পূর্বে প্রকাশিতের পর
মুসলমানরা নিজেদের পক্ষ থেকে কথা বলার জন্যে জাফর বিন আবু তালেবকে মনোনীত করলেন। বাদশাহ তার দরবারে ধর্মযাজকদের ইঞ্জিল খুলে বসতে বললেন। অতঃপর জিজ্ঞেস করলেন,“তোমাদের সেই ধর্মটা কি যা গ্রহণ করে তোমরা নিজ জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছ এবং আমার ধর্ম বা অন্য কোন ধর্ম গ্রহণ করনি।?” মুসলমানদের মুখপাত্র হিসাবে জাফর বিন আবু তালেব উঠে দাঁড়ালেন এবং নাজ্জাশীর কাছে এই মর্মে আবেদন জানালেন যে, প্রথমে তাকে মক্কার দূতদ্বয়ের কাছে কয়েকটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে অনুমতি দেয়া হোক। নাজ্জাশীর অনুমতি লাভের পর তিনি নিম্নরূপ প্রশ্ন করলেনঃ
জা‘ফরঃ আমরা কি মক্কায় কারো ক্রীতদাস ছিলাম যে, আমরা আমাদের মনিবের কাছ থেকে পালিয়ে এসেছি? তা যদি হয়ে থাকে, তাহলে তো আমাদের অবশ্যই ফেরত পাঠানো উচিত।
আমর ইবনুল আসঃ না, তোমরা ক্রীতদাস নও, স্বাধীন ও সম্ভ্রান্ত।
জাফরঃ আমরা কি কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে এসেছি? যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে আমাদেরকে অবশ্যই নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী বা অভিভাবকদের কাছে ফেরত পাঠানো উচিত।
আমর ইবনুল আসঃ না, তোমরা এক ফোঁটা রক্তও প্রবাহিত করনি।
জাফরঃ আমরা কি কারো ধনসম্পদ চুরি করে এসেছি? তা যদি হয়ে থাকে, তাহলে আমরা সেই পাওনা পরিশোধ করতে প্রস্তুত।
আমর ইবনুল আসঃ না, তোমাদের কাছে কারো এক পয়সাও পাওনা নেই।
এই জেরার মাধ্যমে যখন মুসলমানদের নৈতিক অবস্থা ও মান সুস্পষ্ট হয়ে গেল, তখন জাফর তাঁর ভাষণ দেয়া শুরু করলেন। তিনি দরবারে যে ভাষণ দেন, তার বিস্তারিত বিবরণ ইতিহাস গ্রন্থসমূহে সংরক্ষিত রয়েছে। তার থেকে সামান্য তুলে ধরা হলোঃ জাফর বিন আবু তালেব বললেন, “ হে বাদশাহ ! আমরা ছিলাম অজ্ঞ জাতি। অন্ধকার ও বিভ্রান্তির মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলাম। আমরা এক আল্লাহর পরিবর্তে মানুষের গড়া অসংখ্য মূর্তির পূজা করতাম। মরা জীব-জন্তুর গোশত খেতাম: ব্যভিচার, লুটতরাজ, চৌর্যবৃত্তি, পারস্পারিক জুলুম, যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদি ছিলো আমাদের দৈনন্দিন কাজের অন্তর্ভুক্ত। আমাদের শক্তিমানরা দুর্বলদের শোষণ করতে গর্ববোধ করতো। মোটকথা, জীব-জন্তুর চেয়েও আমাদের জীবনযাত্রা ছিলো নিম্ন পর্যায়ের। কিন্তু আল্লাহর রহমত দেখুন, তিনি আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করে আমাদেরই ভিতরকার এক ব্যক্তিকে রাসূল নিযুক্ত করে পাঠিয়েছেন। আমরা তাঁর বংশ-খান্দানকে খুব ভালো করে জানি। তাঁর ব্যক্তিগত অবস্থার সঙ্গেও পরিচিত। তিনি অত্যন্ত ভালো লোক এবং সত্যবাদী, আমানতদার, ও সচ্চরিত্রবান। দোস্ত, দুশমন সবাই তাঁর সততা ও ভদ্রতার প্রশংসা করে। তিনি আমাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পেশ করেছেন এবং এই শিক্ষা দিয়েছেনঃ “তোমরা মূর্তিপূজা ছেড়ে দাও; এক আল্লাহকে নিজের মালিক ও মনিব বলে স্বীকার করে; জীবনের সকল কাজে তাঁরই বন্দেগী করো; সত্য কথা বলো, হত্যা ও খুন-খারাবী থেকে বিরত থাকো। এতীমের মাল খেয়ো না, পাড়াপড়োশীর সাহায্য করো, ব্যভিচার ও অন্যান্য অশ্লীল ক্রিয়াকর্ম থেকে বেঁচে থাকো। নামাজ পড়তে ও যাকাত দিতে বললেন। এভাবে জাফর একে একে ইসলামের বিধানগুলো তুলে ধরলেন। এরপর বললেন, আমরা তাঁর প্রতি ঈমান এনেছি, শির্ক ও মূর্তিপূজা ছেড়ে দিয়েছি এবং সমস্ত অসৎ কাজ থেকে তাওবা করেছি। এরফলে আমাদের কওম আমাদের শত্র“ হয়ে গেল, তারা আমাদের ওপর জুলুম নির্যাতন দ্বারা আমাদের জীবন দুর্বিসহ করে তুললো এবং আমাদেরকে সেই পূর্বের পথে ফিরিয়ে নেয়ার চাপ দিতে লাগলো। এই