মুহাম্মাদ (সা.)-এর নবুয়্যাতের মাদানী জীবন ও পর্যালোচনা
দ্বিতীয় পর্ব
জাতির উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দান
মদীনায় এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথম যে ভাষণ দেন তাতে প্রথমে জনতার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি আল্লাহর প্রশংসা করেন। এরপর জনতার উদ্দেশ্যে বলতে থাকেনঃ “ হে মানবমন্ডলী! তোমরা আখেরাতের জন্য পুজিঁ সংগ্রহ কর। জেনে রেখো, তোমাদের মধ্য থেকে কেউ হয়তো সহসাই মারা যাবে, তার মেষপাল দেখার লোকও হয়তো থাকবেনা। অতঃপর তার রব জিজ্ঞেস করবেন। সেখানে কোন দোভাষীও থাকবেনা। তিনি বলবেন, ‘ তোমার কাছে কি আমার রাসূল আসেনী? রাসূল কি তোমার কাছে আমার বাণী পৌঁছায়নী? আমি কি তোমাকে সম্পদ ও অনুগ্রহ দেইনি? তাহলে তুমি নিজের জন্য কি সঞ্চয় করেছ? তখন সে ডানে বামে তাকাবে। কিছুই দেখতে পাবেনা। এরপর সামনের দিকে তাকাবে। সেখানে জহান্নাম ছাড়া কিছুই চোখে পড়বেনা। অতএব যার পক্ষে সম্ভব, সে যেন একটা খেজুরের বিনিময়ে হলেও নিজেকে দোজখের আগুন থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। যে ব্যক্তি এতটুকুও পারেনা, সে যেন একটু ভালো কথা বলে হলেও আত্মরক্ষা করে। কেননা প্রতিটি ভালো কাজের পুরস্কার দশগুণ থেকে সাতশো গুণ পর্যন্ত দেয়া হয়। তোমাদের ওপর নিরাপত্তা, আল্লাহর রহমত ও বরকত নাযিল হোক।” দ্বিতীয় ভাষণে তিনি বলেনঃ “ সকল প্রশংসা আল্লাহর। আমি তাঁর প্রশংসা করি ও তাঁর কাছেই সাহায্য চাই। আমরা সবাই তাঁর কাছে প্রবৃত্তির কুপ্ররোচনা ও খারাপ কাজ থেকে আশ্রয় চাই। আল্লাহ যাকে হেদায়াত দান করেন তাকে কেউ বিপথগামী করতে পারেনা। আর আল্লাহ যাকে হেদায়াত থেকে বঞ্চিত করেন, তার কোন পথপ্রদর্শক থাকেনা। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া এক ও শরীক বিহীন ইবাদত ও আনুগত্য লাভের যোগ্য আর কেউ নেই। নিঃসন্দেহে আল্লাহর কিতাবই সর্বোত্তম বাণী। আল্লাহ যার অন্তরে কুরআনকে প্রিয় বানিয়েছেন, যাকে কুফরির পর ইসলামে প্রবেশ করিয়েছেন, এবং যে ব্যক্তি অন্য সকল মানবরচিত বাণীর চেয়ে কুরআনকে বেশী পছন্দ করে, সে সাফল্যমন্ডিত হবে। এ হচ্ছে সর্বোত্তম ও সবচেয়ে প্রভাবশালী বাণী। আল্লাহ যা পছন্দ করেন তোমরা তাই পছন্দ করবে এবং আল্লাহকে আন্তরিকভাবে ভালোবাসবে। আল্লাহর বাণী চর্চা ও তাঁর স্মরণে গাফিল হয়োনা এবং মনকে কঠিন হতে দিওনা। যেহেতু আল্লাহ নিজের সৃষ্টি থেকে উত্তম তাই তিনি উত্তম কাজ, উত্তম বান্দা ও পবিত্রতম বাণী মনোনীত করেন। তিনি মানুষকে যা কিছু দিয়েছেন, তার কিছু হালাল ও কিছু হারাম। কাজেই আল্লাহর দাসত্ব অবলম্বন কর। তাঁকে যথার্থ ভাবে ভয় কর। তাঁর সাথে কাউকে শরীক করোনা। তাঁর গযব থেকে এমনভাবে আত্মরক্ষা কর, যেমনভাবে করা উচিত। তোমরা যে সব কথা মুখে বলে থাক তার ভেতরে যে কথা উত্তম তা কাজে পরিণত করার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সত্যবাদী হও। আল্লাহর রহমত দ্বারা পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে তোল। