Originally posted 2013-02-28 10:25:45.
সততা মানবচরিত্রের শ্রেষ্ঠ একটি গুণ। মানবজীবনে এর প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। আল্লাহ তায়ালা ইহ ও পরজগতে এ গুণের অধিকারী ব্যক্তির মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। সত্যিকার মুমিন সততাকে উন্নত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থেকেও ঊর্ধ্বে মনে করেন। কেননা তারা জানেন, এটি ইমান ও ইসলামের পূর্ণতা দান করে। সততা ও বিশ্বস্ততার প্রতি আহ্বান জানিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ইমানদাররা! আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্-সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের সঙ্গী হও।’ (সুরা তওবা : ১১৯)
অনেক সদগুণের সমষ্টিই সততা। ইমানের ক্ষেত্রে এর তাত্পর্য হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার একত্ব, ফেরেশতা, কিতাব, নবী-রাসুল, পরকাল এবং তাকদিরের ভালো-মন্দের প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করা। উপরোক্ত বিশ্বাসের আলোকে ভালো ও কল্যাণমূলক কাজ আনজাম দেয়া এবং আল্লাহ তায়ালার অপছন্দনীয় কথা ও কাজ পরিহার করা। আল্লাহ ও তাঁর রাসুলু্ল্লাহর (সা.) প্রেম ও ভালোবাসা অর্জনে প্রয়াসী হওয়া। মুমিন ব্যক্তি যখন পূর্ণ সততা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে তার পুরো সত্তাকে আল্লাহ তায়ালার প্রেম ও ভালোবাসার প্রাণরসে সিক্ত ও সঞ্জীবিত করে, তখন তার সামনে অফুরন্ত কল্যাণের ঝরনাধারা উন্মুক্ত ও প্রবাহিত হয়। মহত্ চিন্তায় তার হৃদয় আপ্লুত ও আন্দোলিত হয়। তার আচার-আচরণ হয় বিশুদ্ধ, পরিচ্ছন্ন ও মার্জিত।
সততা ও বিশ্বস্ততা মানুষকে উন্নত, আদর্শ ও নৈতিকতায় ভূষিত করে এবং এর মাধ্যমেই ইসলামী জিন্দেগির পূর্ণতা অর্জিত হয়। পবিত্র কোরআনের অসংখ্য আয়াত ও রাসুলে করিমের (সা.) অসংখ্য হাদিসে মুমিনদের সততা ও বিশ্বস্ততার গুণে গুণান্বিত হওয়ার জন্য উত্সাহিত করা হয়েছে। পক্ষান্তরে মিথ্যা থেকে দূরে থাকার ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কোরআনে এসেছে, ‘তোমরা পূর্ব দিকে কিংবা পশ্চিম দিকে মুখ ফেরালে, তা কোনো প্রকৃত পুণ্যের ব্যাপার নয়; বরং প্রকৃত পুণ্যের কাজ হলো মানুষ আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতা, কিতাব ও নবীদের নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে মেনে নেবে আর আল্লাহর ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের প্রিয় ধনসম্পদ আত্মীয়স্বজন, এতিম, মিসকিন, পথিক, সাহায্যপ্রার্থী ও কৃতদাসদের জন্য ব্যয় করবে। এছাড়া নামাজ কায়েম করবে ও জাকাত দেবে। প্রকৃত পুণ্যবান তারাই, যারা ওয়াদা করলে তা পূরণ করে। দারিদ্র্য, সঙ্কীর্ণতা ও বিপদের সময় এবং হক-বাতিলের দ্বন্দ্ব-সংগ্রামে পরম ধৈর্য অবলম্বন করে। বস্তুত তারাই প্রকৃত সততাসম্পন্ন, সত্যাশ্রয়ী এবং তারাই সত্যিকার মুত্তাকি।’ (সুরা বাকারা : ১৭৭)
অসংখ্য হাদিসেও সততার গভীরতার বিষয়টি ফুটে ওঠে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি নিয়তের বিশুদ্ধতা ও সততার সঙ্গে আল্লাহ তায়ালার পথে শহীদ হওয়ার সৌভাগ্য অর্জনের প্রার্থনা করে, আল্লাহ তাকে শহীদদের মর্যাদায় পৌঁছাবে—যদিও সে বিছানায় মৃত্যুবরণ করে।’ (মুসলিম)।
অন্য হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে শাহাদাতলাভ করতে চায়, শহিদ না হলেও তাকে শহিদের মর্যাদা ও সওয়াব দেয়া হবে।’ (মুসলিম) উপরের হাদিসের আলোকে প্রমাণিত হয়, সিদ্ক তথা সততা বলতে আন্তরিক বিশ্বাস এবং মনের ঐকান্তিকতার সঙ্গে সেই বিশ্বাসের স্বীকৃতি বোঝায়। আর বান্দা তার সব আমল বা কাজের প্রতিফল একমাত্র আল্লাহ তায়ালার কাছে আশা করে। আল্লাহ তায়ালার কাছে সর্বাগ্রে বিচার্য বিষয় হচ্ছে, বান্দার আন্তরিকতা ও নিয়তের বিশুদ্ধতা। এর ভিত্তিতে আল্লাহ তায়ালা বান্দাকে পুরস্কৃত করবেন।
