Main Menu

রাসূলুল্লাহ সাল্লালাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেতনা

মুহাম্মাদ (সা.)-এর চেতনা

মুহাম্মাদ (সা.)-এর চেতনা

ভূমিকা
“সুস্পষ্টভাবে এবং আক্ষরিক অর্থে বলতে গেলে ধর্মের চেয়ে রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ নিয়েই ইসলামের উত্থান।” [ইসলামের ঐতিহাসিক ভূমিকা, মানবেন্দ্র নাথ রায়, বদিউর রহমান অনূদিত, অধ্যায়-০২, পৃ.-১৯, প্রকাশক-মোতাহার হোসেন, প্যাপিরাস, ৬৮-৬৯ প্যারীদাস রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০। ]
এম এন রায় বা মানবেন্দ্রনাথ রায়-এর ইসলাম সম্পর্কে এই মূল্যায়ন নিয়ে ভাবার আগে এম এন রায় সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা প্রয়োজন। ভারতবর্ষে মানবতাবাদী আন্দোলনের প্রবক্তা নরেন্দ্রনাথ রায় যিনি এম এন রায় নামেই অধিক পরিচিত; আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের একজন মেধাবী কারিগর। লেনিন, স্ট্যালিন, ট্রটস্কি, বুখারিন প্রমুখদের সাথে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন পরিচালনায় তিনি অবদান রেখেছেন। ইসলামের বিজয়কে এভাবে রাজনৈতিক দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রেও তিনি তৎকালীন সময়ে অগ্রণীদের একজন ছিলেন। কারো কারো কাছে মূল্যায়নটি নিয়ে ভিন্নমত থাকলেও ইসলামে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের যে ঘোষণা রাসূলুল্লাহ সাল্লালাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিয়েছেন তাতে রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ নিয়ে ইসলামের উত্থানের বিষয়ে এম এন রায়ের উক্ত মতামতকে যথাযথ বলেই বিবেচনা করতে হয়। কারণ পৃথিবীর বুকে সকল রাজনৈতিক আদর্শ ও চেতনার মূলই হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ‘সার্বভৌমত্বের ধারণা’। ‘রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব’ এই চেতনার পৃষ্ঠপোষক সকল সরকার প্রধানই নিজেদেরকে নিরংকুশ ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকারী মনে করে। ফলে কম-বেশি প্রায় সকল ক্ষেত্রেই গণতান্ত্রিক স্বৈরাচার বা ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির অবাধ প্রসার ঘটতে থাকে। মানুষ জীবন-মৃত্যুর মালিক না হয়ে বরং নিজেই জীবন-মৃত্যুর শিকার হওয়ার কারণে প্রকৃতপক্ষে কোনো সার্বভৌমত্বের মালিক মানুষ নয়। তাই রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের নামে সরকার প্রধানদের ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির প্রসার হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য। কিন্তু ইসলাম আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ছাড়া অন্যান্য সকল সার্বভৌমত্বের ধারণাকে অনধিকার চর্চা হিসেবে মূল্যায়ন করায় সরকার প্রধানদের ক্ষমতার অপব্যবহার করার কিংবা দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষক হবার কোনো অবকাশ আর থাকেনা। কারণ সরকার প্রধানকেও মূল সার্বভৌম শক্তির কাছে জবাবদিহি করার মতো জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হতে হয়। নিশ্চিত করতে হয় সার্বভৌম শক্তির বিধানসমূহের বাস্তবায়ন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন-যাপন ছিল মূল সার্বভৌম শক্তির কাছে জবাবদিহির চেতনার আলোকে গড়া এবং তিনি নিশ্চিত করেছিলেন মূল সার্বভৌম শক্তি আল্লাহর বিধানসমূহের বাস্তবায়ন।
