এই ধারাাহিক প্রবন্ধে আমরা তাঁর রাষ্ট্রীয় জীবনের সফলতা ও আদর্শ নিয়ে আলোচনা ও পর্যালোচনা করতে চাই। যারা রাসূল (সা.)এর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আগ্রহী, তারা আমাদের এই ধারাবাহিক প্রবন্ধটি পাঠ করবেন।
প্রথম পর্ব
কেননা, ইসলাম শুধু একটি ধর্মের নাম নয়, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। ইসলামের পূর্ণতা যে স্তরে এসে বাস্তবায়ন হয়েছে এবং সর্বস্তরের জনগণ ইসলামের সুফল ভোগ করেছে সে অংশটি প্রায়ই আমাদের আলোচনায় আসেনা। এমনকি অনেক মুসলমান তাঁর রাষ্ট্রীয় জীবনের সফলতা সম্পর্কে জানেন না। আবার জানলেও তা তেমন মূল্যায়ণ করেন না। অথচ মুসলিম মিল্লাতের উত্থান-পতন নির্ভর করছে এ অধ্যায়ের অনুসরণ ও বাস্তবায়নের ওপর। রাষ্ট্র শক্তি এমন এক হাতিয়ার, যার ওপর মানুষের দুনিয়া ও আখেরাতের জীবনে সফলতা ও ব্যর্থতা অনেকাংশে নির্ভরশীল। কারণ, রাজনীতি শুধু রাষ্ট্রই নিয়ন্ত্রণ করে না, রাষ্ট্রের মানুষের গোটা জীবন ব্যবস্থাই নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষের তাহযীব তামাদ্দুন, ধর্মীয় চিন্তাধারা, নৈতিকতা, আচার-আচরণ রাষ্ট্র ও সরকারের উপর বিপুলভাবে নির্ভরশীল। রাষ্ট্র পরিচালকদের দৃষ্টিভঙ্গী এবং তাদের মর্জি মোতাবেক রাষ্ট্রের জনগণের অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবন পরিচালিত হয়। রাষ্ট্র পরিচালকদের নীতি-নৈতিকতার প্রভাবেই রাষ্ট্রের জনগণ গড়ে ওঠে। কাজেই মুসলিম শাসকদের রাষ্ট্রের মূলনীতির ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ হচ্ছে, “এরা এমন সব লোক যাদেরকে আমি যদি পৃথিবীতে কর্তৃত্ব দান করি তাহলে এরা নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে, ভালো কাজের আদেশ দেবে এবং খারাপ কাজ নিষেধ করবে। আর সমস্ত বিষয়ের পরিণাম আল্লাহর হাতে। (সূরা আল হাজ্জ্ব :৪১) রাষ্ট্রের মূলনীতি এর ব্যতিক্রম হলে জাতিকে ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হবে। অর্থাৎ আল্লাহর বিধানের পরিবর্তে নিজেদের মন গড়া মতবাদ দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করলেই জাতির দুনিয়া ও আখেরাতের জীবন সর্বনাশ হয়ে যাবে। আল্লাহ তায়ালার হুঁশিয়ারী “তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যারা আল্লাহর নেয়ামতকে কুফরে পরিণত করেছে এবং জাতিকে সম্মুখীন করেছে ধ্বংসের আলয়ে। দোযখের! তারা তাতে প্রবেশ করবে সেটা কতইনা নিকৃষ্ট আবাস। (সূরা ইবরাহীম: ২৮-২৯)
এখানে জাতির কথা বলা হয়েছে। একটি জাতিকে কল্যাণ-অকল্যাণের পথ দেখাতে সক্ষম কেবল রাষ্ট্রশক্তি। যা বাস্তবে প্রমাণ করেছেন রাসূল (সা.) ও খোলাফায়ে রাশেদীন। রাষ্ট্রব্যবস্থায় শিক্ষা ও সভ্যতার সম্প্রসারণ এবং রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ব্যবস্থায় মুসলিমগণ অতীব বিস্ময়কর স্পষ্ট ও স্থায়ী স্বাক্ষর রেখে মানব সভ্যতার ইতিহাসে অবদানের ক্ষেত্রে যে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে গেছেন, তা চিরদিন অম্লান হয়ে থাকবে। বিন্দু থেকে আরম্ভ করে মানবতার মুক্তিদূত মহানবী (সা.) মদীনায় যে কল্যাণমুখী ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়া পত্তন করেন, তাঁর সেই নব্য প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের আদর্শের পথ ধরে তাঁর বিশ্বস্ত অনুসারীগণ অতি অল্প সময়ের মধ্যে অভাবনীয়ভাবে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিশাল ভূখণ্ড জুড়ে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র-শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। সেই বিশাল রাষ্ট্রে আরব, পারসিক, গ্রীক, সিরীয়, ইহুদী, খ্রীষ্টান, অগ্নি উপাসক, হিন্দু প্রভৃতি নানা ধর্ম ও বর্ণের অনুসারীরা শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতেন। যতদিন মুসলমানরা রাসূল (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ ও অনুকরণে রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন ততোদিনই ছিল বিশ্বে মানব সভ্যতার সোনালী যুগ।