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সাথে কৃত ওয়াদা ভংগ করলে অসন্তুষ্ট হন। তোমাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।” এই ভাষণে সুদূর প্রসারী বক্তব্য সংযোজিত হয়েছে। বলতে গেলে যাবতীয় সমস্যা সম্পর্কে কথা বলা হয়েছে। এতে ইসলামের দাওয়াত রয়েছে, কুরআনের শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, হালাল ও হারাম বেছে চলার তাগিদ দেয়া হয়েছে এবং আদর্শ ভিত্তিক ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার শিক্ষা দেয়া হয়েছে।
ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন
মসজিদ নির্মাণের পর পরবর্তী পদক্ষেপ ছিল মদীনায় বসবাসকারী মুসলিম, ইহুদী ও খৃষ্টান এই তিন জাতির মধ্যে ঐক্য, সংহতি, সম্প্রীতি ও একাত্ববোধ প্রতিষ্ঠা করে একটি শান্তি প্রিয় জাতি গঠনের উদ্দেশ্যে একটি ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করা। তিনি দেখলেন, ধর্মমত যার যাই থাকুক না কেন, সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি ও ঐক্য না থাকলে রাষ্ট্রের কল্যাণ নেই। যে কোন দেশে বৃহত্তর স্বার্থ ও কল্যাণ নির্ভর করে তার অধিবাসীবৃন্দের সংহতি ও ঐক্যের ভিত্তিতে। যে দেশে বিভিন্ন ধর্মের লোকদের বসবাস, সে দেশে পরমতসহিঞ্চুতার প্রয়োজন অত্যন্ত বেশী। নিজে বাঁচএবং অপরকে বাঁচতে দাও-ইহাই হলো নাগরিক জীবনের সর্বপ্রথম নীতি। মক্কায় অবস্থানকালে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাথীদেরকে সে মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এর ফলে সামাজিক জীবনে যে দূর্ভোগের স্বীকার হতে হয় তা তিনি জানেন। সে জন্যে তিনি সকল গোত্রের নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠক করে সকলের শান্তির জন্য আন্তঃসাম্প্রদায়িক ঐক্য ও সম্প্রীতির আবশ্যকতা বুঝালেন। সকলের পরামর্শক্রমে কার কি দায়িত্ব ও কর্তব্য হবে সে বিষয় নীতিমালা সম্বলিত একটি আন্তর্জাতিক সনদ তৈরী করলেন। তিন জাতির নেতৃবৃন্দের যৌথভাবে স্বাক্ষরিত এই আন্তর্জাতিক সনদটিই ঐতিহাসিক ‘মদীনা-সনদ’ নামে খ্যাত এবং এটিই দুনিয়ার প্রথম লিখিত সংবিধান। এর মাধ্যমেই জন্ম নিলো মদীনার ক্ষুদ্রকার কল্যাণ ধর্মী ইসলামী রাষ্ট্র। পরম করুনাময় ও মেহেরবান আল্লাহর নামে সম্পাদিত এই সনদের পূর্ণ বিবরণ সুরক্ষিত রয়েছে ইতিহাসের বিভিন্ন গ্রন্থে। এতে বসবাসকারী বিভিন্ন জাতির লোকদের যে অধিকার ও কর্তব্য নির্ধারণ করা হয়, তার সার সংক্ষেপ নিম্নরূপঃ
