আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে নামাজ বা সালাতের গুরুত্ব অপরিসীম। একজন ভালো ও দক্ষ শিক্ষককে যেমন পিটিআই, বিএড এবং এমএড প্রশিক্ষণ দিয়ে শিক্ষকতা জীবনে পেশাদারিত্ব অর্জন করতে হয়। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সেনাবাহিনীকেও প্রতিদিন দৈহিক কসরত করে ফিজিক্যাল ফিটনেসসহ যুদ্ধাস্ত্র চালানোর সব প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেকে যোগ্য করে নিতে হয়। এমনিভাবে রাষ্ট্রের প্রায় সব বিভাগে সব সেক্টরেই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে। এসব প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা তাদের পেশাদারিত্ব দেখিয়ে প্রমোশন নিয়ে থাকেন। কিন্তু যদি এমন হয়, প্রশিক্ষণ নিয়ে কর্মক্ষেত্রে ওই প্রশিক্ষণের কোনো প্রতিফল ঘটল না। অর্থাৎ বিএড বা এমএড ট্রেনিং নিলো কিন্তু শিক্ষকতা করল না, সেনাবাহিনীও যুদ্ধক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় থাকল, আইন পেশায় উচ্চতর ডিগ্রি নিলো, কিন্তু এই ডিগ্রিকে সে কাজে লাগাল না। তাহলে নিশ্চয়ই আপনারা তাকে দক্ষ সেনাকর্মকর্তা বা সেনাসদস্য, দক্ষ শিক্ষক কিংবা দক্ষ আইনজ্ঞ বলতে পারেন না। সালাতের বিষয়টিও ঠিক তেমনি।
সমাজ পরিবর্তনে সালাতের ভূমিকা : সালাতও অনুরূপভাবে একজন খাঁটি ঈমানদার মুসলমান হিসেবে আপনাকে তৈরি করে। ফলে একজন সত্যিকার নামাজি হবেন সব নৈতিক গুণে সমৃদ্ধ একজন সুনাগরিক। কর্মক্ষেত্রের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তার মধ্যে তৈরি হবে চরম আল্লাহ-ভীতি।
নামাজ হলো ঈমানের চার্জ। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আপনি মসজিদে জামাতের সাথে আদায় করার মধ্য দিয়ে আপনার ঈমানকে চার্জ দিতে পারেন। কর্মক্ষেত্রে ঈমানের এ চার্জকে আপনি কাজে লাগাবেন। অর্থাৎ কর্মক্ষেত্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে আপনি আল্লাহর বিধিনিষেধ মেনে চলবেন। কেননা আল্লাহর আদেশ ও নিষেধ মেনে চলার প্রশিক্ষণ আপনি সালাতের মধ্য দিয়ে অর্জন করেছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘সালাত পূর্ণরূপে আদায় হয়ে গেলে তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড়ো; আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করো। এ সময় তোমরা বেশি বেশি করে আল্লাহকে স্মরণ করো। তবেই সম্ভবত তোমরা সফলকাম হতে পারবে।’ (সূরা আল জুমা : ১০)।
যখন নামাজের সময় উপস্থিত হয়, তখন আপনি ভালোভাবে অজু করে নামাজ আদায়ে জামাতে শরিক হন। এ ক্ষেত্রে আপনি তো অজু ছাড়াই জামাতে শরিক হতে পারেন। কারণ, আপনি অজু করলেন-কি-করলেন না তা তো কেউ দেখেনি; কিন্তু তা কি কখনো করেন? করেন না। কেন করেন না? করেন না এ জন্যই যে, অন্য কেউ দেখুক অথবা না দেখুক আল্লাহ আপনাকে দেখছেন। অর্থাৎ আল্লাহর ভয় আপনার অন্তরে বদ্ধমূল হয়ে গেছে, মানুষের ভয় নয়। ঠিক তেমনি আল্লাহর ভয়ে গভীর অরণ্যে, জনমানবহীন ধু-ধু প্রান্তরেও