মুহাম্মাদ (সা.)-এর নবুয়্যাতের মাদানী জীবন ও পর্যালোচনা
প্রথম পর্ব
মানবতার সবচেয়ে বড় আপনজন, পরম হিতাকাংখী বন্ধু, বিপন্ন মানুষের আশ্রয়স্থল এবং বিশ্বের সবচেয়ে সফল ইতিহাস সৃষ্টিকারী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন ইতিহাসের মাক্কী যুগটা হলো দাওয়াত ও আদর্শ প্রচারের মাধ্যমে আলোকিত মানুষ তৈরীর যুগ। আর মাদানী যুগ শাসন ক্ষমতায় থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠার যুগ। মক্কায় লোক তৈরী করা হয়েছে। আর মদীনায় ইসলামের পূর্ণাঙ্গ রূপ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মক্কায় ইট তৈরী করা হয়েছে। আর মদীনায় ভবন নির্মিত হয়েছে। কুরআন, রাসূলের জীবনী ও ইসলামের ইতিহাসকে স্থূল দৃষ্টিতে অধ্যায়নকারী সাধারণ মানুষের ধারণা হলো, ইসলামী আন্দোলন ও তার আহবায়কের ওপর পরীক্ষার কঠিন সময় কেবল মক্কায়ই কেটেছে। মদীনায় বিরোধিতার তেমন তীব্রতা ও সার্বক্ষণিক নির্যাতনের দুর্বিষহ পরিবেশ ছিলনা,যেমন ছিলো মক্কায়। কিন্তু বাস্তব ঘটনা এর বিপরীত। পাকা ইট তৈরী করা যেমন কষ্টকর, সে ইটের দ্বারা ভবন তৈরী করা তার চেয়েও বেশী কষ্টকর। এ ক্ষেত্রে ভবনের ভিত্তি স্থাপন করতেই অসংখ্য ইট মাটির নীচে চাঁপা দিয়ে তার ওপর ভবন তৈরী করা হয়। মাক্কী জীবনে শত্রুদের তরবারী কোষবদ্ব ছিলো। আর মাদানী জীবনে সে তরবারী কোষ উন্মুক্ত হওয়ায় একের পর এক যুদ্ধের মোকাবেলা করতে হয়েছিলো। আহত ও শহীদ হতে হয়েছিল অসংখ্য সাহাবীকে। ইতিহাসের চিরাচরিত নিয়ম হলো, সংস্কার, সংশোধন ও পুনর্জাগরণের কাজ যতই অগ্রসর হয়, সংস্কার বিরোধী কর্মবিমুখ স্বার্থপর গোষ্ঠীগুলো তাকে বিনষ্ট ও ধ্বংস করার জন্য শত্রুতার আবেগে ততই হন্যে হয়ে উঠে। তখন বাতিলের বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসার সকল সীমা অতিক্রম করে যায়। তাদের নিত্য নতুন ষড়যন্ত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীদেরকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মদীনায় নতুন ইসলামী সমাজ ও শান্তিপূর্ণ কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে এ ধরনের পরিস্থিতিরই মোকাবেলা করতে হয়েছিল। তবে একথা সত্য যে, মক্কার চেয়ে মদীনায় বিপুল সংখ্যক আপামর জন সাধারণের সার্বিক সাহায্য, সহযোগিতা ও অকুন্ঠ সমর্থন পাওয়া গেছে। তারা তাদের জীবন বাজী রেখে দ্বিন প্রতিষ্ঠায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সহযোগিতা করেছেন, যা মক্কায় পাওয়া যায়নী। মক্কার লোকেরা তাঁকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আর মদীনার লোকেরা সাদরে বরণ করে নিয়েছে। তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সাদরে বরণ করে নেয়ার জন্য প্রতিদিন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছে। যা সত্যিই মনকে উদ্বেলিত করে।
মদীনাবাসীর অপেক্ষার মুহূর্ত
মানব জাতির ত্রাণকর্তা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমন বার্তা পূর্বেই মদীনায় ছড়িয়ে পড়লো যে তিনি মক্কা থেকে রওয়ানা হয়ে মদীনার পথ ধরে এগিয়ে চলেছেন। এ খবর শুনে স্বভাবতই মদীনায় উত্তেজনা চরম আকার ধারণ করলো এবং অপেক্ষার মুহূর্তগুলো অসহনীয় হয়ে উঠলো। ছোট ছোট শিশুদের মুখে পর্যন্ত এ কথাই উচ্চারিত হতো যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসছেন। লোকেরা প্রতিদিন সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে শহরের বাইরে জমায়েত হয়ে অপেক্ষা করতো। লোকদের মধ্যে এতোখানি আগ্রহ-উদ্দীপনার সঞ্চার হলো যে, প্রতিটি হৃদয়ই যেনো পথের বিছানায় পরিণত হলো; প্রতিটি জীবনই উৎসর্গীকৃত হবার জন্যে অস্থির হয়ে উঠলো। গ্রীষ্মের সূর্য মাথার ওপর এলে এবং রৌদ্র অসহনীয় হয়ে উঠলে আক্ষেপ করতে করতে ঘরে ফিরে যেত। যেদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্যি সত্যিই এসে পৌঁছলেন, সেদিনও যথারীতি লোকেরা জমায়েত হওয়ার পর ঘরে ফিরে যাচ্ছিলেন। সহসা এক ইহুদী এক দূর্গের ওপর থেকে দেখেই সুসংবাদ শোনালেন, “ওহে ইয়াসরিববাসী!