“ মদীনার ইহুদী, নাসারা, পৌত্তলিক ও মুসলিম সকলেই এক দেশের অধিবাসী। সকলেরই নাগরিক অধিকার সমান। যার যার ধর্ম সে পালন করবে, কেউ কোন হস্তক্ষেপ করতে পারবেনা। রাসূলের অনুমতি ছাড়া কারো সাথে যুদ্ধ করতে পারবেনা। নিজেদের মধ্যে কোন বিরোধ হলে আল্লাহ ও রাসূলের মীমাংসার ওপর সবাইকে নির্র্ভর করতে হবে। বাইরের কোন শত্রুর সাথে কোন সম্প্রদায় গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারবেনা। মদীনাকে পবিত্র মনে করবে এবং এর বহিঃশত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হলে সবাই মিলে তা প্রতিহত করবে। নিজেদের মধ্যে কেউ বিদ্রোহী হলে অথবা শত্রুর সাথে কোনরূপ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলে তাদের ব্যাপারে সমুচিত শাস্তির বিধান করা হবে। সে যদি আপন পুত্রও হয় তাকে ক্ষমা করা হবে না। এ নীতিমালা যে বা যারা ভংগ করবে, তাদের ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত।” এর মাধ্যমে ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আইন ও বিচারবিভাগীয় চূড়ান্ত ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর হস্তগত হয়। এই সাংবিধানিক চুক্তির মাধ্যমে বিধিসম্মতভাবে ও আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামী রাষ্ট্র গঠিত ও ইসলামী জীবন বিধান বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এতদিন ইসলামকে কতিপয় বিধি-নিষেধ ও নীতিবাক্যের সমষ্টি একটি সাধারণ ধর্ম হিসেবেই মানুষ জানতো; রাষ্ট্র পরিচালনা, সমাজ ব্যবস্থায়, নাগরিক জীবন ও আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধান দিতে সে যে সক্ষম তা ছিল অজানা। আসলেই ইসলামী রাষ্ট্র মানবতা-বিকাশে এক যুগান্তকারী সংস্থা। বৃহত্তর মানব কল্যাণে এর বিকল্প নেই। ইসলামী রাষ্ট্রের বিশেষত্ব এখানেই। অনেকে ইহার ভুল ব্যাখ্যা করে; ভাবেন ইসলামী রাষ্ট্র শুধু ইসলামী শরীয়তের পূর্ণ রূপায়ণ ক্ষেত্র। নামাজ,রোজা, হজ্জ, যাকাত, বিবাহ-তালাক ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কিত ইসলামী বিধানই এখানে কায়েম হবে। অমুসলিম নাগরিকদের কোন অধিকার থাকবেনা। প্রকৃতপক্ষে এমনটি নহে। বরং বিভিন্ন ধর্মালম্বীরা একই রাষ্ট্রে শান্তিও নিরাপত্তার সাথে বসবাস করতে পারে,ইসলামী রাষ্ট্রই হলো তার প্রকৃত দৃষ্টান্ত। অন্য কথায় উদার মানবতা ও বিশ্বাসবোধই ইসলামী রাষ্ট্রের মূল প্রেরণা। ইসলামী সমাজে মূর্তিপূজা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ; কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রে মূর্তিপূজার উচ্ছেদ করা অসম্ভব। কেনান সেরূপ করতে গেলে পৌত্তলিক ধর্মালম্বীদের আঘাত দেয়া হয়। আরবের ইসলামী সংগঠন বাহ্যিক উপায় উপকরণ ও সহায় সম্পদের দিক দিয়ে কত রিক্ত হস্ত ছিলো। তা ছাড়া মদীনার অজানা অচেনা পরিবেশে এসে কতিপয় বাস্তু ভিটে হারা ব্যক্তির সমস্যায় জর্জরিত অবস্থাও সামনে রাখি। এরপর লক্ষ্য করা যাক যে, কিভাবে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হলো কত ত্বরিত গতিতে। কিভাবে কয়েক মাসের মধ্যে তার সংবিধানও চালু হয়ে গেল। ধর্মীয় ও জাতিগতভাবে পরস্পর বিরোধী জনতাকে এত শীঘ্র একই নীতিমালার ওপর ঐক্যবদ্ধ করা সত্যিই ইতিহাসের এক মহাবিস্ময়কর ঘটনা।
ভ্রাতৃত্বের বন্ধন তৈরী