আপনি কোনো পাপকাজ করতে সাহসী হবেন না। আপনি প্রচণ্ড অভাবী, চার দিকে নানা আর্থিক সমস্যায় আপনি জর্জরিত। জনমানবহীন গভীর রজনীতে আপনি একাই পথ চলছেন। পথিমধ্যে দেখতে পেলেন বেশ কিছু স্বর্ণ বা অনেক টাকা পড়ে আছে। এ ক্ষেত্রে আপনি যদি সত্যিকার নামাজি হন তাহলে আপনি কিছুতেই রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া স্বর্ণ বা টাকা নিতে পারেন না। কারণ, আপনার নামাজ আপনাকে সে শিক্ষা দেয়নি। সুন্দরী তরুণী আপনার হাতের মুঠোয়, ইচ্ছে করলেই আপনি তাকে ভোগ করতে পারেন, কিন্তু করেন না; কারণ নামাজের মধ্য দিয়ে আল্লাহর ভয় আপনার অন্তরে বদ্ধমূল হয়েছে।
আপনি অফিসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, একটি স্বাক্ষরের বিনিময়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতে পারেন। সেখানেও নামাজ আপনাকে অবৈধ বাসনা থেকে বিরত রাখবে। বস্তুত দুনিয়া এক কঠিন গোলকধাঁধা। এই গোলকধাঁধায় পড়ে আপনি আল্লাহর কথা ভুলে গিয়ে বড় বড় স্বার্থ হাসিলের লোভ কিংবা বিরাট ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর আইন লঙ্ঘন করতে পারেন। নামাজ আদায়ের মধ্য দিয়ে আপনার ভেতর যে গভীর খোদাভীতি তৈরি হয়েছে, সে খোদাভীতির কারণে আপনি এই গোলকধাঁধায় পড়েন না। দুনিয়ার এ গোলকধাঁধা এড়িয়ে মসজিদে বসে শুধু ‘আল্লাহু’, ‘আল্লাহু’ জিকির করবেন কিংবা শত শত রাকাত নফল নামাজ পড়ে সময় অতিবাহিত করবেন, তা আল্লাহর অভিপ্রায় নয়। এ জন্যই আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা সালাত আদায় করো, অতঃপর জীবিকা অর্জনে জমিনে ছড়িয়ে পড়ো। আর বেশি বেশি করে আল্লাহকে স্মরণ করো।’
মুসলমানের ওপর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এ জন্যই ফরজ করে দেয়া হয়েছে যে, তিনি যেন সব সময় মনে করেন তিনি আল্লাহর গোলাম, কোনো গোলকধাঁধার প্ররোচনায় যেন তিনি আল্লাহর গোলামি থেকে ছিন্ন হয়ে শয়তান বা নিজের নফসের গোলাম বনে না যান। আর এ জন্যই হাদিসে আল্লাহর রাসূল সা: বলেছেন : ‘যারা আজানের আওয়াজ শুনেও নিজেদের ঘর থেকে বের হয় না, তাদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়।’ নামাজকে কুফর ও ইসলামের মধ্যে পার্থক্যের প্রধান চিহ্ন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
সালাতের মাধ্যমে মানবচরিত্রে যে নৈতিকতা অর্জিত হয় : পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ে একজন মুসলমানের মধ্যে সর্বপ্রধান যে গুণটি অর্জিত হয়, তা হচ্ছে ‘আল্লাহ-ভীতি’। কি আলোতে কি অন্ধকারে আল্লাহ আপনাকে সব সময় দেখছেন। আপনার গতিবিধি সম্পর্কে আল্লাহ পূর্ণভাবে ওয়াকিবহাল। আপনি দুনিয়ার যে প্রান্তেই আত্মগোপন করে থাকেন না কেন, আল্লাহর দৃষ্টিসীমার বাইরে থাকা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এ দৃঢ়বিশ্বাসের মজবুতি নামাজ ও রোজা ছাড়া অন্য কোনো ইবাদতের মধ্য দিয়ে অর্জন করা সম্ভব নয়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের মধ্য দিয়ে একজন মুসলমান আল্লাহর নির্ধারিত হালাল-হারামের সীমারেখা মেনে চলতে বাধ্য। বিশ্বাসের এ দৃঢ়তা সব সময়ই জাগরূক রাখা ও বদ্ধমূল করে রাখার জন্যই আল্লাহ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেছেন।