পরিস্থিতিতে আমরা আমাদের ঈমান ও জান বাঁচানোর জন্য আপনার দেশে পালিয়ে এসেছি। আমাদের আশা এই যে, আপনার কাছে অত্যাচারের শিকার হবো না।” নাজ্জাশী বললেন, “ বেশ, তোমাদের নবীর ওপর আল্লাহর যে কালাম নাযিল হয়েছে, তার কিছু অংশ পড়ে শোনাও।” জাফর বিন আবু তালেব সূরায়ে মারইয়ামের কতিপয় আয়াত পড়ে শোনালেন। নাজ্জাশী আয়াত গুলো শুনে অত্যন্ত প্রভাবিত হলেন। তাঁর চোখ বেয়ে পানি ঝরে দাড়ি ভিজে গেল। তাঁর সাথে সাথে ধর্মযাজকরাও কাঁদতে কাঁদতে ইঞ্জিল কিতাব ভিজিয়ে ফেললেন। তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে বললেন, “আল্লাহর কসম, এই কালাম আর ইঞ্জিল কিতাব একই উৎস থেকে এসেছে। মুহাম্মদ তো সেই রসূলই, যার ভবিষ্যদ্বাণী হযরত ঈসা আ. করেছিলেন। আল্লাহর শোকর যে, আমি সেই রসূলের যুগটা পেয়ে গেলাম। সাথে সাথে তিনি এই ঘোষণা দিলেন, হে কুরাইশ দূতদ্বয়, তোমাদের হাতে মুসলমানদের,ফেরত দেয়া সম্ভব নয়। ওরা এখানেই থাকবে।”
হযরত উমরের ইসলাম গহণ
রাসূল সা. যখন নবুয়্যত লাভ করেন, তখন উমরের বয়স ছিল সাতাশ বছর। ইসলাম গ্রহণের আগে উমর (রাঃ) ছিলেন ইসলামের কঠোরতম দুশমনদের অন্যতম। ইসলাম খুব দ্রুত গতিতে তাঁর পরিবারে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর ভগ্নীপতি সাঈদ প্রথমে ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাঁর বোন ফাতেমাও মুসলমান হয়ে যান। উমরের (রাঃ) পরিবারের আরো এক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব নঈম বিন আবদুল্লাহও ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেন। প্রথমে তিনি জানতেই পারেননি যে, তাঁর পরিবারে এভাবে ইসলামের বিস্তার ঘটেছে। কুরাইশরা একদিকে ইসলামী আন্দোলন ও তাঁর আহবায়কের বিরোধিতায় চরম পন্থা অবলম্বন করতে লাগলো, অন্যদিকে এদের সঠিক পথ-নির্দেশনার জন্যে মুহাম্মাদ সা.-এর হৃদয়- মন আবেগে উদ্বেলিত হয়ে উঠলো। আবু জেহেল এবং উমর উভয়েই তাঁর দুশমনীতে অত্যন্ত কঠোর ভূমিকা গ্রহণ করেছিলো। দাওয়াত ও তাবলীগের কোন প্রচেষ্টাই তাদের ওপর কার্যকর হচ্ছিলো না। তাই একদিন অল্লাহর কাছে তিনি দোয়া করলেনঃ “প্রভু হে, আবু জেহেল এবং উমর-এ দু‘জনের মধ্যে যে তোমার কাছে বেশি প্রিয়, তাকে তুমি ইসলামের দ্বারা সম্মানিত করো।” উমর (রাঃ) বর্ণনা করেছেনঃ “জাহেলিয়াতের যুগে খুব বেশি পরিমাণে মদ খেতাম। মক্কার একটি বাজারে (হাযওয়ারাতে) আমাদের মদের আসর বসতো এবং সেখানে কুরায়শী বন্ধুরা জমায়েত হতো। এক রাতে আমি নিজের সতীর্থদের আকর্ষণে ঐ আসরে উপস্থিত হই। সতীর্থদের কাউকে সেখানে না পেয়ে চলে গেলাম কা‘বা শরীফে। সেখানে গিয়ে দেখলাম রাসূল সা. নামাজ পড়ছেন। সহসা মনে ইচ্ছা জাগলো, লোকটা কি পড়ে একটু শোনা যাক। কা‘বার গেলাফের ভিতরে ঢুকে আস্তে আস্তে একেবারে কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। তিনি সূরায়ে আল- হাক্কাহ থেকে পড়ছিলেন। আমি কালাম শুনে বিস্ময়-বিমুগ্ধ হলাম। মনে মনে ভাবলামঃ অল্লাহর কসম ! লোকটি নিশ্চয়ই কবি। ঠিক সে মূহূর্তে তিনি এ আয়াত পড়লেনঃ “এ এক সম্মানিত বার্তাবাহকের কালাম,এ কোনো কবির বাণী নয়; (কিন্তু) তোমাদের মধ্যে খুব কম লোকই ঈমান এনে থাকে।” এ কথা শোনামাত্রই আমার ধারণা হলোঃ ‘লোকটি তো আমার মনের কথা জেনে ফেলেছে। এ নিশ্চয় কোনো গণক হবে।’ এরপরই তেলাওয়াত করলেনঃ “এ কোনো গণকের কালাম নয়, তোমরা খুব কমই নসিহত পেয়ে থাকো। এতো রাব্বুল আলামীনের কাছ থেকে নাযিল হয়েছে।” তিনি এ সূরা শেষ পর্যন্ত পড়লেন। আমি অনুভব করলাম, ইসলাম আমার হৃদয়ে তার আসন তৈরি করে নিচ্ছে। কিন্তু হযরত উমর অত্যন্ত শক্ত প্রকৃতির ও দৃঢ়চিত্ত লোক ছিলেন। এজন্যে এবারই তাঁর ভিতরকার পরিবর্তনটা পূর্ণ হলো না। তিনি তাঁর চিরাচরিত পথেই চলতে লাগলেন।