বিষয়টি আরো পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছেন ঐতিহাসিক “ফিসার”। তার ভাষায়, ‘আরব রাষ্ট্রে, নিয়মিত সৈন্য বাহিনী কিংবা সাধারণ রাজনৈতিক অভিলাষ এর কোনো কিছুরই নামগন্ধ ছিল না। আরবরা রাজনীতিক ছিল না, ছিল কবি, স্বপ্নবিলাসী, যোদ্ধা এবং ব্যবসায়ী। ধর্মেও তারা একীকরণ কিংবা স্থিতির কিছু দেখেনি। তারা বহু ঈশ্বরের পূজায় অভ্যস্ত ছিল অত্যন্ত জঘন্যভাবে। একশ’ বছর পর এই অন্ধ অসভ্যরাই পৃথিবীতে বৃহৎ শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করল। জয় করে নিল সিরিয়া ও মিশর। পদানত ও দীক্ষিত করল পারস্য। আধিপত্য বিস্তার করল পশ্চিম তুরস্ক এবং পাঞ্জাবের কতকাংশের উপর। তারা বাইজেনটাইনস্ ও বেরবেরসদের কাছ থেকে আফ্রিকা এবং ভিসিগোথসদের কাছ থেকে স্পেনকে ছিনিয়ে নিল। পশ্চিমে ফ্রান্স, পূর্বে কন্সট্যান্টিনোপলকে তারা সন্ত্রস্ত করে তুলল। আলেকজান্দ্রিয়া বা সিরিয়ার বন্দরে তাদের জাহাজ তৈরি হলো। নির্ভয়ে চলাফেরা করল ভূমধ্যসাগরে। পদানত করল গ্রিক দ্বীপগুলো; আর চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল বাইজেনটাইন সা¤্রাজ্যের নৌ-শক্তিকে। তারা এত সহজে বিজয়ী হলো যে কেবল পারস্য এবং এটলাস পার্বত্য অঞ্চলের বেরবেরসরা ছাড়া আর কেউ তেমন কোনো বাধাই দিতে পারলো না। অষ্টম শতাব্দীর শুরুতে সবার মনে প্রশ্ন দেখা দিল, তাদের এই বিজয়ের পথে আর কোনো বাধাই কি দেয়া যাবে না। ভূমধ্যসাগরের উপর রোমকরা তাদের আধিপত্য হারালো। ইউরোপের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত সারা খিস্ট জগৎ এক নতুন বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত নতুন প্রাচ্য সভ্যতার সামনে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। [H.L. Fisher: A History Of Europe; p137-138.]

কিভাবে এমন বিস্ময়কর ঘটনা ঘটলো? ঐতিহাসিকদের কাছেও এ এক বিস্ময়কর প্রশ্ন। এম এন রায় নিজেই তার জবাব দিয়েছেন এভাবে, “‘শান্ত-সহিষ্ণু মানুষের উপর গোঁড়ামির জয়’ ইসলামের অভ্যুত্থান সম্বন্ধে এই ঘৃণ্য অভিমত আজকের দুনিয়ার শিক্ষিত মানুষরা প্রত্যাখ্যান করছে। ইসলামের এই বিস্ময়কর বিজয়ের মূলে ছিল এর বৈপ্লবিক চেতনা এবং সেই সাথে প্রাচীন সভ্যতার ঘুণেধরা কেবল গ্রিস, রোম, পারস্য এবং চীন নয়, ভারতবর্ষেরও বিপুল জনগোষ্ঠিকে দুঃখ-দুর্দশার পঙ্কিলতা থেকে আলোর পথ দেখানো।” [ইসলামের ঐতিহাসিক ভূমিকা, মানবেন্দ্র নাথ রায়, বদিউর রহমান অনূদিত, অধ্যায়-০১, পৃ.-১৭, প্রকাশক-মোতাহার হোসেন, প্যাপিরাস, ৬৮-৬৯ প্যারীদাস রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০। ]

কি ছিল সেই বৈপ্লবিক চেতনা?
চেতনা বিপ্লব করতে সক্ষম হলেই কেবল তা বৈপ্লবিক চেতনা হিসেবে বিবেচিত হয়। বিপ্লবের ধরণ অনুযায়ী চেতনাকে যেমন উপলব্ধি করা যায়, তেমনি চেতনার পরিধিকে অনুধাবন করেও বিপ্লবের ধরণকে আগাম অনুভব করা সম্ভব। যে চেতনা শুধুই রাজনৈতিক তা রাজনৈতিকভাবে সফল হলেও অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পারিবারিকসহ জীবনের অন্যান্য সকল ক্ষেত্রেই এর ব্যর্থতা অনিবার্য।
চেতনার পরিধি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ইসলামের চেতনা একাধারে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক, সাংস্কৃতিকসহ জীবনের সবগুলো দিক নিয়েই এর পরিধি। তবে যিনি এই চেতনাকে সফলভাবে বিপ্লবে পরিণত করবেন, তাঁকে অতি অবশ্যই ইসলামের এই পূর্ণাঙ্গ পরিধিকে সফলভাবে উপলব্ধি করতে হবে। উপলব্ধির সীমাবদ্ধতা চেতনার সফল বাস্তবায়নে এক অলংঘনীয় বাধা।