হজ্জের ফযীলত ও বিধান

kaba

হজ্জ সম্পর্কে মহান আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করেন:
ولله على الناس حج البيت من استطاع إليه سبيلا
রাসূল (সা.) এরশাদ করেন;
عنْ عبدِ اللهِ بنِ عُمرَ -رَضِي اللهُ عَنْهُما- قالَ: سَمِعْتُ رسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ:((بُنِيَ الإِسْلاَمُ عَلَى خَمْسٍ: شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللهِ، وَإِقامِ الصَّلاَةِ، وإِيتَاءِ الزَّكَاةِ، وَصَوْمِ رَمَضَانَ وَحَجِّ بَيْتِ الله الحرام، رَوَاهُ البُخَارِيُّ ومُسْلِمٌ.
এই হাদীসে ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের আলোচনা করা হয়েছে। তন্মধ্যে সর্বশেষ স্তম্ভ হলো হজ্জ। আজকের আলোচনার বিষয় হলো; হজ্জের ফযীলত ও বিধি-বিধান। আশা করি সম্মানিত দর্শক শ্রোতা বিষয়গুলো মনোযোগ দিয়ে শুনবেন।
পঞ্চম রোকন হলো হজ্জ: অর্থাৎ আল্লাহর ঘরের দিকে হজ্জ করা। হজ্জ শব্দের আভিধানিক অর্থ ইচ্ছা বা সংকল্প করা। ইসলামী পরিভাষায় নির্দিষ্ট কিছু কাজ নির্দিষ্ট দিনে সম্পাদন করার জন্য বায়তুল্লাহ অভিমুখে গমন করা।
হজ্জ ফরয হওয়ার প্রমাণ: হজ্জ হলো ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভেও সর্বশেষ তথা পঞ্চম স্তম্ভ। ইহা দৈহিক ও আর্থিক ত্যাগের সমন্বেয় বিরাট ফযীলত পূর্ণ ইবাদত। এবং হজ্জ নবম হিজ্জরীতে ফজর হয়। মক্কা যাতায়াত ও হজ্জ পালন কালে অবস্থানের খরচের অর্থ এবং ফিরে আসা পর্যন্ত পরিবারের প্রয়োজনীয় খরচাদি সমপরিমাণ অর্থের যে কোন মালিকের উপর জীবনে একবার হজ্জ পালন করা ফরজ।
১। কুরআন থেকে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ولله على الناس حج البيت من استطاع إليه سبيلا} ( آل عمران : ৯৭ )

অর্থ: আল্লাহর উদ্দেশ্যে মানুষের উপর বায়তুল্লাহর হজ্জ পালন করা ফরয, যারা সেখানে পৌঁছার ক্ষমতা রাখে। আর যে ব্যক্তি উহা আদায়ের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও পালন করতে অস্বীকার করবে, তবে (জেনে রেখ) আল্লাহ সমগ্র জগৎ থেকে মুখাপেক্ষীহীন। (সূরা আলে ইমরান: ৯৭)
২। হাদীস থেকে:

عنْ عبدِ اللهِ بنِ عُمرَ -رَضِي اللهُ عَنْهُما- قالَ: سَمِعْتُ رسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ:((بُنِيَ الإِسْلاَمُ عَلَى خَمْسٍ: شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللهِ، وَإِقامِ الصَّلاَةِ، وإِيتَاءِ الزَّكَاةِ، وَصَوْمِ رَمَضَانَ وَحَجِّ بَيْتِ الله الحرام، رَوَاهُ البُخَارِيُّ ومُسْلِمٌ.
৩। হাদীস থেকে:

عن أبي هريرة قال خطبنا رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال أيها الناس قد فرض الله عليكم الحج فحجوا فقال رجل أكل عام يا رسول الله فسكت حتى قالها ثلاثا فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم لو قلت نعم لوجبت ولما استطعتم ثم قال ذروني ما تركتكم فإنما هلك من كان قبلكم بكثرة سؤالهم واختلافهم على أنبيائهم فإذا أمرتكم بشيء فأتوا منه ما استطعتم وإذا نهيتكم عن شيء فدعوه، رَوَاهُ البُخَارِيُّ ومُسْلِمٌ.
হজ্জের ফযীলত:
১والحج المبرور ليس له جزاء إلا الجنة : رَوَاهُ البُخَارِيُّ
অর্থ : মাবরুর হজ্জের প্রতিদান জান্নাত ভিন্ন অন্য কিছু নয়।
২من حج لله فلم يرفث ولم يفسق ، رجع كيوم ولدته أمه : رَوَاهُ البُخَارِيُّ ومُسْلِمٌ.