কর্মক্ষেত্রের প্রতিটি অংশে যখন আল্লাহর ভয় প্রয়োগ করবেন, তখন আপনার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, আপনার অধীনস্থ এক কথায় কেউ কোনো ক্ষতির আশঙ্কা করবে না, করবে না কোনো বেইনসাফির ভয়।
নামাজে আপনার মধ্যে দ্বিতীয় যে গুণটি অর্জিত হয় তা হচ্ছে, আল্লাহর বিধানকে ভালোভাবে জানার সুযোগ। কেননা আপনি নামাজে আল্লাহর কালাম পাঠ করেন। এ কালাম পাঠের মাধ্যমে আল্লাহর আইন ও বিধান সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারেন। যদিও আমরা অর্থসহ কুরআন বুঝে পড়তে মোটেও অভ্যস্ত নই। আমরা আমাদের জীবনে শুধু একটি গ্রন্থই না বুঝে পড়ি, তা হচ্ছে কুরআন। কুরআন ছাড়া সব গ্রন্থই আমরা বুঝে পড়ি। কুরআন না বোঝার কারণে নামাজে দাঁড়ালে নানা চিন্তাভাবনা এসে ভিড় জমায়। ফলে নামাজের খুশুখুজু হারিয়ে যায়। নামাজের রূহ বা তাৎপর্য উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হই। জুমার নামাজের খুতবায় কি আলেম কি শিক্ষিত কি অশিক্ষিত সব শ্রেণী-পেশার মানুষ একত্র হয় এবং আল্লাহর বিধানাবলি জানার অপূর্ব সুযোগ হয়।
নামাজের মাধ্যমে আপনি তৃতীয় যে শিক্ষাটি অর্জন করতে পারেন তা হচ্ছে- সঙ্ঘবদ্ধ জীবনের প্রশিক্ষণ। মিলিতভাবে আল্লাহর বিধান পালন করার প্রশিক্ষণ। একে অপরকে জানার ও সহযোগিতা করার প্রশিক্ষণ। আল্লাহদ্রোহী শক্তির বিপক্ষে একজন মুসলমান বিচ্ছিন্নভাবে থেকে জয়লাভ করতে পারেন না। জামাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, জুমার নামাজ, দুই ঈদের নামাজ মুসলমানদের মধ্যে বিরাট ঐক্যশক্তি গঠনের অপূর্ব সুযোগ। এ ঐক্যশক্তি একটি সুদৃঢ় দেয়াল বা সিসাঢালা প্রাচীরের মতো সম্পর্ক গড়ে তোলে।
নামাজের মাধ্যমে আপনি চতুর্থ যে শিক্ষাটি অর্জন করেন তা হচ্ছে- ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সমাজ, রাষ্ট্র ও সরকারের একমাত্র উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য থাকে আল্লাহর ভয় ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন। তখন স্বাভাবিকভাবেই এই একমুখিনতার কারণে মানুষের চিন্তা-চেতনায়, ইচ্ছা ও মননে এবং সব কর্মকাণ্ড ও আচরণে একমুখিতার জন্ম নেয়। মানুষের এ একমুখী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের ফলে পরস্পরের মধ্যে হানাহানি, বিদ্বেষ, আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তারের পথ বন্ধ করে সেখানে জন্ম নেয় সাহায্য, সহযোগিতা ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন।