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশেই শুধু রাজনৈতিক চেতনা বা শুধু অর্থনৈতিক চেতনার বৈপ্লবিক রূপ মানবজাতি দেখেছে এবং এসব চেতনার অপমৃত্যুও দেখেছে এবং দেখছে। নানা চেতনার এই অপমৃত্যু বরণের মধ্যেও ইসলাম সারা বিশ্বে এখনও ক্রম-সম্প্রসারণশীল এক অপ্রতিরোধ্য চেতনা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। জীবনের সকল দিককেই ইসলাম তার চেতনায় ধারণ করার কারণে আজকের দুনিয়ার শিক্ষিত মানুষরা ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও প্রপাগান্ডাকে মূল্যায়ন করেই ইসলামের চেতনায় নিজেদেরকে সিক্ত করছে। অন্যদিকে ক্ষমতালোভী ও প্রতিপত্তিলোভীরা আবহমানকাল হতেই বিভিন্ন রাজনৈতিক চেতনার নামে ইসলামের রাজনৈতিক চেতনা ‘আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে’ অস্বীকার করছে এবং ইসলামকে নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি অর্জনের প্রতিবন্ধক হিসেবেই বিবেচনা করেছে এবং করছে।
ইসলামের বিস্ময়কর বিজয়ের মূলে ছিল বৈপ্লবিক চেতনা। দেখা যাক কি ছিল সেই বৈপ্লবিক চেতনা।

০১. রাজনৈতিক বৈপ্লবিক চেতনা ঃ
আল্লাহ তাঁর মনোনীত রাসূলের মাধ্যমে যে রাজনৈতিক বৈপ্লবিক চেতনা অবহিত করলেন; তা স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ধারণ করার কথাও বলে দিলেন। গোটা আরব শুধু নয় ঐতিহাসিক ফিসারের মতামত অনুযায়ী এই বৈপ্লবিক রাজনৈতিক চেতনা মানব ইতিহাসে এক বিস্ময়কর রাজনৈতিক বিজয় এনে দিয়েছিল। আল্লাহ যে চেতনা নাযিল করেছেন তা ছিল নিম্নরূপ ঃ
“বল ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলের জন্য আল্লাহর রাসূল, যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্বের অধিকারী। তিনি ব্যতীত অন্য কোনো ইলাহ নেই; তিনিই জীবিত করেন ও মৃত্যু ঘটান। সুতরাং তোমরা ঈমান আন আল্লাহর প্রতি ও তাঁর বার্তাবাহক উম্মী নাবীর প্রতি; যিনি (উম্মী নাবী) আল্লাহ ও তাঁর বাণীতে ঈমান আনেন এবং তোমরা তাঁর (উম্মী নাবীর) অনুসরণ কর, যাতে তোমরা সঠিক পথ পাও। [সূরা আ’রাফ ঃ ১৫৮] ”
আল্লাহর সার্বভৌমত্বের এই চেতনাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে, প্রকাশ্যে বা গোপনে অস্বীকারকারী ব্যক্তি চেতনায় একজন অমুসলিম। তার লেবাস, চেহারা, ডিগ্রি যাই থাকুক না কেন। এ বিষয়টি তিনি উপলব্ধি করুন বা না করুন। কেউ তা ঘোষণা দিক বা না দিক।
০২. নেতৃত্বের বৈপ্লবিক চেতনা ঃ
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাঙালী, বাংলাদেশী, আরবীয়, ইংরেজ, ফরাসী, ভারতীয়, জার্মান, ইত্যাদি সকল জাতীয়তার মানুষের জন্যই রাসূল। তিনি আব্রাহাম লিংকনের জন্য যেমন তেমনি শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমানের জন্যেও একমাত্র অনুকরণীয় রাসূল।
আল্লাহ বলেন, আমি তো তোমাকে সমগ্র মানবজাতির প্রতি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না। [সূরা সাবা ঃ ২৮] আল্লাহ আরো বলেন, “মুহাম্মাদ … আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ। [সূরা আল আহযাব ঃ ৪০]”
বাঙালী, বাংলাদেশী, আরবীয়, ইংরেজ, ফরাসী, ভারতীয়, জার্মান,, ইত্যাদি সকল জাতীয়তাবাদের চেতনাকে সরলীকরণ করে ইসলাম একটি গ্লোবাল জাতীয়তার অধীনে মানবজাতিকে রাসূলের নেতৃত্বে বিশ্ব পরিচালনার ধারণা দিয়েছেন। কার্যতঃ বিশ্ব এখন গ্লোবাল জাতীয়তার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের যে কোনো দেশকে যে এখন গ্লোবাল ভিলেজ বলা হচ্ছে এ তারই প্রক্রিয়ার একটি অংশ। মাতৃভাষা ছাড়াও গ্লোবাল ল্যাংগুয়েজ ইংরেজিতে পারদর্শীতা অর্জন করছে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ। যারা বর্তমান জাতীয়তাবাদী পরিচয়ের দিক দিয়ে বিভিন্ন। বিভিন্ন