(পর্ব: ১)
সমস্ত প্রশংসা সেই সুমহান সৃষ্টিকর্তা ও পরম প্রতিপালকের। যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন নর-নারীর মিলিত শুক্রবিন্দু থেকে, তাকে পরীক্ষা করবার জন্য। এই জন্যে তিনি মানুষকে দিয়েছেন শ্রবণ ও দর্শন শক্তি এবং বিবেক-বুদ্ধি। আর যিনি মানুষকে তার মনের ভাব অন্যের নিকট প্রকাশ করার জন্যে বক্তৃতা ও লিখনি শক্তি প্রদান করেছেন।
অসংখ্য দরূদ ও ছালাম সেই মহামানব, মানবতার পরম বন্ধু, আল্লাহর প্রিয় নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদা সাল্ল¬াল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর পবিত্র পরিবার-পরিজন এবং তাঁর প্রাণপ্রিয় সহচরবৃন্দ (রা.)’র প্রতি।
পরম দয়ালু মহাল আল্লাহ অত্যন্ত মূল্যবান এবং গুরুত্বপূর্ণ কিছু ক্ষদ্র ক্ষুদ্র অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সমন্বয়ে মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন। আর মানুষের শরীরের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হচ্ছে জিহ্বা। অত্যন্ত এ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটির মাধ্যমে মানুষ তার নিজের অন্তরের ভাব বা ভাষা অন্যের কাছে তুলে ধরতে পারেন। আমরা যদি কোন একটি বোবা বিকলাঙ্গ মানুষের কথা চিন্তা করি, যিনি তার মুখ দিয়ে কোন কথা প্রকাশ করতে পারেন না, তাহলে অতি সহজেই আমরা আমাদের জিহ্বার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারবো, ইনশা আল্লাহ।
আর এই জিহ্বার ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষ এই দুনিয়াতে যেমনিভাবে অতি সম্মানের পাত্র হয়ে আল্লাহর ইচ্ছায় অসাধ্য সাধন করতে পারেন। আবার এই জিহ্বার ব্যবহারেই মানুষ এ দুনিয়াতে নিকৃষ্ট মানুষে পরিণত হতে পারে। শুধু এ দুনিয়াতেই নয়, আখেরাতের বিচারের দিনও আল্লাহর আদালতে এই জিহ্বার ব্যবহারের কারণে মানুষ জান্নাতের অনাবিল সুখ শান্তিময় জীবন অতিবাহিত করবে, আবার কাউকে জাহান্নামের জ্বলন্ত আগুনে টাকী মাছের মত উল্টা পাল্টা করে ভাজা হবে। এর কারণ, মানুষের জিহ্বা থেকে যা বের হবে সেটার উপরই ভিত্তি করে মানুষের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। আর তাই মানুষের জিহ্বা থেকে যা বের হয় সেটাকে রেকর্ড করার জন্যে আল্লাহর আদেশে দুইজন রেকর্ডকিপার ফিরিশতা প্রত্যেকটি মানুষের দুই কাঁধে সার্বক্ষণিক প্রহরায় নিয়োজিত রয়েছেন। আর সে ব্যাপারেই সুমহান সৃষ্টিকর্তা বলছেন:
“স্মরণ রেখো (হিসাব) গ্রহণকারী দুই (ফিরিশতা) তার দক্ষিণে ও বামে (কাঁধে) বসে তার (সার্বক্ষণিক) কর্ম লিপিবদ্ধ করে। মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে তা লিপিবদ্ধ করার জন্যে তৎপর প্রহরী তার (জিহ্বার) নিকটেই রয়েছে।” (সূরাহ: ক্বাফ:১৭-১৮)।