নামাজের মধ্য দিয়ে পঞ্চম যে শিক্ষাটি আপনি অর্জন করেন তা হলো- বিশ্বমানবতা বা আন্তর্জাতিকতা। হজের মওসুমে পৃথিবীর সব প্রান্তের লোক পবিত্র কাবাকে কেন্দ্র করে একত্র হন। দুনিয়ার সব মুসলমান এক জাতি। এক আল্লাহর দিকেই তাদের ফিরে যেতে হবে। বর্ণ, গোত্র, ভাষা, ভৌগোলিক অবস্থান কোনোটিই মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে পারে না। ভাষা, বর্ণ, গোত্র কিংবা আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে কারো মর্যাদা বা অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় না কিংবা কারো অধিকার খর্ব হয় না। শাসক এবং শাসিত এক কাতারে দাঁড়াতে বাধ্য। এ শিক্ষাও আপনি নামাজের মধ্য দিয়েই অর্জন করেন। রাসূল সা: বিদায় হজের ভাষণে বলেছেন, ‘ইসলামে জাতি, শ্রেণিভেদ ও বর্ণবৈষম্য নেই। আরবের ওপর অনারবের, অনারবের ওপর আরবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তেমনি সাদার ওপর কালো এবং কালোর ওপর সাদার কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই।’ ‘হে লোক সকল, শুনে রাখো, মুসলমানেরা পরস্পরের ভাই ভাই।’
নামাজের মাধ্যমে মানবচরিত্র দৃঢ়বিশ্বাস বা ঈমানের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। তার মধ্যে আত্মসম্মানবোধ ও দায়িত্ববোধ সৃষ্টি হয়। যেহেতু সে বিশ্বাস করে, আল্লাহ ছাড়া আর কেউই মানুষের কোনো কল্যাণ বা অকল্যাণ করতে পারে না। তাই সে শুধু আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে মাথা নত করে না।
শেষ কথা : সালাতের মাধ্যমে আপনার চিন্তা-চেতনায় গভীরভাবে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি হয়। এর ফলে একজন প্রশিক্ষিত ও অনুগত বান্দা হিসেবে রাষ্ট্র ও সমাজের সব কর্মকাণ্ডে তার শতভাগ প্রভাব পড়তে বাধ্য। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আমাদের বিচার বিভাগ, আমাদের শিক্ষা বিভাগ, আমাদের সংসদ সদস্যরা, প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রিবর্গ কম-বেশি সবাই নামাজি। নামাজের এই শিক্ষা যদি তারা নিজ নিজ বিভাগে প্রয়োগ করতেন, তাহলে কি সমাজ ও রাষ্ট্রের চিত্র বদলে যেত না? সালাতের মাধ্যমে যে জীবন দর্শনের শিক্ষা পাই, তা প্রয়োগের মাধ্যমে সমাজ থেকে সুদ-ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, মদ-জুয়া, এক কথায় যাবতীয় অন্যায়, অবিচার, ব্যভিচার কোথায় বিলীন হয়ে যেত।
নামাজ হলো ঈমানের ভিত্তি। আর ঈমান হলো চরিত্র গঠনের মানসিক ভিত্তি। ফলে একজন নামাজির চারিত্রিক দৃঢ়তা উন্নত ও অসাধারণ। কেননা বিশ্বাসীরা জানেন, মানুষের যা কিছু গৌরব, শক্তি ও যোগ্যতা তা কোনোটাই তার নিজের নয়; সবই আল্লাহর দান। বিশ্বাসীরা এ-ও জানেন যে, মানুষের ক্ষমতা বা গর্বকে যেকোনো সময় চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিতে পারেন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। ফলে একজন নামাজি বিনয়ী, নম্র ও নিরহঙ্কার হয়ে থাকেন। তিনি কখনো প্রবৃত্তির দাস হন না। কারণ তিনি জানেন, সৎকর্মের মধ্যে জান্নাত লাভ করা সম্ভব। একজন ঈমানদারকে হতাশা গ্রাস করে না। কারণ তিনি জানেন আল্লাহর মহিমা, শক্তি ও অনুগ্রহ অসীম