Main Menu

মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুয়্যাতের মাদানী জীবন ও পর্যালোচনা

(৩য় পর্ব এখানে)

মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুয়্যাতের মাদানী জীবন ও পর্যালোচনা

মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুয়্যাতের মাদানী জীবন ও পর্যালোচনা

পূর্বে প্রকাশিতের পর

(৪র্থ পর্ব)
উভয় বাহিনী বদর প্রান্তরে
যুদ্ধ-সম্ভার ও রসদ-পত্রের এই দৈন্য সত্ত্বেও দ্বিতীয় হিজরীর ১২ই রমযান নবী করীম (সাঃ) আল্লাহর ওপর ভরসা করে মুিষ্টমেয় মুসলিম সৈন্য নিয়ে মদীনা থেকে যাত্রা করেন। আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রাঃ) কে মসজিদে নববীর ইমাম এবং আবু লুবাবা (রাঃ) কে মদীনার প্রশাসনিক আমীর নিযুক্ত করলেন। নবী করীম (সাঃ) মুসলিম বাহিনীকে দু’ভাগ করলেনঃ আনসার ও মুহাজির। মুহাজির দলের পতাকা দিলেন আলী (রাঃ) কে। আনসার দলের পতাকা দিলেন সা’দ বিন মু’আয (রাঃ) কে। ডানে, বামে এবং পশ্চাৎ ভাগেও দলপতি নিযুক্ত করলেন। আর তিনি নিজে মুজাহিদ বাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন। ১৬ই রমাযান রাসূল (সাঃ) বদর প্রান্তরে পৌঁছে একটি জায়গায় শিবির স্থাপন করলেন।
অপর দিকে যুদ্ধক্ষেত্রের যে অংশটি কুরাইশরা দখল করল, উপযোগিতার দিক দিয়ে তা ছিলো খুবই উত্তম। তাদের জমিন ছিলো অত্যন্ত মজবুত। আশেপাশে পানির ভাল ব্যবস্থা ছিল। সা’দ বিন মু’আয (রাঃ)-এর পরামর্শ অনুযায়ী রাসূল (সাঃ)-এর জন্য, যুদ্ধক্ষেত্রের উত্তর-পূর্বে একটি টিলার উপর মঞ্চ (আরীশ) তৈরী করা হলো এবং সা’দ বিন মু’আয (রাঃ)-এর নেতৃত্বেই একটি বাহিনী রাখা হল।
যুদ্ধ শুরু
দ্বিতীয় হিজরীর ১৭ই রমযান, শুক্রবার রাত। ঐ রাতে বৃষ্টি হল। মুসলিম বাহিনী রাতে ঘুমে বিভোর। আর রাসূল (সঃ) সারারাত নামাজ পড়লেন। শুক্রবার সকাল বেলা যুদ্ধের ময়দানে আল্লাহর অভয় বাণী আসলোঃ “তোমরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ো না এবং চিন্তিতও হয়ো না! তোমরাই বিজয়ী হবে যদি তোমাদের অন্তরে ঈমানের তেজ থাকে।”(আল-ইমরান ১৩৯)। আল্লাহ পাক আরো বললেনঃ “ আল্লাহর ইচ্ছা এটা যে, তিনি নিজ নির্দেশ দ্বারা সত্যকে সত্যরূপে প্রকাশ করবেন এবং কাফিরদের মূল কেটে ফেলবেন।” (আনফাল ৭ শেষাংশ)। অন্যদিকে আবু জাহল ফয়সালার দু’আ করলঃ ‘হে আল্লাহ! আমাদের মধ্যে যে দলটি তোমার নিকট প্রিয় ঐ দলটিকে সাহায্য কর।’ উত্তরে আল্লাহ জানালেনঃ “তোমরা যে ফয়সালা চেয়েছিলে তা তো তোমাদের নিকট এসেছে। তোমারা যদি (কুফরী থেকে) বিরত হও তবে সেটা হবে তোমাদের জন্যে কল্যাণকর। আর যদি তোমারা পূনরায় (সীমা লংঘন) কর, তবে আমিও পূনরায় তোমাদের শাস্তি দিবো। আর তোমাদের দল সংখ্যায় অধিক হলেও তোমাদের কোন কাজে আসবে না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ মুমিনদের সাথে রয়েছেন।” (আনফাল ১৯)।