যে হজ্জ করল ও শরীয়ত অনুমতি দেয় না এমন কাজ থেকে বিরত রইল, যৌন-স্পর্শ রয়েছে এমন কাজ ও কথা থেকে বিরত থাকল, সে তার মাতৃ-গর্ভ হতে ভূমিষ্ট ‘হওয়ার দিনের মতো পবিত্র হয়ে ফিরে এল।
৩عن عائشة رضي الله عنها، أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: (ما من يوم أكثر أن يعتق الله فيه عبيداً من النار من يوم عرفة، إنه ليدني، ثم يباهي بهم الملائكة، فيقول: ما أراد هؤلاء) روى الإمام مسلم في “صحيحه”
‘আরাফার দিন এতো সংখ্যক মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন যা অন্য কোনো দিন দেন না। এদিন আল্লাহ তাআলা নিকটবর্তী হন ও আরাফার ময়দানে অবস্থানরত হাজিদেরকে নিয়ে তিনি ফেরেশতাদের সাথে গর্ব করেন, ও বলেন ‘ওরা কী চায়?।’
৪عن ماعز التميمي رضى الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم : أنه سئل أي الأعمال أفضل؟ قال : إيمان بالله وحده ، ثُمَّ حِجَّةٌ مَبْرُورَةٌ تَفْضُلُ سَائِرَ الأعْمَالِ كما بين مَطْلَعِ الشَّمْسِ إلى مَغْرِبِهَا (رواه أحمد)

সর্বোত্তম আমল কী এ ব্যাপারে এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জিজ্ঞাসা করলেন। উত্তরে বললেন, ‘অদ্বিতীয় আল্লাহর প্রতি ঈমান, ও তারপর মাবরুর হজ্জ যা সকল আমল থেকে শ্রেষ্ঠ। সূর্য উদয় ও অস্তের মধ্যে যে পার্থক্য ঠিক তারই মত।’
৫عن أبي هريرة ‏رضي الله عنه قال: سأل رجل رسول الله‏ ‏صلى الله عليه وسلم: ‏أيُّ الأعمال أفضل ؟ قال : “‏ ‏إيمان بالله ” قال : ثم ماذا ؟ قال : ” الجِهَادُ في سبيل الله ” قال : ثم ماذا ؟ قال : “حَجٌّ مَبْرُورٌ* رَوَاهُ البُخَارِيُّ ومُسْلِمٌ.
অন্য এক হাদিসে এসেছে, ‘উত্তম আমল কি এই মর্মে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞাসা করা হল। উত্তরে তিনি বললেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান। বলা হল, ‘তারপর কী’? তিনি বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদ। বলা হল তারপর কোনটি? তিনি বললেন, মাবরুর হজ্জ।
৬عن عائشة أم المؤمنين رضي الله عنها قالت : قلتُ يا رسول الله : ألا نَغْزُو ونُجَاهِدَ معكم ؟ فقال : ” ‏لَكِنَّ أَحْسَنَ الْجِهَادِ وَأجْمَلَهُ: الْحَجُّ حَجٌّ ‏ ‏مَبْرُورٌ ” فقالت عائشة : فَلاَ أدَعُ الحَجَّ بَعْدَ إذْ سَمِعْتُ هَذَا مِنْ رسول الله صلى الله عليه وسلم رَوَاهُ البُخَارِيُّ
একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করে আয়েশা (রা.) বলেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ আমরা কি আপনাদের সাথে জিহাদে ও অভিযানে যাব না? তিনি বললেন, ‘তোমাদের জন্য উত্তম ও সুন্দরতম জিহাদ হল ‘হজ্জ’, তথা মাবরুর হজ্জ।”
عن أبي هريرة رضى الله عنه ، أن رسول الله قال : الحجاج والعمار وفد الله ، إن دعوه أجابهم وان استغفروه غفر لهم رواه النسائي و ابن ماجة

