো এবং হুদাইবিয়ার সন্ধি পুনর্বহাল করার জন্যে নিজেদের পক্ষ থেকে আবু সুফিয়ানকে প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরণ করলো। কিন্তু সামগ্রিক পরিস্থিতি, বিশেষত কুরাইশদের এতদিনকার আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের এই নয়া প্রস্তাব সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারলেন না। তিনি আবু সুফিয়ানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন।
মক্কা অভিযানের প্রস্তুতি : কা’বাগ্রহ ছিলো খালেস তওহীদের কেন্দ্রস্থল। নির্ভেজাল খোদার বন্দেগীর জন্যে এটি হযরত ইবরাহীম (আ) নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু এ যাবতকাল তা মুশরিকদের অধিকারে থেকে শিরকের সবচেয়ে বড়ো কেন্দ্র-স্থলে পরিণত হয়েছিলো। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) প্রকৃতপক্ষে হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর প্রচারিত দ্বীনের আহবায়ক এবং খালেস তওহীদের অনুবর্তী ছিলেন। এ কারণে তওহীদের এই পবিত্র কেন্দ্রস্থলকে শিরকের সমস্ত নাপাকী ও নোংরামি থেকে অবিলম্বে মুক্ত করার একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছিলো। কিন্তু এতদিন এ অবস্থা অনুকূলে ছিলো না। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এবার অনুমান করতে পারলেন যে, অল্লাহর এই পবিত্র ঘরকে শুধু তাঁরই ইবাদতের জন্যে নির্ধারিত করা এবং মূর্তিপূজার সমস্ত অপবিত্রতা থেকে একে মুক্ত করার উপযুক্ত সময় এসেছে। তাই তিনি চুক্তিবদ্ধ সমস্ত গোত্রের কাছে এ সম্পর্কে পয়গাম পাঠালেন। অন্য দিকে এই প্রস্তুতির কথা যাতে মক্কাবাসীরা জানতে না পারে, সেজন্যে তিনি কঠোর সতর্কতা অবলম্বন করলেন। প্রস্তুতি কার্য সম্পন্ন হলে অষ্টম হিজরীর ১০ রমযান প্রায় দশ হাজার আত্নোৎসর্গী সৈন্যের এক বিরাট বাহিনী সঙ্গে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মক্কা অভিমুখে যাত্রা করলেন। পথিমধ্যে অন্যান্য আরব গোত্রও এসে তাঁর সঙ্গে মিলিত হলো।
আবু সুফিয়ানের গ্রেফতারী : মুসলিম সৈন্যবাহিনী মক্কার সন্নিকটে পৌঁছলে কুরাইশ-প্রধান আবু সুফিয়ান গোপনে তাদের সংখ্যা-শক্তি আন্দাজ করতে এলো। এমনি অবস্থায় হঠাৎ তাকে গ্রেফতার করে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর খেদমতে হাযির করা হলো। এ সেই আবু সুফিয়ান, ইসলামের দুশমনি ও বিরুদ্ধতায় যার ভূমিকা ছিল অনন্যসাধারণ। এই ব্যক্তিই বারবার মদীনা আক্রমণের ষড়যন্ত্র করেছিলো এবং একাধিকবার রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে হত্যা করার গোপন চক্রান্ত পর্যন্ত ফেঁদেছিলো। এই সব গুরুতর অপরাধের কারণে আবু সুফিয়ানকে সঙ্গে সঙ্গে হত্যা করা উচিত ছিলো। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার প্রতি করুণার দৃষ্টি প্রসারিত করে বললেন : ‘যাও, আজ আর তোমাকে কোনো জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে না। আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করে দিন। তিনি সমস্ত ক্ষমা প্রদর্শনকারীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ ক্ষমা প্রদর্শনকারী।’