জাতীয়তা নির্বিশেষে মানুষের এই গ্লোবাল ল্যাংগুয়েজে পারদর্শীতা অর্জন মানুষের গ্লোবাল জাতীয়তা অর্জনের প্রক্রিয়ারই একটি অংশ। এছাড়া দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থাও এখন বিশ্বের প্রতিটি দেশকে এক একটি গ্রামে পরিণত করেছে। বিশ্বের যে কোনো দেশ এখন তাই পূর্বের যে কোনো সময়ের তুলনায় আর্ন্তজাতিক ঘটনা প্রবাহে মুহূর্তেই আন্দোলিত ও প্রভাবিত হয়। ‘গ্লোবাল জাতীয়তা’ চেতনার রূপকার আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে রক্ত, ভাষা, বর্ণ, সম্প্রদায়, গোত্র ও দেশ নির্বিশেষে মানবিকভাবে চিন্তা করার দিকেই আহ্বান করেছেন। রক্ত, ভাষা, বর্ণ, সম্প্রদায়, গোত্র ও দেশের বিভক্তিকে আল্লাহ তা‘আলা পারস্পরিক পরিচয়ের, জানা-বোঝা এবং জ্ঞানের বিনিময়ের জন্য নির্ধারণ করেছেন। রক্ত, ভাষা, বর্ণ, সম্প্রদায়, গোত্র ও দেশভিত্তিক শ্রেষ্ঠত্বের অহমিকার জন্য নয়। আল্লাহ বলেন, হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সেই ব্যক্তিই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকী। নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল কিছু জানেন, সমস্ত খবর রাখেন। [সূরা আল হুজুরাত ঃ ১৩]

০৩. অর্থনৈতিক বৈপ্লবিক চেতনা ঃ
ইসলামে আর্থিক বিবেচনায় মানুষের মর্যাদা নির্ধারিত হয় না। শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্যের পার্থক্যের কারণে মানুষে মানুষে আর্থিক অবস্থার পার্থক্য হয়ে থাকে। তাই যত দরিদ্রই হোক না কেন মানবিক দিক বিবেচনায় প্রত্যেক মানুষই ইসলামে সম্মানিত ও মর্যাদাবান হিসেবে বিবেচিত। মানুষকে ইসলাম অর্থনৈতিক পণ্য হিসেবে কখনই বিবেচনা করেনা; ইসলামে একজন দরিদ্র ও একজন ধনী ব্যক্তি মানবিক মর্যাদার দিক দিয়ে সমান মর্যাদার। আল্লাহ বলেন, ‘আমি তো আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি;(সূরা বানী ইসরাঈল ঃ ৭০)’। এই মর্যাদা ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে। ধনীদের দায়িত্ব রয়েছে, আত্মীয়-স্বজন, অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকে দান করার। আল্লাহ বলেন, ‘আত্মীয়-স্বজনকে দিবে তার প্রাপ্য এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও এবং কিছুতেই অপব্যয় করো না। (সূরা বানী ইসরাঈল ঃ ২৬)’। অর্থাৎ ধন বা সম্পদে সামর্থ্যবান হলে যাচ্ছেতাই করা, ইসলামে অপব্যয়ের শামিল। সুদ ভিত্তিক পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে অপব্যয়ের কোনো সংজ্ঞা নেই। আছে অভাবের সংজ্ঞা। সুদ ভিত্তিক পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে একজন পুঁজির মালিকের ‘অভাব অসীম’। ‘অসীম অভাব’ যার, তার পক্ষে কি আত্মীয়-স্বজন, অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরের জন্য কিছু করা সম্ভব? সুদ নির্ভর পুঁজিবাদী অর্থনীতি তাই পুঁজির মালিক কেন্দ্রিক। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে ব্যস্টিক কিংবা সামষ্টিক অর্থনীতি পুঁজির মালিকের, পুঁজির মালিক দ্বারা, পুঁজির মালিকের জন্য। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে আত্মীয়-স্বজন, অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরের জন্য ব্যয়ের কোনো খাত নেই। ইসলাম, আত্মীয়-স্বজন, অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরের জন্য ব্যয়ের কথা বলেই শেষ করেনি। আল্লাহতায়ালা আরো নির্দেশনা দিয়েছেন, ‘ সুন্দর কথা বলা এবং ভুল ক্ষমা করে দেয়া সেইসব দানের চাইতে ভালো, যে দানের পর মানুষকে (দান গ্রহণকারীকে) কষ্ট দেয়া হয়, আর আল্লাহতায়ালা কারোই মুখাপেক্ষী নন, তিনি অতিশয় সহনশীল (সূরা আল বাকারাহ ঃ ২৬৩)’।
বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রেরই রাজনৈতিক মতবাদ যাই-ই হোক না কেন অর্থনৈতিক মতবাদ হলো সুদ ভিত্তিক অর্থনৈতিক মতবাদ-পুঁজিবাদ। সুদ হচ্ছে ‘দু-ধারী ছুরি’। এই ‘ছুরি’ বাঙালী, বাংলাদেশী, আরবীয়, ইংরেজ, ফরাসী, ভারতীয়, জার্মান, ইত্যাদি সকল জাতীয়তা এবং হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, মুসলিম ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অভাবী মানুষের বেচে থাকার সহায়কে খুন করে তাকে আর্থিকভাবে কপর্দকহীনে পরিণত করে নিঃস্ব করে দেয়। ভেতর থেকে মানুষটির সব স্বপ্নকে মেরে ফেলে। সমাজে তাঁর অবস্থান হয় ঠিকানাবিহীন ভাসমান আর্বজনার মতো। সুদ ভিত্তিক অর্থনীতি মানুষকে দারিদ্রমুক্ত করতে সক্ষম হয়নি। বরং তাঁর হাতের পাঁচ যা কিছু দরিদ্র মানুষের থাকে তার সবই কেড়ে নিয়ে তাঁকে সর্বহারা করেছে। সুদ এভাবেই সারা বিশ্বে দরিদ্র মানুষের মিছিলের সারি বংশ পরম্পরায় নিরবচ্ছিন্নভাবে সৃষ্টি করে যাচ্ছে। আর বিশ্ব সমাজকে উপহার দিচ্ছে জুয়া, মাদক, সন্ত্রাস, খুন ও বহুমুখী অজাচার।
হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, মুসলিম ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানবতার এতবড় শত্র“কে আল্লাহ নিষিদ্ধ করে মানবজাতিকে এক অর্থনৈতিক বৈপ্লবিক চেতনা দান করেছেন। আল্লাহ বলেন, “ এরা বললো, ব্যবসা বাণিজ্যতো সুদের মতোই, অথচ আল্লাহতায়ালা ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম” [০২ ঃ ২৭৫]।
সুদকে অবৈধ করে অর্থনীতিকে বায়বীয় সম্পদ বা ভার্চুয়্যাল সম্পদের মরীচিকা মুক্ত করে বাস্তব সম্পদের ভিত্তির উপর দাড় করিয়েছে ইসলাম এবং ধনী-দরিদ্রের ব্যবধানকে আকাশ থেকে নামিয়ে ভূমির সমান্তরাল করেছে। সুদের হিসাবের মারপ্যাচে অপরের সম্পদকে নিজের সম্পদে পরিণত করার ধূর্তামীকে নিষিদ্ধ করে বিশ্বের অভাবী মানুষদেরকে ধনীদের লালসার শিকার হওয়া থেকে রক্ষা করেছে। আর এজন্যই বিশ্বের ধনলোভীদের এক বিশাল অংশ ইসলামের সুদবিহীন মানবিক অর্থনৈতিক মতবাদের পৃষ্ঠপোষক না হয়ে সুদ ভিত্তিক পুঁজিবাদের নিবিড় পৃষ্ঠপোষক।
ইসলামের অর্থনৈতিক বৈপ্লবিক চেতনার অন্যতম আরো কিছু দিক হলো “ যাকাত, কারদান হাসানান এবং স্বতঃপ্রণোদিত দান ”। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন, “তোমাদের মধ্যে কে আল্লাহকে ‘করজে হাসানা’ দিতে প্রস্তুত, যাতে আল্লাহ তা কয়েকগুণ বাড়িয়ে তাকে ফেরত দিবেন ? কমাবার ক্ষমতা আল্লাহর আছে, বাড়াবারও এবং তাঁরই দিকে তোমাদের ফিরে যেতে হবে।” ( সূরা আল বাকারাহ্ ঃ ২৪৫)
আল্লাহ আরো বলেন,
“যারা নিজেদের ধনৈশ্বর্য আল্লাহর পথে ব্যয় করে তাদের উপমা একটি শস্যবীজ, যা সাতটি শীষ উৎপাদন করে, প্রত্যেক শীষে একশত শস্যদানা। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বহু গুণে বৃদ্ধি করে দেন। আল্লাহ, প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।
যারা আল্লাহর পথে ধনৈশ্বর্য ব্যয় করে অতঃপর যা ব্যয় করে তার কথা বলে বেড়ায় না এবং ক্লেশও দেয় না, তাদের পুরস্কার তাদের রবের কাছে আছে। তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।
সুন্দর কথা বলা এবং ভুল ক্ষমা করে দেয়া সেইসব দানের চাইতে ভালো, যে দানের পর মানুষকে (দান গ্রহণকারীকে) কষ্ট দেয়া হয়, আর আল্লাহতায়ালা কারোই মুখাপেক্ষী নন, তিনি অতিশয় সহনশীল।” (সূরা আল বাকারাহ্ : ২৬১-২৬৩)