‘হজ্জ ও উমরা পালনকারীগণ আল্লাহর অফদ-মেহমান। তারা যদি আল্লাহকে ডাকে আল্লাহ তাদের ডাকে সাড়া দেন। তারা যদি গুনাহ মাফ চায় আল্লাহ তাদের গুনাহ মাফ করে দেন।’
عن أبي هريرة رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : العمرة إلى العمرة كفارة لما بينهما ، والحج المبرور ليس له جزاء إلا الجنة ،، رَوَاهُ البُخَارِيُّ

আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত এক হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘এক উমরা হতে অন্য উমরা, এ দুয়ের মাঝে যা কিছু (পাপ) ঘটবে তার জন্য কাফফারা। আর মাবরুর হজ্জের বিনিময় জান্নাত ভিন্ন অন্য কিছু নয়।”

হাদীসে আরো এসেছে,
৯ إن الإسلام يهدم ما كان قبله ، و إن الهجرة تهدم ما كان قبلها ، و إن الحج يهدم ما كان قبله ،، رَوَاهُ مُسْلِمٌ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কারো ইসলাম-গ্রহণ পূর্বকৃত সকল পাপকে মুছে দেয়। হিজ্জরত তার পূর্বের সকল গুনাহ মুছে দেয়, ও হজ্জ তার পূর্বের সকল পাপ মুছে দেয়।

উপরোল্লেখিত হাদীসসমূহের বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট। তাই হজ্জ পালনেচ্ছু প্রতিটি ব্যক্তিরই উচিত পবিত্র হজ্জের এই ফজিলতসমূহ ভরপূরভাবে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করে যাওয়া। হজ্জ কবুল হওয়ার সকল শর্ত পূর্ণ করে সমস্ত পাপ ও গুনাহ থেকে মুক্ত থেকে কঠিনভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা।

হজ্জের তাৎপর্য
ইসলামি ইবাদতসমূহের মধ্যে হজ্জের গুরুত্ব অপরিসীম। এক হাদীস অনুযায়ী হজ্জকে বরং সর্বোত্তম ইবাদত বলা হয়েছে। তবে হজ্জের এ গুরুত্ব বাহ্যিক আচার- অনুষ্ঠান থেকে বেশি সম্পর্কযুক্ত হজ্জের রূহ বা হাকীকতের সাথে। হজ্জের এ রূহ বা হাকীকত নিম্নে বর্ণিত পয়েন্টসমূহ থেকে অনুধাবন করা সম্ভব।

১। এহরামের কাপড় গায়ে জড়িয়ে আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে হজ্জের সফরে রওয়ানা হওয়া কাফন পরে আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে আখেরাতের পথে রওয়ানা হওয়াকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

২। হজ্জের সফরে পাথেয় সঙ্গে নেয়া আখেরাতের সফরে পাথেয় সঙ্গে নেয়ার প্রয়োজনয়ীতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

৩। এহরাম পরিধান করে পুত-পবিত্র হয়ে আল্লাহর দরবারে হাজিরা দেয়ার জন্য ‘লাব্বাইক’ বলা সমস্ত গুনাহ-পাপ থেকে পবিত্র হয়ে পরকালে আল্লাহর কাছে হাজিরা দেয়ার প্রয়োজনীয়তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। আরো স্মরণ করিয়ে দেয় যে এহরামের কাপড়ের মতো স্বচ্ছ-সাদা হৃদয় নিয়েই আল্লাহর দরবারে যেতে হবে।