আবু সুফিয়ানের সঙ্গে এই আচরণ ছিলো সম্পূর্ণ অভিনব। রাহমাতুল্লিল আলামীন-এর এই অপূর্ব ঔদার্য আবু সুফিয়ানের হৃদয় -নেত্রকে উন্মীলিত করে দিলো। সে বুঝতে পারলো, মক্কায় সৈন্য নিয়ে আসার পেছনে এই মহানুভব ব্যক্তির হৃদয়ে না প্রতিশোধ গ্রহণের মানসিকতা আছে আর না আছে দুনিয়াবী রাজা-বাদশাদের ন্যায় কোনো স্পর্ধা-অহংকার। এ কারণেই তাকে মুক্তিদান করা সত্ত্বেও সে মক্কায় ফিরে গেলো না; বরং ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আত্নোৎসর্গী দলেরই অন্তর্ভুক্ত হলো।
মক্কায় প্রবেশ : এবার রাসূলুল্লাহ (সাঃ) খালিদ বিন অলীদ (রাঃ)-কে আদেশ দিলেন : তুমি পিছন দিক থেকে মক্কায় প্রবেশ করো, কিন্তু কাউকে হত্যা করো না। অবশ্য কেউ যদি তোমার ওপর অস্ত্র উত্তোলন করে, তাহলে আত্নরক্ষার জন্যে তুমি ও অস্ত্র ধারন করো। এই বলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজে সামনের দিক থেকে শহরে প্রবেশ করলেন। হযরত খালিদ-এর সৈন্যদের ওপর কতিপয় কুরাইশ গোত্র তীর বর্ষণ করলো এবং তার প্রত্যুৎত্তর দিতে হলো। ফলে ১৩ জন হামলাকারী নিহত হলো এবং বাকী সবাই পালিয়ে গেলো। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এই পাল্টা হামলার কথা জানতে পেরে হযরত খালিদ-এর কাছে কৈফিয়ত তলব করলেন। কিন্তু তিনি প্রকৃত ঘটনা জানতে পেরে বললেন : আল্লাহর ফয়সালা এ রকমই ছিলো।’ পক্ষান্তরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কোনোরূপ প্রতিরোধ ছাড়াই মক্কায় প্রবেশ করলেন। তাঁর সৈন্যদের হাতে একটি লোকও নিহত হলো না।
মক্কায় সাধরণ ক্ষমা : হযরত (স) মক্কায় প্রবেশ করে কোনো প্রতিশোধ গ্রহণের কথা বললেন না, বরং তিনি এই মর্মে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেনঃ
১. যারা আপন ঘরের মধ্যে দরজা বন্ধ করে থাকবে,তারা নিরাপদ।
২. যারা আবু সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে, তারও নিরাপদ এবং
৩. যারা কা’বাগৃহে আশ্রয় নেবে, তারাও নিরাপদ।
কিন্তু এই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা থেকে এমন ছয়-সাত ব্যক্তি ব্যতিক্রম ছিলো, ইসলামের বিরুদ্ধতায় ও মানবতা বিরোধী অপরাধে যাদের ভূমিকা ছিলো অসাধারণ এবং যাদের হত্যা করার প্রয়োজন ছিলো অপরিহার্য।
নবী করীম (সাঃ) কি অবস্থায় মক্কায় প্রবেশ করলেন, তাও এখানে উল্লেখযোগ্য। তাঁর পতাকা ছিলো সাদা ও কালো রঙের। মাথায় ছিলো লৌহ শিরস্ত্রাণ এবং তার ওপর ছিলো কালো পাগড়ী বাঁধা। তিনি উচ্চ:স্বরে সূরা ফাতাহ (ইন্না ফাতাহনা….. ) তিলাওয়াত করছিলেন। সর্বোপরি আল্লাহ তা’আলা সমীপে তাঁর এমনি বিনয় ও নম্রতা প্রকাশ পাচ্ছিলো যে, সওয়ারী উটের পিঠের ওপর ঝুঁকে পড়ার দরুন তাঁর পবিত্র মুখমণ্ডল যেনো উটের কুঁজ স্পর্শ করছিলো।
কা’বা গৃহে প্রবেশ : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কা’বা মসজিদে প্রবেশ করে সর্বপ্রথম মর্তিগুলোকে বাইরে ছুঁড়ে ফেলার নির্দেশ দিলেন। তখন কাবাগৃহে ৩৬০ টি মূর্তি বর্তমান ছিলো। তার দেয়ালে ছিলো নানারূপ চিত্র অংকিত। এর সবই নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হলো। এভাবে আল্লাহর পবিত্র ঘরকে শিরকের নোংরামি ও অপবিত্রতা থেকে মুক্ত করা হলো। এরপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকবীর ধ্বনি