প্রাচীন আরব প্রথানুযায়ী প্রথমে মল−যুদ্ধ শুরু হল। হামযা (রাঃ)-শাইবার বিরুদ্ধে; আলী (রাঃ)- ওয়ালীদ বিন উতবার এবং উবাইদা বিন হারিস- উতবার বিরুদ্ধে। মল−যুদ্ধে কুরাইশরা পরাজিত হওয়ার পরেই উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ শুরু হল। এ সময় রাসূল (সাঃ) দু’আ করতে থাকলেনঃ “হে আল্লাহ! তোমার এ ক্ষুদ্র দলটি যদি আজ শেষ হয়ে যায়, তবে তোমার ইবাদত করার মত কেউ থাকবে না।” “এ সময় আল্লাহ ফেরেশতাদের বললেনঃ আমি তোমাদের সাথে আছি। সুতরাং তোমারা মুমিনদের অবিচল রাখো, আমি এখনই কাফেরদের মনে আতংক সৃষ্টি করে দিব। কাজেই তোমারা তাদের গর্দানসমূহের উপর আঘাত কর এবং তাদের আঙ্গুল সমূহের প্রত্যেক জোড়ায় আঘাত কর।”(আনফাল ১২)। “এ সময় আল্লাহ পাক আরও বললেনঃ আমি তোমাদেরকে এক হাজার ফেরেশতা দ্বারা সাহায্য করবো, যারা একের পর এক আসবে।”(আনফাল ৯ শেষাংশ )। তখন নবী (সাঃ) একমুষ্টি পাথুরে মাটি নিয়ে শা-হাতিল উজূহ্ বলে কাফেরদের দিকে নিক্ষেপ করলেন। এরপরই মুসলমান সেনারা এক যোগে কাফিরদের উপর ঝঁপিয়ে পড়লেন। আর অল্পক্ষণের মধ্যেই কাফেরদের বড় বড় নেতারা নিহত হতে লাগল। আবু জাহলের মৃত্যুর সাথে সাথেই কুরাইশ সেনাদল ছত্র-ভঙ্গ হয়ে পালাতে লাগলো। মুজাহিদগণ দ্বিগুণ শক্তিতে বলিয়ান হয়ে কুরাইশ সৈন্যদের ধাওয়া করে, ৭০ জনকে নিহত এবং ৭০ জনকে বন্দী করলেন। মুসলিমগণ ইচ্ছা করলে এ সুযোগে আরো বহু সৈন্যকে নিহত করতে পারতেন। কিন্তু প্রেম ও করূণার মূর্ত প্রতীক মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর অন্তর হতভাগ্য মানুষের বেদনায় কেঁদে ফিরছিলো। তৎক্ষণাৎ তিনি আদেশ দিলেন; ওদেরকে মেরোনা। ওদের অনেকেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসেছে। দুনিয়ার অন্যান্য আন্দোলনের তুলনায় ইসলামী আন্দোলন যে কতখানী উন্নত ও শ্রেষ্ঠ এবং অনুগামীদেরকে সে কি ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে, এ থেকে তা সহজেই অনুমান করা যায়। মুসলমানদের পক্ষে মাত্র ৬ জন মুহাজির এবং ৮ জন আনসার শহীদ হলেন। যুদ্ধে মুসলমানগণ আল্লাহর রহমতে বিজয় লাভ করলেন।
কঠিন পরীক্ষা ছিলো যাদের
ইসলামী আন্দোলনের জিহাদ হচ্ছে চুড়ান্ত পরীক্ষা, যার মাধ্যমে আন্দোলনের অনুবর্তীদের পূর্ণ যাচাই হয়ে যায়। এ যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়েছিল মক্কার মুহাজিরদেরকে। এদের প্রতিপক্ষ ছিলো আপন ভাই-চাচা আত্মীয়-স্বজন ইত্যাদি। কারো বাপ, কারো চাচা, কারো মামা আবার কারো ভাই ছিলো তার তলোয়ারের লক্ষ্যবস্তু এবং নিজ হাতে তাদের হত্যা করতে হয়েছিল এসব কলিজার টুকরাকে। এ ধরনের কঠিন পরীক্ষায় একমাত্র তারাই টিকে থাকতে পারেন যারা পরিপূর্ণ নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা সহকারে হক ও সত্যের সাথে সম্পর্ক জুড়েছে এবং মিথ্যা ও বাতিলের সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করতে পুরোপুরী প্রস্তুত হয়েছে। ওদিকে আনসারদের পরীক্ষাও কোন দিক দিয়ে সহজ ছিলনা। এতদিন তারা মুসলমানদেরকে শুধুমাত্র আশ্রয় দিয়ে কুরাইশ ও তাদের সহযোগী গোত্রগুলোর শক্রতার ঝুঁকি নিয়েছিল। কিন্তু এবার তো তারা ইসলামের সমর্থনে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসেছে। এর মানে ছিল, কয়েক হাজার লোকের একটি জনবসতি সমগ্র আরব দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়ে গেছে। এ ধরনের দুঃসাহস একমাত্র তারাই করতে পারে যারা সত্য আদর্শের ওপর ঈমান এনে তার জন্য নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থকে সম্পূর্ণ জলাঞ্জলি দিতে প্রস্তুত হতে পারে। নতুবা আপন ধন-দৌলত এবং স্ত্রী পুত্র-পরিবারকে এভাবে সমগ্র আরব ভূমির শত্রুতার ন্যায় কঠিন বিপদের মুখে কে নিক্ষেপ করতে পারে?