কিন্তু আমাদের সেদিকে কোন খেয়ালই নাই। আর তাই আমাদের মধ্যে কিছু কিছু নর-নারী আছেন পূর্বাপর চিন্তা না করেই যখন যা অন্তঃকরণে উদিত হয় সাথে সাথেই তা জিহ্বার মাধ্যমে বের করে দেন। আমাদের স্মরণ রাখা উচিত, যে কথাটা আমি জিহ্বার সাহায্যে অন্যের সামনে উপস্থাপন করছি, সেটার পরিণতি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? আমাদের সকলকেই স্মরণ রাখা উচিৎ যে, অন্তঃকরণে যখন যা উদিত হয়, চিন্তা-ভাবনা না করে জিহ্বার মাধ্যমে বের করা ঠিক নয়। কারণ যখন মানুষের অন্তঃকরণে অন্যের জন্যে কল্যাণকর কিছু উদ্ভাসিত হয় যা করলে আল্লাহর নিকট আখেরাতে তার বিনিময় পাওয়া যাবে এই কথাগুলো আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে। যা করলে অন্যেরও কল্যাণ হয় এবং নিজেরও কল্যাণ হয়। আর যখন মানুষের অন্তঃকরণে অন্যের কি হয় হউক, ‘‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম” অর্থাৎ এ দুনিয়াতে নিজের স্বার্থকে পরিপূর্ণভাবে পাওয়ার ইচ্ছাতেই যে কাজ গুলো উদ্ভাসিত হয় তখন বুঝতে হবে এটা শয়তানের কুমন্ত্রনা। এ ব্যাপারে নিম্নের আয়াত দুটি স্মরণ করা যায়।
দয়াময় আল্লাহ বলছেনঃ “এবং তোমরাদের মধ্যে এরূপ এক সম্প্রদায় থাকা উচিৎ যারা (মানুষকে) কল্যাণের দিকে আহবান করে এবং ভাল কাজের আদেশ করে ও মন্দ কাজের নিষেধ করে আর তারাই সুফল প্রাপ্ত হবে”। (আল-ইমরান: ১০৪)।
আর অন্য একটি আয়াতে আল্ল¬াহ তায়ালা বলছেন : “সে (শয়তান) তো কেবল তোমাদেরকে মন্দ ও অশ্ল¬ীল কার্যের এবং আল্লাহ সম্বন্ধে তোমরা জান না, এমন সব বিষয় বলার নির্দেশ দেয়”। (আল-বাকারা: ১৬৯)।
আর তাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা, মানুষ কখন কোন কথা বলে এবং কোন কাজটি করে, সেগুলির রেকর্ড রাখার জন্য মানুষের দুই কাঁধে দুইজন রেকর্ডার ফিরিশতা বসিয়ে রেখেছেন। মুখ বা জিহ্বা থেকে যখন যা বের হয়, তখনি তাই রেকর্ড করে রাখা হয়। আবার কখনও কখনও আমরা প্রত্যক্ষভাবে কোন বিষয়ে অবগত না হয়ে অনুমান দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনেক কথাই জিহ্বার মাধ্যমে প্রকাশ করে থাকি। যার পরিণামফল কখনও কখনও এমনও ধ্বংসাত্মক অবস্থার সৃষ্টি করে, যার কারণে মানুষের জনজীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে।
আর এজন্যেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা বলছেন: “যে বিষয়ে তোমার (প্রত্যক্ষ) জ্ঞান নেই, সেই বিষয়ে অনুমান দ্বারা পরিচালিত হয়ো না। নিশ্চিত কর্ণ, চক্ষু ও হৃদয় ওদের প্রত্যেকের নিকট কৈফিয়ত তলব করা হবে।” (বনি ইসরাইল: ৩৬)
অন্য আরো একটি আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন: “হে মুমিনগণ! তোমরা বহুবিধ অনুমান থেকে দূরে থাকো; কারণ কোন কোন অনুমান পাপ”… (আল হুজরাত: ১২)