৪ ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ বলে বান্দা হজ্জ বিষয়ে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে আল্লাহর যে কোনো ডাকে সাড়া দেয়ার ব্যাপারে সদা প্রস্তুত থাকার কথা ঘোষণা দেয়। এবং বাধাবিঘœ বিপদ-আপদ কষ্ট-যাতনা পেরিয়ে যে কোনো গন্তব্যে পৌঁছতে সে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে, এ কথা ব্যক্ত করে।

৫ এহরাম অবস্থায় সকল বিধি-নিষেধ মেনে চলা স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে যে মুমিনের জীবন বল্গাহীন নয়। মুমিনের জীবন আল্লাহর রশিতে বাঁধা। আল্লাহ যেদিকে টান দেন সে সেদিকে যেতে প্রস্তুত। এমনকী যদি তিনি স্বাভাবিক পোশাক-আশাক থেকে বারণ করেন, প্রসাধনী আতর ¯েœা ব্যবহার, স্বামী-স্ত্রীর সাথে বিনোদন নিষেধ করে দেন, তবে সে তৎক্ষণাৎ বিরত হয়ে যায় এসব থেকে। আল্লাহর ইচ্ছার সামনে বৈধ এমনকী অতি প্রয়োজনীয় জিনিসকেও ছেড়ে দিতে সে বিন্দুমাত্র ইতস্ততা বোধ করে না।

৬ এহরাম অবস্থায় ঝগড়া করা নিষেধ। এর অর্থ মুমিন ঝগড়াটে মেজাজের হয় না। মুমিন ক্ষমা ও ধৈর্যের উদাহরণ স্থাপন করে জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে। মুমিন শান্তিপ্রিয়। ঝগড়া-বিবাদের ঊর্ধ্বে উঠে সে পবিত্র ও সহনশীল জীবন যাপনে অভ্যস্ত।

৭ বায়তুল্লাহর সান্নিধ্যে গিয়ে মুমিন নিরাপত্তা অনুভব করে।
وَإِذْ جَعَلْنَا الْبَيْت مَثَابَةً لِلنَّاسِ وَأَمْنًا (سورة البقرة ১২৫)
কেননা বায়তুল্লাহকে নিরাপত্তার নিদর্শন হিসেবে স্থাপন করেছেন আল্লাহ তা’আলা। সফরের কষ্ট-যাতনা সহ্য করে বায়তুল্লাহর আশ্রয়ে গিয়ে মুমিন অনুভব করে এক অকল্পিত নিরাপত্তা।
الَّذِينَ آَمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُمْ بِظُلْمٍ أُولَئِكَ لَهُمُ الْأَمْنُ وَهُمْ مُهْتَدُونَ (الأنعام(৮১
তদ্রƒপভাবে শিরকমুক্ত ঈমানি জীবযাপনের দীর্ঘ চেষ্টা-সাধনার পর মুমিন আল্লাহর কাছে গিয়ে যে নিরাপত্তা পাবে তার প্রাথমিক উদাহরণ এটি।

৮ হাজরে আসওয়াদ চুম্বন-স্পর্শ মুমিনের হৃদয়ে সুন্নতের তাজিম-সম্মান বিষয়ে চেতনা সৃষ্টি করে। কেননা নিছক পাথরকে চুম্বন করার মাহাত্ব কী তা আমাদের বুঝের আওতার বাইরে। তবুও আমরা চুম্বন করি, যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেছেন। বুঝে আসুক না আসুক কেবল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনুসরণের জন্যই আমরা হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করে থাকি। এ চুম্বন বিনা-শর্তে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আনুগত্যে নিজেকে আরোপিত করার একটি আলামত। ওমর (রাঃ) হাজরে আসওয়াদকে চুম্বন করার পূর্বে বলেছেন,
إني أعلم أنك حجر لا تضر ولا تنفع ، ولولا أني رأيت النبي صلى الله عليه وسلم يقبلك ما قبلتك رَوَاهُ البُخَارِيُّ
‘আমি জানি নিশ্চয়ই তুমি একটি পাথর। ক্ষতি-উপকার কোনোটারই তোমার ক্ষমতা নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চুম্বন করতে না দেখলে আমি তোমাকে চুম্বন করতাম না।
হাজরে আসওয়াদের চুম্বন, তাই, যুক্তির পেছনে না ঘুরে, আল্লাহ ও রাসূলের নিঃশর্ত আনুগত্যের চেতনা শেখায় যা ধর্মীয় নীতি-আদর্শের আওতায় জীবনযাপনকে করে দেয় সহজ, সাবলীল।