শেষ কথা
হৃদয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখেরাতে সাফল্যের প্রবল বাসনা থাকলেই আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠায় নিজেকে পুরোপুরী উৎসর্গ করা যায় এবং যে কোন কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া যায়। যার বাস্তব উদাহরণ হচ্ছে মুহাজির ও আনসারগণ। যুদ্ধে যেভাবে তাঁরা বিজয়ী হলেন, অন্য কোন লোক হলে এ ঘটনাকে নিজের ‘কেরামত ( অলৌকিক) কীর্তি বলে ইচ্ছামত গর্ব করতে পারতো এবং একে ভিত্তি করে তার অনুগামীরাও নানারূপ কিস্সা কাহিনীর সৃষ্টি করতো। কিন্তু কুরআনে স্বয়ং আল্লাহ তা’য়ালা মুসলমানদেরকে বলে দিলনঃ “তাদেরকে তোমরা হত্যা করোনি, বরং তাদের হত্যা করেছেন আল্লাহ।” এমন কি, তিনি নবী (সাঃ)কে পর্যন্ত বলে দিলেন যে, “(বালু) তুমি ছুঁড়োনি,বরং ছুড়েছেন আল্লাহ এবং মুমিনদেরকে একটি উত্তম পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ করার জন্যেই এসব কিছু করা হয়েছে।”(আনফাল ১৮)। এভাবে মুসলমানদেরকে বলে দেয়া হলো যে, প্রকৃতপক্ষে সমস্ত কাজের চাবিকাঠি রয়েছে আল−াহর হাতে এবং যা কিছু ঘটে তাঁর নির্দেশ ও ইচ্ছানুসারেই ঘটে থাকে। মুমিনদের কাজ হচ্ছে আল−াহ তা’য়ালার ওপর পুরোপুরী নির্ভর করা এবং সর্বাবস্থায় আল−াহ ও রাসূলের পূর্ণ আনুগত্য করা। এরই ভিতর নিহিত রয়েছে তাদের জন্যে সাফল্য।
রাসূল (সা.)-এর সমর কৌশল
অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাসূল (সা.) কে যুদ্ধের ময়দানে নামতে হয়েছিল। তারপরেও তিনি ভূখন্ড জয়ের পরিবর্তে মানুষের হৃদয় জয় করতে চেয়েছিলেন। তিনি তরবারী দিয়ে মানুষের দেহকে অনুগত করার পরিবর্তে যুক্তি দিয়ে বিবেককে ও সুন্দর চরিত্র দিয়ে মনকে বশীভূত করতে চেয়েছিলেন। তাঁর আসল যুদ্ধ ছিল জনমতের ময়দানে। এই ময়দানে শত্রুরা ক্রমাগত পরাভূত হয়েছিল। কাজেই ইসলামের দুশমনদের সাথে রাসূল সা: কে যে সংঘাতে লিপ্ত হতে হয়েছিল, সশস্ত্র যুদ্ধ ছিল তার একটা অতি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। তাঁর সমর কৌশলের মূল কথা ছিল, শত্রুর রক্ত ঝরানোর চেয়ে তাকে অসহায় করে দেয়াকে অগ্রাধিকার দান, যতক্ষণ না সে সহযোগিতা করে অথবা প্রতিরোধ ত্যাগ করে। তাঁর রাজনীতির লক্ষ্য কোরেশদেরকে ধ্বংস করা ছিল না, বরং সম্পূর্ণরূপে অক্ষত রেখে অক্ষম ও পরাভূত করা ছিল তাঁর লক্ষ্য। কোরায়শদের কাছ থেকে আঘাতের পর আঘাত পেয়েও তাঁর মধ্যে এই আকাংখা প্রবলভাবে বিরাজ করতো যে ওরা ধ্বংস হয়ে না যাক বরং হেদায়েত লাভ করুক। কিন্তু তাঁর এ আকাংখাকে কেউ মূল্যায়ণ না করে বরং ইসলাম ও মুসলমানদের সমুলে ধ্বংস করার পায়তার করেছে। কাজেই মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁকে সমর কৌশল প্রণয়ন করতে হয়েছে। তিনি নিজের প্রতিরক্ষা শক্তিকে সংখ্যা, সংঘবদ্ধতা, পরিশ্রম, সামরিক প্রস্তুতি ও চারিত্রিক প্রশিক্ষণের দিক দিয়ে দ্রুত বিকশিত করেছেন, অতঃপর তাকে একটা যন্ত্রের মত সদা সক্রিয় রেখেছেন এবং তা দ্বারা বিরোধীদেরকে তিনি ভীত