যাকাত, একটি অর্থনৈতিক ইবাদাত। আল্লাহর পক্ষ হতে সামর্থ্যবান ঈমানদারদের জন্য নির্ধারিত ফারয বা অবশ্য পালনীয় অর্থনৈতিক কর্মকান্ড। স্বতঃপ্রণোদিত দান ও যাকাত এক নয়। যাকাত প্রদানের পরও আল্লাহ স্বতঃপ্রণোদিত দানের জন্য উৎসাহিত করেছেন। যা বাধ্যতামূলক করা হয়নি।
যাকাত, স্বতঃপ্রণোদিত দান এবং কারদান হাসানান বা করজে হাসানা এগুলো অর্থনৈতিক টুলস্ যা সমাজে দারিদ্র বিমোচনে সর্বাধিক কার্যকর। ‘কারদান হাসানান বা করজে হাসানা’ এর শাব্দিক অনুবাদ হচ্ছে “উত্তম ঋণ”। অর্থাৎ এমন ঋণ যা কেবলমাত্র সৎকর্ম অনুষ্ঠানের প্রেরণায় চালিত হয়ে নিঃস্বার্থভাবে কাউকে দেয়া হয়। অনুরূপভাবে আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করলে আল্লাহ তাকে নিজের জন্য ঋণ বলে গণ্য করেন। এক্ষেত্রে তিনি কেবল আসলটি নয় বরং তার ওপর কয়েকগুণ বেশী দেয়ার ওয়াদা করেন। তবে এ জন্য শর্ত আরোপ করে বলেন যে, সেটি ‘করজে হাসানা’ অর্থাৎ এমন ঋণ হতে হবে যা আদায়ের পেছনে কোনো উপরি অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিলের নিয়ত থাকবে না বরং নিছক আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার নিয়তেই এ ঋণ দিতে হবে (ঋন লেনদেনের ক্ষেত্রে লিখিত রাখা ইসলামের বিধান এবং তাতে সাক্ষীও রাখতে হবে। আল্লাহ বলেন, “হে মুমিনগণ, যখন তোমরা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পরস্পর ঋণের লেন-দেন করবে, তখন তা লিখে রাখবে। …যার উপর পাওনা (চাপছে) সে (ঋণগ্রহীতা) যেন তা লিখিয়ে রাখে। আর সে যেন তার রব আল্লাহকে ভয় করে (তাকওয়া অবলম্বন করে) এবং পাওনা থেকে যেন সামান্যও কম না দেয়। …আর তোমরা তোমাদের পুরুষদের মধ্য হতে দু’জন সাক্ষী রাখ। অতপর যদি তারা দুজন পুরুষ না হয়, তাহলে একজন পুরুষ ও দু’জন নারী -যাদেরকে তোমরা সাক্ষী হিসেবে পছন্দ কর। …আর তা (ঋণ) ছোট হোক কিংবা বড় তা নির্ধারিত সময় পর্যন্ত লিপিবদ্ধ করতে তোমরা বিরক্ত হয়ো না। এটি আল্লাহর নিকট অধিক ইনসাফপূর্ণ এবং সাক্ষ্যদানের জন্য যথাযথ। আর তোমাদের সন্দিহান হয়ে না পড়ার অধিক নিকটবর্তী।” -সূরা বাকারাহ্ ঃ ২৮২।) এবং তা এমন কাজে ব্যয় করতে হবে যা আল্লাহ পছন্দ করেন। হালাল যে কোনো কাজে এই ঋণ বিনিয়োগ বা ব্যয় করার ক্ষমতা – হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, মুসলিম ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অভাবী মানুষের বেচে থাকার সহায়; একটি মানবিক সমাজ নিমার্ণের অর্থনৈতিক নীতি এবং বিশ্ব থেকে দারিদ্র দূরীকরণের কার্যকর উপায়।
সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কিংবা পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে যাকাত, স্বতঃপ্রণোদিত দান এবং করজে হাসানা বা উত্তম ঋণ এ জাতীয় কোনো ইকোনমিক টুলস নেই যা দারিদ্র দূরীকরণে ভূমিকা রাখতে সক্ষম। অর্থনৈতিক এ বৈপ্লবিক চেতনা কেবল ইসলামেই রয়েছে। আর তাই অর্থনৈতিক এই চেতনার সুফল হিসেবে আল্লাহর দেখানো পথে যারা অর্থনীতিকে পরিচালিত করছে, আরবের সেইসব দেশে এখনও পর্যন্ত দারিদ্র সীমার নীচে বসবাসকারী কোনো মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না। আমাদের বাংলাদেশে দারিদ্র সীমার নীচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা কোটি ছাড়িয়েছে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কিংবা পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে যাকাত, স্বতঃপ্রণোদিত দান এবং করজে হাসানা বা উত্তম ঋণ জাতীয় কোনো ইকোনোমিক টুলস না থাকলেও সেখানে সিএসআর বা করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি নামে কিছু চ্যারিটেবল অর্থনৈতিক কার্যক্রম রয়েছে। যা বাংলায় প্রচলিত একটি বাগধারা ‘গরু মেরে জুতা দান’-এর শামিল। যা পরিচালিত হয়, অধিক মুনাফা অর্জনের জন্য অধিক বিপণণ-এর নীতির আলোকে।