উচ্চারণ করলেন, কা’বা গৃহ তওয়াফ করলেন এবং ‘মাকামে ইবরাহীম’-এ গিয়ে নামায আদায় করলেন। এই ছিল তার বিজয় উৎসব। এ উৎসব দেখে মক্কাবাসীদের হৃদয়-চক্ষু খুলে গেলো। তারা দেখতে পেলো, এতোবড়ো একটি বিজয় উৎসবে বিজয়ীরা না প্রকাশ করলো কোনো শান-শওকত আর না কোনো গর্ব-অহংকার, বরং অত্যন্ত বিনয় ও কৃতজ্ঞতার সাথে তারা আল্লাহর সামনে অবনমিত হচ্ছে এবং তাঁর প্রশংসা ও জয়ধ্বনি উচ্চারণ করছে। এই দৃশ্য দেখে কে না বলে পারে যে, প্রকৃতপক্ষে এ বাদশাহী কিংবা রাজত্ব জয় নয়, এ অন্য কিছু।
বিজয়ের পর ভাষণ : মক্কা বিজয় সম্পন্ন হবার পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। এর কিছু অংশ হাদীস শরীফে বিধৃত হয়েছে। তাতে তিনি বলেন : এক আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বুদ (ইলাহ) নেই; কেউ তাঁর শরীক নেই। তিনি তাঁর ওয়াদাকে সত্যে পরিণত করেছেন। তিনি তাঁর বান্দাদের সাহায্য করেছেন এবং সমস্ত শত্রুবাহিনীকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। জেনে রেখো; সমস্ত গর্ব-অহংকার, সমস্ত পুরনো হত্যা ও রক্তের বদলা এবং তামাম রক্তমূল্য আমার পায়ের নীচে। কেবল কা’বার তত্ত্বাবধান এবং হাজীদের পানি সরবরাহ এর থেকে ব্যতিক্রম। হে কুরাইশগণ! জাহিলী আভিজাত্য ও বংশ-মর্যাদার ওপর গর্ব প্রকাশকে অল্লাহ নাকচ করে দিয়েছেন। সমস্ত মানুষ এক আদমের সন্তান আর আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে মাটি থেকে। অতঃপর তিনি কুরআন পাকের নিম্নোক্ত আয়াত পাঠ করেন : লোক সকল! আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে পয়দা করেছি এবং তোমাদেরকে নানান গোত্র ও খান্দানে বিভক্ত করে দিয়েছি, যেনো তোমরা একে অপরকে চিনতে পারো। কিন্তু আল্লাহর কাছে সম্মানিত হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যে অধিকতর পরহেজগার। আল্লাহ মহাবিজ্ঞ ও সর্বজ্ঞ। (সূরা )
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মক্কা বিজয়ের পর অন্য কতিপয় জরুরী মসলাও শিক্ষা দেন : ইসলামের শ্রেষ্ঠতম বিজয়ী তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ বিজয়ের পর যে ভাষণ দান করেন, এই হচ্ছে তার নমুনা। এতে না আছে তাঁর দুশমনদের বিরুদ্ধে জিঘাংসা, না আছে কোনো বিদ্বেষ। এতে না আছে তাঁর আপন কৃতিত্বের কোনো উল্লেখ আর না তাঁর আত্নোৎসর্গী সহকর্মীদের কোনো প্রশংসা, বরং প্রশংসা যা কিছু, তা শুধু আল্লাহরই জন্যে আর যা কিছু ঘটেছে তা শুধু তাঁরই করুণার ফলমাত্র।
আরব দেশে হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করা হতো। বংশের কোনো ব্যক্তি কারো হাতে নিহত হলে ঐ বংশের স্মরণীয় ঘটনাবলীর মধ্যে তা শামিল করা হতো। এমনকি ভবিষ্যত বংশধররা পর্যন্ত হত্যাকারীর বংশ থেকে নিহত ব্যক্তিদের রক্তের বদলা না নিয়ে স্বস্তি লাভ করতো না। তাই এ উপলক্ষে হযরত (স) এ ধরনের যাবতীয় রক্তের বদলাকে বাতিল করে দিলেন এবং বলা যায়, তিনি আরববাসীদেরকে সত্যিকর অর্থে এক অনাবিল শান্তি ও স্বস্তিময় জীবন প্রদান করলেন। আরবে বংশ ও গোত্র নিয়ে গৌরব করার এক বহু পুরনো ব্যাধি বর্তমান ছিলো। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষে মানুষে এ ধরনের পার্থক্য সৃষ্টি সম্পূর্ণ অবৈধ। ইসলামে পার্থক্য সৃষ্টির একমাত্র বৈধ মাপকাঠি হচ্ছে খোদায়ী বিধানের আনুগত্যের প্রশ্ন। যে ব্যক্তি আল্লাহর বিধানের যতো অনুগত হবে, তাঁর সন্তোষ-অসন্তোষকে ভয় করবে, সে ততোই সম্ভ্রান্ত ও সম্মানিত বলে গণ্য হবে। ইসলামে বংশগত শরাফতের কোনে স্থান নেই। বংশ বা খান্দানের সৃষ্টি কেবল পারস্পরিক পরিচয়ের জন্যে। আল্লাহর রাসূল তাই এই ব্যাধিটিরও মূলোৎপাটন করে দিলেন এবং মানুষের জন্যে এমন এম সাম্যের বাণী ঘোষণা করলেন, আজ পর্যন্ত যা ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মই মানুষকে দিতে পারে নি।
শত্রুর হৃদয় জয় : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যে জনসমাবেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন, সেখানে বড়ো বড়ো কুরাইশ নেতা, উপস্থিত ছিলো। যে সব ব্যক্তি ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যে জীবন পণ করেছিলো, সেখানে তারাও হাযির ছিলো। যাদের অকথ্য উৎপীড়নে মুসলমানরা একদিন নিজেদের ঘর-বাড়ি পর্যন্ত ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলো, তারাও সেখানে ছিলো। যারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে গালি-গালাজ করতো, তাঁর পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখতো, তাঁর প্রতি প্রস্তর নিক্ষেপ করতো, প্রতি মুহূর্ত তাঁকে হত্যা করার চিন্তা করতো, তারাও সেখানে উপস্থিত ছিলো। যে পাষণ্ড রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আপন চাচার কলিজা বের করে চিবিয়েছিলো, সেও সেখানে হাযির ছিলো। যারা এক আল্লাহর বন্দেগী করার অপরাধে বেশুমার মুসলমানকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিলো, তারাও সেখানে ছিলো। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এদের সবার দিকে তাকালেন এবং জিজ্ঞেস করলেন : বলো তো, আজ তোমাদের সঙ্গে আমি কিরূপ আচরণ করবো? রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কিভাবে মক্কায় পদার্পন করেছেন এবং এ পর্যন্ত কিরূপ ব্যবহার করেছেন, লোকেরা তা গভীরভাবে লক্ষ্য করেছিলো। তাই তারা সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠলো : আপনি আমাদের সম্ভ্রান্ত ভ্রাতা ও সম্ভান্ত- ভ্রাতুষ্পুত্র। একথা শুনেই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ঘোষণা করলেন : যাও, আজ আর তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই; তোমরা সবাই মুক্ত। যারা মুসলমানদের পরিত্যক্ত বাড়ি-ঘর দখল করে নিয়েছিলো,রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাও তাদেরকে প্রত্যর্পন করার ব্যবস্থা করলেন না’ বরং মুহাজিরদেরকে নিজেদের দাবি পরিত্যাগ করার উপদেশ দিলেন।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর এই বিস্ময়কর আচরণে মুগ্ধ হয়ে বড়ো বড়ো কুরাইশ নেতা তাঁর চরণে লুটিয়ে পড়লো। তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘোষণা করলো : আপনি সত্যি আল্লাহর নবী, কোনো দেশজয়ী বাদশাহ নন। আপনি যে দাওয়াত পেশ করেন, তা ই সত্য। এই ছিল মক্কা বিজয়ের দৃশ্য। এ বিজয় কোনো দেশ, সম্পদ বা ধন-রত্ন দখল নয়, এ ছিলো মানুষের হৃদয়-রাজ্য অধিকার আর এটাই ছিলো সবচেয়ে বড়ো জয়।