সন্ত্রস্থ করে রেখেছেন। মক্কাবাসীর বাণিজ্যপথকে অবরোধ করে তাদেরকে নিস্তেজ করে দিয়েছেন। সমঝোতা ও চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে বিভিন্ন গোত্রেকে ক্রমান্বয়য়ে শত্রুর কাছ থেকে বিছিন্ন করে নিজের সাথে নিয়েছেন। সামরিক অভিযানের জন্য তিনি রকমারি কৌশল অবলম্বন করেছেন। কখনো অবলম্বন করেছেন শত্রুকে প্রস্তুত হবার সুযোগ না দিয়ে অতর্কিতে আক্রমণের পন্থা ( যেমন মক্কা বিজয়)। কখনো অপ্রত্যাশিত পথ অবলম্বন করে এবং অভিযানের গন্তব্যস্থলকে গোপন রেখে বিরোধীদেরকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলেছেন (যেমন বনুল মুস্তালিকের যুদ্ধ)। কখনো যুদ্ধের নকশা আগে থেকে নিজের পক্ষ করে রেখেছেন (যেমন বদরের যুদ্ধ)। আবার কখনো এমন কোন নতুন প্রতিরক্ষাকৌশল অবলম্বন করেছেন, যার পূর্ব অভিজ্ঞতা শত্রুর ছিল না (যেমন খন্দক যুদ্ধ)।
এরপরেও রাসূল সা: এর হৃদয়ে মানবতার সংস্কার ও সংশোধনের যে মনোভাব সক্রিয় ছিল,তা সহজেই অনুমান করা যায়। মক্কায় যখন যুলুম নির্যাতন চরম আকার ধারণ করলো এবং কোরায়শদের আক্রোশ অতিমাত্রায় আগ্রাসী রূপ ধারণ করলো, তখন সেই নারকীয় সন্ত্রাস ও সহিংসতার প্রধান হোতাদের মধ্যে অন্যতম ছিল আবু জাহল ও ওমর বিন খাত্তাব। এমন কট্টর দুশমনদের ব্যাপারে কোন দুনিয়াদার রাজনীতিক চরম রুষ্ট মনোভাব ও মনে মনে ধ্বংস কামনা না করে পারতো না। কিন্তু হিংস্রতার আগুনে দগ্ধ হয়েও রাসূল সা: কাতর কন্ঠে দোয়া করতেন, আল্লাহ যেন তাদের অন্তত কোন একজনকে হেদায়েত দান করেন। ওমরের ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে তাঁর দোয়া সফল হয়। এর থেকে প্রমাণিত হয় যে রাসূল সা: নিজের শত্রুদের ধ্বংসের চেয়ে তাদের কল্যাণ কামীই ছিলেন বেশী এবং শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের ব্যাপারে ভালো আশা পোষণ করতেন।
দ্বিতীয় ঘটনা হলো, তায়েফের হৃদয়-বিদারক ঘটনা। তায়েফবাসীদের হিতকামনার অপরাধে তাদের হাতে রাসূলের মর্মান্তিকভাবে আহত হওয়ার পরও তাদের জন্য কোন খারাপ ধারনা পর্যন্ত তিনি করলেন না। কোন দুনিয়াদারী রাজনীতিবীদের কাছে কি এমনটা আশা করা যায়? সে তাদের ওপর সারা জীবন রুষ্ট, ক্ষুদ্ধ ও হিংস্র হয়ে যেত এবং ক্ষমতা হাতে পাওয়ার প্রথম সুযোগেই এমন অসভ্য শহরবাসীকে শহর সহ ধ্বংস করে দিত। নির্যাতনের পর রাসূল সা: এর সাথী মর্মাহত হয়ে ঠিক এই ধারায়ই চিন্তা করেছিলেন এবং বলেছিলেন, এই নরপশুদের জন্য বদদোয়া করুন। এমনকি জিবরীল (আ:) ও তাঁর প্রচ্ছন্ন মনোভাব পরীক্ষা করার জন্য জানান যে, তাঁর ইংগিত পেলে পাহাড়ের ফেরেশতারা মক্কা ও তায়েফকে ধ্বংস করে দিতে প্রস্তুত। কিন্তু রাসূল সা: বললেন, না,ওরা অজ্ঞতার কারণে ভুল পথে চলছে। ওরা যদি ঈমান নাও আনে, তবে ওদের বংশধররা সত্যের দাওয়াত কবুল করে এক আল্লাহর খাঁটি বান্দা হয়ে যাবে। এমনি ধরনে আরো অনেক ঘটনা আছে যা