০৪. সামাজিক বৈপ্লবিক চেতনা ঃ
মানবজাতির সামাজিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দুটি উপাদান – নারী ও পুরুষ। সমাজে নারী ও পুরুষের ভূমিকা ও অধিকার নিয়ে ধর্ম ও নানান আদর্শের যে অবস্থান সে অনুযায়ীই সংশ্লিষ্ট ধর্মের অধীনে বা আদর্শের অধীনে সমাজ গড়ে ওঠে। নারী ও পুরুষ সে অধিকার ভোগ করে এবং একত্রে সমাজে বসবাস করে। সামাজিক জীবনে নারী ও পুরুষের অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আল্লাহ যে বৈপ্লবিক নির্দেশনা দিয়েছেন তা অনুসরণে একটি শৃংখলাপূর্ণ সমাজ নিমার্ণ করেছিলেন মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
সামাজিক বৈপ্লবিক চেতনাগুলো ছিল এমন ঃ
ক. মানবিক সাম্যতা ঃ
জ্ঞানের বিবেচনায় নারী হোক বা পুরুষ হোক কারো সামাজিক মর্যাদায় ভিন্নতা থাকলেও মানবিক বিবেচনায় মানুষের মর্যাদা সমান।
আল্লাহ বলেন, ‘হে মানুষ! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করে চলো, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন একটি জীবন থেকে। আর সেই জীবন থেকেই সৃষ্টি করেছেন তার স্ত্রীকে। আর এ দুটি জীবন থেকেই সৃষ্টি করেছেন-বহু নর ও নারী এবং চর্তুদিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন।’(সূরা আন্ নিসা ঃ ০১)
মানবিক বিবেচনায় যারা নারী-পুরুষের সাম্যতাকে অস্বীকার করে তারা ইগো বা অহংবোধ দিয়ে পরিচালিত। শুধু পুরুষ হওয়ার কারণে কোনো পুরুষ অধিক মর্যাদাসম্পন্ন নয়।
আল্লাহ বলেন, ‘হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে এক নারী ও এক পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি আর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি। যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে (নর-নারী নির্বিশেষে) আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া সম্পন্ন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত।’ (সূরা আল হুজুরাত ঃ ১৩)
মানুষ সৃষ্টির এই উৎস বিবেচনায় নর-নারীর মানবিক সাম্যতা প্রশ্নাতীত। আর অহংকারের বিষয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যার সাথে তার ভৃত্য আহার করে, সে অহংকারী নয়।’ (বাইহাকী : ৭৮৩৯)
খ. প্রতিদানের সাম্যতা ঃ
নারী ও পুরুষের গঠনগত পার্থক্য আল্লাহই দিয়েছেন। একজন পুরুষ শারীরিকভাবে নারীর চেয়ে সবল বলে তা যদি তার শ্রেষ্ঠত্বের কারণ হয় তবে সন্তান ধারণের অক্ষমতা তার নিকৃষ্টতার কারণ বিবেচ্য হয়। অন্যদিকে সন্তান ধারণ ও জন্মদানের সক্ষমতা বিবেচনায় নারী, নরের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হলে শারীরিক সক্ষমতার দুর্বলতা তার নিকৃষ্টতার কারণ বিবেচ্য হয়। আল্লাহ, নারী ও পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি এবং তাদের ভূমিকার জন্য প্রতিদান দেয়ার বিষয় এভাবে নির্ধারণ করেননি। নারী ও পুরুষের জন্য আল্লাহ যা যা সৎকর্ম হিসেবে বিবেচ্য করেছেন, তাই তাদের শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রতিদানের মাপকাঠি।
আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদের কোনো পুরুষ অথবা কোনো নারী সৎকর্মপরায়নকারীর আমল নষ্ট করবো না। তোমরা একে অপরের অংশ।’ (সূরা আলি ‘ইমরান ঃ ১৯৫)