৯ তাওয়াফ আল্লাহ-কেন্দ্রিক জীবনের নিরন্তর সাধনাকে বুঝায়। অর্থাৎ একজন মুমিনের জীবন আল্লাহর আদেশ-নিষেধকে কেন্দ্র করে ঘোরে। এক আল্লাহকে সকল কাজের কেন্দ্র বানিয়ে যাপিত হয় মুমিনের সমগ্র জীবন। বায়তুল্লাহর চার পাশে ঘোরা আল্লাহর মহান নিদর্শনের চার পাশে ঘোরা। তাওহীদের আন্তর্জাতিক কেন্দ্রের চার পাশে ঘোরা। তাওহীদ নির্ভর জীবনযাপনের গভীর অঙ্গীকার ব্যক্ত করা। আর সাত চক্কর চূড়ান্ত পর্যায়কে বুঝায়। অর্থাৎ মুমিন তার জীবনের একাংশ তাওহীদের চার পাশে ঘূর্ণায়মান রাখবে আর বাকি অংশ ঘোরাবে অন্য মেরুকে কেন্দ্র করে, এরূপ নয়। মুমিনের শরীর ও আত্মা, অন্তর-বহির সমগ্রটাই ঘোরে একমাত্র আল্লাহকে কেন্দ্র করে যা পবিত্র কুরআনে
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ كَافَّةً
‘পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো’ বলে ব্যক্ত করা হয়েছে।

১০ আল্লাহ তা’আলা নারীকে করেছেন সম্মানিতা। সাফা মারওয়ার মাঝে সাত চক্কর, আল্লাহর রহমত-মদদ কামনায় একজন নারীর সীমাহীন মেহনত, দৌড়ঝাঁপকে স্মরণ করিয়ে দেয়। যে শ্রম-মেহনতের পর প্রবাহ পেয়েছিল রহমতের ফোয়ারা ‘যমযম’। সাত চক্করে সম্পূর্ণ করতে হয় সাঈ যা, স্মরণ করিয়ে দেয় যে আল্লাহর রহমত-সাহায্য পেতে হলে সাত চক্কর অর্থাৎ প্রচুর চেষ্টা মেহনতের প্রয়োজন রয়েছে। মা হাজেরার মতো গুটি গুটি পাথর বিছানো পথে সাফা থেকে মারওয়া, মারওয়া থেকে সাফায় দৌড় ঝাঁপের প্রয়োজন আছে। পাথুরে পথে সাত চক্কর, তথা প্রচুর মেহনত ব্যতীত দুনিয়া- আখেরাতের কোনো কিছুই লাভ হবার মতো নয় এ বিধানটি আমাদেরকে বুঝিয়ে দেয় পরিষ্কারভাবে।

১১ উকুফে আরাফা কিয়ামতের ময়দানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যেখানে সমগ্র মানবজাতি একত্রিত হবে সুবিস্তৃত এক ময়দানে। যেখানে বস্ত্রহীন অবস্থায় দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে গুণতে হবে অপেক্ষার প্রহর। সঠিক ঈমান ও আমলের অধিকারী ব্যক্তিরা পার পেয়ে যাবে আল্লাহর করুণায়। আর ঈমানহীন-ত্রুটিপূর্ণ ঈমান ও আমলওয়ালা ব্যক্তিদেরকে অনন্ত আযাব ভোগ করাতে শেকল পরিয়ে ধেয়ে নেয়া হবে জাহান্নামের পথে।