থেকে আমরা তাঁর মানব দরদী হওয়া প্রমাণ পাই। তিনি রাজনীতিতে শক্তি প্রয়োগের পরিবর্তে কৌশল ও কল্যাণকামিতা ছিলেন। রাজনৈতিক কুশলতা ও বিচক্ষণতার এর চেয়ে বড় অলৌকিক প্রমাণ কী হতে পারে যে, তিনি মদীনায় যাওয়ার অব্যহতি পরই বিভিন্ন পর্যায়ের লোকদের সাথে আলাপ আলোচনা চালিয়ে ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করলেন। কোন বৈপ্লবিক মতবাদের ওপর এক ফোঁটা রক্ত না ঝরিয়েই একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার দৃষ্টান্ত সম্ভাবত সমগ্র মানবেতিহাসেও পাওয়া যাবে না। একমাত্র এটাই ছিল সঠিক অর্থে রক্তপাতহীন বিপ্লব। যার জন্য মানুষেরা এক ফোঁটা রক্ত ও ঝরায়নি একটা লাশও পড়েনি। এমন দৃষ্টান্ত স্থাপনের পরও শত্রুরাকি রাসূল সা: ও মুসলমানদের নিশ্চিন্তে বসবাস করতে দিয়েছে? একের পর এক ষড়যন্ত্র, যুদ্ধের পর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে ইসলাম ও মুসলমানদের শেষ করে দেয়ার অব্যাহত চেষ্টার ত্রুটি তারা করেনী।

অপর দিকে মুসলমানদের ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ব শুধু নিজেদের জানমাল ও সম্মান রক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়নি, বরং অন্য কোন এলাকায়ও যদি দুর্বল অসহায় লোকেরা নির্যাতনে নিষ্পেষিত হতে থাকে তবে তাদের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়াও মুসলমানদের কর্তব্য। সে ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা থাকবে নিরীহ ও নির্দোষ জনগণকে অব্যাহতি দেয়া, আর জালেমদেরকে কঠোর হস্তে দমন করা। মানবতার কল্যাণে মুসলমানদের এ কাজটি ফরজ করা হয়েছে, এক্ষেত্রে কোন রকম শীতিলতা দেখানো চলবে না। এক্ষেত্রে যদি কোন রকম শৈথিল্য ও উদাসীনতা করা হয় তাহলে তার ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে এই বলে যে, একাজে উদাসীনতার ফলে তোমাদের রাষ্ট্র, সরকার ও ক্ষমতা সবই ধ্বংস হয়ে যাবে। তোমরা যদি সাহস করে এগিয়ে না যাও, তবে বিরোধীরা তোমাদের ওপর চড়াও হবে, এবং তোমাদের হটিয়ে পদদলিত করে নিজেদের শাসন চালু করবে। তখন তোমরা দুর্বল কাপুরুষের মত তাকিয়ে থাকবে,নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত হবে তখন ঈমানও বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়বে। কাজেই যারা ইসলামের কাজে প্রতিনিয়ত বাধার সৃষ্টি করে, আক্রমন চালিয়ে মুসলমানদের সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে চায়,তাদের বিরুদ্ধে জেহাদ করা ছাড়া কোন উপায় থাকে না। ইসলামের শত্রুদেরকে এ কাজ চালিয়ে যেতে দেয়া হলে তারা ইসলামেরই মূলোৎপাটন করে ছাড়বে। অতএব সত্য ও ন্যায়ের পথে প্রতিরোধকারীদেরকে পুরোপুরিভাবে নির্মূল করা এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ দীন চালু না হওয়া পর্যন্ত সর্বশক্তি নিয়োগের মাধ্যমে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। (চলবে…)

Related Post