আল্লাহ আরো বলেন, ‘যে সকল মুমিন সৎকর্মশীল ও পূণ্যবান হবে তারা নারী হোক বা পুরুষ হোক, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের পাওনা ও অধিকার বিন্দু পরিমাণও নস্যাৎ করা বে না।’ (সূরা আন্ নিসা ঃ ১২৪)
সৎকর্মের প্রতিদান বিবেচনায় আল্লাহ নর-নারীর মধ্যে কোনো মর্যাদার পার্থক্য রাখেননি। পুরুষ ও নারীর প্রকৃতি অনুযায়ী তাদের সুখ বিবেচনায় যা যর্থাথ হয় জান্নাতে তাই-ই আল্লাহ নারীকে বা পুরুষকে দেবেন। আর পৃথিবীতে তাদের দিবেন পবিত্র জীবন। পবিত্র জীবন বলতে পবিত্র জীবনোপকরণ, পবিত্র সম্পর্ক, চক্ষু শীতলকারী পবিত্র সন্তান, পবিত্র বন্ধু, পবিত্র চরিত্র, পবিত্র লেনদেন, পবিত্র মৃত্যু। মৃত্যু জীবনেরই অংশ। জীবনের অপর পিঠ।
আল্লাহ বলেন, ‘যে মুমিন, সে নারী হোক বা পুরুষ হোক, যদি সৎকর্মশীল হয়, তবে তাদেরকে আমি এই পার্থিব জগতে পবিত্র জীবন দান করবো এবং তারা যা করতো তার তুলনায় অবশ্যই আমি তাদেরকে উত্তম প্রতিদান দিব।’ (সূরা আন্ নাহল্ ঃ ৯৭)
মানবিক সাম্যতা ও প্রতিদান প্রাপ্তির সাম্যতার এই বৈপ্লবিক চেতনা ইসলাম ছাড়া আর কোথাও নেই। যা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিস্ময়কর বিজয়ের উৎস।
গ. সকল ধরণের মন্দকে ভালো দিয়ে প্রতিহত করা ঃ
ভালো আর মন্দ নিয়েই সমাজ। সমাজে মন্দ নিয়ে যত দুশ্চিন্তা তত চিন্তা আর কিছু নিয়ে করার প্রয়োজন হয়না। সমাজের শান্তি-শৃংখলা বজায় রাখতে সব স্তরেই মন্দকে দূর করার কথা ভাবতে হয়। আর এই ভাবনার সাধারণ প্রবণতা হলো মন্দকে মন্দ দিয়ে মোকাবেলা করা বা উৎখাত করা। কিন্তু মন্দকে মন্দ দিয়ে মোকাবেলার পরিণাম হচ্ছে মন্দের প্রসার লাভ করা। তাই আল্লাহ তার রাসূলকে জানালেন সমাজ থেকে মন্দ দূর করার এক বৈপ্লবিক চেতনার কথা। আল্লাহ বললেন, ‘ ভাল ও মন্দ সমান হতে পারে না। মন্দকে প্রতিহত কর ভাল দ্বারা, ফলে তোমার সাথে যার শত্র“তা রয়েছে, সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত। এই গুণের অধিকারী করা হয় কেবল তাদেরকেই, যারা ধৈর্যশীল, এই গুণের অধিকারী করা হয় কেবল তাদেরকেই, যারা মহাভাগ্যবান। ’ (সূরা হামীম আস সাজদা ঃ ৩৪-৩৫)।
০৫. সাংস্কৃতিক বৈপ্লবিক চেতনা ঃ
সৌজন্যতাই একজন ব্যক্তি বা একটি জাতির সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রকৃত মাপকাঠি। নাচ, গান, নাটক, সিনেমা, খেলাধুলা ইত্যাদি সে জাতির বিনোদনের বিভিন্ন উপায়কে প্রতিফলিত করে। এই উপায় ব্যক্তি ও জাতিভেদে বিভিন্ন। এই উপায়গুলো সংস্কৃতি নয়। তাই পৃথিবীতে যে জাতি নাচ, গান, চলচিত্র, খেলাধুলায় যত বেশী নিমজ্জিত সে জাতি ততবেশী সংস্কৃতিবান জাতি বলে বিবেচিত নয়। বরং যে জাতি যত বেশী সৌজন্য প্রকাশের অধিকারী সে জাতিই বিশ্বে ততবেশী সংস্কৃতিবান বলে বিবেচিত হয়। আল্লাহতায়ালা সে বৈপ্লবিক চেতনাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে মানব জাতিকে জানালেন। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদেরকে যখন অভিবাদন করা হয় (সৌজন্য প্রকাশ করা হয়) তখন তোমরাও তা অপেক্ষা উত্তম প্রত্যাভিবাদন করবে অথবা তারই অনুরূপ করবে; নিশ্চয় আল্লাহ সর্ববিষয়ে হিসাব গ্রহণকারী। ’ (সূরা আন্ নিসা ঃ ৮৬)
শেষ কথা
হৃদয়ে চেতনা বা আদর্শ বা বিশ্বাসকে ধারণ করার অধিকারে মানুষকে স্বাধীনতা দিয়েছেন আল্লাহ। [“দীন গ্রহণে জোর-জবরদস্তি নেই; সত্য পথ ভ্রান্ত পথ হতে সুস্পষ্ট হয়েছে। {সূরা আল বাকারা ঃ ২৫৬}”] এবং সেই সাথে তিনি কোন্ চেতনাগুলো ধারণ করতে হবে তাও বলে দিয়েছেন তাঁর প্রেরিত রাসূলের মাধ্যমে এবং বলেছেন, তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে সর্বোত্তম চেতনা’। (সূরা আল আহযাব ঃ ২১) 

Related Post