ঐ দেখ, তোমরা যে মহা মানবের অপেক্ষা করছো, তিনি এসে গেছেন।” আর যায় কোথায়, সমগ্র শহর আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে ফেটে পড়লো। লোকেরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে ছুটে চললো। অধিকাংশ আনসার সশস্ত্র হয়ে বেরুলো। এমনকি মেয়েরা গৃহের ছাদে উঠে গাইতে লাগলোঃ চন্দ্র উদিত হয়েছে, বিদা’পর্বতের ঘাঁটি থেকে, আল্লাহর শুকরিয়া আদায় আমাদের কর্তব্য, যতক্ষণ প্রার্থনাকারীরা প্রার্থনা করে। কিশোরী বালিকারা ‘দফ’ বাজিয়ে গাইতে লাগলোঃ আমরা নাজ্জার বংশের বালিকা, (আর) মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের কতো উত্তম পড়োশি। মদীনার ভাগ্যে যখন এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটা জুটলো, তখন সেখানে কেমন চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল, তা একবার কল্পনা করুন! সেখানকার অলিগলিতে কেমন দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল এবং আকাশে বাতাসে কেমন অনুতূতি ও কেমন সাড়া জেগেছিল একটু ভাবুন তো! মদীনা থেকে তিন মাইল দূরবর্তী শহরতলীর জনপদ কুবাতে তিনি সর্বপ্রথম আবাসস্থল করলেন। আমর বিন আওফের পরিবারই তাঁর আতিথেয়তা করার সৌভাগ্য লাভ করলো। এই বাড়ী আসলে ইসলামী আন্দোলনের একটা ঘাঁটিতে পরিণত হলো। আর মোহাজেরদের অধিকাংশের জন্যই এই বাড়িটা প্রথম মনযিলে পরিণত হলো। হযরত আলী (রা:)ও মানুষের আমানতগুলো পৌঁছিয়ে দিয়ে এখানেই নিজের প্রাণপ্রিয় নেতা ও কাফেলার সাথে এসে মিলিত হলেন। কুবায় অবস্থানকালে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হাতে একটি মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করলেন। প্রত্যেক মুসলমান এর নির্মাণ কাজে শরীক ছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসের সেরা ব্যক্তিত্ব একজন সাধারণ শ্রমিকের ন্যায় বড় বড় পাথর বহন করলেন। এ মসজিদ শুধু ইঁট পাথর ইত্যাদির সমষ্টি ছিল না, বরং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুরু করে একজন সাধারণ মুসলমান পর্যন্ত সবাই আন্তরিকতা ও তাকওয়ার পরিচয় দিয়েছিলেন। এ জন্যই এ মসজিদ সম্পর্কে কুরআন বলেছেঃ “এটা এমন মসজিদ যার ভিত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাকওয়ার ওপর।” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুবায় আগমন করেন নবুয়্যাতের ত্রয়োদশ বছরের ৮ই রবিউল আউয়াল (মুতাবেক ২০ শে সেপ্টেম্বর, ৬২২ ঈসায়ী সনে)।
মদীনায় অবস্থান, উন্নয়ন ও নির্মাণ কাজ
কুবায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চৌদ্দ দিন অবস্থানের পর সদলবলে তিনি মদীনায় রওয়ানা দিলেন। কুবা থেকে মদীনা পর্যন্ত আনসারগণ রাস্তার দু‘ধারে লাইন করে দাঁড়িয়েছিলেন মোবারকবাদ জানানোর জন্য। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মায়ের পক্ষের আত্মীয়রা বিশেষভােেব সশস্ত্রভাবে অবস্থান গ্রহণ করেন। দিনটি ছিল শুক্রবার। পথে বনী সালেমের মহল্লা পর্যন্ত পৌঁছলে যোহর নামাজের সময় হলো। এখানে তিনি সর্বপ্রথম জুম‘আর খুতবা প্রদান করেন এবং প্রথমবার জুম‘আর নামাজ পড়ালেন। মদীনায় প্রবেশকালে প্রতিটি আত্মোৎসর্গী মুসলিমের হৃদয়েই তাঁর মেহমানদারীর সৌভাগ্য লাভের আকাংখা জাগলো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মেহমানদারীর সৌভাগ্য কে লাভ করবে? এ বিষয়টি মীমাংসা করা মোটেই সহজসাধ্য ছিলো না। তিনি বললেন যে, “আমার উষ্ট্রী যার গৃহের সামনে দাঁড়াবে, এ খেদমত সে- ই গ্রহণ করবে।” ঘটনাক্রমে এ সৌভাগ্যটুকু হযরত আবু আইয়ূব আনসারীর ভাগ্যে জুটলো। বর্তমানে যেখানে মসজিদে নববী অবস্থিত, তার নিকটেই ছিলো তাঁর গৃহ। গৃহটি ছিলো দ্বিতল বিশিষ্ট। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্যে ওপরের তলাটি পেশ করেন। কিন্তু লোকদের আসা-যাওয়ার সুবিধার্থে তিনি নীচের তলায় থাকাই পছন্দ করলেন। আবু আইয়ূব এবং তাঁর স্ত্রী নীচতলা
ছেড়ে ওপর তলায় চলে গেলেন। একটু স্বস্তি লাভ করার এবং সফরের ক্লান্তি দূর হওয়ার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উন্নয়ন ও নির্মাণ কাজ শুরু করলেন। প্রথম যে কাজটা শুরু করা হলো, তা ছিল মসজিদ নির্মাণ। দু‘জন এতীম শিশুর পতিত জমি খরিদ করা হলো এবং আবু আইয়ূব আনসারী তার মূল্য পরিশোধ করলেন। এই জমিতে মসজিদে নববীর ভিত্তি স্থাপিত হলো। মসজিদ শুধু নামাযের স্থান হিসেবেই গুরুত্ব বহন করতো না বরং তাকে ইসলামী রাষ্ট্র ও সভ্যতার কেন্দ্র ও উৎস হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল। একাধারে সরকারের দরবার, পরামর্শ কক্ষ, সরকারী অতিথি ভবন, গণপাঠাগার ও জাতীয় সম্মেলন ভবন হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল মসজিদে নববীকে। এই নির্মাণ কাজের বেলায়ও কুবার মত সাড়া জাগলো। এমন কোন মুসলমান থাকতে পারে কি, যে এই কাজে মনে প্রাণে অংশ গ্রহণ করেনি? স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাথর ও কাঁদা মাটি তুলে আনছিলেন। এ দৃশ্য দেখে জনৈক সাহাবী আবেগাপ্লুত হয়ে বলে উঠলেনঃ ‘আাল্লাহর নবী যদি এ কাজে এমনভাবে আত্মনিয়োগ করেন, আর আমরা বসে বসে দেখতে থাকি, তাহলে আমাদের সমস্ত সৎকাজ বাতিল হয়ে যাবে।’ কাজের ব্যস্ততার ফাঁকে কোন বাজে কথাবার্তার বালাই ছিলনা। বরং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সহ সবাই একযোগে বলতে লাগলেনঃ “আখেরাতের শান্তিই প্রকৃত শান্তি। তা না হলে জীবন নিরর্থক। হে আল্লাহ, আপনি আনসার ও মোহাজেরদের প্রতি অনুগ্রহ করুন।” এই প্রেরণা ও দোয়াই ছিল মসজিদে নববী নির্মাণের আসল উপকরণ। মসজিদের সাথে একটা হুজরাও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য তৈরী হয়ে গেল লতাপাতা ও মাটি দ্বারা। আবু আইয়ূব আনসারীর বাড়িতে সাতমাস অবস্থানের পর তিনি এই হুজরাতেই থাকতে আরম্ভ করলেন। মদীনায় অবস্থানের ফলে আপনা আপনি দাওয়াতী কাজ সম্প্রসারিত হতে লাগলো। এই সাত মাসে ইসলামী আন্দোলন প্রত্যেক গৃহ ও প্রত্যেক গোত্র থেকে নিবেদিত প্রাণ সাথী সংগ্রহ করা হলো। কেবলমাত্র আওস গোত্রের কতিপয় প্রভাবশালী লোক শিরকের অন্ধকারে অবশিষ্ট্য ছিল। দাওয়াতী কাজের বিস্তার ঘটানো ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গঠনমূলক কাজ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যক্তিগত দাওয়াত তো দিতেনই। সেই সাথে গণ জমায়েতে তিনি যে ভাষণ দিতেন তা সামষ্টিক দাওয়াতের কাজে খুবই ফলপ্রসূ হতো। তাঁর ভাষণ সাধারণত সংক্ষিপ্ত হতো। কিন্তু এর ভেতর ফলাফল ছিল সূদুর প্রসারী। তাঁর ভাষণে একদিকে থাকতো মৌলিক আদর্শের প্রতি আহবান। অপরদিকে ঐ আদর্শের আলোকেই নিহিত থাকতো সমাজের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান। (চলবে)