বর্তমান বিশ্ব শিক্ষা-দিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও গবেষণায় যথেষ্ট উন্নত হওয়া সত্ত্বেও মানুষের জীবনে শান্তি ও স্বস্তি কোথায়? বরং মানুষের জীবনে নেমে এসেছে মহাদুর্যোগ ও বিপর্যয়। তার একটি মাত্র কারণ, আজ কুরআনের আলোকে ও রাসূল (সা.)-এর পদ্ধতিতে রাষ্ট্র ব্যবস্থা না থাকার ফলেই পৃথিবীতে নেমে এসেছে এক মহা অন্ধকার যুগ। সমগ্র বিশ্ব আজ অশান্ত, ভীত সন্ত্রস্ত। তার মধ্যে মুসলমানদের অবস্থাই সবচেয়ে শোচনীয়। আধুনিক সভ্যতায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের অভাবনীয় সাফল্য সত্ত্বেও আধুনিক মারণাস্ত্রের চরম আশঙ্কায় কোটি কোটি মানুষের অন্তর আজ ভীত সন্ত্রস্ত। আর যেসব দেশ দারিদ্র প্রীড়িত তারা অভ্যন্তরীণ কলহ দ্বন্দ্বে সর্বশান্ত। দলা-দলি, হানা-হানি, হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ইত্যাদি অপকর্ম এসব দেশে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। কোথাও গণতন্ত্রের জন্য চিৎকার, কোথাও বাঁচার জন্য হাহাকার। এক কথায় বলতে গেলে সর্বত্রই অত্যাচার-অনাচারে পৃথিবী আজ ধ্বংসের আলয়। পরস্পরের মমত্ববোধ, সহানুভূতি, ভ্রাতৃত্ববোধ: জীবনের কোন পর্যায়েই পরিলক্ষিত হচ্ছে না, এসব শুধু অভিধানেই দেখতে পাওয়া যায়। এর ফলে আজ আমাদের সমাজ জীবনের কাঠামো ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। এর থেকে রক্ষা পেতে হলে মানব জীবনের সকল স্তরেই রাসূল (সা.)-এর আদর্শ বাস্তবায়নই একমাত্র পথ। তাঁকে আমরা একদিকে দেখি ইসলাম ধর্মের প্রচারক ও আল্লাহর দিকে আহ্বায়করূপে। সেই সাথে আবার দেখি সমাজ সংস্কারকরূপে। তাঁকে দেখি মদীনা মসজিদের ইমাম হিসেবে, তারই পাশা-পাশি তাঁকে দেখি আদর্শরাষ্ট্রনায়ক হিসেবে। তাঁকে দেখি সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে, আবার দেখি বদর, ওহুদ, খন্দকসহ প্রভৃতি রণাঙ্গনে যুদ্ধের ময়দানে সেনাপতি হিসেবে। তাকে দেখি প্রধান বিচারপতি হিসেবে, যুদ্ধ-বন্দী, সন্ধি, চুক্তিসহ সকল স্তরেই তাঁর বিচরণ। তাঁর মহান জীবনের এই পরিপূর্ণতা, ইসলামের পরিপূর্ণতারই প্রমাণ বহন করে। রাষ্ট্র শাসন রাসূল (সা.)-এর জীবনেরই একটি সফল ও চূড়ান্ত অধ্যায়। তিনি একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং দশটি বছর তা পরিচালনা করে অনাগত ভবিষ্যতের রাষ্ট্রনায়কদের জন্য একটি মাইলফলক রেখে গেছেন। রাষ্ট্র পরিচালনায় তিনি যে সফলতা দেখিয়েছেন বিশ্বের বুকে তার দৃষ্টান্ত বিরল। জর্জ বার্ণাডশ বলেছেন, “বিশ্ববাসী যদি শান্তি পেতে চাও তবে বিশ্বের নেতৃত্ব মুহাম্মাদ (সা.) এর হাতে তুলে দাও”।
আজ অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, বর্তমান যুগে এক শ্রেণীর মুসলমান এবং ওলামায়ে কেরাম মনে করেন, ইসলামে রাজনীতি নেই। আবার কেউ কেউ বলেন, এটা যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এ ধারণা যে নিতান্তই ভিত্তিহীন ও অমূলক তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। রাসূল (সা.) কি দশটি বছর মদীনা রাষ্ট্রের শাসক ছিলেন না? দশটি বছর যেভাবে রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও শাসক হিসেবে অনুকরণীয় ভূমিকা পালন করেছেন তা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট। এর পরেও কিছু মুসলমানদের ধারণা কি করে হলো যে, ধর্ম এবং রাজনীতি দু‘টি সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়? মুসলমান থেকেও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এবং রাষ্ট্রপরিচালনায় ইসলাম বিরোধী কাজ করা যায়? এ আত্মঘাতি ধারণা মুসলমানরা পেল কোথায়?
অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দিতে ইউরোপীয় সা¤্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শক্তি পশ্চিম আফ্রিকা থেকে পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত মুসলিম জাহান দখল করে নেয়ার পর রাষ্ট্রব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিপরীত ধারা সূচিত হয়। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসন মুসলিম উম্মাহকে তছনছ করে দেয়। তারা মুসলিম দেশসমূহকে খণ্ড-বিখণ্ড করে দিয়ে বিভিন্ন জাতি রাষ্ট্রে পরিণত করে দেয়। মুসলিমদের এক জাতি তত্ত্বকে দেশ ভিত্তিক বহু জাতিতে পরিণত করে। যেমন, আরব জাতি, ইন্দোনেশিয়ান জাতি, বাংগালী জাতি, কাশ্মীরি জাতি, আফ্রিকার জাতি ইত্যাদির মাধ্যমে মুসলমানদের ঐক্য বিনাশ করে দেয়। যদিও মুসলমানরা তাদের হারানো স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছে কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের পর এসব মুসলিম দেশের শাসনভার পশ্চিমা শিক্ষায়-শিক্ষিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী রাষ্ট্রশাসক, আমলাব্যবস্থা ও সামরিক চক্রের হাতে পড়ে। এরা পশ্চিমাদের এজেন্ট হিসেবে কাজ করে জাতিকে ইসলাম বিমুখের খেলায় মেতেছে। তাদের প্রচেষ্টা ও পশ্চিমাদের সহযোগিতায় এসকল অপদার্থরা আজ মুসলমানদের চিন্তা-চেতনায় ধর্ম ও রাজনীতিকে আলাদা করে ফেলেছে। এমনকি ধর্মীয় ক্ষেত্রেও মুসলমানদের বহু দলে বিভক্ত করে রেখেছে। এসব দলসমূহের মধ্যে যে গুলো বেশি ভণ্ড, তাদেরকে পশ্চিমারা সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। আর এদের খপ্পরে পরে একশ্রেণীর সরল-সহজ মুসলমানরা নিজেদের কষ্টার্জিত অর্থ খরচ করে শুধু ঈমানই ধ্বংস করছেনা, দেশ ও জাতির বৃহত্তর ঐক্যের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে।
অতএব আর বিলম্ব নয়, সমস্যায় জর্জরিত দিশেহারা মুসলমানদের সকল সমস্যার সমাধানের একটি মাত্র পথ সামনে রয়েছে। আর তা হলো রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাসূল (সা.)-এর নীতি অনুসরণ করা। জাতির অন্ধকার দূরীকরণে এটিই একমাত্র সঠিক ও সহজ পথ। যে পথেই রয়েছে ইহকাল ও পরকালীন জীবনের সাফল্য। এ পথে কিভাবে রাসূল (সা.) অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে যুগ যুগ ধরে চলতে থাকা যুদ্ধ-বিগ্রহ ও পৌত্তলিকতায় ভরপুর কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ ভেঙ্গে একটি সোনালী সমাজ ও রাষ্ট্র উপহার দিয়েছিলেন, সে ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করা হবে ইনশাল্লাহ। হে আল্লাহ! তুমি মুসলিম মিল্লাতকে কুরআন-সুন্নাহর পথে ফিরায়ে আনো। আমাদেরকে কবুল কর, সত্যটা বুঝার তাওফীক দাও । তুমি দয়াময়, তুমিই মেহেরবান! “হে আমাদের রব! আমাদের এই খেদমতটুকু কবুল করে নাও। তুমি সবকিছুর শ্রবণকারী ও মহাজ্ঞানী।” (চলবে…)