এই জিহ্বার অসঙ্গতি বা অপব্যবহার আমাদের সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশি দেখা যায় আমাদের মধ্যে কিছু নেতৃস্থানীয় শীর্ষব্যক্তি বা পথ প্রদর্শকগণের মধ্যে। অর্থাৎ আমরা যারা নিম্ন শ্রেণীর অজ্ঞ মূর্খ সাধারণ জনগণ, যাদের নেতৃত্বে পথ চলবো বা যাদেরকে নেতা মেনে তাদের পথ অনুসরণ করবো, অর্থাৎ যারা আমাদেরকে পথ দেখাবেন, তাদেরই জিহ্বার ব্যবহার এতটাই মারাত্মক ও বিপজ্জনক, যা কল্পনা করাও যায় না।
তার সাধারণ একটি উদাহরণ যেমন: দেশে নির্বাচনের সময় হলে প্রার্থীগণ ভোটারদের বাড়ি-বাড়ি, ঘরে-ঘরে গিয়ে অতি বিনয়ের সাথে অনুনয়-বিনয় সহকারে এমনভাবে ভোট ভিক্ষা চান, যাতে বিশেষ করে আমাদের গ্রামের সহজ-সরল সাধারণ মানুষের হৃদয়-মন সহজেই বিগলিত হয়। তখন মানুষের মনগলানো অভিনয়ের মাধ্যেমে চোখের পানি, নাকের পানি একত্রে বের করে ধর্মের আল-খেল্লা তথা গায়ে মাথায় লোক দেখানো ধর্মের পাগড়ি পট্টি বেঁধে সেই সব অতি সহজ-সরল মানুষের কাছে ওয়াদা করে বলেন:
“আমারে আপনারা এইবার ভোট ভিক্ষা দিয়া আপনাদের সেবা করার সুযোগ দেন। সংসদে গিয়া, আপনাদেরকে দশ টেকা কেজিতে চাল খাওয়ামু। ঘরে ঘরে চাকরি দিমু। বিনা পয়সায় জমির সার দিমু। আপনারা আমার ধর্মের অমুক তমুক। আপনাদের ধর্ম আমার ধর্ম এক। ধর্মের সাথে প্রতারণা করুম না এবং কুর’আন-সুন্নাহ বিরোধী আইন পাশ করে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তথা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মনে কোন কষ্ট দিমু না। ইত্যাদি ইত্যাদি।”
এইভাবে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে সহজ-সরল ভোটারদেরকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ভোট কেড়ে নিয়ে, সেবকের পরিবর্তে শাসক সাজে। সেবার পরিবর্তে শাসনের চাবুক দিয়ে সাধারণ ভোটারদের পিঠের চামড়া তুলে নেয়। ঘরে ঘরে চাকুরী দেয়ার ওয়াদা করে অসহায় ও নিরীহ চাকরিজীবিদের চাকরিচ্যুত করে তার অসহায় পরিবার-পরিজন ও ছোট-ছোট কচি-কাঁচা শিশু কিশোরদের পেটের আহার কেড়ে নিয়ে তাদেরকেও কষ্ট দেয়। ধর্ম রক্ষার ওয়াদা করে ধর্মগ্রন্থ পুড়িয়ে দেয়। মানুষকে শান্তি দেয়ার ওয়াদা করে অন্তঃকরণ জ্বালিয়ে দেয়। ক্ষমা করার ওয়াদা দিয়ে এসে প্রতিহিংসার আগুন জ্বালিয়ে দেয়। মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে, পরে স্বৈরাচারী আচরণ করে। ধর্মের সহযাত্রী সেজে লোক দেখানো পাগরি-পট্টি তথা ধর্মের আল-খেল্লা পড়ে ভোট ভিক্ষা করে, ক্ষমতায় গিয়ে ধর্মপ্রচারকদেরকে ধরে-ধরে নির্যাতন করে। ভোটের পূর্বে ভোটারের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে, ভোট পাওয়ার পর ক্ষমতায় গিয়ে ভোটারের কোমড়ে লাথি মারে। (চলবে…)