অতএব বান্দাকে সদাসর্বদা কথা ও কাজে সততা, সত্যতা ও স্বচ্ছতা রক্ষা করতে হবে এবং মিথ্যার অভিশাপ ও গ্লানি থেকেও বাঁচাতে হবে। রাসুলুল্লহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের উচিত সততা ও সত্যতা অবলম্বন করা। কেননা সততা ও সত্যতা মানুষকে পুণ্যের পথে পরিচালিত করে আর পুণ্য জান্নাতের দিকে চালিত করে। কোনো ব্যক্তি যখন সত্য কথা বলে এবং সততা ও সত্যতার গুণ-বৈশিষ্ট্য অর্জন করে, তখন তার নাম আল্লাহর কাছে সত্যবাদী-সিদ্দিক হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়। আর তোমরা মিথ্যা থেকে দূরে থাক। নিঃসন্দেহে মিথ্যা পাপের দিকে চালিত করে। পাপ জাহান্নামে নিয়ে যায়। ব্যক্তি যখন মিথ্যা বলে এবং মিথ্যায় মনোনিবেশ করে, তখন আল্লাহর কাছে তার নাম মিথ্যাবাদী হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়।’ অতএব, মুমিন প্রকৃতিগতভাবেই সত্ ও সত্যবাদী হবে এবং কখনোই মিথ্যাবাদী হবে না— এটাই স্বাভাবিক। পক্ষান্তরে মিথ্যা সব ধরনের দোষত্রুটি, পাপ, অন্যায় অপরাধের মূল উত্স। মিথ্যার চর্চা ও প্রচলনের ফলে মুসলিম সমাজে নেফাক, খেয়ানত ও প্রতারণার মতো নৈতিক অধঃপতন ও বিকৃতি দেখা দেয়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহর নিয়ামতপ্রাপ্ত বান্দাদের মধ্যে সিদ্দিকিন বা সাদেকিনদের কথা নবীদের পরপরই উল্লেখ করা হয়েছে। সাদেকিনদের পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্যে প্রত্যেক মুমিনেরই চেষ্টা-সাধনায় ব্রতী হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে বিশ্বমানবতার মুক্তির দিশারি প্রিয় নবী হজরত মোহাম্মদই (সা.) হচ্ছেন সর্বোত্তম আদর্শ ও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। নবুয়তলাভের অনেক আগেই তার সততা ও বিশ্বস্ততার সুনাম-সুখ্যাতি কিংবদন্তির মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী নির্বিশেষে তত্কালীন সব মানুষ তাকে ‘সাদিকুল আমিন’ পরম বিশ্বস্ত সত্যবাদী উপাধিতে ভূষিত করেছিল। তিনি প্রতিটি কথা ও কাজে সততা, সত্যতা ও বিশ্বস্ততা রক্ষা করতেন। এমনকি তার রসিকতাও ছিল সত্যনির্ভর। হাদিসে এসেছে, একদা রাসুলুল্লাহর (সা.) কাছে এক বৃদ্ধা এসে আরজ করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আপনি আল্লাহর কাছে দোয়া করুন, তিনি যেন আমায় বেহেশতে দাখিল করেন। তিনি বৃদ্ধাকে লক্ষ্য করে বললেন, বৃদ্ধারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এ কথা শুনে ওই বৃদ্ধাটি কাঁদতে কাঁদতে চলে যাচ্ছিলেন। হুজুর (সা.) সাহাবাদের বললেন, তাকে (মহিলাকে) আমার কাছে ফিরিয়ে আন। বৃদ্ধা ফিরে আসার পর তিনি বললেন, তুমি কি কোরআন মজিদের ওই আয়াতটি পড়োনি— ‘আমরা তাদের (নারীদের) বিশেষভাবে সম্পূর্ণ নতুন করে সৃষ্টি করব এবং তাদের কুমারী বানিয়ে দেব, তারা হবে নিজেদের স্বামীদের প্রতি আসক্ত এবং বয়সে সমকক্ষ। (সুরা ওয়াকিয়া : ৩৫-৩৭) এ কথা শুনে বৃদ্ধা আনন্দে উত্ফুল্লে চলে গেলেন। (তিরমিজি)
মানবীয় চরিত্রের অন্যতম প্রশংসিত গুণ হচ্ছে সততা। প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য, জীবনে সততা ও বিশ্বস্ততার ফসল আহরণে তত্পর ও যত্নবান হওয়া। কেননা সততা ও সত্যবাদিতা আখলাকে হাসানার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যার মধ্যে এ গুণের সমাহার থাকবে, সমাজের সব ধরনের লোক তাকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করবে। সর্বোপরি সে আখেরাতে আল্লাহর কাছে এর বিনিময় লাভ করবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করবে। তাই প্রত্যেক মুমিনের সততার গুণে গুণান্বিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।