হজ্জের কার্যাদির তালিকা
প্রথমত: হজ্জের রোকনসমূহ:
হজ্জের ঐ সমস্ত জরুরী কাজ যার একটি ছুটে গেলে হজ্জ শুদ্ধ হয় না। সে-গুলিকে আরকান বলা হয়। আর উহা চারটি ঃ-
(১) হজ্জ পালন করার নিয়তে ইহরাম বাঁধা।
(২) আরাফাতে অবস্থান বা উকুফে আরাফাহ করা।
(৩) তাওয়াফে ইফাযাহ বা তাওয়াফে যিয়ারাহ করা।
(৪) ছাফা-মারওয়ার সাঈ করা। (কোন কোন ইমামদের মতে ওয়াজিব)

দ্বিতীয়ত: হজ্জের ওয়াজিবসমূহ
হজ্জের ঐ সমস্ত জরুরী কাজ যার একটি ছুটে গেলে দম (একটি পশু কুরবানী) দ্বারা উহার ত্রুটি পূর্ণ হয়ে হজ্জ সহীহ হয়। আর উহা আটটি, যথাঃ-
(১) মীকাত থেকে ইহরাম বাঁধা।
(২) সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলার পর (যোহরের ওয়াক্ত) থেকে নিয়ে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতে অবস্থান করা।
(৩) ঈদের রাত্রি তথা যিলহজ্জের ৯ই তারিখের দিবাগত রাত্রের শেষ ভাগ পর্যন্ত মুযদালিফায় যাপন করা।
(৪) তাকবীরে তাশরীকের রাতগুলো মিনায় যাপন করা। (যিলহজ্জের ১১,১২, কিংবা ১৩ তারিখের রাত)
(৫) ক্রমানুসারে তিন জামরায় পাথর মারা।
(৬) কুরবানী করা, কুরবানী করতে অপারগ হলে, ১০টি রোযা রাখা। তন্মধ্যে হজ্জের সময় আরাফাতের দিবসের পূর্বে ৩টি এবং হজ্জ সমাপ্ত করে বাড়িতে ফিরে আসলে সাতটি রোযা রাখা।
(৭) মাথা মুণ্ডানো বা চুল ছোট করা।
(৮) ঋতুবতী ও গর্ভপাতুত্তোর স্রাব বিশিষ্ট নারী ব্যতীত অন্যদের জন্য বিদায়ী তাওয়াফ করা।

উপরিউক্ত কাজগুলো ছাড়া অবশিষ্ট সমস্ত কাজ সুন্নাত।
যেমন:
(১) পুরুষগণ সাদা রং এর ইহরাম পরবে আর মহিলাগণ যে কোন রং এর ইহরাম পড়তে পারবে, মহিলাদের জন্য সাদা রং ছাড়া অন্য রং এর ইহরাম পরা উত্তম।
(২) পশম পরিষ্কার করা
(৩) গোসল করা
(৪) আতর ব্যবহার করা
(৫) সম্ভব হলে যে কোন ফরয নামাযের পরে ইহরাম বাধা, না হলে দুই রাকাত নামায পড়ার পর বাধা
(৬) তালবিয়া পাঠ করা (লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক…)
(৭) তাওয়াফুল কুদুম করা
(৮) প্রথম তিন তাওয়াফে রমল করা
(৯) তাওয়াফের প্রথমে হাজরে আসওয়াদ এবং রুকনে ইয়ামনী চুমো দেওয়া
(১০) প্রত্যেক তাওয়াফের প্রথমে বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলা
(১১) হাজরে আসওয়াদ এবং রুকনে ইয়ামনী মধ্যখানে (اللهم ربنا آتنا في الدنيا حسنة وفي الآخرة حسنة وقنا عذاب النار) দোয়াটি পাঠ করা
(১২) সাফা মারওয়ার সাঈর সময় তাকবীর বলা
(১৩) মিনায় চার রাকাত বিশিষ্ট নামায দুই রাকাত করে আদায় করা
(১৪) পাথর নিক্ষেপের সময় তাকবীর বলা
(১৫) বেশি বেশি যিকির করা, কুরআন তেলওয়াত করা,
(১৬) যমযম পানি পান করা

Related Post