মদীনায় নব গঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম সমস্যা ছিল মুহাজিরদের সামাজিকভাবে পুনর্বাসন করা। মক্কা থেকে যেসব মুসলমান ঘর-বাড়ী ত্যাগ কলে মদীনায় চলে এসেছিলেন, তাদেল প্রায় সবাই ছিলেন সহায়-সম্বলহীন। তাদেল মধ্যে যারা স্বচ্ছল ছিলেন, তারাও নিজেদের মালপত্র মক্কা থেকে আনতে পারেননি। তাদের সবকিছু ছেড়ে একদম খালী হাতেই আসতে হয়েছিলো। এসব মুহাজির যদিও মদীনার মুসলমানদের মেহমান ছিলেন, তথাপি এদের স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থা করার প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছিলো। তাছাড়া এরা নিজেরাও স্বহস্তে পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করতে ভালোবাসতেন। মদীনার সমাজ ও রাষ্ট্রপ্রধান যেরূপ দক্ষতা, বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে এ সমস্যার সমাধান করেছিলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে তার কোন নজীর নেই। কোন অর্ডিন্যান্স জারী করা হয়নি, কোন আইন চাপিয়ে দেয়া হয়নি, ভূমি ও অন্যান্য সম্পদ সরকারীভাবে বরাদ্দ করতে হয়নি। শরনার্থীদের সংখ্যা নির্ধারণ করে কোন কঠোরতা করা হয়নি এবং কোন বলপ্রয়োগও করা হয়নি। কেবল একটি নৈতিক আবেদন দ্বারা এত বড় জটিল সমস্যার সমাধান মাত্র কয়েক দিনে সমাধান হয়ে যায়। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আকীদা, আদর্শ ও লক্ষ্যের ভিত্তিতে সত্যিকার অর্থে একটা নতুন ভ্রতৃত্বের বন্ধন তৈরী করে দেন। তিনি আনসার দিগকে ডেকে বললেন, “আজ থেকে তোমরা পরস্পর ভাই ভাই।” এভাবে সমস্ত মুহাজিরকে তিনি আনসারদের ভাই বানিয়ে দিলেন। এর ফলে আল্লাহর এই খাঁটি বান্দাগণ শুধু ভাই-ই-নয়, পরস্পরে ভাইয়ের চেয়েও ঘনিষ্ট বন্ধুতে পরিণত হলো। আনসারগণ মুহাজিরদেরকে নিজ নিজ বাড়ীতে নিয়ে গেলো এবং তাদের সামনে নিজেদের সমস্ত সম্পত্তি ও সামান পত্রের হিসেব পেশ করে বললো, “ এর অর্ধেক তোমাদের আর অর্ধেক আমাদের।” এভাবে বাগানের ফল, ক্ষেতের ফসল, ঘরের সামান, বাসগৃহ, সম্পত্তি মোটকথা প্রতিটি জিনিসই সহোদর ভাইদের মতো বিভক্ত হলো। কেউ কেউতো নিজের একাধিক স্ত্রীর মধ্য থেকে একজনকে তালাক দিয়ে তার দ্বীনি ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিতে পর্যন্ত প্রস্তুত হয়েছিলেন। অবিবাহিত, বিশেষত উঠতি বয়সের যে সব মুহাজির সংসারী হওয়ার পরিবর্তে নিজেদেরকে ইসলামের খেদমতে নিয়োজিত করতে চাইছিলেন, তাদের বাসস্থান ছিল ‘সুফফা’ অর্থাৎ মসজিদে নববীর একটি চত্বর। তাদেরকে আসহাবে ‘সুফফা’ বলা হতো। বিনির্মাণ কাজের জন্য এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের রূপ নেয়। সুফফাবাসী সাহাবীদের অভিভাবক ছিল ইসলামী সমাজ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং তাদের প্রয়োজন পূরণের সহায়তা করতেন। ফলে আশ্রয়হীন মুহাজিরগণ সব দিক দিয়ে নিশ্চিত বোধ করলেন। তারা যথারীতি ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্ষেত খামারের কাজে লিপ্ত হলেন। এভাবে মুহাজির পুনর্বাসনের কাজ সুষ্ঠভাবে সম্পাদিত হলো। (চলবে…)